নিভৃতে
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রাতটা যে কিভাবে কাটে সারার। এমনকি ফাবিয়ান রাতেও তার কাছে শুতে আসেনি। একটা কথাও বলেনি। কোন কথার জবাবও দেয়নি। সারা রাত কেঁদে কেঁদে সারা তার চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সকাল ১১টায় স্টিভেন ওকে নিতে আসবে। বিকাল ৫টায় তাদের সুইডেনগামী ফ্লাইট। খুব ভোরে উঠে সারা তার বাবার কবরে ফুল দিয়ে আসলো, কথা বললো বাবার সাথে-
: বাবা, আমি যাচ্ছি! ফাবিয়ান রইলো তুমি দেখো। বাবা জীবনে ১টি ভুলের মাশুল সারা জীবন আমাকে দিতে হবে। বাবা তুমি বলেছিলে নতুনভাবে, নতুন করে জীবন গড়তে। তাই চেষ্টা করছি। কিন্তু বলতে পারো বাবা, কেন নিরলশ আনন্দ নেই আমার জীবনে? বাবা আমি এখন কি করি? একজনকে ধরতে চাইলে আর একজন যে দূরে সরে যায়।
সারা কান্নায় ভেঙে পড়ে। একটা অসহায়, অব্যক্ত কান্নায় তার বুকের খুউব গহীন থেকে গুমরে ওঠে। সারা মনে মনে ভাবে তার প্রিয় কবি দান্তের কিছু লাইন-
‘Incipit Vita Nova
Ecce deus fortior me
qui veniens dominabitur mihi’
(আজ থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হলো, আমার চেয়েও শক্তিমান, এই দেবতা আমাকে আচ্ছন্ন করলেন।)
আমান্ডা আজ অনেক রকম খাবার বানিয়েছে। রাত থাকতে উঠে সে খাবার বানাচ্ছে। একটু পরেই রোডিকা, কেভিন, ডোরিন চলে এলো। ওরা এসে সারাকে সব প্যাক করতে সাহায্য করলো। ওরা দুজন অবশ্য যতটুকু কাজ করছে তার থেকে কাঁদছে বেশি। এমনকি কেভিনও খুব বিষন্ন। একটু পর স্টিভেনও চলে এলো। ওর মা সবাইকে ডাকলো খেতে। কেউ খেতে পারলো না। সকালে সারা একটি বার মাত্র ফাবিয়ানকে দেখেছিল। মায়ের খাটে ঘুমাচ্ছিল। সারা খুব আস্তে ছেলের পাশে বসে নির্নিমেশ ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিল। চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিল। কপালে চুমো দিল অনেক বার। যেন বা আকণ্ঠ শুষে নিল তার ছেলের ঘ্রাণ। তার চোখ দিয়ে ১ ফোটাও অশ্রু পড়তে দিল না, ছেলের কপালে। কারণ, মায়ের অশ্রু সন্তানের ললাটে পড়া, এটা ভালো নয়। শুধু খুব গোপনে, নীরবে নিভৃতে তার প্রথম ভালোবাসার ফসলকে আদর করলো প্রাণভরে। সে ভালোবাসা যেন কেউ দেখে না ফেলে।
প্রায় পৌনে এগারোটা বেজে গেছে। বেরোতে হবে। ঘর থেকে স্যুটকেস, ব্যাগ সব বের করতে শুরু করলো স্টিভেন। কেভিনও সাহায্য করছে। রোডিকা সারার রোরুদ্যমান শরীর জড়িয়ে ধরে ঘর থেকে বের হলো। কিন্তু সারার চোখ খুঁজে ফিরছে ফাবিয়ানকে। এ ঘর, ও ঘর- এমনকি জলপাই তলা কোথাও নাই। ডোরিন ঠোট ফুলিয়ে বললো-
: সারা আন্টি আমিতো এমনকি লেকের পাড়েও খুঁজে এসেছি, সেখানেও নেই। কি জানি কোথায় গেল?

আমান্ডা তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো। বুক ফাটা কান্না! কিন্তু সারা মায়ের দুঃখেও কাঁদতে পারছে না। কারণ, তার হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রী তার ছেলেকে খুঁজছে। কোথায় তার নাড়ী ছেড়া ধন? ওকে, না দেখে সে কিভাবে যাবে?
রোডিকা তার মনের কথা বুঝতে পারলো। রোডি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললো-
: সারা, কাঁদিস না- শোন ফাবিয়ানকে খুঁজে লাভ নাই। কেউ যদি ইচ্ছা করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে তাকে কিভাবে খুঁজে পাবি? ও কোথাও লুকিয়ে আছে! তুই চিন্তা করিস না, আশেপাশেই আছে আমি সিওর।
: ওকে একটি বার দেখবো না? তুই-ই বল, কিভাবে যাবো আমি?
: ছোট তো, বুঝতে পারছে না। যখন বড় হবে তখন ঠিক বুঝবে একদিন যে, তোর এই যাওয়াটা সত্যিই দরকার ছিল!
: কিন্তু, ফাবি আমায় খুউব ঘৃণা করবে!
: দূর বোকা, কোন সন্তানই তার মাকে শেষ পর্যন্ত ঘৃণা করতে পারে না। সারার কান্না দেখে এমনকি স্টিভেনেরও খুবই মন খারাপ হলো। তার নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছিলো। কিন্তু তার কিই-ই বা করার ছিলো? সেতো প্রথম থেকেই ফাবিয়ানকে আপন করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এমনকি ফাবিয়ানকে দত্তক নিতে চেয়েছে আইনগতভাবে। কিন্তু সারাই রাজি হলো না। তার বাবা, মায়ের কথা ভেবে। তারা একেবারেই চায়নি ফাবি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাক। কিন্তু তার বাবা তাকে বার বার করে এমনকি মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও বলে গেছে, জীবনকে এগিয়ে নিতে।
যাই হোক, সবাইকে কাঁদিয়ে এবং নিজেও কান্নার সাগরে ডুবতে ডুবতে সারা বিদায় নিলো।
নয়
ফাবিয়ানের জীবন-এর পট এরপরই দারুণ বদলে গ্যালো। মনে হলো মনের বয়সে সে যেন অকস্মাৎ বহু গুণ বেড়ে গ্যালো। নিজেকে ক্রমশই গুটিয়ে নিলো। একমাত্র ডোরিন আর নন্নার সাথেই সে ছিলো পূর্বের ফাবি। কিছুটা প্রগলভ, স্বচ্ছ। মা চলে যাবার পর সে একাই ঘুমাতে শুরু করলো। মা’কে ভুলবার সব রকম প্রয়াস সে খুউব যত্ন করে করতো। তবে তার সব প্রয়াশই ব্যর্থ হতো। কারণ, মা শেষ দিন পর্যন্তও ঘুমের আগে, ঘুম পাড়ানি গান গাইতো অথবা রূপকথার গল্প শুনাতো। ওসব শুনতে শুনতে কখন জানি ফাবি ঘুমিয়ে যেতো। এখন সেই সব গানের সুর রূপকথা তার কানে অবিরত রেকর্ডের মত বেজে চলে। সেই সুর ফাবিকে আচ্ছন্ন করে রাখতো! ফাবিয়ান একা বিছানায় ছটফট করতো। প্রায়শই সে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে অবশেষে ক্লান্ত শ্রান্ত ফাবিয়ান ঘুমিয়ে যেত। তবু তার এই বেদনার কথা কাউকে, কখনো বলেনি। ঐ সময় থেকেই ফাবি খুব চাপা স্বভাবের হয়ে গেল। আর তখন থেকেই ওর যেন নিজের একটা জগত হয়ে গ্যালো। সে জগৎটা সম্পূর্ণভাবে ওর নিজের। অন্য কারো ঠাঁই ছিলো না। এমনকি তার প্রিয় নন্নারও না। শুধু গান। গানই একমাত্র তার জীবনটাকে গ্রাস করে ফেললো। যেন ওর বেঁচে থাকার শেষ খড় কুটো। আর হৃদয়ের গভীরে তখন থেকেই তার চিঢ় ধরলো। আর কাউকেই সে আর গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে না। ক্যামন জানি হালকা মন-মানসিকতার হয়ে গ্যালো।
যদিও মা যাবার পর রোডি আন্টি আর কেভিন আঙ্কেল আরো দ্বিগুণভাবে ওকে কেয়ার করতো, এমনিতেই তাকে আগাগোড়াই নিজের সন্তানের মতই ভালোবাসতো। তবুও।
আমান্ডা বুক দিয়ে আগলে রাখতো ফাবিকে। টাকা-পয়সার যদিও কোন সমস্যাই ছিল না, তবুও সুইডেনে যাবার পর, সারা নিয়ম করে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতো। আমান্ডার নিষেধ সত্ত্বেও। প্রায় প্রতিদিন ২/৩ বার ফোন করতো। ফাবি ফোন ধরতে চাইতো না। কখন যেন তার ভেতরকার অভিমানের মেঘ তীব্র ক্ষোভের আকার ধারণ করেছে, সে নিজেও জানে না। জোর করে নানী ফোনটা ধরিয়ে দিলেও কথা বলতো না। সারা ওপাশ থেকে কথা বলেই যেত, অবশেষে কাঁদতো অঝোরে। তখন ফাবি ফোনটা ঠাস করে রেখে দিত।
ফাবির ক্যাবলই মনে হতো, ওর কেউ নাই। কিচ্ছু নাই। সমস্ত জগতে একমাত্র নানীই তার শেষ আশ্রয়!
এরপর দিনগুলি যেন খুউব দ্রুত এগিয়ে যায়। ফাবি দিনে দিনে একটির পর একটি নতুন ক্লাসে উঠতে থাকে। এর ভেতর সারারও ২টা বাচ্চা হয়েছে। তবু সারার ফাবির জন্য আকুতি এতটুকু কমেনি। প্রায় প্রতি ৫/৬ মাস পর পর সারা চলে আসে তার কলিজার টুকরাকে দেখতে। সারা এলেই ফাবিকে জোর করে তার বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমাতো। তবু সে মাকে এড়িয়ে চলতো। যদিও ডেভিড আর নাটালিকে খুব আদর করতো!
মা চলে গেলেই আবার ফাবি অন্যরকম। সে নিজের মত বাড়তে থাকে। ওর আরো অনেক বন্ধু হয়েছে। তার ভেতরে ওরা চারজন ডোরিনকে ধরে, প্রায় সারাক্ষণ এক সাথেই থাকে। ওরা চারজনেই ভ্যালেলংগার। ডোরিন যদিও এক ক্লাস নিচে, তাতে কিছুই আসে যায় না। একমাত্র রাতের ঘুম ছাড়া তারা এক সঙ্গেই থাকে। সারা যাবার পর আরো ৭ বছর দেখতে দেখতে চলে গেলো। এই সাত বছরে সারা বহুবার এসেছে।
ফাবিয়ান এখন গ্রেড-টেন-এ উঠলো। ফাবিয়ান এখন লম্বায় দরজার চৌকাঠ ছুঁয়েছে ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। এখন তাকে দেখলে ফ্রাঙ্কও চমকে যাবে। হুবহু বাবার মত। মাঝে মধ্যে আমান্ডাই চমকে যায়। গলার স্বর ভেঙ্গেছে। নাকের উপর গোঁফের হালকা রেখা। বাবার মত ব্লু আই, ব্লন্ড (সোনালী) চুল। শুধু হাসিটা সারার মত। হাসলে সবাই বলে মায়ের মত হাসি।
ডোরিনও অপরূপ সুন্দরী হয়েছে। ডোরিন ওর বাবা-মা মিলিয়ে হয়েছে। পাঁচ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা। বড় বড় নীল আর সবুজ মিশানো চোখ। ডার্টি ব্লন্ড চুল। পাতলা গোলাপী ঠোট। ঠোটে সব সময় একটা লাজুক হাসি ঝুলে থাকে।
ওদের আবাল্যের সখ্যতা কখন যেন অন্য রকম হয়েছে। আগের মত ডোরিনের পিঠে আর ঘুষি মারে না। ডোরিনও এখন রেগে গেলে ফাবিয়ানের চুল টানে না। ওদের এই পরিবর্তনে আমান্ডা খুব খুশি। তখন তার মনে হয় এই দুটিকে বিয়ে দিয়ে এখানেই রেখে দেবে তার চোখের সামনে। কোন দিন আর দূরে যেতে দেবে না।
এর ভেতরে সারা আবার বেড়াতে এলো তার একটি কন্যা আর একটি পুত্র নিয়ে। ছেলে ডেভিড ৭ বছর আর মেয়ে নাটালি ৬ বছর। ছেলেমেয়ে দুটোই সারা আর স্টিভেন মিলিয়ে হয়েছে। মেয়েটা বেশ সুন্দর। আর খুব মিশুক।
ওরাতো এসেই ফাবিয়ানকে জড়িয়ে ধরে ‘ভাইয়া’ ‘ভাইয়া’ করছে। ফাবিয়ানও অবশ্য ওদের খুব ভালোবাসে। শুধু মায়ের ব্যাপারেই যত গন্ডগোল। তার মায়ের সাথে তো পারতপক্ষে কথাই বলে না। মায়ের অসাক্ষাতে ভাইবোনের সাথে অনেক কথা বলে। তখন ফাবিয়ানের বাইরে থাকবার প্রয়াস বেড়ে যায়। তবে সারারও ডোরিনকে অনেক ভালো লাগে। ফাবিয়ানকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমান্ডাকে বললো-
: বুঝলে মা, আমি ডোরিনকে বৌ করে এই ঘরে আনবো।
: হ্যাঁ, আমিও তো তাই চাই।
: কি সুন্দর হয়েছে, বল? দুজনকে খুউব মানাবে।
: তা আর বলতে! যেন এক বৃন্তে দুটি ফুল।
রোডিকা আর কেভিনেরও ইচ্ছা সেরকমই।
মানুষের ইচ্ছাইতো সব নয়। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাই হলো শেষ ইচ্ছা। সারা, আমান্ডা সবাই তাই চাইলো। এমনকি ফাবিয়ান-ডোরিনও দুজন দুজনার প্রতি প্রচন্ড অনুরক্ত।
এবারে সারা বেশ কিছুকাল রইলো। সামারের ছুটি সারা বরাবর ফাবির কাছেই কাটায়। তারপর আবার চলে যাবার সময় হলো। যাবার আগে সারা ফাবিয়ানকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো। তারপর বললো-
: ফাবি বাবা, এখন তুমি সুইডেনে চলে আসতে পারো।
: সেটা সম্ভব নয়।
: কিন্তু আমি তোমার নানীর সাথে কথা বলেছি। তোমার নানী বলেছে গ্রেড টুয়েলভ এরপর তুমি সুইডেনে আসলে ভাল হবে। কারণ, ওখানে আমরা স্টকহোমেই থাকি। তোমার ভার্সিটিতে যেতে সুবিধা হবে।
: ঠিক আছে তখন দেখা যাবে।
: আর কিছু লাগলে বলিস, বুঝলি সোনা?
ফাবিয়ান কোন জবাব দিল না। তার ছোট দুই ভাইবোন ডেভিড আর নাটালিও তাকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করলো।
এবারে সারা চলে যাবার পর ফাবিয়ান কেমন যেন আরো বেপরোয়া হয়ে গেল। স্কুলে যায়। আর সারাক্ষণ বন্ধুদের সাথে মেতে থাকে। তারা তিনজনে একটা গানের গ্রুপ এর মত করেছে। ফাবিয়ান, জেসন, রায়ান এবং অবশ্যই ডোরিন। ডোরিন অবশ্য তেমন কিছু করে না। শুধু ওদেরকে সঙ্গ দেয়। ফাবিয়ান গান গায় এবং গিটার বাজায়। জেসন এবং রায়ান কঙ্গো এবং সেক্সোফোন বাজায়।
স্কুলে তাদেরকে সবাই চেনে। মোটামুটি ভ্যালেলংগার বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে তাদেরকে এখন নিমন্ত্রণও করে নিয়ে যায়। অবশ্য বিনে পয়সাতে। তবে ভালো করে পেট পুরে খেতে দেয়। ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশংসা করে। ওরা তাতেই খুশি। ঐ বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রশংসা বাক্যেই মূলত বিগলিত হয়।
এরপর গ্রেড টুয়েলভে তারা ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হলো। ফাবিয়ান গ্রেড টুয়েলভ মেজর করেছিল মিউজিকে। তার মিউজিক নিয়েই পড়বার ইচ্ছা বরাবর। যদিও আমান্ডা চেয়েছিল ফাবিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং সাইডে যাক। কিন্তু সে কখনো ফাবিয়ানের ইচ্ছার উপর কোন কথা বলে না। তার বন্ধুরা জেসন এবং রায়ান দুজনেই বিজনেস লাইনেই পড়তে চাইলো।
আর এবারে তাদের ভ্যালেলংগার ছাড়তে হলো। কারণ, ওটা ছোট্ট শহরতলী। প্রথমে ওরা ঠিক করেছিল কাটিনজারো’তে যাবে। কিন্তু সেখানকার ভার্সিটির মানও ততো ভালো না। এরপর তারা তিনজনেই কালাব্রীয়াতেই যাওয়া মনস্থ করলো। কালাব্রীয়া প্রভিন্সের মধ্যেই কাটিনজারো একটি রিজন। আর কাটিনজারোর মধ্যেই তাদের ভ্যালেলংগা উপশহর। প্রায় গ্রামই বলা চলে। তো কালাব্রীয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজনেই চান্স পেয়ে গেল। আমান্ডা অত দূরে যেতে দিতে চায়নি। কিন্তু তার কোন আপত্তিই ধোপে টিকলো না।
তখনতো ওদের তিনজনেরই মনের পাখা উড়তে শুরু করেছে। অগত্যা, যাবার বেলা এগিয়ে এলো। বাঁধাছাদা শেষ। এবারে কান্নার পালা। আমান্ডাতো গত দু’সপ্তাহ ধরে অবিরত কেঁদে চলেছে। ডোরিনের ও মন খুবই মৃয়মান। রওনা হবার মুহূর্তে অবশ্য ফাবিয়ানও কেঁদে ফেললো নানীকে জড়িয়ে ধরে। নানীকে ছেড়ে জীবনে কোথাও সে যায়নি। এই প্রথম, তাই সেও খুবই আবেগাক্রান্ত-
: নন্না, খুব জলদিই আমি আসবো। প্রতি মাসেই আমি আসবো। তুমি কোন চিন্তা করো না।
: হ্যাঁ, সোনা- বেশি দেরি করো না।
দশ
সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তিনজন ছটফটে যুবক কালাব্রীয়াতে এলো। প্রথমে জেসনের মামার বাড়িতে দু রাত ছিলো। তারপর তারা একেবারে ভার্সিটির ডর্মিটরিতে চলে এলো। আগেই ঠিক করা ছিল। এক এক রুমে দুইজন। ওখানে রায়ানের সঙ্গে ফাবিয়ানের পড়লো একটি রুমে। আর জেসনের পড়লো রবার্ট মিলার নামে একটি ছেলের সাথে। দারুন একটা টগবগে ছেলে। সারাক্ষণ নিত্য নতুন আইডিয়া তার মাথায় খেলা করছে। ওদের সাথে এমনভাবে মিশে গেল যেন কতকালের পরিচয়। আর মজার ব্যাপার রবার্টও মিউজিকে পড়তে এসেছে। ওর বাবা সুইজারল্যান্ডের। তবে দীর্ঘদিন আগে ইটালিতে এসেছিল ব্যবসার জন্য। ভালো লেগে যাওয়াতে থেকে গিয়েছিল ইটালিরই একটা মেয়েকে বিবাহ করে।
এরপর চারটে বছর কিভাবে কেটে গেল ফাবিয়ান নিজেই জানে না। মাঝে মাঝেই বুকের মধ্যে কেমন করলেই নানীর কাছে ছুটে যেত। ডোরিনও অভিমানে ঠোট ফুলাতো। কিন্তু তখন ফাবিয়ানের ডানায় পাখির বাতাস ভর করেছে। তার তখন উড়তে ভালো লাগে। নিত্য নতুন আইডিয়া। আর তাদের গানের পরিধিও তখন বিস্তার লাভ করেছে। কালাব্রীয়াতেও তখন তারা চারজন সমান জনপ্রিয়। রবার্ট মিলারও ওদের গানের গ্রুপে জয়েন করেছে। ওদের গানের গ্রুপ দিনে দিনে আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে রবার্টের ঝোঁক সুর সৃষ্টিতে আর ফাবিয়ানের ঝোক ভোকালে। এভাবেই চলছিল যদি না রবার্টের মাথায় হঠাৎ করে কানাডাতে আসবার ঝোক চাপতো। রবার্টের মাথায় সারাক্ষনই বিভিন্ন আইডিয়া ঘুরতে থাকে। তাছাড়া ওর পিছুটানও কম। কেমন যেন কোকিলের মত। এক জায়গায় ডিম পাড়ে কিন্তু অন্য জায়গাতে রাত কাটায়। কোন নারীও ওকে আকর্ষণ করে না। ওর নজর ছেলেদের উপর। অলরেডি স্কুলের তিন-চারটে ছেলের ও প্রেমে পড়েছে।
আসলে ফাবিয়ানরা অনেক পরে বুঝেছে যে, রবার্ট একজন সমকামী। রবার্টের একজন সমকামী বন্ধু আছে কানাডিয়ান, যার সাথে ওর ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচয়। প্রায়ই তাদের ফোনালাপও হয়। ওর নাম গেরী রেফোর্ড। ও একজন কানাডিয়ান হেয়ার স্টাইলিস্ট। রবার্ট এখন গেরীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। গেরীই তাদেরকে উৎসাহিত করছে, কানাডাতে যাবার ব্যাপারে। আর রবার্ট মোটামুটি তা-ধিন, তা-ধিন নাচ্ছে। আর ওদের কান মোটামুটি পচিয়ে দিচ্ছে, কানাডা-কানাডা যাবো বলে। তারই অত্যুৎসাহে ওরা চারজন কানাডাতে যাবার জন্য আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। আর ইমিগ্রেশনের সমস্ত হ্যাপা রবার্ট একাই ধরতে গেলে সামলাচ্ছে। শুধু আবেদন করবার জন্য যা যা দরকার ওরা সব দিয়েছে। তবে এসব প্রসেসিং হতে হতে ২/৩ বছরতো লাগবেই। ইতিমধ্যেই ওদের সবার গ্রাজুয়েশন হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে ওরা ৩ জন বিভিন্ন জায়গাতে চাকরিতে ঢুকে পড়েছিল। শুধু ফাবিয়ান মিউজিকের উপর M.S.C করবার জন্য আবার ভর্তি হলো। সারা তাকে এই ব্যাপারে দারুণভাবে উৎসাহিত করছিল।
নতুন ক্লাস শুরু হবার আগে তারা চারজন একটু নিজের দেশ দেখবে বলে বের হলো। নন্না তার গোপন ভান্ডার উজাড় করে দিল। আবার যাবার আগে বললো, ‘যা ঘুরে আয়, ঘুরলে অভিজ্ঞতা বাড়ে।’
প্রথমেই রোমে গেল। খুবই মোহিত হলো ওরা রাজধানী দেখে। যদিও রাস্তাগুলো বেশির ভাগই বেশ ছোট ছোট। এমনকি গাড়িও যথেষ্ট ছোট ছোট। তবুও মনোরম সমুদ্র সৈকত ওদের মোহিত করলো।
আলপাইন লেক, আলপ্স পর্বতমালা ওদের বিস্মিত করলো। ওরা ছোট শহরের ছেলে।
রোমের সাথেই ভ্যাটিকান সিটি। নানীর বিশেষ অনুরোধে এখানে যেতে হলো। একই ইটালির মধ্যে হলেও এই সিটির নিয়মকানুন সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি ট্যুরিস্টদের আলাদা করে ভিসা করা লাগে ভ্যাটিকানে যেতে। এবং মজার ব্যাপার এখানে সুইস পুলিশ পাহারা দেয়। ছবি তুলতে দেয় না।
বিশাল টিভির স্ক্রীনে অনবরত পোপের কার্যক্রম দেখানো হয়। ফাবিয়ান ভেবে ফেললো এরপর নন্নাকে নিয়ে একবার ভ্যাটিকান সিটিতে আসবে।
এরপর ওরা নেপলস, পোমপেই, ফ্লোরেন্স, পিসা, প্রাটো এবং ভেনিস ঘুরলো।
নেপলস বন্দর নগরী। ইটালির সব ধনীরা এখানে বসত করে। এটা ফাবিকে আকর্ষণ করেনি। তাকে ভেনিস এবং পোমপেই খুবই আকর্ষণ করলো। এই সিটিটা নেপলস থেকে বেশ দূরে। তবে এখানে যেয়ে ফাবির খুবই কষ্ট লাগলো। পুরো শহরটাই যেন মিউজিয়াম। পুরো শহরটা ভলকানোতে ধংস হয়ে গেছে। যেদিন ভলকানো হয়েছিল, মানুষরা জান বাঁচাতে উপুড় হয়ে পড়েছিল। ভলকানো তাদের উপর দিয়েই চলে গিয়েছিল, মানুষগুলো ওভাবেই সব পাথর হয়ে গেল।
তবে এই শহরের মাউন্টেনগুলো দেখার মত। আর মার্বেলের কিছু স্কাল্পচার আছে যা সত্যি দৃষ্টি নন্দন। এই সব শহর ঘুরতে ঘুরতে তার মনে হলো, সে সত্যিই কুয়োর ব্যাঙ!
আবারো নতুন করে ক্লাসে যোগ দিল। মনটা বেশ ফুরফুরে। ঘোরাঘুরি করে আসলেই খুউব ভালো মুডে ছিল। নন্নাকে প্রতি শহরে যেয়ে সব ডিটেলসে বর্ণনা দিয়েছে। সময় অতিক্রান্ত হয় মন্থর চালে। কখনো দ্রুত। এর মধ্যে একদিন কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন থেকে ওদের ইন্টারভিউর ডাক এলো। চারজন এক সাথেই গেল। ওদের সবার ইন্টারভিউ খুবই ভালো হলো। একমাত্র জেসন মুখ হাড়ি করে বের হলো। জেসন বললো, ওর ইন্টারভিউ খুব খারাপ হয়েছে। তবে ওরা সবাই একই সাথে সিওর হলো জেসন ইচ্ছা করেই খারাপ করেছে। কারণ, জেসনের আসলে কানাডায় যাবার একটুও ইচ্ছা নাই। শুধুমাত্র ওদের তিনজনের মন রক্ষার্থে জেসন আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল। সে আসলে ওর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। জেসনের বাবা ভ্যালেলংগার অত্যন্ত ধনী একজন মানুষ। ল্যান্ডলর্ড ধরনের। প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিক। জেসন মূলত বাবা-মায়ের অসম্ভব আদরের সন্তান।
ফাবিয়ান নিজেও নানীকে এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত কিছুই বলেনি। ইন্টারভিউতে উত্তীর্ণ হবার পরই, এই প্রথম ওর ব্যাপারটা সিরিয়াস মনে হলো। এখন তো নানীকে, মাকে বলতেই হবে। টাকা-পয়সার বিশাল ধাক্কা। এত টাকা কোথায় পাবে? প্রায় ১০,০০০ ইউএস ডলারের মত লাগবে। ওর পকেট ফাকা। এমনিতেই আবেদন করার টাকাই নানীর কাছ থেকে চলাকি করে নিয়েছিলো। পাসপোর্টও বানাতে বেশ কিছু লেগেছে।
অবশেষে মেডিকেলেও সুন্দরভাবে হয়ে গেল। এক সময় ওদের কানাডাতে যাবার কনফার্ম লেটারও চলে এলো।
এবার ওরা তিনজন বাক্স, পেটরা বাঁধলো ভ্যালেলংগাতে যাবার জন্য। যদিও জেসন যাবে না। তবু ওদের সাথে সময় কাটাবার জন্য চললো। রবার্টতো কালাব্রীয়াতেই রয়ে গেল। রবার্টের বাবাতো কালাব্রীয়াতেই থাকে। তারও কোন অমত ছিল না। রবার্ট নিজেই টিকিট বুকিং দিয়ে দিল। ওদের খুব আনন্দের সাথে বললো : তোরা বাড়ি যা। টাকা ম্যানেজ কর। তিন মাস আগে বুকিং দিলাম। বেশ সস্তায় টিকিটের দাম পড়ছে। এদিকটা আমি দেখছি। তবে পকেটে বেশি করে ডলার নেওয়া ভালো। কাপড়ও বেশ কিছু নেওয়া লাগবে।
জ্যাকেট, নতুন জুতা, বুট, অনেক কিছু লাগবে। সেই সব বুঝে টাকা-পয়সা ম্যানেজ করিস।
আর ওরা তিনজন আবার ফিরে চললো ভ্যালেলংগাতে। জেসন বেশ একটু মনমরা হয়ে রয়েছে। যদিও জেসন তার লেবেলে একটা চাকরিও পেয়েছে। তবে ওর বাবার ইচ্ছা না, ছেলে চাকরি করে। সে ভ্যালেলংগাতে থেকেই তাদের পারিবারিক বিজনেস এবং জমিজমা দেখাশুনা করুক। যার জন্য তাকে ওরা বিবিএতে পড়িয়েছে।
রায়ানও অবশ্য বিজনেস ম্যানেজমেন্টে পড়েছে। ও আবার পরিসংখ্যানে ডাবল মেজর করেছে। রায়ান খুব ভালো ছাত্র।
ফাবিয়ানতো মিউজিকের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে। এখন তার অনেক অনেক এ্যামবিশন। বড় কিছু করার। নিজের সিডি বের করবার। আর তার স্বপ্ন হলো কোন মুভিতে মিউজিক পরিচালনা করা এবং গান গাওয়া। সব স্বপ্নের পরও ফাবিয়ান খুবই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে নানীর কথা ভেবে। নানী কিভাবে যে ব্যাপারটা নেবে? নানী ওকে ছেড়ে কখনো থাকেনি। তবু ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই ক’টা বছর মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু, এখন? হাতে মাত্র ৩ মাসের মত সময়। (চলবে)

লেখক রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।