বাবা খুবই পোলাইট একজন মানুষ ছিলেন, মানুষের সুখে দুখে সবসময় পাশে থাকতে দেখেছি তাকে : আসমা আহমেদ
প্রবাসী কণ্ঠ : কিংবদন্তি অভিনেতা ইনাম আহমেদ জন্মেছিলেন ১৯২২ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি। শতবর্ষ আগে জন্ম নেয়া এই অভিনেতা ছিলেন একজন অভিনয়পাগল মানুষ। অভিনয় যেন মিশে ছিল তার রক্তে। মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি নাটকে অভিনয় করা শুরু করেন।
ইনাম আহমেদ ছিলেন প্রথম সবাক বাংলা চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। চলচ্চিত্রটি মুক্তিপায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। পরিচালক ছিলেন আবদুল জব্বার খান। তারও আগে ১৯৪৩ সালে কলকাতায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় ‘সমাধান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এই ছবিতে তিনি ‘অরুণ চৌধুরী’ ছদ্মনামে অভিনয় করেন। কয়েকটি উর্দু ছবিতেও অভিনয় করেন পাকিস্তান আমলে।

ইনাম আহমেদ ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তার বাবা’র ইচ্ছে ছিল তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নিবেন। কিন্তু অভিনয়ের নেশা তিনি ত্যাগ করতে পারননি। ফলে লেখাপড়া শেষ করে সেই অভিনয়কেই বেছে নেন পেশা হিসাবে। মাঝখানে অবশ্য তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা এবং কলকাতায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভিনয়কেই তিনি স্থায়ী পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। শক্তিমান অভিনেতা ইনাম আহমেদ টেলিভিশনেও বেশকিছু নাটকে অভিনয় করেছেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে বিচরণ করে গেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্রে। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬), হারানো দিন (১৯৬১), সূর্যস্নান (১৯৬২), সোনার কাজল (১৯৬২), চান্দা (১৯৬২), জোয়ার এলো (১৯৬২), সুতরাং (১৯৬৪), মেঘ ভাঙ্গা রোদ (১৯৬৪), কাজল (১৯৬৫), রূপবান (১৯৬৫), ভাওয়াল সন্ন্যাসী (১৯৬৬), পাতাল পুরীর রাজকন্যা (১৯৬৯), নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯), টাকা আনা পাই (১৯৭০) ও শুভদা (১৯৮৬) উল্লেখযোগ্য।
গুণী এই অভিনেতা বাংলা ছাড়া আরো তিনটি ভাষায় বলতে ও লিখতে পারতেন। সেই ভাষা তিনটি হলো ইংরেজী, উর্দু ও ফরাসি। ঝিনুক নামের একটি সাপ্তাহিকীতে ‘আমার শিল্পী জীবন’ শিরোনামে ইনাম আহমদের একটি ধারাবাহিক লেখা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল একসময় পাঠক মহলে।
ইনাম আহমেদ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে রাজিয়া খানমের সাথে। তাদের চার ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। তাঁর এক ছেলে মারুফ আহমেদ (অভিনেতা ও বিটিভির সংবাদ পাঠক) এবং মেয়ে আসমা আহমেদ (এক সময়ের জনপ্রিয় বিটিভির সংবাদ পাঠিকা)।
ইনাম আহমেদ বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন ২০০৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটে। তার জন্মস্থানও ছিল সিলেট। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ইনাম আহমদের অবদান অনেক। কিন্তু তারপরও তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বা কোন রাষ্ট্রীয় পদক পাননি। এ বিষয়ে তার মেয়ে কানাডা প্রবাসী আসমা আহমেদকে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, খুব ভাল একটি প্রশ্ন। দেখুন আমি আমার বাবাকে অকাতরে কাজ করে যেতে দেখেছি। কখনো দর্শকের ভালবাসা ছাড়া তাকে কোনো পুরষ্কার প্রত্যাশা করতে দেখিনি। সবসময় বলতেন আমার পুরষ্কার দর্শকের ভালবাসা। আমি এবং আমার ভাই যারা মিডিয়ায় কাজ করতাম তাদের সবসময় এই কথাই বোঝাতেন যে, দেখ দর্শকের ভালবাসাটাই জয় করবে, Crest হাতে উঠল কি উঠলো না সেটা নিয়ে মোটেই ভাববে না বা তার পিছু ছুটবে না।
আসমা আহমেদ ১৯৮৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে একজন জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন।
প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে আসমা আহমেদ তার বাবা সম্পর্কে আরো অনেক অজানা তথ্য শেয়ার করেছেন পাঠকদের জন্য। নিচে তা তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন : বাবাকে নিয়ে সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি কোনটি?
উত্তর : প্রচুর স্মৃতি। তবে আমাদের স্কুলের অভিভাবক দিবসে আব্বা নিয়মিত যেতেন, আর তাঁর উপস্থিতিতে একটা হুলুস্থুল অবস্থা তৈরী হয়ে যেত। সবাই আব্বার অটোগ্রাফের জন্য হুড়োহুড়ি করত যা দেখে ঐ ছোট্ট বয়সে আমার এক অনাবিল আনন্দ হত।
প্রশ্ন : প্রায় প্রতিটি মেয়ের কাছেই বাবা হলেন তার আদর্শ পুরুষ। আপনার জীবনে?
উত্তর : অবশ্যই তাই। আমার বাবা এক সুশিক্ষিত পরিবারের সন্তান, নিজেও পড়াশোনা করছেন কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। আমার শিশুকাল থেকে তিনি ছিলেন আমার শিক্ষাগুরু। একজন আধুনিক মনস্ক মানুষ হিসাবে তিনি আমাকে ও আমার ভাইবোনদেরকে গড়ে তুলতে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন শত ব্যস্ততার মাঝেও। একই সাথে আমরা যেন সত্যিকার মানবিকতায় গড়ে উঠি সেই চেষ্টাও ছিল উনার। দেশপ্রেম, মানুষকে কিভাবে আপন করে নিতে হয় তাও পুরোপুরি তার কাছ থেকে শিখেছি আমি ।
প্রশ্ন : আপনার জীবনে আপনার বাবার প্রভাব কতটুকু?
উত্তর : দেখুন আজ আমি যে বয়সে এসে দাঁড়িয়েছি তাতে আমার যে সাফল্য বা প্রাপ্তি তা বাবার প্রভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। আমি আমার ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি দর্শকমন জয় করার এক অনাবিল টেকনিক তার জানা ছিল। আমি তার দর্শনেই বিশ্বাসী। মানব প্রেম এবং দর্শকের কাছে থাকা এবং তাদের ভালবাসা আয়ত্ব করা এসব আমি শিখেছি তাঁর কাছ থেকেই ।
প্রশ্ন : বাবার পথ ধরে আপনিও চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেননি কেন?
উত্তর : চলচ্চিত্র আমার একটি প্রিয় মাধ্যম। কিন্তু আমি গণমাধ্যম বেছে নিয়েছি। এটিতেও আমার পিতার স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। পঞ্চাশ এর দশকে আমার বাবা তদানীন্তন পাকিস্তানের করাচী বেতারের একজন সংবাদ পাঠক ছিলেন, অনেকেই হয়ত তা জানেন না।
প্রশ্ন : আপনার বাবা কি আপনাকে কখনো অভিনয় জগতে পা রাখার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন?
উত্তর : আসলে আব্বা আমাদের লেখাপড়ায অত্যন্ত উৎসাহী ও মনোযোগী ছিলেন। তার প্রত্যাশা ছিলো আমরা যেন প্রথমে সুশিক্ষিত হয়ে উঠি এবং তারপর যে যার পছন্দমত পেশা বেছে নেই ।
প্রশ্ন : আপনার বাবা কিছুদিন ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। আবার কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন খলনায়কের ভূমিকায়। এসবের প্রভাব কি উনার ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনেও ছিল? মানে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও কি উনি খুব রাগী মানুষ ছিলেন? নাকি একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন?
উত্তর : একজন জাত অভিনেতা ছিলেন তিনি। পিউর প্রফেশনাল। অভিনয়ের ধরণ হিসাবে খল নায়ককে বেছে নিয়েছিলেন যেটি ছিল খুব কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন অভিনয়ের বিষয়টা এত নিখুঁতভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন যে তাকে দেখেই লোকে ভয় পেত। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুব পোলাইট একজন মানুষ ছিলেন। মানুষের সুখে দুখে সবসময় পাশে থাকতে দেখেছি তাকে। আর পুলিশে খুব কম সময়ের জন্য কাজ করেছিলেন তিনি। মুলত তার একমাত্র আকাঙ্খার পেশা ছিলো অভিনয়।

প্রশ্ন : খুব শাসনের মধ্যে রাখতেন কি আপনাদেরকে। দু একটি উদাহরণ?
উত্তর : পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ এবং প্রমিত বাংলাকে যেন আমরা সব ভাইবোন ধারণ করতে পারি এ বিষয়ে খুব Disciplined ছিলেন ।
প্রশ্ন : কখনো কখনো সন্তানেরাও বিশেষ করে মেয়েরাও আদর করে বাবাকে শাসন করে থাকে। সে রকম কোন অভিজ্ঞতা আছে কি আপনার?
উত্তর : আব্বার প্রিয় একটি বিষয় ছিল রাত জেগে পড়া আর ধুমপান। আমি এ বিষয়ে তাকে চেষ্টা করেছি বিরত রাখতে শাসনের মধ্য দিয়ে।
প্রশ্ন : কখনো কোন কারণে আপনি বা আপনার ভাই-বোনেরা রাগ বা অভিমান করে থাকলে আপনার বাবা কি মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করতেন?
উত্তর : অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে আব্বা আমাদের জন্মদিন ভুলে যেতেন। পরে শপিং বা চাইনিজ খাবার খাইয়ে মান ভাঙ্গাতে দেখেছি।
প্রশ্ন : ঈদে বা জন্মদিনে আপনারা বাবার কাছে কি উপহার পেতেন?
উত্তর : সবসময় সাধ্যমত উপহার পেতাম। আব্বা আমাদের শপিং এ নিয়ে যেতেন আর আব্বাকে দেখতে দর্শকেরা যে কি ভীড় জমাতো তা আমরা ভাইবোনেরা ভীষণ উপভোগ করতাম। শপিং এর পর আব্বা আমাদের নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে বসতেন বা সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন।
প্রশ্ন : চাকরী জীবনের ব্যস্ততা প্লাস অভিনয় জীবনের ব্যস্ততা। এতকিছু করেও উনি কি পরিবারে সময় দিতে পারতেন?
উত্তর : চেষ্টা করতেন। তবে যেটুকু শূন্যতা থাকতো তা পুষিয়ে দিতেন আমাদের মা।
প্রশ্ন : উনি অভিনয় জগতের সঙ্গে কি ভাবে জড়ালেন? কাকতালীয়ভাবে নাকি অভিনয়ের প্রতি উনার আগ্রহ ছিল প্রবল।
উত্তর : অভিনয়ের প্রতিই ছিলো তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা। আমার দাদা ছিলেন তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা পরিদর্শক। দাদার ইচ্ছা ছিলো তার দুই ছেলেও শিক্ষাকেই পেশা হিসাবে বেছে নেবে। আমার চাচা পড়াশোনা শেষ করেই বেছে নেন শিক্ষা পেশা, কিন্তু আব্বা প্রেসিডেন্সীতে লেখাপড়া করেও চলচ্চিত্র কে বেছে নেন পেশা হিসাবে। এর মাঝে জীবন ধারণের জন্য এখানে সেখানে কিছু কাজে জড়িত হন কিন্তু তা তার মনে ধরেনি।
প্রশ্ন : উনার অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতেন কি? করে থাকলে তার দু একটা ঘটনা বলা যাবে?
উত্তর : সবসময় করতেন। তার প্রিয় মাধ্যম এই চলচ্চিত্র। এর খুঁটিনাটি দিক, তাঁর পছন্দের ছবি, প্রিয় অভনেতা এ সবকিছু আমাদের সাথে শেয়ার করতেন। আমি শুরুতে একজায়গায় বলেছি চলচ্চিত্র আমার একটি প্রিয় মাধ্যম। এই ভাল লাগাটা আমার বাবাই আমার মাঝে তুলে ধরেছেন।
প্রশ্ন : সেকালের খ্যাতিমান অভিনেতাদের কেউ কি আপনাদের বাড়িতে আসতেন নিয়মিত আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করতে? কারা আসতেন? কোন স্মৃতি মনে আছে কি?
উত্তর : তখনকার চলচ্চিত্র ছিল যেন এক স্বর্ণযুগ। তেমনি ছিল সবার মাঝে এক দারুণ আন্তরিকতা। এক শিল্পী আরেক শিল্পী পরিবারকে মনে করতেন নিজের পরিবার। আমাদের বাসায় খুব আসতেন সবাই আমার আব্বাও আমাদের নিয়ে যেতেন তাঁর সহকর্মীদের বাসায়। তখনকার খুবই জনপ্রিয় তারকা জুটি রহমান – শবনাম, আজিম – সুজাতা, কবরী- রাজ্জাক এবং পরিচালক খান আতাউর রহমান, মনে হত যেন আমাদেরই পরিবার। একদিন সকালে দেখি এক ছোটোখাটো লোক আব্বার সঙ্গে বসার ঘরে কথা বলছেন। নজরে পড়ল তার দুটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরে জানলাম তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান।
প্রশ্ন : চলচ্চিত্র জগতের কার সঙ্গে আপনার বাবার সখ্যতা ছিল সবচেয়ে বেশী।
উত্তর : ঐ যে বললাম তখন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জগতটা ছিল যেন এক পরিবার। প্রায় সবার সাথে সবার এক পেশাগত সখ্যতা ছিল আর আব্বাকে দেখেছি সবাইকে বন্ধুর মত মনে করে কাজ করতে। সবাই মিলে সময়ে সময়ে আড্ডা দিতে। সেই আড্ডায় পরিবারের পক্ষ থেকে অংশ নিতাম আমরা ভাই বোনেরাও।
প্রশ্ন : আপনার বাবার অভিনয় জীবনের ব্যস্ততা নিয়ে আপনার মা’র কোন ক্ষোভ ছিল কি? নাকি উনিও পছন্দ করতেন বিষয়টি।
উত্তর : আব্বার মন প্রাণ ঢেলে অভিনয় করার অনেক বড় কৃতিত্ব আমার মায়ের। যিনি সংসারের সবকিছু আব্বার হয়েই করতেন। অনেক সময় অনেক সমস্যা আব্বাকে জানাতেনও না। একাই সামাল দিতেন। আব্বার অভিনয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন আম্মা। মনে আছে আব্বার কোনো নতুন ছবি রিলিজ হলে দিনের সব কাজকর্ম শেষ করে আম্মা খালার সাথে রিকসায় চেপে চলে যেতেন হলে সেই সিনেমাটা দেখতে।
প্রশ্ন : আপনার মা কতটা গর্বিত ছিলেন আপনার বাবার সাফল্য দেখে?
উত্তর : অসম্ভব গর্ব বোধ করতেন আমার মা নিজেকে মিসেস ইনাম আহমদ পরিচয় দিতে এবং আমার মা চলচ্চিত্র শিল্পের সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একজন ছিলেন। সবাই আম্মাকে সম্মান করতেন।
প্রশ্ন : শৈশবে আপনারা ভাই বোনেরা কতটা গর্ব করতেন বাবার সাফল্যে?
উত্তর : একজন শিল্পী হিসাবে বাবার সাফল্যে আনন্দিত বোধ করতাম। অনুভব করতাম একজন সৎ শিল্পী কত কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন এটা ভেবেও গর্ব বোধ করতাম এবং এখোনো করি।
প্রশ্ন : আপনার বাবাকে নিয়ে কোন ডকুমেন্টারী তৈরী হয়েছে কি? আর না হয়ে থাকলে আপনারা ভাই-বোনেররা মিলে করার ব্যবস্থা করছেন না কেন?
উত্তর : এটি একটি ভাল চিন্তা। হয়ত হতে পারে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। তবে গত বছর আমার বাবার শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বিরাট ট্রিবিউট করে তাদের ডেনফোরথ মিলনায়তনে, সেটি একটি ভাল ডকুমেন্টেশন ।
প্রশ্ন : আপনার বাবার অভিনিত কোন ছবি মুক্তি পেলে সেটা দেখার জন্য উনি কি আপনাদের নিয়ে যেতেন সিনেমা হলে? যদি না নিতেন তবে তার পিছনে কারণ কি ছিল?
উত্তর : ঐ সময় ছবি মুক্তি পাবার পর সিনেমা হলে (বেশীরভাগ হত মধুমিতা সিনেমা হলে) একটা প্রেস শো হতো। আমাদের সব ভাইবোন এবং মাকে নিয়ে যেতেন আব্বা। তবে মাঝে মধ্যে পরীক্ষা পড়ে গেলে বা আমাদের কারো জ্বর-টর হলে যেতে পারতাম না।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় উনি কোন ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন?
উত্তর : একটা মুক্তচিন্তা এবং অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা আজন্ম দেখেছি তার মাঝে। আমার দুই ভাইকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠান তিনি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। সে সপ্ন দেখে গিয়েছেন তিনি।
প্রশ্ন : কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন উনি?
উত্তর : মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন মানুষ ছিলেন তিনি। স্বাধীন চিন্তা ও চেতনায় বিশ্বাসী একজন বাংলাদেশী শিল্পী ছিলেন তিনি। কোনো দলের নয়।
প্রশ্ন : বন্ধুমহলে উনার জনপ্রিয়তা ছিল কেমন? খুব আড্ডাবাজ ছিলেন কি? আড্ডায় মধ্যমণি থাকতেন কি উনি?
উত্তর : খুব বেশীই আড্ডা ভালবাসতেন। প্রচুর বন্ধু ও গুনগ্রাহী ছিলো তার। আমাদের বাড়িতেও প্রচুর আড্ডা হতো।
প্রশ্ন : বেড়াতে ভালবাসতেন কি। আপনাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতেন কি?
উত্তর : আমাদের নিয়ে দেশের বাড়িসহ দেশের অনেক আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেশের বাইরেও অনেক দেশে গিয়েছেন আব্বা। তবে বসবাসের জন্য তাঁর পছন্দ ছিলো তার দেশ বাংলাদেশ।
প্রশ্ন : বাবাকে সবচেয়ে কাছে পেয়েছিলেন কোন সময়টা। সেই সময়ের কিছু স্মৃতি শেয়ার করবেন কি?
উত্তর : আমার পুরো ছেলেবেলা আব্বাকে কাছে পেয়েছি। আমার লেখাপড়া, প্রমিত বাংলাশেখাটাই বাবার হাতে। বলতে গেলে জীবনটাকে বুঝতে শিখেছি বাবার তত্ত্বাবধানে।
প্রশ্ন : বাবাতো সবসময় কাছে থাকতেন না। কাজে কর্মে দূরে যেতে হতো। তখন মন কেমন করতো? মানে বাবাকে কতটা মিস করতেন?
উত্তর : খুব মিস করতাম, কিনতু সেটা ছিলো সাময়িক। বাবা ফিরে এসে তা পুষিয়ে দিতেন। আসলে আমার বাবা ছিলেন ফুল অফ লাইফ। উনি কাজ থেকে ফিরে এলেই বাড়িটা আলোকিত হত।
প্রশ্ন : এবার আপনার মা সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : আমার মা ছিলেন এক মহীয়সী মহিলা। একজন শিল্পীর সাথে ঘর করে তাকে অকাতরে সম্মান আর ভালবেসে তাকে তাঁর কাজে উৎসাহই দিয়ে গেছেন। নিজের চাওয়া পাওয়া নিয়ে কখনো তাকে কিছু বলতে শুনিনি। আমাদের পরিবারের এক মহীরুহ আমার মা।
প্রশ্ন : আপনাদের ভাই বোনের জীবনে মায়ের প্রভাব, আদর –ভালবাসা অথবা শাসন কতটুকু ছিল?
উত্তর : মা মঝে মাঝে বাবা/ মা দুইয়ের ভূমিকাই পালন করতেন বাবার অবর্তমানে। অবাক হয়ে যেতাম তাঁর দৃঢ়তা দেখে। সবসময় দুঃখকে আড়াল করে রাখার শক্তি ছিল তার মাঝে। কড়া শাসন আমাদের বাড়িতে ছিলোনা। তাই আমাদের মায়ের ভালবাসাটার কথাই মনে পড়ে সবসময় ।
প্রশ্ন : এবার আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : আমি এই একটি জিনিষ ভয় পাই, নিজের সম্বন্ধে বলতে। সম্ভবত আমাকে যারা চেনেন তারাই সবচেয়ে বেশী ভাল বলতে পারবেন। তবুও যঁখন জানতে চাওয়া হল তখন বলি- আমি এক শিল্পী বাবার ঘরে জন্ম নেয়া মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী একজন মানুষ। আমি মানুষের স্বাধীন চিন্তায় বসবাসের সপ্ন দেখি। যার যার মানবিক
অধিকার নিয়ে সবাই বেঁচে থাকুক এই আশা করি। পড়াশোনা শেষ করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। বেতার ও টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ ও প্রশিক্ষকের কাজ করি। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের কেবিন ক্রু’র প্রশিক্ষকও ছিলাম মেলাদিন। টরন্টো এসে আবার হিস্ট্রি ও সোশ্যাল সাইন্স। নারীর সামাজিক উন্নয়ন ও সিনিয়রদের নিয়ে কাজ করা আমার পছন্দ।
প্রশ্ন : আপনি বিটিভি’র খবর পড়ার সঙ্গে জড়ালেন কি ভাবে?
উত্তর : একসময় সংবাদ পাঠ করতেন দিলারা হাসেম। সংবাদ পাঠ যে এত সুন্দর আর শোনার মত হতে পারে জানা ছিলোনা। একসময় নিজেই আগ্রহী হই। বাসায় কাউকে না জানিয়ে অডিশন দেই। পাশ করি এবং শুরু করি সংবাদ পাঠ।
প্রশ্ন : একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড/ বিয়ে/ ছেলে-মেয়ে/ তারা কে কি করছে। স্বামীর নাম, দেশে কি করতেন, এখানে কি করেন?
উত্তর : আমার স্বামী এনভায়রনমেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করেন। নাম নুরুল মাসুদ জামিল। আমার দুই ছেলে তামহিদ ইশাত ও মাশরুর ইশরাক। একজন আরকিটেক্ট এবং ডিজিটাল এনিমেটার। আমাদের বিয়ে হয়েছে ১৯৮৮ সালে।
প্রশ্ন : কানাডায় কবে এসেছেন? তার আগে অন্যকোন দেশে ছিলেন?
উত্তর : কানাডায় আসি স্কিলড পরফেশনাল হিসাবে ২০০২ সালে। না সরাসরি বাংলাদেশ থেকেই এসেছি আমরা।
প্রশ্ন : কেমন আছেন প্রবাস জীবনে?
উত্তর : এটিই এখন আমার দেশ আর বাংলাদেশটি মাতৃভুমি। একটি মাল্টি কালচারাল দেশে থাকতে ভালবাসি।
প্রশ্ন : এখন সময় কাটে কি নিয়ে?
উত্তর : সময় কাটানোর নানা ফেক্টর বের করাই যায় যদি আপনার করার বা পছন্দের তালিকায় অনেক কিছু থাকে ।
প্রশ্ন : ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
উত্তর : একটি চলচ্চিত্র তৈরী করতে চাই সর্ট বা ফিচার। দেখা যাক।