ঢাকা পথকথন ২০২৫

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

(এক)

গতকাল ২৪ই জানুয়ারী সন্ধ্যায় ঢাকা নিউমার্কেট থেকে বাড়ি ফিরছিলাম অটো রিকশা নিয়ে। নিউপল্টন (ইরাকী মাঠ) তিরিশ টাকা ভাড়া। ভাড়া দিয়ে চালককে জিজ্ঞাস করলাম কত টাকা গাড়ীর ভাড়া দিতে হয় আপনার মালিক’কে? বলল ৪০০ টাকা। আপনার কত থাকে? বলল ৪০০-৫০০। দেশের বাড়ী কোথায়? কুষ্টিয়া। এক মাসের সামান্য কদিন বেশি হলো ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন। জানালেন, আগামী কাল বাড়ি যাবেন। ছেলের চাকুরীর একটি পরীক্ষা আছে। বিমানে চাকুরীর পরীক্ষা। আমাকে জিজ্ঞাস করল বিমানে চাকুরী কি এয়ারপোর্টের চাকুরী? আমি বললাম আকাশে যেই বিমান উড়োজাহাজ দেখেন সেই কম্পানী। এয়ার পোর্টেও হতে পারে। আচ্ছা-আচ্ছা ভাই অমিতো মুর্খ মানুষ কিছুই জানিনা। বলল তার পুত্র সেনাবাহিনীতে চাকুরীর শেষ পরীক্ষায় এসে বাদ পরল, কারণ তার দাঁত কিছুটা বাঁকা। দালাল বলেছিল সাত(৭) লাখ টাকা লাগবে তাহলে চাকুরী হয়ে যাবে। ভাই আমি এত টাকা পাব কোথায়? গরীব মানুষ।

দেখি এখানে ছেলের চাকুরী হয় কিনা! নতুন সরকার! নতুন আশা। আমি বললাম আপনার ছেলের জন্য অনেক অনেক দোয়া রইল। ভাল থকুন। ঢাকার হালকা শীতের (১৯ ডিগ্রী) সন্ধ্যায় গায়ে একটা পুরানো জ্যাকেট -গলায় স্কার্ফ বাঁধা রিকশা চালক সামসুউদ্দিন আবার চলল ঢাকার পথে-পথে জীবিকার তাগিদে।

২৩শে,জানুয়ারী ২০২৫

(দুই)

এবার ঢাকা নামার পরদিনই ভাগ্নে নিলয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠনে নিমন্ত্রণ ছিল ভায়রা ভাইয়ের বাসায় গুলশানে। নতুন পল্টন থেকে উবারে উঠলাম। জানি পথে প্রায় দেড় ঘন্টা লেগে যাবে। বললাম হাতিরঝিলের ওভার ব্রিজ দিয়ে যেতে। সে গুগুল করল পথ নির্দেশনা দেখার জন্য। বুঝলাম রাস্তাঘাট খুব বেশি চেনে না। পুরানো ড্রাইভার সে নয়। বললাম গুলশান দুই ওয়েস্টিন হোটেলের পাশের গলি দিয়ে গেলে পেয়ে যাবেন ঠিকানা। ড্রাইভার সাহেব ওয়েস্টিন হোটেল চেনেনা। এক মহা বিপদ। আমিও এখন ঢাকা শহর রাস্তা ঘাট অলমোস্ট কিছুই চিনিনা। কাজেই আমিও তাকে কোন ডাইরেকশন দিতে পারব না। গুগুলই একমাত্র ভরসা। আমি বললাম ভাই উবার চালান,শহরের এত বড় প্রসিদ্ধ হোটেল না চিনলে আপনার ব্যবসার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াবে। সে বলল, ভাই আমি শহরে নতুন। আসলে আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করি। এটা আমার নিজের গাড়ী। এটা ভাড়ায় চলে। আজ ছুটির দিন আমার ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে তাই আমি আজ গাড়ীটা চালাচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম সপ্তাহে কদিন আপনি চালান? বললো দুই দিন চালাই। কেমন আয় হয়? বলল মাসে প্রায় ১৫০০০ থাকে। আমি বললাম বাহ্ চমৎকার! আপনার আয়তো বেশ ভাল। সে বলল আলহামদুলিল্লাহ। ভাল আছি। গাড়ীর ব্যাংক লোনের টাকা শোধ হয়ে গেছে গত বছর। আমি খুব ভাল আছি।

যাইহোক রওনা দিলাম। লম্বা জার্নি। ড্রাইবারের সাথে কথা বার্তা শুরু হল। আমি দেশে এলে উবার ড্রাইভার, ঈঘএ ড্রাইভার, রিকশা ড্রাইভার, হকার, ফল বিক্রেতা, মুদি দোকানদার, গাওসিয়া মার্কেটের সেলসম্যন,বন্ধু, উকিল, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী এদের সাথে কথা বলে দেশের রাজনীতির খবর নেবার চেষ্টা করি। দেশের হালচাল কি? জনজীবন কেমন? দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির কারণ কি? সামাজিক নিরাপত্তা কেমন? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ধারণা তাদের জীবন দর্পনে প্রতিফলিত হয় রাজনীতির বর্তমান ভবিষ্যত চিত্রনাট্য। রাজনীতির গভীরতর দর্শন রূপরেখা পথ নির্দেশনা এদের আশা আকাঙ্খাতেই লুকিয়ে থাকে। তারা দেশের খেটে খাওয়া পরিশ্রমী আমজনতা চাকুরে ব্যবসায়ী। এরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নয় কিন্তু ওরাই King Maker. আমি জিজ্ঞেস করলাম ভাই দেশের খবর কি বলেন? বলল ‘ভাই, এই দেশ আর ভাল হইব না। হাসিনাই ভাল ছিল। ডান্ডা মাইরে বাংগালী সোজা রাখত। দেখেন না দাবী আদায়ের নামে রাস্তা অবরোধ। ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তা বন্ধ। ছাত্ররা রাস্তা আটকাইয়া দাবী আদায়ের সমাবেশ করে। আমরা আছি মাইনকার চিপায়।’ আমি বললাম ছাত্ররা নতুন (স্বাধীনতা!) এনেছে তাদের দাবী দাওয়া থাকতেই পারে। বলল ‘না সেটা ঠিক আছে কিন্তু আমাদেরওতো ব্যবসা করে খেতে হবে। সংসার চালাতে হবে। ছেলে মেয়েদের খোরাক লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

তারপর আসল বিএনপি প্রসঙ্গ। বলল ‘বিএনপি শুধু চায় ইলেকশন। তাদের একটাই কথা ইলেকশন দেও। যত তাড়াতাড়ি ইলেশন চায় তারা। কেন এত বছর ইলেকশন নিতে পারলা না হাসিনার কাছ থেকে। বুঝলেন ভাই ক্ষমতায় গেলেই খাওয়া শুরু হবে। এক দল খাইয়া গেছে ওনারা খাওয়ার জন্য রেডি হইতাছে। তর সইতাছে না। এত বছর খাইতে পারে নাই। পেট খালি। দেখেন না ছাত্র দলের পোলা পাইনেররা কেমনে চাদাবাজি করতাছে এদিক সেদিক। ধরাও খাইতাসে বুজলেন না!’ বললাম জামাতের কি অবস্থা? বলল ‘জামাতের অবস্থা খুব ভাল। ওরাতো চোর না। চাদাবাজ না। সৎ লোক। জামায়াত প্রচুর ভোট পাবে।’ তার কথাবার্তার ধরণ, প্রকাশভঙ্গি, পোশাক, মনোভাব এসব দেখে মনে হলো সে জামায়াতকে পছন্দ করে। তার ভোট নিশ্চিতভাবে জামাতের বাক্সে যাবে। তার ধারণা দেশে এবার জামাতের উত্থান হবে। বিএনপি ভয়ংকর ভাবে ধরাশায়ী হবে ইলেকশনে। বর্তমান রাজনৈতিক দৃশপটে ছাত্র সমন্বয়ক -জামায়াত এবং বিএনপি একে অপরের আর মিত্র শক্তি নয়। এরা এখন দুই দল ভীষণ ভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তাদের দুই দলের রাজনৈতিক দর্শন দুই ভিন্ন মেরুতে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে -বিপক্ষে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। জামায়াত অতি কৌশলে দ্রুত নির্বাচন চাইছেনা। তাদের এজেন্ডা মতন কাজ চলছে। দেশে Law And Order নেই। প্রায় পুলিশবিহীন একটা রাষ্ট্র চলছে আল্লার পরম কৃপায় বলা যায়।

ঢাকা শহরে এখন প্রচুর মাদ্রাসা। ঘরে ঘরে হিজাব। ধর্মের প্রচন্ড প্রভাব। ফেসবুকে ওয়াজ মাহফিলের প্রচারে সমাজে প্রচন্ড ভাবে প্রভাব ফেলছে। প্রচুর মানুষের জামাতের প্রতি আকর্ষন। বৃহৎ দল বিএনপির অনেকেই জামাতের প্রতি ঝুঁকছে। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গুরুত্বহীন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন জামাতের ভূমিকা তাদের কাছে আর কোন ইসুই নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই এখন বাস্তবতা। কিন্তু শেষ কথা হল যে, যদি স্বচ্ছ নির্বাচন হয় তবে জামায়াত ক্ষমতায় যাবার যে স্বপ্ন দেখছে সেটা স্বপ্নই থেকে যাবে কিন্তু প্রশাসনের চাবি থেকে যাবে জামাতের পকেটে। আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে সেকুলারিজম হুমকীর মুখে পড়ার প্রচন্ড সম্ভবনা রয়েছে বলে ধারণা করি।

জানুয়ারী ২৫-২০২৫

(তিন)

বড় ভাবীকে নিয়ে গত বুধবার ২২শে জানুয়ারীতে একটু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম গাওছিয়া -চাঁদনী চক মার্কেটে। আমাদের ছেলেদের পাঞ্জাবী, বউয়ের কিছু ঘরের পোষাকের জন্য কাপড় কেনা।

গতবার দামে একটু ধরা খেয়েছিলাম তাই এবার একটু সচেতন থাকায় দামাদামিতে মনে হয় বেশ ভাল ক্রেডিট অর্জন করেছি।

শপিং শেষে গাওছিয়ার পাশে ছোট্ট একটা স্নেক স্টলে খেতে বসলাম। ভাবী লাঞ্চ করল ফ্রাইড রাইস এন্ড চিকেন দিয়ে। আমিও একটা পেস্ট্রির অর্ধেকটা খেলাম। বাড়ী এসে লাঞ্চ করব বলে বেশি খেলাম না। আমাদের পাশের টেবিলে তিন ললনা লাঞ্চ করছেন। তারা হাসাহাসি খুনসুটি করছেন। বোধ হয় তিন বান্ধবী স্কুল কলেজের বন্ধু। পরিবার সংসার ছেলে মেয়ে স্বামীদের রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছে। খুব মৃদু অনুউচ্চস্বরে কথাবার্তা। মাঝে মাঝেই রিনিঝিনি ঝংকারে হাসিতে মুখরিত হচ্ছেন। আমি বেহায়ার মতন খুব কান পেতে রইলাম তাদের কথোপকথন শুনার জন্য। আমার আড়িপাতার মূল কারণ হচ্ছে তাদের সাংসারিক কথার ভেতর যদি কোন রাজনৈতিক কথোপকথন ভেসে উঠে। পাঁচই আগস্টের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর (শেখ হাসিনার লজ্জাজনক পলায়ন) তাদের আশা-আকাঙ্খা ভালবাসা স্বপ্ন উদ্বেগ কোন আকাশে ভাসছে জানার জন্য।

তিন বান্ধবী কথা হচ্ছে কার স্বামী সংসারে কেমন সহযোগিতা করে কার স্বামী চাকুরীতে কতটা উপরে উঠেছে কার স্বামী ব্যবসাতে কেমন সফল। কার স্বামী রাজনীতির মতামত দর্শন কার উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। বর্তমান সরকার কেমন দেশ চালাচ্ছে। রাজনীতিতে জামায়াতের উত্থান দেশের জন্য কতটা সুফল আনবে এবং জামায়াত- শিবির রাজনীতিতে কেমন ভূমিকা রাখছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কর্ণযুগল অত্যন্ত সচেতন এবং গভীর মনোযোগী হল যখন শুনলাম তারা দেশের রাজনীতি নিয়ে গভীর মমতায় ভালবাসায় শংকায় মৃদুস্বরে কথা বলছে। রমনীদল (মিড থার্টি) সবাই উচ্চশিক্ষিত বিশ^^বিদ্যালয় পাশ করা ছাত্রী মনে হয়। তাদের একজন বলল তার স্বামী জামায়াত পন্থী। সে তাকে জামায়াতের পক্ষে থাকার জন্য বলে। তার উত্তর জামায়াত স্বাধীনতা বিরোধী দল তারা ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর গনহত্যার সাথে জড়িত। তারা লক্ষ লক্ষ নারীদের ধর্ষণ ও হত্যার সাথে জড়িত। আমি তাদের পক্ষে নই। বুঝা গেল তিন বান্ধবী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের।

তাদের তিন বান্ধবী দেশের রাজনীতি নিয়ে বেশ হতাশ। সরকার প্রধান নোবেল লরিয়েট ড: ইউনুস বেসামাল অবস্থায়। খুন হত্যা চাদাবাজি সামাজিক জীবনে এক ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তিন ললনার রাজনীতির কোলাহল মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

আজ শনিবার জানুয়ারী ২৫,ভায়রা ভাইয়ের বাসায় লাঞ্চ করে এলিফেন্ট রোডে স্যুট পিকআপ করতে গিয়েছি। এত মাপজোপ করার পরও জ্যাকেটটা টাইট করে ফেলেছে। মেজাজটা বিগড়ে গেল। দর্জী আমাকে খুব করে বুঝতে চাচ্ছে আসলে সব ঠিক আছে। তখন আমার মেজাজ সাত আসমানে। আমি বললাম স্যুট আমি পরব না আপনি পরবেন? ফালতু কথা না বলে যেভাবে বলি সেভাবে বানিয়ে দেন। আমার ধারণা এবং ভয় ছিল প্রথম দফায় দর্জি ঠিক মতন বানাতে পারবে না। সেকারণে আমি হাতে কয়েক দিন সময় রেখেই স্যুটের অর্ডার দিয়েছি। যাই হোক বাকি কেনাকাটার লিস্ট নিয়ে গলির মুখে এসেছি। দেখলাম একজন বয়সী খেজুর বিক্রেতা একজন (ক্রেতা সম্ভবত) লোকের সাথে কথা বলছে। কথা হচ্ছে দেশের হালচাল নিয়ে। আমি গভীর উৎসাহ নিয়ে দাড়িয়ে গেলাম গলির অপর পাশে।

ঢাকার রাস্তায় খেজুর বিক্রেতা। ছবি : লেখক

খেজুর বিক্রেতা বলছেন, ‘বুজলেন না স্যার সবাই বড় হইতে চায়। কেউ ছোট থাকতে চায় না। খালি খাই খাই। আন্দোলন করে রাষ্ট্রিয় সম্পদ জ্বালিয়া পুড়াইয়া দেয়। কেন রাষ্ট্রের সম্পদ পুড়াবি কেন? সরকারী অফিস বাস দালন কোঠা কেন পুড়াবি তোরা? এইগুলো আপনার আমার ট্যাক্সের টাকায় কেনা। সন্ত্রাস চাদাবাজি জ্বালাও পোড়াও যেভাবে আবার শুরু হইছে কঠিন অবস্থা। ছাত্ররা কেমনে কি করতাছে বুঝা মুশকিল। আমি ভাই মালশিয়া ছিলাম ১৫ বছর কই দেখলাম নাতো রাষ্ট্রের সম্পদ কেউ নষ্ট করে আগুল লাগায়। এইগুলো করলে খবর আছে। আর আমাগো দেশে দেশের সম্পদ নষ্ট কইরা পার পাইয়া যায়।’

এলিফেন্ট রোড থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ী ফিরছি আর ভাবছি দেশের রাজনীতির হর্তাকর্তারা (নষ্ট ভন্ড লুটেরা) লম্পট অসৎ লুটেরা প্রসাসনিক কর্মকর্তারা যেই কথাটা বুঝেনা, জনগনের পালস বুঝেনা সেটা একজন হতদরিদ্র সামান্য খেজুর বিক্রেতা (হকার) কিভাবে বুঝল! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিস্কার গল্পটা মনে আছেতো!

জানুয়ারী ২৬,২০২৫

(চার)

এবার ২০২৫ সালে ঢাকায় এসে পৌঁছালাম শুক্রবার ১০ই জানুয়ারী রাত সাড়ে দশটায় বাংলাদেশ বিমান করে। বিমান সরাসরি ফ্লাইট টরন্টো -ঢাকা। মাঝপথে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুল এক ঘন্টা যাত্রা বিরতি। ইস্তাম্বুলে যাত্রী উঠা নামা হয় না। শুধুমাত্র উড়োজাহাজ পরিস্কার পরিচ্ছনতার কাজ হয় এবং নতুন দল (কেবিন ক্রু) নিয়ে ঢাকা রওনা হয়। প্রায় সাত ঘন্টার পথ। তিন সপ্তাহ সফর শেষে আজ ২৯শে জানুয়ারী শেষ দিন ঢাকায়। আজ তৃতীয় বারের মতন গেলাম ডেন্টিস্টের কাছে। কয়েকটি দাত ফিলিং করার জন্য। ইবনেসিনা – লালবাগ। আমি ঢাকায় কখনো ডেন্টাল ক্লিনিকে যাই না কারণ অপরিস্কার- অপরিচ্ছন্নতার জন্য। ঢাকায় খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে এখানে বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আমার কাছে যে ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে যে, নীচে কাউন্টারে চেক ইন ডেস্কে সবাই (ছেলেরা) ব্লু রংয়ের সুট পরা। চমৎকার ড্রেস কোড। লুকিং ভেরী হেন্ডসাম। ডেন্টিস্ট গতকাল বলল আজ সময় মত চলে আসবে সাকাল এগারটায়। আমিও চলে গেলাম ঠিক সময়মত কিন্তু ডাক্তার সাহেবের আসার পাত্তা নেই। জনাব আসলেন ১১.৪৫ মিনিটে। ডাক্তার আসার কথা ১১ টায়। সকাল ১১ টায় তার চেম্বারে আসার কথা থাকলেও গত দুই দিন তিনি চেম্বারে এসেছিল ১১:৪৫ মিনিটে। মেজাজ তখন ভীষণ খারাপ। আজ আমার আরো কিছু কাজ বাকি আছে। মিনিট মিনিট সময় যাচ্ছে। ভীষণ ব্যস্ততা। আমার খুব প্রয়োজন না হলে আমি বসে থাকতাম না চলে আসতাম। আবার ডাক্তার সাহেব গতকালের বেশ কিছু টাকাও পাবে আমার কাছে। দুই কারণ মিলিয়ে বসে থাকলাম। ডাক্তারকে বললাম আমি আপনাকে বলেছিলাম  আজ আমার খুব ব্যস্ততা থাকবে। আপনি আজকেও দেরী করলেন। তিনি দাত বের করে বললেন সরি চাচা। ডেন্টিস্ট সাহেব আবার আমার ভাতিজা তমালের (টিভি নাট্য অভিনেতা -পরিচালক) খুব পরিচিত এবং সে একজন ভাল ফ্যান। সে তমালের খুব প্রসংসা করল গতকাল। বলল মিডিয়াতে ডান এবং বাম পন্থীদের মধ্যে তমাল ভাই একটা দারুন ব্যলেন্স করতে পারে। ইত্যাদি ইত্যাদি। তমালের কারণে আমাকে ২০০০ টাকা ছাড় দিয়েছে তিরিশ হাজার টাকার মধ্যে। নট ব্যাড।

গত দুইদিন ডাক্তার এসিস্টেন্ট মেয়েটা ছিল বেশ হাসি খুশি প্রাণবন্ত। আজ মেয়েটা ছিল বেশ কর্কশ। মুখে হাসির কোন চিহ্ন নেই। খুব রুড না, কাইন্ড অফ রুড।

দুজন এসিস্টেন্টই হিজাব পরিহিতা। তাদের পায়ে সেন্ডেল (ঘরে পরার)। ডাক্তার ক্লিনিং কাজ শুরু করার সময় ফোনে লাউড ভলিউমে সুরা (কোরান) অন করে দেন, গত তিন দিন তাই দেখলাম। বুঝা গেল খুব ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। আসার সময় ডাক্তার সাহেবকে বলে আসলাম আপনার এসিস্টেন্টকে হাসতে বলবেন। কাস্টমার সার্ভিস। Smile খুব ইম্পোর্টেন্ট। বলল আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। WhatsUpp ফোন নাম্বার দিয়ে বলল আপনাদের পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের বলবেন ঢাকায় এলে দাতের সমস্যার জন্য আমার কাছে আসতে। বললেন আমি জানি আপনাদের ওখানে খুব এক্সপেনসিভ। দেশে সে তুলনায় খুব কম।

ডাক্তারের কাজ শেষ করে গেলাম ব্যংকে। সেখানে কাজ শেষ করে সর্বশেষে এলিফেন্ট রোডে গেলাম স্যুটটা পিক আপ করতে ।

বিকাল চারটায় উবার কল দিলাম। যাব গুলশান দুই। সময় দেখাল ২২ মিনিট। কল করে জানলাম ধানমন্ডি ল্যাব এইডের সামনে আছে। দশ মিনিট পর আবার কল দিলাম বলল সে আছে জিকাতলা। আমি বললাম আপনি ওদিকে গেলেন কেন? আপনিতো নিউমার্কেটের দিকে আসবেন। বলল স্যার আপনার সাথেতো আমার কথা হয় নাই। বললাম বলেন কি? সে বলল জ্বী স্যার। বুজলাম ইনি আগের ওবার চালক নন। বললাম চলে আসেন। ওবারে এমন হল দ্বিতীয় বার। মাথায় ঢুকল না ওবারের কারবার। ১৫ মিনিট পর ওবার ড্রাইভার কল দিয়ে বলল স্যার নিউমার্কেটের দিকে যেই জ্যাম দুই ঘন্টা লাগবে। তাহলে কি আসব? আমি বললাম থাক আর দরকার নেই। ভাগ্নে শাকিলকে বললাম মামা দুইটা CNG নিয়ে আসো আজিমপুর মোড় থেকে। শাকিল কল দিল পনের মিনিট পর বলল মামা সি এন জি বা ভ্যান কোনটাই পাচ্ছিনা। আমি এর মধ্যে আরেকটা উবার কল দিলাম বলল স্যার আমি মেডিকেলের সামনে আছি। বড় ভাবি বলল চলে আসতে বল। ওদিকে জ্যাম নাই। ওবার চলে আসল পনের মিনিটের মধ্যে। ওবার চালক আমাকে শহরের ভিতর দিয়ে গুলশান নিয়ে এল প্রচন্ড যানজট ঠেলে। আমি বললাম আপনি ফ্লাই ওভারে উঠলেন না কেন। সে বলল আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার আপনিতো বলেন নাই। আমি বললাম আরে ভাই আমিতো আর এখন ঢাকা শহর চিনি না। আপনারে কেমনে বলব। ওদিকে সাত্তার দুলাভাই ফোন করে করে অস্থির। এত দেরী করতেছ! তোমার আসার দরকার ছিল আরো অনেক আগে।

আমার এক ব্যক্তিগত কাজের কারণে দুলা ভাই তাড়া দিচ্ছিলেন। বলা বাহুল্য তার সময় জ্ঞান অতি তীব্র। সন্ধ্যা হয়ে গেছে শহরে শংকা – অনিরাপত্তা পায়ে -পায়ে, সে কারণে ছিল তার অস্থিরতা।

২৯শে জানুয়ারী ২০২৫

(চলবে)

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *