এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা
জসিম মল্লিক
আমার দুটো খারাপ স্বভাব আছে সেটা হচ্ছে ইনডিসিশন এবং অস্থিরতা। অস্থিরতা নিয়ে একটু বলি। আমার যদি কখনো অর্ক, অরিত্রি বা জেসমিনের সাথে কথা বলার দরকার হয় সেটা আমি সাথে সাথে বলতে চাই। দেরি আমার সহ্য হয় না। রাত দিন মাথায় থাকে না। ওদের ব্যস্ততাও গ্রাহ্য করি না। ওরা আমার স্বভাব জানে তাই দ্রুতই রেসপন্স করে। একান্ত না পারলে মাসেজ দেয়, কল ইউ লেটার। তখন হয়ত অফিসের জরুরী মিটিং এ আছে। কখনো রাগ করে না বা কোনো অভিযোগ করে না। গত বছরের কথা, তখন আমি ঢাকায়। জেসমিনকে ফোনে পাচ্ছি না। পাচ্ছিনা তো পাচ্ছিনা। ফোনে না, হোয়াটসএপে না, ম্যাসেঞ্জারে না। জেসমিনকে আমার এখনই দরকার। একটা কথা মনে পড়ছে। এখনই বলতে হবে। না বললে ভুলে যাব। ফোন দিলাম অরিত্রিকে। অরিত্রিও ফোন ধরছে না। তারপর দিলাম অর্ককে। অর্ক ফোন ধরল। বললাম, তোমার আম্মুকে পাচ্ছিনা। তখন ওদের রাত বারোটা। অর্ক শুয়ে পড়েছে। অর্কর স্বভাব হচ্ছে ঘুমানোর আগে বই পড়া। সম্ভবত পড়ছিল। পরদিন শনিবার। ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নাই।
কিছুক্ষণ পরই জেসমিনের ফোন। ঝাঁঝের সাথে বলল, একেবারে পাগল হয়ে যাও। মানুষ ওয়াশরুমেও যেতে পারবে না! এগারোবার ফোন দিছ। মাথা খারাপ লোক।
পরে যেটা জানলাম, অর্ক তার মাকে ফোন করে বলেছে, তুমি বাবার স্বভাব জানো না! এখনই ফোন করো।
এই যেমন কাল রাত সাড়ে বারোটায় অরিত্রিকে ফোন দিয়েছি।
অরিত্রি ঘুম ঘুম চোখে বলল, ‘হ্যালো।’
আমি বললাম ‘সরি আম্মু।’
অরিত্রি বলল, ‘বলো কি জন্য ফোন করছ।’
আমি বললাম, ‘চেক ইন করে দাও। টাইম হইছে প্রায়। অল সেগমেন্ট আইল সীট করবা।’
অরিত্রি বলল, ‘বাবা তোমার আইটেনারি দেখেছি। চেক ইনের সময় আমার রাত দুইটা চল্লিশে।’
আমি বললাম ‘ওহ্ থাক তাহলে, তুমি ঘুমাও। আমি চেষ্টা করি।’
একটু পরেই দেখি অরিত্রি হোয়াটসএপে ডিরেকশন পাঠিয়েছে কিভাবে চেক ইন করব। ভেরি ইজি ছিল।
তারপর অর্ককে ফোন দিলাম। সবুর সইছিল না।
‘আব্বু ই সীম কিভাবে নেবো। এ্যাপসের লিঙ্কটা পাঠাও।’
অর্ক এয়ারএলো’র লিঙ্ক পাঠাল। আমি বললাম ‘কিভাবে করতে হয় বুঝব না।’
অর্ক বলল, ‘বাবা সকালে ফোন দিও আমি বলে দিব।’
‘সকালে তোমার অফিস থাকবে না!’
‘সমস্যা নাই। তুমি দশটার দিকে ফোন দিও।’
ঠিক দশটায় ফোন দিয়েছি। প্রবলেম সলভ।
এই অস্থিরতা যে শুধু পরিবারের সাথে তা না, আমার ক্লোজ বন্ধুদের সাথেও এমন করি। ওরাও আমার স্বভাব জানে। তবে অল্প পরিচিতদের জ্বালাই না।
এবার ইনডিসিশনের কথা বলি। এটা আমার সারা জীবনের সমস্যা। প্রতিটা কাজে আমি সীদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। রেষ্টুরেন্টে খেতে গেছি কি খাব জানিনা। অনেক ভেবেও খাওয়ার মেন্যু ঠিক করতে পারি না। এমনও হয়েছে খাবার অর্ডার দিয়ে না খেয়ে বিল পরিশোধ করে চলে এসেছি। কারণ মেন্যু পছন্দ হয়নি। প্রায় সময়ই রেষ্টুরেন্টে ঢুকে আবার বের হয়ে আসি। কোথাও যাব বলে রাস্তায় বের হয়ে আবার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলি। নাহ্ যাব না। এমনও হয়েছে কোনো বাড়ির সামনে পর্যন্ত যেয়েও ফিরে এসেছি। টিকিট কেটেও যাইনি এমন ঘটনাও আছে। একবার তো ইউরোপে যাওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন, টাকাও এডভাঞ্চ করা হয়েছে। প্যাকেজ ট্যুর। কিন্তু আগের দিন মনে হলো নাহ্ যাব না। সেবার টাকাও ফেরত পাইনি। এই যেমন ঠিক করেছি এবার জাপান যাব। টিকিট অনেক আগেই করা। ঢাকা থেকে যাব। ফিরবোও ঢাকা। কিন্তু কদিন থেকেই দোনো মনা করছিলাম। যাব কি যাব না। কেনো যাবনা তার কোনো কারণ নাই। অর্ককে ঘটনা বললাম। অর্ক সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে। ওদের আঠারো বছর পর্যন্ত আমি পরামর্শ দিয়েছি। এখন আমি ওদের পরামর্শ নেই। যদিও অর্ক অরিত্রি খুব বেশি দ্বিমত করে না আমার কোনো কিছুতে। ভুল করি আর সঠিক সব ঠিক। তবে এবার অর্ক বলল, বাবা টিকিট যখন করেছো যাও। ঘুরে আসো। ভাল লাগবে। গতবছর অর্কর পরামর্শেই ভিসা করেও ভিয়েতেনাম যাইনি। অর্ক বলল, একলা এনজয় করবা না। তুমিতো খুঁতখুঁতে, খাবার সমস্যা হবে তোমার। তাই এবার সাহস পেলাম। সবচয়ে বড় কথা টোকিওতে বন্ধু মোতালেব আছে। মূলতঃ ওর আমন্ত্রণেই যাচ্ছি।

এবার আসল কথাটা বলি। আমি যথেষ্ট বিদেশ ঘুরেছি। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পরতে চাই। ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে একটা বোহেমিয়ান স্বভাব আছে। এক জায়গায় স্থির থাকতে পারি না। অস্থির স্বভাবের জন্যই এটা হয়েছে। বেশিদিন এক জায়গায় থাকলে পাগল পাগল লাগে। তাই কোনো কিছুই আমি মন দিয়ে করতে পারিনি। লেগে থাকা বলতে যা বোঝায় তা আমার মধ্যে নাই। তবে আমি আমার পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধুত্বের প্রতি নিবেদিত থেকেছি। ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী হতে পরিনি এ কারণে। লেখালেখিতেও না। তবে যতই ইনডিসিশনে ভুগি, যতই ভুল করি আমি জীবনে অনেক সঠিক সিদ্ধান্তও নিয়েছি। ইনডিসিশনে যখন ভুগি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলি, আমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও বা মায়ের কথা স্মরণ করি।
অনেকেই ভ্রমণ কাহিনী লিখে। আমাকেও অনেকেই জিজ্ঞেস করে আপনি ভ্রমণ কাহিনী লিখেন না! সত্যি কথা বলতে আমি কখনো ভ্রমণ কাহিনী বলতে যা বোঝায় তা লিখিনি। অথচ বিদেশের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছে ভ্রমণ কাহিনী পড়েই। আমার কেনো যেনো মনে হয় লেখার চিন্তা মাথায় থাকলে বিদেশ দেখার আনন্দ মাটি হবে। কিন্তু এবার ঠিক করেছি ভ্রমণ কথা লিখব। জাপান পৃথিবীর সেরা দেশ। আমার ছেলে মেয়ে দুজনেরই প্রিয় দেশ। তাই ওদের সাথেও শেয়ার করতে পারব। তিনজনের চোখ দিয়ে জাপান দেখা হবে। আবার এটাও ঠিক ইনডিসিশনের জন্য লেখা নাও হতে পারে।
তবে যতযাই হোক যখনই প্লেনে উঠি মায়ের কথা মনে পড়বেই। যেমন মনে পড়ে অসুস্থ্য হলে। মা ছাড়া উৎকন্ঠিত হওয়ার কেউ নাই। একসময় মাকে দেখার জন্য প্রতি বছর ছুটে এসেছি দেশে। এখনও আসি। কিন্তু মা নাই। তাই এখন প্লেনে উঠলে সেই তীব্র অনুভূতিটা আর জাগে না। কখন প্লেনটা হুস করে ঢাকার মাটিতে ল্যান্ড করবে। কখন ঢাকা থেকে স্টীমারে চড়ে বরিশালের পথে রওয়ানা হবো। কখন ফজরের নামাজের পর আধো অন্ধকারে রিক্সাটা বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে। একসময় সে সব ছিল বড়ই আনন্দের। এখন আর সেই আনন্দ নেই জীবনে। এখনও বরিশাল যাই কিন্তু থাকি হোটেলের নির্জন কক্ষে। এখন আর সেই স্টীমার সার্ভিসও নাই, মাও নাই, দরজার গ্রীল ধরে কারো অপেক্ষাও নাই। মনে আছে একদিন মা বলেছিলেন তুমি একটা পাখী। এই দেখি, আবার দেখি নাই। এই বলে মা চোখের জল ফেলেন। এখন বরিশাল গিয়ে মায়ের কবরের পাশে বসে থাকি। কিন্তু মাতো আর ফিরবে না, বলবে না, ওদেশে কেনো যাও, নিজের দেশে ছেড়ে কেউ যায়!
কথাহীনতার ঘেরাটোপ
অনেক ছোট ছোট ব্যাপারেও আমার রাগ হয়। আবার অনেক বড় কোনো ঘটনায় আমি রাগ করি না। নির্বিকার থাকি। আমার সাথে কেউ অনিয়ম বা চালাকি করলে আমার রাগ হয়। যখন দেখি আমাকে ঠকানো হচ্ছে তখন আমার রাগ হয়। যখন দেখি আমার সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে তখন রাগ হয়। যখন দেখি আমাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে তখন রাগ হয়। কখন যে রাগ ওঠে নিজেও জানিনা। হুট করে চলে আসে রাগ। নিজের প্রতি কোনো কন্ট্রোল থাকে না তখন। তবে ভাল দিক হচ্ছে আমি রাগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না। হুট করে যেমন রাগ আসে তেমনি ধুপ করে চলে যায়। রাগ চলে যাওয়ার কারণে নিজের উপর রাগ হয় আমার। কেনো রাগ চলে যাবে! কেনো রাগ ধরে রাখতে পারি না! এটা বেশি হয় জেসমিনের সাথে রাগ করার পর। অন্যদের সাথে রাগ করার পর খুব লজ্জিত হই। নিজেকে বলি এমনটা করা ঠিক হয়নি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমি বহুবার সরি বলেছি। ছেলে মেয়েদেরকেও সরি বলি। সরি বলতে আমি মোটেও সরি ফিল করি না।
তবে আমার রাগের চেয়ে অভিমানই বেশি। এই রকম বয়সে শিশুসুলভ অভিমান থাকা ঠিক না। নানা কারণে আমার অভিমান হয়। অনেক হাস্যকর কারণেও হয়। কারো কাছ থেকে কিছু একটা আশা করছি, কিন্তু প্রত্যাশামতো ঘটছে না, তখন অভিমান হয়। প্রত্যাশা বলতে বিরাট কোনো চাওয়া না। সামান্য চাওয়া। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাওয়া। হয়ত আমি কারো সাথে দেখা করতে চাই। কিছু একটা শেয়ার করতে চাই। কিন্তু আমার চাওয়ার মতো ঘটছে না। সেটা নাই ঘটতে পারে। যার সাথে দেখা করতে চাই সে হয়ত ব্যস্ত। তখন আমার অভিমান মতো হয়। কেনো সে ব্যস্ত থাকবে! হয়ত কাউকে আমি পাশে চাই কিন্তু পাচ্ছি না, তখন হয়। কারো সামান্য একটা বাক্যেও অভিমান হয়। অনেক মানুষ আছে সহজেই বাস্তবতা মেনে নেয়, অভিমানের কেনো বালাই নাই। অভিমান কি জিনিস তাই হয়ত জানে না। মুখের উপর না বলে দিতে পারে। আমার সমস্যা হচ্ছে আমি কোনো কিছুতেই না বলতে পারি না। না বলা শিখত হবে। যে যা বলে তাই গুরুত্বের সাথে নেই। সেইমতো পরিকল্পনা সাজাই। অন্যের কথায় খুব প্রভাবিত হই। নিজের সিদ্ধান্ত বদলে যায়।
গত কয়েক বছর থেকে ঢাকা আসলে একলা থাকি। একলা থাকার আনন্দ যেমন আছে কষ্টও আছে। এবার নানা কারণে সেই কষ্টটা বেশি। শৈশবকাল থেকেই আমি নিঃসঙ্গ। একলা বাঁচায় অভ্যস্ত আমি। দলছুট এক বালক উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলত। একটু ভুতুরে টাইপ। এই যে চারিদিকে এতো মানুষ তা সত্ত্বেও আমার একাকীত্ব কিছুতেই ঘোচে না। অনেক কথার ভীড়েও আমি আনমনা হয়ে যাই। অনেকের মধ্যে থেকেও আমি হারিয়ে যাই। সবাই কথা বলছে আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। কোথায় যেনো মন চলে গেছে। ওয়ান টু ওয়ান কথা বলার সময়ও আমার এমন হয়। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম ঠিকই কিন্তু সে কি বলেছে শুনিনি। কথা বলার ভয়ে আমি কারো সাথে একলা হতে দ্বিধাগ্রস্থ থাকি। আপনজনের সাথেও। অনেক লম্বা কনভারসেশন হলে খেই হারিয়ে ফেলি। অথচ কথাই সব। কথা ছাড়া মনের ভাব বোঝানো যায়না। ফোনালাপেও আমার এমন হয়। হঠাৎ কেউ ফোন করলে দু’একটা কথার পরই কথার ভান্ডার ফুরিয়ে যায়। আমি কী কথা বলব! অনেক দরকারি কথাও বলা হয় না আমার। মনের কথা মনেই থাকে। কথাহীনতার ঘেরাটোপে বন্দী এই জীবন।
পৃথিবীর মানুষের ভিড়
পৃথিবীতে কার্যকারণ ছাড়া নাকি কিছুই ঘটে না। কথাটা আমিও বিশ্বাস করি। আজকে এই যে আমার দেশ থেকে বেড়িয়ে পরা, এর পেছনে কি কোনো কারণ ছিল না? অন্যরা যেভাবে সরলীকরণ করে বলে থাকে, ‘দেশের যা অবস্থা, তাতে না পালিয়ে উপায় আছে?’ আমি ঠিক এভাবে বলতে চাই না বা দেশের অবস্থা খুবই খারাপ, বসবাসের অনুপযোগী, এজন্যও আমি দেশ ছাড়িনি। আমার দেশ ছাড়ার উদ্দেশ্যটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি মানুষটা ভেতরে ভেতরে খুবই বোহেমিয়ান, কিছুটা পলায়নপরও। কোনো কিছুই আমাকে তেমনভাবে বেঁধে রাখতে পারে না। এই যে আমি এতাটা বছর ধরে আমার মনটা সবসময়ই পালাই পালাই করছে। আমার স্ত্রী সেদিন রসিকতা করে বলছিল, একদিন হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখবো তুমি কাগজে স্লিপে লিখে চলে গেছ। তাতে লেখা ‘আমি চললাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। তুমি সব ঠিকঠাক রেখো।’ এ রকম হয়তো কখনো ঘটবে না, তবুও আমার স্ত্রীর এরকম আশঙ্কা আছে আমাকে নিয়ে। এই আশঙ্কা তেমন অমূলকও নয়। আমি হুট-হাট এ রকম অনেক কিছুই ছাড়তে পারি। ছেড়েছিও। অনেকে আবার সন্তানের লেখাপড়ার দোহাই দেয়। সন্তানের উন্নত ভবিষ্যৎ বা উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য দেশ ছাড়তে হলো, এরকম বলে অনেকেই। আমি এ পথেও যাচ্ছি না। আমি দেশ ছেড়েছি আমার নিজের জন্যই। প্রবাসী হওয়ার চিন্তাটা আমার মাথায় প্রথম আসে ২০০০ সালে। আমি নিউইয়র্কে এসেছি বেড়াতে। যেহেতু এটা ছিল আমার প্রথম আমেরিকা আসা, তাই আমার ভেতরের উত্তেজনাটাই ছিল অন্যরকম। সেবার নানা জায়গায় বেড়ানো আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে এতটাই বুঁদ হয়েছিলাম যে, মনে হয়েছিল বিদেশ মানেই স্বর্গ। আমেরিকায় দেড়-দুই মাস বেড়িয়ে দেশে ফিরে গিয়ে প্রবাসী হওয়ার কথাটা অনেকটাই আবার ভুলে যাই।
তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রার একটি জনপ্রিয় বিভাগ ছিল ‘প্রবাস থেকে’। প্রবাস থেকে বিভাগে বিশেষ করে যারা আমেরিকা থেকে লিখতেন তাদের লেখা আমি খুব মন দিয়ে পড়তাম। এরও আগে যখন আমি স্কুলে পড়ি, তখন শঙ্করের ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ বইটি পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। বইটি আমেরিকার ওপর ভ্রমণকাহিনী ছিল। বইটি পড়ে আমি এতটাই মুগ্ধ হই যে, তখনই ভেবে রেখেছিলাম একদিন ওই দেশটিতে আমিও যাবো। এরপর আমেরিকার ওপর অনেক বই পড়েছি। কিন্তু সে দেশে যাওয়ার যে ব্যাপারটি সেটাই হয়ে উঠছিল না বা সেভাবে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করিনি। কয়েকবার ‘ওপি ওয়ান’ ও ‘ডিভির’ জন্য আবেদনও করেছি কিন্তু ভাগ্যের শিঁকে ছেঁড়েনি। যদিও এখন আমি কানাডার নাগরিক কিন্তু আমেরিকা দেশটাকেও কম ভালোবাসি না।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমার প্রিয় সম্পাদক, যার সঙ্গে আমি ১৯৮৩ সাল থেকে কাজ করছি, সেই শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ২০০০ প্রকাশিত হলো ১৯৯৮ সালে। সাপ্তাহিক ২০০০-এরও জনপ্রিয় বিভাগ হচ্ছে ‘প্রবাস জীবন’। ২০০৩ এর জুনে কানাডা আসার দিন পর্যন্ত এই বিভাগটি আমি দেখেছি। সেই সুবাদে প্রবাসীদের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে। তাদের অগোচরেই আমি প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার অংশীদার হয়ে যাই। আমি যখন ২০০০ সালে নিউইয়র্কে আসি, তখন আমার অনেক বন্ধুর সঙ্গেই দেখা হয়। এর মধ্যে অনেকেই ছিল ‘প্রবাস জীবন’ বিভাগের লেখক। সেই সময়ই জ্যাকসন হাইটসের একটি রেস্টুরেন্টে ‘ঠিকানা’ পত্রিকার প্রেসিডেন্ট সাঈদুর রব ভাইয়ের সঙ্গ পরিচয় হয়। তখন কি আর ভেবেছি যে, এই আমিও একদিন প্রবাসী হবো এবং ‘ঠিকানায়’ লিখবো? আর ‘ঠিকানা’ পত্রিকার সঙ্গে যিনি সংযোগ ঘটিয়েছিলেন তিনি আমার অতি প্রিয় বন্ধু ও সহকর্মী আকবর হায়দার কিরণ। যিনি সাপ্তাহিক ২০০০-এর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি। তবে আমি ‘ঠিকানা’ পত্রিকার ঢাকা ব্যুরো অফিসে নিয়মিতই যেতাম, সেখান থেকেই ‘ঠিকানা’ সংগ্রহ করে পড়তাম। সেবার নিউইয়র্কে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছিল আবার পুরনো অনেক সহকর্মীরও দেখা পেয়েছিলাম। এই সহকর্মীদের অনেকেই অনেক বছর ধরে আর দেশে যাননি।
আমেরিকা থেকে ফেরার পথে লন্ডনে থেকেছিলাম সপ্তাহখানেক। আমি তখন মুন্নু শিল্পগোষ্ঠীর জনসংযোগ কর্মকর্তারও দায়িত্বে ছিলাম। একই সঙ্গে মুন্নু শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হারুণার রশীদ খান মুন্নুর একান্ত সহকারি ছিলাম আমি। তিনি বিএনপি’র সাবেক মন্ত্রী এবং এমপি। তিনি যখন ১৯৯০ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তখন থেকেই আমি তার সঙ্গে কাজ করে আসছিলাম। পর পর চারটি নির্বাচনে আমি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছি। তাই বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র এবং তাদের রাজনীতিবিদদের আমি খুব ভেতর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা আমার খুবই অম্ল মধুর। এগারো বছরের চাকরি জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আমি এই গ্রন্থে লিখতে চাই না। যাই হোক। লন্ডনে মুন্নু শিল্পগোষ্ঠীর একটি অফিস রয়েছে। সেখানেরই এক কর্মকর্তা লতিফ সাহেব আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে ‘ব্রেড এন্ড ব্রেকফাষ্ট’ টাইপ একটা হোটেলে পৌঁছে দেন। আমি একদিন মাত্র থেকে নিঃসঙ্গ হোটেল ছেড়ে শামীম আজাদের ইলফোর্ডের বাসায় চলে যাই। আজাদ ভাই লম্বা গাড়ি ড্রাইভ করে সেদিন রাতে আমাকে তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, আমাকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করার সুযোগ শামীম আপাই প্রথম করে দিয়েছিলেন। আমার প্রতি তার পক্ষপাতিত্বের কথা আমি চিরদিন মনে রাখবো। সেবার শামীম আপা আমাকে লন্ডন ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। শামীম আপাও আমার অজান্তে আমার মনের গোপন কোঠায় প্রবাসী হওয়ার বীজ ঢুকিয়ে দিয়ে থাকবেন।
দেশ থেকে চলে আসার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেলেও কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি একাকী কখনো বিদেশে থাকার চিন্তা করিনি বা স্ট্যাটাস ছাড়াও বিদেশ থেকে যাওয়ার চিন্তা বাদ। এদিকে চাকরি নিয়ে এমনি নাজেহাল অবস্থা যে, কোনো কিছু ভালোভাবে ভাবারই সুযোগ পাচ্ছিলাম না। একদিন আমার এক আত্মীয় বাশার ভাই আমাকে বললেন কানাডার ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করতে। ব্যাপারটা আমার মনঃপুত হলো। আমি খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম। দেখলাম বেশ লম্বা প্রক্রিয়া এবং বেশ জটিল। তারপর শুনলাম ঢাকায় কিছু কনসালটেন্সি ফার্ম নাকি এসব প্রসেস করে থাকে। সাউথ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা আমার ফাইল প্রসেস শুরু করল, প্রসেস করতে গিয়ে এমনি হ-য-ব-র-ল করে ফেলল যে, এক পর্যায়ে আমি আশাই ছেড়ে দিলাম।
এদিকে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন এসে গেল। সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করল এবং যে বিশাল মন্ত্রিসভা গঠন করলো তাতে মুন্নু সাহেবও ছিলেন। আমাকে বানালেন এপিএস। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মুন্নু সাহেব দীর্ঘ আঠারো মাস দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থেকেই বাদ পড়ে গেলেন। তার বাদ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে দলে তার প্রধান প্রতিপক্ষ চিফ হুইপ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে রাজনৈতিক ফ্যাসাদ। মুন্নু সাহেব নির্বাচনে মানিকগঞ্জের দুটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে উপনির্বাচনে মন্নু ক্ষোভে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী শামসুদ্দীন আহমেদ নির্বাচনে জয়ী হন। নির্বাচনের সব খরচ মুন্নুই বহন করেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার কারণেই মুন্নুর মন্ত্রিত্ব চলে গিয়েছিল। আমি অবশ্য জনাব মুন্নু মন্ত্রী হবার ছয় মাসের মধ্যে তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। মানিকগঞ্জের দুই নেতৃত্বের অব্যাহত দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং কিছু লোকের অনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে এডজাস্ট না হওয়ার কারণেই স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেই। তাছাড়া বিএনপির সাথে আমার কোনো রাজনৈতিক সংযোগ নাই। আমাকে মানিকগঞ্জের অনেকেই আওয়ামী লীগের লোক মনে করত। মুন্নু সাহেবও একদিন ডেকে বললেন, তুমি আওয়ামী লীগ করো!
এমনই একটা বিভীষিকাময় পরিবেশ তৈরি হলো যে, শুধু চাকরিই ছাড়া নয়, দেশ থেকে পালাতে পারলেও যেন বেঁচে যাই। দীর্ঘ এক যুগ মুন্নুর সাহেবের সঙ্গে কাজ করার পরও কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির লোভলালসার কাছে আমি পরাভূত হলাম। একই সঙ্গে আমার
ইমিগ্রেশনের চেষ্টাও চলতে থাকলো। এর মধ্যে ৯/১১ এর ঘটনায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। থমকে গেল সমস্ত বিশ্ব, তেমনি ইমিগ্রেশনের কর্মকান্ডও। আমি আবার অন্ধকারে ডুবে গেলাম। এদিকে মুন্নুর চাকরি ছেড়ে দিয়ে আরেকটা চাকরি পেতে আমার অসুবিধা হয়নি। সাংবাদিকতার কাজ তো ছিলই। আমেরিকার প্রবাসী ছাড়াও ইউরোপে বসবাসকারী প্রবাসীরা আমার বিদেশে আসার পেছনে একটা ভূমিকা রেখেছে বলে আমার মনে হয়। ইউরোপ থেকে অনেকে সাপ্তাহিক ২০০০-এ লিখতেন। তাদের লেখা আমি মুগ্ধ হয়ে পড়তাম এবং আমিও ভাবতাম, যদি একবার ঐ দেশগুলোতে যেতে পারতাম! ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম আমেরিকা থেকে পাঠানো চিঠি পড়ে। কখনো ভাবিনি যে কানাডাই হবে আমার ঠিকানা। যদিও জানতাম কানাডা দেশটি পৃথিবীর সেরা দেশের একটি। অনেক কিছুই আমার অবচেতন মনে কাজ করে যেত, ইউরোপে কয়েকজন আছেন যারা খুবই ভালো লেখেন।
নির্দিষ্ট কোনো কারণে আমি প্রবাসী হইনি। দেশ বসবাসের অনুপযোগী এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, বাংলাদেশটা আমাদের সবার। কারো বাপের না, কারো স্বামীরও না বা দেশটা ওই সব লুটেরাকে ইজারাও দেয়া হয়নি। একটা গোষ্ঠী আছে যারা নিজেদের সন্তান-সন্ততি বিদেশে নিরাপদে রেখে যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। মরলে সাধারণ মানুষ মরবে। তাদের কিছু যায়-আসে না। আমরা প্রবাসে নিরাপদ থাকলেও আমরা আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী বা স্ত্রীকে রেখে এসেছি নরককুন্ডে। তাদের তো সেখানেই থাকতে হবে। এরকম অনেকগুলো মিশ্র কারণ মিলে আজ আমি প্রবাসী। কিছু ঘটনা সব মানুষের জীবনেই থাকে যা তার মনে গভীর রেখাপাত করে, যা কখনো সে ভুলতে পারে না। প্রতিটি মানুষই একেকটা ঘটনার শিকার। এরকম ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা থেকেই একেকজন মানুষের রূপরেখা আমূল বদলে যায়। সে মানুষটি হয়ে ওঠে একজন পরিবর্তিত মানুষ। মানুষের মনের শেকড় যে কোথায় রোপিত থাকে তা বলা সত্যি খুব কঠিন। আমিও আমার মনের হদিস পাই না কখনো কখনো। আমাদের অনেক দুঃখ আছে, বেদনা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে- এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। এটাই নিয়ম, এটাই নিয়তি।
ঢাকা ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
জসিম মল্লিক
লেখক ও সাংবাদিক
টরন্টো
jasim.mallik@gmail.com