আমার বন্ধু ভাগ্য, আমার যন্ত্রণা ও কিছু স্বপ্ন
জসিম মল্লিক
অসুস্থ মানুষের পাশে থাকা সহজ কথা না। অসুস্থ মানুষের সেবা করাও সহজ কথা না। এটা সবাই পারে না। এজন্য দরকার গভীর মমতা। যা সবার নাই। আমার ভাই অনেকই অসুস্থ। ক্রিটিক্যাল অবস্থা অনেকদিন থেকে। তাকে ক্রমাগত বরিশাল ঢাকা করতে হচ্ছে। সেই সাথে আমিও বরিশাল ঢাকা করছি। অবাক কাণ্ড আমার ভাইর পাশে থেকে সবচেয়ে বেশি সেবা করছে যে মানুষটি সে হচ্ছে তার পুত্রবধূ রোজি। এতো দরদ দিয়ে আমি কোনো মানুষের সেবা করতে দেখিনি। এম্বুলেন্সে প্রতিবার তার পাশে থাকছে বরিশাল ঢাকা আনা নেওয়ার সময়। হাসপাতালে রাত জাগছে। খাওয়া নাই, নাওয়া নাই। নিজের ছোট ছোট দুটো সন্তানকে অন্যের কাছে রেখে এসে রোগীর সেবা দিচ্ছে। মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, পায়খানা প্রস্রাব পরিষ্কার করছে, ডায়াপার চেঞ্জ করে দিচ্ছে। সেটা একদিন দুই দিন না। দিনের পর দিন। আর একজনের কথা না বললেই নয় সে হচ্ছে শাকিব। প্রতিবার এই ছেলেটি পাশে থাকছে।
মনে আছে রোজি তখন মাত্র এই পরিবারে বউ হয়ে এসেছে। আমার মা তখন গুরুতর অসুস্থ। সেটা ২০০৯/১০ সালের কথা। তখন দেখেছি এই মেয়েটি আমার মায়ের কীভাবে সেবা করছে। তার পাশে বসে থাকছে। আমার মা নাত বউকে খুব ভালোবাসত। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, রোজি তুমি এতো করছ! আমার খুবই অবাক লাগে। অসুস্থ হলে কত আপনজনরা কিছুই করে না। এড়িয়ে যায়। অনেক স্ত্রীকে দেখেছি স্বামীর অসুস্থতায় বিরক্ত হয়। রোজি চোখের পানি ফেলে বলল, চাচ্চু, যে আমাকে একটু ভালোবাসে তার জন্য আমি সব করতে পারি। আমার শ্বশুর আমাকে অনেক স্নেহ ভালবাসা দিয়েছেন। তার মতো মানুষ হয় না। আমি মজা করে বললাম, আমি তো শেষ জীবন বরিশালে থাকতে চাই। আমার জন্য করবা না! রোজি অবলীলায় বলল, আপনার জন্যও করব। প্রমিজ।

দেশে আসলে আমি অসুস্থ হবোই। এবারও হয়েছি। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছি। কিন্তু অসুস্থ হলে কাউকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না। নিজের কষ্ট নিজের কাছে। নিজের কষ্ট নিজেকেই ভোগ করতে হয়। আনন্দের ভাগ দেওয়া যায় কষ্টের ভাগ দেওয়া যায় না। কেউ কারো কষ্ট দূর করে দিতে পারে না। আমি স্বীকার করি যে আমি একটু দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। অল্পতেই ভেঙ্গে পরি। তখন কাউকে পাশে পেতে ইচ্ছে করে। এই রকম সময় যাকে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করি সে কখনোই আমার ডাকে ছুটে আসবে না। আবার এটাও ঠিক বিপদে কাউকে না কাউকে পাশে পাওয়া যায়। আল্লাহ কাউকেই বঞ্চিত করে না। আমার বন্ধুরা অসাধারণ।
এবার বাংলাদেশে অন্যান্য সময়ের চেয়ে একটু আগেই এসে পড়েছিলাম। একটু লম্বা সময় বলাই যায়। প্রথম কথা হচ্ছে বাংলাদেশে কেনো ছুটে আসি বছর বছর! এর উত্তর সহজ, বাংলাদেশ আমার ভালো লাগে। বাংলাদেশকে আমি ভালোবাসি। এই দেশের আলো বাতাসে আমি বড় হয়েছি। অনেক লড়াই সংগ্রাম ছিল আমার। প্রতি পদে পদে এক পয়সা দ্‘ুপয়সার হিসাব ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক বেলা খেয়ে আর এক বেলা না খেয়ে থাকার গল্প আছে আমার জীবনে। একটা দুটা জামা প্যান্ট আর স্যান্ডেল পড়ে দিনের পর দিন কেটেছে আমার। কিন্তু সেসব ভেবে আমার কিছু খারাপ লাগে না। কোনো রিগ্রেট নাই। বরং ওইসব দিনের কথা মনে পড়লে আনন্দের একটা স্রোত কুল কুল করে বয়ে যায় হৃদয়তন্ত্রীতে। আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, যা কিছু প্রাপ্তি সবই অবিশ্বাস্য এবং প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আমি যে এতো ঘুরতে পারি, এতো স্বাধীনতা ভোগ করি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সবকিছুর জন্য আমার পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। ওরাই আমার শক্তির জায়গা। আমার সন্তানরা সবসময় বলে, বাবা এনজয় ইয়োর লাইফ। আমার স্ত্রী সংসারের সব দ্বায়িত্ব একাই সামলায়। তাই আমি নির্ভার থাকতে পারি, বেরিয়ে পড়তে পারি। এটাও কম পাওয়া না জীবনে।
এবারের বাংলাদেশ আসাটা সব অর্থে সুখপ্রদ ছিল না। এটাই জীবন। আল্লাহ সব ডিজাইন করে রাখেন। দেশে আসার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে বইমেলা। লেখালেখি আমার সবসময় আনন্দের জায়গা। লেখা আছে বলেই আমি আমার নিঃসঙ্গতাকে ভরিয়ে তুলতে পারি, লেখা আছে বলেই আমি মানুষের সাথে নৈকট্য তৈরি করতে পারি। আমি যেহেতু কারো কাছে খুব বেশি কিছু চাই না তাই আমার না পওয়ার বেদনাও নাই। আমি এভাবেই বড় হয়েছি। যা কিছু আমাকে একলা অর্জন করতে হয়েছে। আমি সবসময় যতটুকু পারি মানুষের জন্য করি। বিনিময় প্রত্যাশা করিনা। আমার দেশে আসার কারণ শুধু বইমেলাই না, আমার কিছু অসাধারণ বন্ধু আছে, কিছু অসাধারণ আত্মীয় আছে, ভক্ত আছে তাদের টানেও আসি। আমি সবসময় আমার লেখায় তাদের কথা উল্লেখ করি। এর কারণ তারা সবসময় আমার দুঃখের দিনে, কষ্টের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছে। সেটা দেশে বলেই না, বিদেশেও। যখন যেখানে গিয়েছি বন্ধুদের পাশে পেয়েছি। সেটা হোক টরন্টো, হোক নিউইয়র্ক, হোক টোকিও, হোক লসএঞ্জেলেস, হোক সিডনী, হোক সিঙ্গাপুর, হোক কোলকাতা। তারাই আমার আনন্দের জায়গা, শক্তির জায়গা। এমন বন্ধু ভাগ্য পৃথিবীতে বেশি মানুষের নাই।
বাংলাদেশে আসাটা সুখপ্রদ হয়নি এই কারণে যে আমার ভাই যাকে আমি অনেক ভালোবাসি তিনি অনেক ক্রিটিক্যাল অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন। তার কষ্টটা আমি নিতে পারিনি। আমি নিজেও বার বার অসুস্থ হয়েছি। কিছু বৈষয়িক কাজ নিয়ে এসেছিলাম তার প্রায় কিছুই করতে পারিনি। বইমেলায় তেমন একটা যেতে পারিনি, পাঠকদের সময় দিতে পারিনি, লেখক বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারিনি। সব আশা বা ইচ্ছা সবসময় পূরণ হয় না। জীবনে কিছু অপ্রাপ্তি থাকা ভাল। সবকিছু পেয়ে গেলে জীবনের চ্যালেঞ্জ নষ্ট হয়ে যায়। সবকিছু পেতেই হবে এমনও না। তবে এতোকিছুর পরও প্রাপ্তিও কম না। অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল জাপান যাওয়ার। সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। টোকিওতে অসাধারণ কয়েকজন বন্ধু পেয়েছি। যারা সার্বক্ষণিক আমাকে সময় দিয়েছেন। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি জীবনে। সবচেয়ে বড় আনন্দের খবর দিচ্ছি একটা। সেটা হচ্ছে আমার জীবনী গ্রন্থ স্মৃতির আলপনায় আঁকা কোলকাতার একটি অভিজাত প্রকাশনী থেকে ইংরেজিতে বের হচ্ছে। গতকাল প্রকাশক জানিয়েছেন অনুবাদের কাজ শেষ। এ বছরই বইটি বের হবে। এবং আগামী কোলকাতা বইমেলায় বইটি পাওয়া যাবে। সবশেষে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
সেই অর্থে আমার তেমন কোনো উচ্চাশা ছিল না। শৈশবে যখন থেকে আমি পৃথিবীকে জানতে শুরু করেছি, আমার পারিপার্শ্ব, আমার পৃথিবী, আমার অবস্থান তখন থেকেই আমি বুঝতে পেরেছি আমার উচ্চাশা পোষণ করার কোনো কারণ নাই। জীবন তার আপন নিয়মে চলবে। প্রাকৃতিক নিয়মে বেড়ে উঠতে থাকি আমি। এই পৃথিবীতে আসার পিছনে আমার কোনো ভূমিকা নাই। মানুষ পৃথিবীতে আসে দুঃখ কষ্ট, রোগ শোকে ভুগে গত হওয়ার জন্য। সুখ সাময়িক। এটাই জন্মের রহস্য। এটাই মানুষের নিয়তি। যতদিন বেঁচে থাকে একটা ছোট্ট জার্নি শুধু। সেই পথ চলায় অনেক কিছু থাকে। সাফল্য থাকে, ব্যর্থতা থাকে। পাওয়া থাকে, হারানো থাকে। আমি জন্মের পর থেকেই জানতাম আমার নিঃসঙ্গতা থাকবে, কাউকে না বোঝা থাকবে, আমাকে কারো বুঝতে না পারা থাকবে, নানা প্রতিকূলতা থাকবে, দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, না পাওয়া থাকবে। অনেক লড়াই থাকবে। ভুল ভ্রান্তি থাকবে। পাপ থাকবে। অনুশোচনা থাকবে, প্রেম-ভলবাসা থাকবে, মায়া- মমতা থাকবে, অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া থাকবে। আজও আমি কোনো কোনো উচ্চাশা পোষণ করি না, কোনো প্রত্যাশা নাই। শুধু একটাই প্রত্যাশা সুস্থ্যভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া।
এই দীর্ঘ চলার পথে যা কিছু পেয়েছি তার বেশিরভাগ অপ্রত্যাশিত। সংসার, সন্তান, বন্ধু যা কিছু আমার বলে মনে হয় তার সবই অচিন্তিনীয়ভাবে ঘটেছে। এতো কিছু ঘটার কথা কথা ছিল না। এতো আনুকল্য পাওয়ার কথা ছিল না। এতো বিস্তৃত পরিসর হওয়ার কথা ছিল না। কোনো পরিকল্পনা করে কিছু ঘটেনি আমার জীবনে। প্রকৃতি হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে গেছে নানাভাবে। আমি নিজেকে সৃষ্টিকর্তার করুণার কাছে সঁপে দিয়েছিলাম। আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম একজন কেউ ক্ষমতাবান আছেন যার ইশারায় এই বিশ্বভ্রম্মান্ড পরিচালিত হয়। না হলে এতো সুচারুরূপে সব চলত না। রাতের পর দিন আসত না। শীতের পর গ্রীষ্ম আসত না। এতো নিখুঁত হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব না। আমি সেই অর্থে কঠিন ধার্মিক না হলেও আমার ঈশ্বর বিশ্বাসের জায়গাটা অনেক শক্ত। যারা বিশ্বাস করে না তাদের প্রতিও আমার কোনো দ্বিধা নাই। সবাই একভাবে সৃষ্টি, সবাই মানুষ এই বিশ্বাস আমি নিজে নিজেই অর্জন করেছি। মানবতার চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নাই এটা আমি কারো কাছ থেকে শিখিনি। তাই ধর্ম বর্ণ নির্ষিশেষে আমি মানুষকে ভালবাসি, সখ্যতা করি, বন্ধু ভেবে বুকে টেনে নেই। তারাও আমাকে বুকে টেনে নেয়।
আমার ভিতরে অনুশোচনা অনেক প্রবল। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। আপাতদৃষ্টিতে সেই ভুলগুলো অন্যের জন্য ক্ষতিকর না হলেও এসব আমাকে সবসময় পীড়া দেয়, বিষণ্ন করে দেয়। আমি সামান্য মানুষ বলেই আমার ভুল হয়। এমন অনেক ভুল আছে যা জেনে শুনেই করেছি। সেইসব ভুল এখন অহর্নিশ আমাকে যন্ত্রণা দেয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্তবোধ করে। আমি আমার ভুলগুলো শোধরাতে চাই, অনুশোচনায় ভুগি এবং ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী থাকি সবসময়। ক্ষমা চাইতে আমার একটুও খারাপ লাগে না। নিজেকে ছোট মনে হয় না। আমি আমার সন্তানদের কাছেও ক্ষমা চাই। আমি স্ত্রী, বন্ধু, আত্মীয়দের কাছেও ক্ষমার পাওয়ার জন্য অনুনয় করি। হয়ত বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজের মধ্যে পরিবর্তন হয়। নানা কার্যকারণ, ঘটনা, পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে। আমি নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি বলে এইসব কথা বলতে পারছি। বলতে পেরে নিজেকে কিছুটা হালকা করতে পারছি। তবে সব কথা বলা যায় না। সবারই এমন অনেক গোপনীয়তা আছে যা কাউকে বলা যায় না।
আমি পৃথিবীর প্রতি মোহ ঘোচানোর চেষ্টা করছি। চাওয়া পাওয়াগুলিকে ছোট করে আনতে চাচ্ছি। ঠিক শৈশবের দিনগুলিতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা যখন জীবনে কোনো আয়োজন ছিল না। আমাকে ভুল বোঝার কিছু নাই। দিনশেষে সবাইকেই এই পথ বেছে নিতে হয়। কেউ সেটা স্বীকার করুন চাই না করুন। আমার এই বোধহয় হচ্ছে যে জীবন অতি তুচ্ছ। ছোট্ট একটা জার্নি মাত্র। চোখ মুদলেই সব কিছুর পরিসমাপ্তি। এক অনন্ত ঘুম। মহান ঘুম। এই কথা আমি সবসময়ই লিখি। এটা নেগেটিভ কোনো ভাবনা না, এটা চরম সত্যি। চলার পথে আমাদের অনেক ভুল ভ্রান্তি থাকে, অন্যকে কষ্ট দেওয়া থাকে, সাফল্য আর ব্যর্থতা থাকে, রোগ শোক থাকে। কত মানুষ নানা কষ্টে ভুগছে, অসুস্থতায় ভুগছে, অভাবে ভুগছে, বিনে চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। অনেকে চিকিৎসার অতীত। মানুষ আসলে অনেক অসহায়। মানুষ আসলে অনেক একলা। কেউ সফল, কেউবা ব্যর্থ এই যা তফাত।
সৃষ্টির রহস্য বোঝা সত্যিই কঠিন। মানুষ যতদিন বাঁচে ততদিনই আশা স্বপ্ন আর প্রত্যাশা থাকে। থাকারই কথা। আমি মুখে কোনো উচ্চাশা নাই বলি, কিন্তু ঠিকই অবচেতনে অনেক স্বপ্ন লালন করি। স্বপ্ন দেখি একদিন দেশে ফিরে যাব। মা বাবার কবরের পাশে শায়িত হওয়ার স্বপ্ন দেখি, নিজেকে সুস্থ দেখতে চাই, অসুস্থতায় ভুগতে চাই না। জানি জীবনে চাওয়ার মতো করে সবকিছু ঘটবে না। সবকিছু মানুষের হাতে নাই। সব স্বপ্ন পূরণ হবে না। যে কোনো সময় স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। এই যেমন আগামী শনিবার আমার নিউইয়র্ক বইমেলায় যাওয়ার কথা ছিল। টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কিরণ ভাই তার কাছে থাকার সব আয়োজন করে রেখেছেন। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ থেকে তীব্র মাথা ব্যথার কারণে যাওয়া হচ্ছে না। জীবন এমনই। রহস্যে ভরা। তাই বলে স্বপ্ন থাকবে না তা নয়। স্বপ্নই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। শুধু জীবন জার্নিটা সুন্দর হোক, স্বাভাবিক হোক, ভালবাসার হোক, মায়া মমতার হোক, সুস্থ থাকার হোক- এই প্রত্যাশা।
লেখালেখি ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে শখের পর্যায়ে রয়ে গেছে। এমনটাই থাকবে। আমি লিখি আমার যখন লিখতে ইচ্ছা করে তখন। লেখালেখি নিয়ে আমি কোনো চাপ নিতে পারি না। ফরমায়েশি লেখাও আমি লিখি না। কেউ লেখার ব্যাপারে ডিক্টেড করলে তার জন্য লিখা থেকে বিরত থাকি। লেখালেখি কোনো পরীক্ষার হলে বসা না! লেখালেখি হচ্ছে আনন্দের একটা উপকরণ। লিখে সম্মানী পেতে ভাল লাগে আমার। বই লিখে রয়্যালটি পেতেও ভাল লাগে। নর্থ আমেরিকার অনেক পত্রিকা আছে যারা ফ্রি লেখা চায়। যারা ফ্রি লেখা চায় তাদের যা মন চায় দিয়ে দেই। তারাও কিছু বলতে পারে না। যারা লেখার সম্মানী দেয় তারা মাঝে মাঝে তাদের চাহিদার কথা বলে। চাহিদা পূরণ করতে না পারলে লেখা বন্ধ থাকে আমার তরফ থেকেই। লেখালেখি নিয়ে আমার কোনো দৌড়ঝাঁপ নাই। একটা লেখার জন্য দশটা বই খুলে বসি না আমি। আমি অন্যের বই থেকে সহজে কিছু কোট করি না। শুধু মাঝে মাঝে কবিতার লাইন ব্যবহার করি। যদিও আমি নিজে কোনোদিন কবিতা লিখব বলে মনে হয় না।
মনের আনন্দের জন্য লিখি আমি। লেখা আছে বলে নিজেকে আমার কখনও একলা মনে হয় না। লেখার হরফের সাথে আমি সখ্য গড়ে তুলি। লেখার চরিত্রদের সাথে কথা বলি। হাসি, কাঁদি, অভিমান করি। মানুষের সাথে আমি এগুলো করতে পারি না। মানুষের কাছে হাসি, কান্না, অভিমানের কোনো ভ্যালু নাই। আমার শৈশবকালটা ছিল অদ্ভুত এক আলো আঁধারিতে ভরা। এক-একদিন সন্ধেবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন এক-একটা বিকেল বেলা আছে যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়তো উঠোনে। আকাশের রং যেত পালটে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ’আমি’ আছে। সেই সব বিষণ্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হত। প্রায়ই পশ্চিমের ঘরে মাকে খুঁজতে গিয়ে পেতাম না। সারা বাড়ি খুঁজে মাকে হয়ত পেতাম বড় ঘরের পাটাতনের সিঁড়ির তলায় গামলায় চাল মেপে তুলছে। আমি অবোধ দুর্জ্ঞেও এক বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যে মায়ের কাছে গেছি তা মা বুঝত না।
আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি লিখব। আমার যে একটা ভুতুড়ে আমি আছে, কল্পনার জগৎ আছে, বই পড়ে আমার সেই জগতটা আরো জীবন্ত হয়ে উঠে। আমি লিখতে চাই কিন্তু কীভাবে লিখতে হয় তা জানি না। কীভাবে বাক্য গঠন করতে হয়, শুদ্ধ বানান, ভাষাজ্ঞান থাকা দরকার সেসব আমার নাই। পাঠ্য বইয়ের গল্পগুলো খুব মন দিয়ে পড়তাম। লেখার ব্যাকরণ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। লেখা পড়তে ভাল লাগলেই হলো। হৃদয়কে স্পর্শ করলেই হলো। আমি পড়তে খুব ভালবাসি। লেখার চেয়েও পড়ার আগ্রহ আমার বেশি। আমার সংগ্রহে এতো অপঠিত বই আছে যে সেসব কবে শেষ করব জানি না। মনে হচ্ছে আর একবার জন্ম নিতে হবে। স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকেই আমি প্রচুর চিঠি লিখতাম। আমার অনেক পেনফ্রেন্ড ছিল। চমৎকার সব চিঠি আসত আমার কাছে। আমিও রিপ্লাই দিতাম প্রতিটা চিঠির। পত্রিকায় চিঠিপত্র লিখতাম। পত্রলেখক হিসেবে আমার একটা খ্যাতি হয়েছিল। চিঠি লিখতে লিখতেই আমার গল্প উপন্যাস লেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। পরবর্তীকালে অনেক স্মৃতিকথাও লিখেছি। এজন্য ফেসুবকের প্রতি কৃতজ্ঞ। সেইসব পত্রবন্ধুদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যারা আমার কল্পনার জগতটাকে উসকে দিয়ে দিয়েছিলেন।
লেখা নিয়ে কখনও সাহিত্য সম্পাদকের কাছে যাইনি। লেখা ছাপানোর জন্য অনুরোধ করিনি। সত্যি বলতে কি আমি সাহিত্য সম্পাদকদের খুব বেশি চিনিও না। আমার যে এতো বই প্রকাশিত হয়েছে আমি কখনও আমার বই নিয়ে কোনো লেখকের দরজায় ধরনা দেইনি। বলিনি ভাই আমার লেখাটা একটু পড়বেন। কারণ লেখা পড়ে যখনই কেউ বলবেন কিছুতো হয়নি বা অনেক ভুল ধরবেন তখন আমার মন ভেঙ্গে যাবে। নিজের লেখা নিয়ে তাই কথা বলতে আমার লজ্জা লাগে। লেখকদের মধ্যে গ্রুপিংয়ের কথাও শোনা যায়। আমার কোনো গ্রুপ নাই। ওসব একদম পারি না আমি। শুধু ভাল লিখতে পারা বা পাঠক প্রিয় হওয়াই একজন লেখকের একমাত্র যোগ্যতা না। তার আরো অনেক যোগ্যতা থাকতে হয়। কেউ আমার বই কিনলে আমি মহা খুশী। লেখা পড়লে খুশী হই। উৎসাহ বেড়ে যায়। আমি আমার আনন্দের জন্য লিখি। সবশেষে একটা গোপন কথা বলি, লেখকরা আমার কাছে এখনও এক স্বপ্ন। আমি বরিশাল ছেড়ে ঢাকা এসেছিলাম লেখকদের কাছ থেকে দেখব বলে।
শুধু ভালবাসাই বেঁচে থাকে।
অবচেতনে হলেও মানুষের মনে সবসময় অহঙ্কারবোধ থেকেই যায়। কিছুতেই মানুষ এই দোষ থেকে বের হতে পারে না। পারলে ভাল হতো। কিন্তু সেটা খুবই কঠিন একটা কাজ। যে একটু উপরের পজিশনে চাকরি করে সে ছোট পজিশনের চাকরিকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। যে বাড়িতে থাকে সে যারা এপার্টমেন্টে থাকে তাদের একটু ছোট জাতের মনে করে। অথচ সে নিজেও একসময় এপার্টমেন্টে থেকেছে, সরকারি বাড়িতে থেকেছে। যে একটু দামি গাড়ি চালায় সে কম দামের গাড়ি যারা চালায় তাদের তেমন গুরুত্ব দেয় না। তাদের কথায়, বডি ল্যাংগুয়েজে ফুটে উঠে অহংকার আর অবজ্ঞা। মানুষের মন আসলে বিচিত্র। মানুষ তার অতীতকে ভুলে যায়। অতীতের অবস্থান, অতীতের কথা ভুলে যায়। বর্তমান নিয়ে পড়ে থাকে। আমি মানুষের এইসব পরিবর্তনগুলো খুব লক্ষ্য করি। যেখানেই যাই মানুষের গল্পগুলো শুনি। আমি খুব ভাল শ্রোতা। মুগ্ধ শ্রোতা।
কে কত দামী বাড়িতে থাকে, কে বিজনেস ক্লাসে ট্রাভেল করে, কে দামি গাড়িতে চড়ে, কে এপার্টমেন্টে থাকে বা সরকারি বাড়িতে সেসব নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নাই। এই ধরনের মানুষের প্রতি আমার আলাদা কোনো অনুরাগ নেই, কোনো পক্ষপাত নেই। আমার কাছে বাসের হেল্পার থেকে শুরু করে যে যত বড়ই পদের অধিকারী হোক সমান। মানুষ সবসময় নিজেকে আলাদা ভাবতে ভালবাসে। অন্যের তুলনায় নিজেকে সুপিরিয়র ভাবতে ভালবাসে। আপতাদৃষ্টিতে এতে কোনো দোষের কিছু নাই। প্রতিটা মানুষই আলাদা। ভিন্ন একক। প্রতিটি মানুষ অনন্য। কিন্তু কাউকে ছোট ভাবা, তাচ্ছিল্য করা, নিজের বন্ধু বা আপনজনের সাথে তুলনা করা খুব খারাপ অভ্যাস। মানুষ কিছুতেই এই দোষ থেকে বেরুতে পারে না। আমি যতই বলি আমি সবাইকে সমান চোখে দেখি কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করলে এর উত্তর পাওয়া যায়। অবচেতনে আমার মধ্যেও শ্রেনীবৈষম্য রয়েছে, সূক্ষ্ম বিভেদ রয়েছে।
কি দেশে কি বিদেশে এই বিভাজনগুলো খুব চোখে পড়ে। আমি নিজেও এর অংশ হয়ে যাই। সর্বত্র একটা প্রতিযোগিতা। কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে সেই প্রতিযোগিতা। কে কাকে পিছনে ফেলবে সেই প্রতিযোগিতা। অসুস্থ এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মানুষ ক্রমে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, একা হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে দেখেছি সর্বত্র একটা বিভাজন, সূক্ষ্ম বিভেদ। সামনে এক রকম ভিতরে অন্য। যারা বাড়িতে থাকে তারা অন্য বাড়ি ওয়ালাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের সাথে গল্প করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, বেশিরভাগ সময় জুড়ে থাকে গাড়ি, বাড়ি বা দাওয়াতের গল্প। প্রবাসীদের মনন, চিন্তা চেতনা সবকিছু বস্তুনির্ভর হয়ে পড়ছে। প্রবাসীদের কাছে বাড়ি না থাকা যেনো বিরাট ব্যর্থতা। যেনো বাড়িতে থাকাটাই
জীবনের সবকিছু। কিন্তু সে ভুলে যায় একদিন সেও অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। কষ্টের দিন ছিল তার। দেশে গেলেও এসব চোখে পড়ে। কার কয়টা বাড়ি, কয়টা গাড়ি, কে কয়টা দেশে ঘুরেছে, রিসোর্টে থেকেছে, দামি হোটেলে খেয়েছে এইসব গল্প শুধু।
আমরা ক্ষমতাকে পছন্দ করি। ক্ষমতাবানদের পছন্দ করি। ক্ষমতাবানরা সেটা জানেন, তারা এটা উপভোগ করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেটা ভাল বোঝা যায়। একজন পুলিশের বড় কর্তা বা একজন বড় লেখক, সাংবাদিক বা অভিনেতা, সচিব পদমর্যাদার কেউ, বড় ব্যবসায়ী বা যে পদে থাকলে কিছু পাওয়ার সম্ভবনা থাকে তাদের আমরা লাইক কমেন্টস করি, অঢেল প্রশংসা বাক্য লিখি। কিন্তু সাধারণ একজন বন্ধুর ক্ষেত্রে, আত্মীয়র ক্ষেত্রে সেটা আমরা করি না। এই দ্বৈত চরিত্র আমাদের মজ্জাগত। এমন না যে ক্ষমতাবান ব্যক্তি আপনার জন্য কিছু করে দেবে, এমনকি আপনাকে চেনেও না, কখনও আপনার জন্মদিনে একটা শুভেচ্ছা পর্যন্ত দেয়নি তাকেও আপনি ভালবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন। আসলে আপনি তার পদকে, তার জনপ্রিয়তাকে, তার ক্ষমতাকে ভালবাসেন। আপনি কিছু পাবেন না তাও তোষামোদ করেন। মনে রাখুন যেকোনো সম্পর্ক হচ্ছে রেসিপ্রোকাল। একতরফা না। হাজার হাজার লাইক কমেন্টস যারা পেয়ে বুঁদ হয়ে থাকেন তারাও জানবেন কিছুই চিরস্থায়ী না। একদিন সবাইকেই চলে যেতে হবে। শুধু ভালবাসাই বেঁচে থাকে।
জসিম মল্লিক
লেখক ও সাংবাদিক। টরন্টো
jasim.mallik@gmail.com