ডলি বেগম আবারও ইতিহাস সৃষ্টি করলেন
প্রবাসী কণ্ঠ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৫: অন্টারিও’র পার্লামেন্ট নির্বাচনে তৃতীয়বারের মত বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ডলি বেগম আবারও ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ডলি বেগম ভোট পেয়েছেন ১৪,৫৫৭ টি যা ‘স্কারবরো সাউথওয়েস্ট রাইডিং’ এ প্রদত্ত মোট ভোটের ৪২.৮৯%।
ডলি বেগম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি অব অন্টারিও’র প্রার্থী দারামোলা অ্যাডি ভোট পেয়েছেন ১০,৪০০টি। আর অন্টারিও লিবারেল পার্টির প্রার্থী জ্যাকসন কাদিরা ভোট পেয়েছেন ৭,৭৮৬টি।

ডলি বেগমের এই ঐতিহাসিক বিজয়ে আনন্দে ভাসছেন কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন জানাচ্ছেন দলমত নির্বিশেষে সবাই।
উল্লেখ্য যে, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবারের নির্বাচন ডলি বেগমের জন্য ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। কারণ ড্যাগ ফোর্ডের নেতৃত্বাধীন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি অব অন্টারিও’র জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এই সুযোগে ড্যাগ ফোর্ড হঠাৎ করেই নির্ধারিত সময়ের ১৪ মাস আগাম নির্বাচন ডেকে বসেন। যদিও পার্লামেন্টে তার ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র এক মাস। কিন্তু তারপরও ডলি বেগম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েন। তার অতীত কর্মকাণ্ড ও স্কারবরো সাউথওয়েস্ট রাইডিং এর জনগণের প্রতি তার ভালবাসা তাকে আবারও নির্বাচনী যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে অন্টারিও পার্লামেন্টের নির্বাচনে প্রথমবার জয়ী হয়ে ডলি বেগম প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন এক ইতিহাস। অন্টারিওসহ কানাডার অন্য কোন প্রভিন্সে কোন বাংলাদেশি কানাডিয়ান তখন পর্যন্ত এরকম মর্যাদায় ভূষিত হননি। এবং এখন পর্যন্তও না। এমপিপি বা এমপি কোনো পদেই ডলি বেগম ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশি কানাডিয়ান পাশ করতে পারেননি।
২০১৮ সালে অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) থেকে মনোনয়ন পেয়ে ডলি বেগম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন স্কারবরো সাউথওয়েস্ট রাইডিং থেকে। সেবার তিনি ১৯ হাজার ৭ শত ৫১ ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করেছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির গ্রে এলিস পেয়েছিলেন ১৩ হাজার ৫ শত ৯২ ভোট। অত্র রাইডিং এ চার মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় ছিলেন লিবারেল পার্টির লরেঞ্জো বেরারডিনেটি। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৮ হাজার ২ শত ১৫টি।
দ্বিতীয়বারের নির্বাচনেও ডলি বেগম বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। তার রাইডিং এর ৪৭.১% ভোটার তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন। তিনি মোট ভোট পেয়েছিলেন ১৫,৯৫৪ টি। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী ব্রেট স্নাইডার। ২৭.৯% ভোটার তাকে ভোট দিয়েছেন। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৯,৪৩৬ টি। আর অন্টারিও লিবারেল পার্টির প্রার্থী লিসা প্যাটেলকে ভোট দিয়েছিলেন ১৮.৮% ভোটার। তিনি মোট ভোট পেয়েছিলেন ৬,৩৫৬ টি।
ডলি বেগম স্কুল এবং ইউনিভার্সিটিতে অত্যন্ত ভাল রেজাল্ট করে নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন আগেই। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো বিশ্বসেরা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি। সেখান থেকে পলিটিক্যাল সাইন্সে ডিগ্রি নিয়ে Development Administration and Planning এর উপর মাস্টার্স শেষ করেন ব্রিটেন থেকে।
২০১৮ সালে প্রথমবার অন্টারিও পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রবাসী কণ্ঠে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ডলি বেগম বলেছিলেন, আমি আসলে কখনোই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না আগে। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে মানুষকে সাহায্য করতে পারবো, কমিউনিটিকে সাহায্য করতে পারবো। আমার যে বিশ্বাস বা দর্শন ছিল – সেটা শিক্ষা হোক বা হেলথ কেয়ারই হোক, আমি দেখতাম তার সঙ্গে এনডিপি’র যে নীতি ও আদর্শ তার সঙ্গে অনেক মিল আছে। এমনকি লিবারেল পার্টির চেয়েও অনেক ভাল এনডিপি’র নীতি ও আদর্শগুলো। ইমিগ্রেশন বিষয়েও এনডিপি’র যে নীতি রয়েছে সেটা লিবারেল পার্টির চেয়ে অনেক ভাল এবং ইমিগ্রেন্ট বান্ধব। এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে আমি দেখলাম এনডিপি’র সঙ্গে আমার নিজের নীতি ও আদর্শগুলো বেশী খাপ খায়। এ কারণেই মূলত আমি এনডিপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাই।
তিনি আরো বলেছিলেন, রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে আমি অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তবে এ ক্ষেত্রে আমি আমার মা’র কথাই আগে বলবো। কারণ, উনার ইচ্ছাশক্তি খুবই প্রবল এবং খুবই শক্তিশালী। দুর্ঘটনায় আমার বাবা আহত হওয়ার পর থেকে আমাদের পুরো পরিবারটিকে উনিই টেক কেয়ার করেন। সে কারণে স্পষ্টতই উনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখার আছে। আমি এখানে মূলধারার কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গেও কাজ করেছি। যেমন বিচেস ইস্ট ইয়র্ক এলাকার ওয়ার্ড ৩১ এর সিটি কাউন্সিলর (সাবেক) জেনেট ডেভিস। এরকম আরো কয়েকজন এর সঙ্গে কাজ করেছি। আর তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েও রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি এবং আগ্রহী হয়ে উঠেছি।
উল্লেখ্য যে, আগাম নির্বাচনের ডাক দেয়ার পিছনে ড্যাগ ফোর্ডের যুক্তি ছিল ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ মোকাবেলায় তার আরো বেশি শক্তিশালী সাপোর্ট দরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডা থেকে পণ্য আমদানির উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার হুমকি দিয়ে আসছেন। কানাডার প্রায় ৭৫ শতাংশ পণ্য ও পরিষেবা রফতানি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এর প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ড্যাগ ফোর্ড। পাশাপাশি ‘কানাডা ইজ নট ফর সেল’ স্লোগানের প্রচারণা চালিয়েও অন্টারিওবাসীর মন জয় করেন তিনি। এই স্লোগান তিনি শুরু করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরেক হটকারী আহ্বানের প্রতিবাদে। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কানাডাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫১তম অঙ্গরাজ্য হিসাবে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন ট্রাম্প।
কিন্তু গতকালের নির্বাচনের পর সমালোচকরা এখন প্রশ্ন তুলছেন এই বলে যে, কি লাভ হলো ১৮৯ মিলিয়ন ডলারের এই আগাম নির্বাচন করে? নির্বাচনের ফলাফলে তো দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন ড্যাগ ফোর্ডের দলের আসন সংখ্যা প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের মোকাবেলায় আরো বেশি শক্তিশালী সাপোর্ট তো তিনি পেলেন না। তাহলে কেন তিনি এই নাটক করলেন টেক্সপেয়ারদের বিপুল অর্থ খরচ করে?
শুক্রবার সকালে এই রিপোর্ট যখন লেখা হয় তখনকার আনঅফিসিয়াল রেজাল্টে দেখা যাচ্ছে ড্যাগ ফোর্ডের দল ১২৪টি আসনের মধ্যে ৮০টি আসনে জয়ী হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি অবশ্য একটি রেকর্ড গড়েছেন। গত ১৯৫০ সালের পর তিনিই প্রথম নেতা যিনি পরপর তিনবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হলেন। অন্যদিকে অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি জয়ী হয় ২৭টি আসনে। এই জয়ের মধ্য দিয়ে দলটি প্রধান বিরোধী দল হিসেবে রয়ে গেল। আর অন্টারিও লিবারেল পার্টি জয়ী হয় ১৪টি আসনে। গ্রিন পার্টি দুই আসনে।
এদিকে অন্টারিও লিবারেল পার্টি তাদের অফিসিয়াল অপজিশন পার্টির মর্যাদা ফিরে পেলেও দলের নেত্রী নিজেই ফেল করেছেন। তিনি হেরেছেন ব্র্যাম্পটনের মেয়র প্যাট্রিক ব্রাউনের শাশুড়ি প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী সিলভিয়া গুয়ালটিয়ের ‘র কাছে। বনি ক্রম্বি ছিলেন মিসিসাগার মেয়র। কিন্তু পরে প্রভিন্সিয়াল পলিট্রিক্সে যোগ দেওয়ার জন্য মেয়রের পদ ছেড়ে দিয়ে অন্টারিও লিবারেল পার্টির নেতা নির্বাচিত হন। তবে প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টে তার কোন আসন ছিল না।