বেইজিং-এর স্মৃতিকথা
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পর্ব-২)
আমি যে সময়ে আন্ডারগ্রেড করার জন্য বেইজিং যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সেই সময়ে দেশ হিসেবে চীনের তেমন কদর ছিল না। কম্যুনিস্ট ব্লকের দেশ হিসেবে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও আমাদের দেশের অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। তখন কেউ চীনে পড়তে যাচ্ছে সেটা সহজে শোনা যেত না। সেই সময়ে ভালো ছাত্রদেরকে দেখা যেত আই-টুয়েন্টি যোগাড় করে আমেরিকাতে আন্ডারগ্রেড করার জন্য ভিসার জন্য আমেরিকার অ্যাম্বাসীর সামনে লাইনে দাঁড়াতে। আর যারা অতটা ভালো ছাত্র নয় তাদের অনেককেই দেখা যেত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন রিজিওনাল ইঞ্জিনয়ারিং কলেজগুলোতে ভর্তি হতে। তাদের মধ্যে অবশ্য বেশীরভাগই বাংলাদেশের কোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স না পাওয়ার কারণেই ভারতমুখী হত। তবে ভারতের আই.আই.টি-এর কথা ভিন্ন। সেই সময়ে ইন্ডিয়ান গভর্মেন্ট প্রতি বছর কিছু সংখ্যক মেধাবী বাংলাদেশী ছাত্রদেরকে আই.আই.টি-তে পড়ার জন্য স্কলারশীপ দিত। আমি সেই স্কলারশীপের ফর্ম আনতে ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাজির হই একদিন। আমাদের সময়েই তারা প্রথম ইংরেজীতে লেটার মার্কস থাকতে হবে এই নিয়ম চালু করে। ইংরেজীর দুই পেপার মিলিয়ে আমার লেটার মার্কসের চেয়ে দুই মার্কস কম ছিলো -ফলে মেধা তালিকায় আমার ঠিক পেছনে থাকা রাজশাহী ক্যাডেটের পরিচিত এক ছেলে চান্স পেয়ে গেলো অথচ আমি অ্যাপ্লিকেশন করার ফর্মই পেলাম না। সেই ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ‘চ্যান্সেলর’ পুরষ্কার আনার সময়। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ আমরা যে বছর ম্যাট্রিক পাশ করি সেই বছর থেকে এই পুরষ্কার চালু করেন। আমি আমার জীবনে রাষ্ট্রপতি এরশাদকে সামনা সামনি মোট তিনবার দেখেছি। দু’বার চ্যান্সেলর পুরষ্কার নিতে গিয়ে, আর একবার বেইজিং-এ।
রাজশাহী বোর্ডের মেধা তালিকায় যেহেতু আমি সপ্তম স্থান দখল করেছি এবং সেই সাথে পরীক্ষা দিয়ে বুয়েটে অ্যাডমিশন পেয়েছি, সেই হিসেবে আমাকে নিশ্চয় ভালো ছাত্রদের দলে ফেলাই যায়। ফলে আমার উচ্চ শিক্ষার জন্য চীনে যাওয়ার ব্যাপারটা সেই সময়কালের প্রেক্ষিতে অনেকটাই ছিল গতানুগতিক ধারার বাইরে। স্বভাবতই চীনে যাওয়াটা কি ঠিক হবে কি হবে না সেটাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল সর্বক্ষণ। তদুপরি চীনের পরীক্ষায় যে ছেলেটি মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিল সে ইতিমধ্যেই চাইনিজ কর্তৃপক্ষকে তার না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে জানিয়ে দিয়েছে। এহেন দোটানা অবস্থায় চীনে যাওয়ার পাকা সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে দু’টি কারণ সাহায্য করেছিল। এক, বুয়েটে তখন ভীষণ সেশন জট। কানাঘুষা চলছে যে, আমাদের ক্লাস শুরু হতে নাকি দুই বছর লেগে যেতে পারে। আমার সাথে যারা বুয়েটে ভর্তি হয়েছে তাদের অনেককেই দেখলাম বসে না থেকে দু’বছরের ডিগ্রী কোর্সে ভর্তি হয়ে যেতে। মনে মনে ভাবলাম তাহলে আমিও কেন বসে থাকব? বরং চীনে চলে যাই। কোন কারণে যদি চীনের সিস্টেমকে পছন্দ না হয় তবে তো বুয়েটের দুয়ার তো আমার জন্য খোলা। দ্বিতীয়ত, যেহেতু চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে যাব তাই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে কোন খরচ বহন করতে হবে না। বর্তমানের চিত্র অবশ্য ভিন্ন। চীন আজ একটি উদীয়মান পরাশক্তি এবং চীনের শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বিশ্বমানের সেটাও প্রমাণিত। শুনেছি এখন নাকি বাংলাদেশ থেকে নিজ খরচে উচ্চশিক্ষার জন্য অনেকেই চীনে যাচ্ছেন।

চীনে যাওয়ার প্রস্তুতি স্বরূপ প্রথম যে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য উদ্যোগী হলাম সেটা হলো রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে টেস্টিমোনিয়াল এবং রাজশাহী বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েটের মার্কসশীট ও সার্টিফিকেটের ইংরেজী ভার্সন সংগ্রহ করা। রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে দীর্ঘ ছয় বছর আমি ঢাকা-রংপুর করেছি। তবে তখন ঢাকার সব সহপাঠীরা এক সাথে যাতায়াত করতাম। কখনই একা যাওয়া আসা করিনি। তাছাড়া রাজশাহীতে আগে কখনো যাওয়াই হয়নি। এবার নিজ প্রয়োজনে একা একা যেতে হবে ভাবতেই একটু ভয় ভয় লাগছিল। আমাকে এই অসহায় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ করতে এগিয়ে আসে আমার কলেজ জীবনের দীর্ঘ ছয় বছরের রুমমেট ফয়সল। সেও এই সুযোগে টেস্টিমোনিয়াল, মার্কসশিট আর সার্টিফিকেটের ইংরেজী ভার্সন করিয়ে নিবে। আমাদের সেই জার্নিটা আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে বেশ সমৃদ্ধ করেছিল নানা কারণে। প্রথমেই আমরা ট্রেনে করে রংপুরে যাই। কলেজের আরেক সহপাঠী হুমায়ূনদের বাসায় থাকি প্রায় সপ্তাহ খানেক। যদিও কলেজের কাজ প্রথম দু’দিনেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু খালাম্মার বিশেষ আতিথেয়তার কারণে অতিরিক্ত তিন-চার দিন থেকে যাই। রাজশাহীতে গিয়ে উঠি হোটেল অমরাবতী-তে। বোর্ড অফিস থেকে বেশ কাছেই সেই হোটেল। ফলে যাতায়াতের কোন সমস্যা রইল না। বোর্ডের কাজও নির্বিঘ্নে শেষ হয়। কিন্তু গোল বাঁধে ফিরতি যাত্রার সময়। বন্যার কারণে রাজশাহী টু ঢাকার বাস চলাচল বন্ধ। অনেক কষ্টে আমরা দু’জন লোকাল বাসে ভেঙে ভেঙে নগরবাড়ী পর্যন্ত এলাম। বন্যার তোপে ফেরী বন্ধ। তাই জান হাতে নিয়ে স্টীমারে চেপে আরিচা এসে পৌঁছাই। তারপর আবার বাসে করে ঢাকায় এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি আমরা দু’জনে। প্রস্তুতির দ্বিতীয় পর্ব ছিল কিছু কাপড় চোপড় কেনা। আমাদের বলা হয়েছিল যে বেইজিং-এ যাওয়ার সাথে সাথেই আমাদেরকে বাড়তি টাকা দেয়া হবে শীতের উপযোগী জ্যাকেট ও অন্যান্য কাপড়-চোপড় কেনার জন্য। ফয়সল তাদের ‘ফিবকো গার্মেন্টস’ থেকে আমার জন্য একটা লং স্লিভ পোলো শার্ট বানিয়ে দেয়। এই পোলা শার্টটা বেইজিং-এর নাতিশীতোষ্ণ ‘ফল ওয়েদারে’ খুব কাজে এসেছিল।
চীনে যাবার দিন যখন ঘনিয়ে আসতে লাগল তখন একদিন আমাদেরকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে জানালো হলো যে আমাদের সবাইকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘গ্র্যাটিস পাসপোর্ট’ দেয়া হবে। বিধি মোতাবেক এই পাসপোর্ট শুধুমাত্র সরকারী কাজে বা মিশনে দেশের বাইরে যাওয়ার নিমিত্তে ব্যবহার করা যায়। তাই এই পাসপোর্ট ব্যবহার করার জন্য আমাদের প্রত্যেককেই একটি করে সরকারী অনুমতিপত্র বা জি. ও. (গভঃ অর্ডার) দেয়া হলো। পাসপোর্ট আর জি. ও. হাতে আসার পরপরই চাইনিজ কালচারাল সেন্টার আমাদেরকে থাইল্যান্ডের ভিসা বিনা খরচে যোগাড় করে দেয়। কারণ পথিমধ্যে ব্যাংককে দুই রাতের যাত্রা বিরতি। এক সময় যাত্রার দিন ধার্য্য হয় ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭। সেই মোতাবেক আমাদেরকে ব্যাংকক হয়ে বেইজিং-এর যাওয়ার থাই এয়ারওয়েজের টিকেট দেয়া হয়।
কারও বিদেশ যাত্রা আমাদের দেশের যে কোন ফ্যামিলির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সবার সাথে দেখা করে বিদায় নেয়ার একটা রেওয়াজ আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। তবে সাধারণত ভিসা আর টিকেট হাতে আসার পরই নিকট আত্মীয়দেরকে জানানো হয় সেই সংবাদ। আমার ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যত্যয় হলো না। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে উপদেশ, দোয়া এবং উপকারী কিছু উপহার পেলাম। এই উপহারের মধ্যে ছিল কিছু জামাকাপড় আর একটি সিলেক্টেড বাংলা গানের ক্যাসেট। আর উপদেশের মধ্যে যেটা মনে রেখেছিলাম কিন্তু পালন করতে পারিনি সেটা হলো আমার চীন জীবনের অভিজ্ঞতা ডায়েরীতে লিখে রাখা। খোদা তায়ালা প্রদত্ত আমার স্মরণশক্তির উপর আমি আস্থা রেখেছি সব সময়। আমার কেন যেন মনে হয় খোদা আমাকে কিছুটা হলেও ফটোগ্রাফিক মেমোরি দিয়েছেন তার অপার দান ভাণ্ডার থেকে। তাই তো চীন জীবনের প্রায় প্রতিটি ঘটনাই আমার স্মৃতির মানসপটে এখনও উজ্জ্বল। সেই স্মৃতি ধূসর হওয়ার আগেই সেটাকে লিখে রাখাটাই হবে খোদার প্রতি বান্দার শোকর গুজরান।

বেইজিং যাত্রার নির্ধারিত দিনে হাতে পর্যাপ্ত সময় রেখেই জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এসে উপস্থিত হই। সাথে আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন, ভাই-বোনদের স্পাউস এবং ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ আমার ভাগ্না-ভাগ্নি, ভাতিজা-ভাতিজিদের বিরাট বহর। সেটাই ছিল সেই সময়ের জন্য স্বাভাবিক। আমাকে বিদায় জানাতে আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এসে উপস্থিত। তাদের এই আন্তরিকতা আমার জন্য ছিল একটি বিরাট প্রাপ্তি। বোর্ডিং-এর সময় হয়ে এলে আমরা যারা চীনে যাচ্ছি তারা সবাই একত্রিত হই। সেখানে চাইনিজ কালচারাল সেন্টারের ফার্স্ট সেক্রেটারিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদের এবং আমাদের পরিবারের সবাইকে আশ্বাস দিলেন যে আমাদের যাত্রার সমস্ত খুঁটিনাটি সুন্দরভাবে ম্যানেজ করা আছে। ফলে চিন্তার কোন কারণ নেই। এক সময় সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা ইমিগ্রেশন পার হয়ে থাই এয়ারওয়েজের বিমানের দোরগোড়ায় এসে পৌছি। জীবনের প্রথম বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে তাই স্বভাবতই আমরা সবাই রোমাঞ্চিত। সেই রোমাঞ্চের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুললো যখন বিমানের দরজায় দাঁড়ানো একজন থাই এয়ারহোস্টেস আমাদেরকে ‘সা-ওয়াত-ডি কা’ (ওয়েলকাম এবং গুডবাই দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়) বলে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে আমাদের জন্য নির্ধারিত সিট দেখিয়ে দিল। বিমানের ঠান্ডা হাওয়ায় মনে হলো সত্যিই ‘স্মুথ এ্যাজ সিল্ক’ – সেই সময়কার থাই এয়ারওয়েজের বিজ্ঞাপনের বিখ্যাত পাঞ্চ লাইন। এই পাঞ্চ লাইন তারা কিন্তু এখনও ব্যবহার করে। দুই ঘণ্টার কিছু বেশী সময়ের এই বিমান ভ্রমণ আমাদের জন্য ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ সবকিছুই ছিল আমাদের জন্য নতুন। তবে এয়ারহোস্টেসদের সার্ভিস ছিল চমৎকার। খাবার পরিবেশনের সময় মেন্যু সিলেকশনে আমাদের আনাড়িপনাতে তাদেরকে মোটেও বিরক্ত হতে দেখেনি। বিমান যখন ব্যাংকক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের টারমার্ক স্পর্শ করে তখন দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি একটা সময়। বিমানের দোরগোড়াতে লাগানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমাদেরকে বাসে উঠতে হবে। সেই বাস আমাদেরকে নিয়ে যাবে এয়ারপোর্টের ভেতর। বিমান থেকে নামার মুখে আবারও সেই এয়ারহোস্টেসদের বিদায় সম্ভাষণ। হাসিমুখে তাদেরকেও বিদায় জানিয়ে বিমানের বাইরে পা দিতেই গরম বাতাসের এক হল্কা এসে মুখে যেন এক ঝাপটা দিল। তখন বুঝতে পারলাম ব্যাংকক শহরটা আমাদের ঢাকা থেকে বেশ অনেকটাই গরম। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চড়তেই আবারো সেই ঠান্ডা হাওয়ায় স্বস্তি ফিরে পেলাম। আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে ইমিগ্রেশন পার হয়ে সোজা চলে যেতে হবে থাই এয়ারওয়েজের কাউন্টারে। তারাই আমাদের হোটেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। আমরা থাই এয়ারওয়েজের কাউন্টারে যেতেই তারা আমাদেরকে একটি মাইক্রোবাসে করে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘হোটেল এশিয়া’-তে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিল। হোটেলে কে কোন রুমে থাকবে সেটাও তারা ঠিক করে দিল। তার কারণ হয়ত ‘হোটেল এশিয়া’-এর কিছু রুম থাই এয়ারওয়েজ আগে থেকেই বুক করে রেখেছে তাদের ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য। মাইক্রোবাসে করে যখন ব্যাংকক শহরের রাস্তায় বের হলাম তখন প্রথমেই যে জিনিষটা চোখে পড়েছিল সেটা ছিল ট্রাফিক জ্যাম। আমাদের ঢাকা শহর তখনও ট্রাফিক জ্যামের শহর হয়ে উঠেনি। খেয়াল করে দেখলাম যে এই ট্রাফিক জ্যামের ভেতর অন্যান্য গাড়ীগুলিকে এঁকেবেঁকে পাশ কাটিয়ে তীর বেগে ছুটে যাচ্ছে কিছু মোটর বাইক। পরে জেনেছি তারা নাকি ভাড়ার বিনিময়ে পিছনে যাত্রী বহন করে থাকে। যাদের খুব তাড়া, তারা এই মোটর বাইকে সওয়ার হন। এখন যেমনটি দেখা যায় আমাদের ঢাকা শহরে। প্রায় ঘণ্টা খানেক লেগে গেল আমাদের হোটেলে এসে পৌঁছাতে। হোটেলের রিসিপশনে এসে রিপোর্ট করার সাথে সাথে আমাদের হাতে রুমের চাবি দেয়া হলো। সেই সাথে দেয়া হলো খাবারের কুপন। এই হোটেলের বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আমাদের কুপনগুলি সেই রেস্টুরেন্টগুলির একটির জন্য প্রযোজ্য।
দেশে থাকতে আমার বেশ কয়েকবার ঢাকার বাইরের সাধারণ মানের আবাসিক হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে। চিটাগং, কক্সবাজার, রাজশাহী এবং বগুড়ায় আমি হোটেলে থেকেছি। এই হোটেলগুলির ভেতর আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে বগুড়ার হোটেল আকবরিয়া। আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি তাদের আছে একটি উন্নতমানের রেস্টুরেন্ট। সেখানে আমি বেশ তৃপ্তি সহকারে ডিনার করেছিলাম। শুনেছি প্রতি রাতে এই রেস্টুরেন্টের খাবার দিয়ে প্রায় শ’খানেক গরীব লোককে বিনামূল্যে খাওয়ান হয়। ব্যাংককের হোটেল এশিয়া হচ্ছে একটি থ্রী-স্টার হোটেল। আগে কখনো এই রকম লাক্সারিয়াস হোটেলে থাকা হয়নি। ফলে প্রথম বিমান ভ্রমণের মতন এটাও আমার জন্য নতুন। দলের অন্যান্যদেরও একই অবস্থা। ফলে হোটেলের রুমে ঢুকে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কিভাবে এয়ারকন রেগুলেট করতে হয় কিংবা ফ্রীজের ভেতর দেয়া ড্রিংকসগুলো কি ফ্রি ইত্যাদি নিয়ে। যাই হোক, আমরা হাতমুখ ধুয়ে ফেশ হতে না হতেই সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেল। ডিনার টাইম। সবাই মিলে কুপন হাতে ছুটলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে। ক্যাডেট কলেজে পড়ার কারণে কাঁটা-চামচ দিয়ে খাওয়া সহ অন্যান্য টেবিল ম্যানারিজমের ব্যাপারে অভ্যস্থ। ডিনারের পর রুমে এসে ঘুম। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা ছোট ছোট দলে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। অল্প কিছু ডলার আমরা ভাঙিয়ে নিয়েছিলাম হোটেলের রিসিপশনের লাগোয়া মানি এক্সচেঞ্জ বুথ থেকে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই হোটেলটির অবস্থান হওয়াতে হোটেল থেকে বেরুতেই আমরা দেখতে পেলাম রাস্তার দুইপাশে অসংখ্য দোকানপাট। আমরা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। পথে এক দোকান থেকে কিছুটা দামাদামি করে আমি ‘লাকোস্টে’ ব্র্যান্ডের সাদা একটি টি-শার্ট কিনে ফেললাম। আমাদের দেশের বঙ্গবাজার টাইপের দোকান, তাই এত দামী ব্র্যান্ডের টি-শার্ট খুব কম দামে পেয়ে গেলাম। দলের অন্যান্যরাও কেনাকাটায় মশগুল। আমাদের ভেতর একজন তো একটা ক্যামেরা এবং সেই সাথে একটা টু-ইন-ওয়ান টাইপের ক্যাসেট প্লেয়ার কিনে ফেললো। এক সময় টের পেলাম যে আমরা হোটেল থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি এবং সেই সাথে কিভাবে ফিরতে হবে সেই রাস্তাও গুলিয়ে ফেলেছি। তার উপর কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেছে সেটাও টের পাইনি। তাই হোটেলের রেস্টুরেন্টের লাঞ্চ ধরার একমাত্র ভরসা হচ্ছে ‘টুকটুক’। ‘টুকটুক’ অবিকল আমাদের দেশের বেবিট্যাক্সির অনুরূপ একটি বাহন। টুকটুকে চেপে যখন আমরা হোটেলে ফিরে এলাম তখন দেখি আমাদের জন্য নির্ধারিত রেস্টুরেন্টটির লাঞ্চ আওয়ার পার হয়ে গেছে। রিসেপশন ডেস্কে এসে সেটা জানাতেই তারা আমাদেরকে অন্য একটি রেস্টুরেন্টের কুপন দেয়। সেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে আমাদের নতুন কুপন দেখাতেই তারা আমাদেরকে লাঞ্চ সার্ভ করে। সত্যিই হোটেল এশিয়ার সার্ভিস ছিল অতি চমৎকার।
পরদিন সকালে আমাদের ব্যাংকক টু বেইজিং ফ্লাইট। আমাদেরকে রিসেপশন ডেস্ক থেকে বলা হলো যে সাত সকালেই আমাদেরকে এয়ারপোর্টের নিয়ে যাওয়ার জন্য থাই এয়ারওয়েজের মাইক্রোবাস রেডি থাকবে। রিসেপশন থেকে ভোরে আমাদেরকে ফোন করে জাগিয়ে দেয়া হবে যাতে আমরা সময়মতন সেই বাস ধরতে পারি। ডিনারের পর আমরা সবাই একটি রুমে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মেতে উঠলাম। সদ্য কেনা ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজানো হলো বাংলা গান। নতুন দেশ দেখার উত্তেজনায় সবাই বেশ অধীর। এক সময় যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো রিসেপশন ডেস্ক থেকে আসা ফোন কলে। এখন আমাদেরকে রেডি হয়ে নীচে নামতে হবে। প্ল্যান অনুসারে থাই এয়ারওয়েজের মাইক্রোবাস আমাদেরকে সময়মতন পৌঁছে দিল এয়ারপোর্টে। আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া বিশেষ পাসপোর্ট আর রয়েছে ঢাকা থেকে ইস্যু করা চীনের ভিসা। তাই কোন রকম ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম আমরা। এবার এয়ারপোর্টের বাস আমাদেরকে নিয়ে যাবে বিমানের সাথে লাগানো সিঁড়ির কাছে। বাসে উঠার সময় খেয়াল করলাম আমাদের বয়সী প্রায় আট-দশ জন ছেলেমেয়ের আরেকটি দল সেই বাসে উঠেছে। দূর থেকে তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো তারা ভারতীয়। দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে তাদেরকে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলাম তারা কি আমদের মতন আন্ডারগ্রেড করতে চীনে যাচ্ছে? আমাদের দেখে তাদের মনেও একই প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল। তাই আগ বাড়িয়ে কথা বলাতে তারা বেশ খুশীই হলো। জানা গেলো তারা নেপালী, আমাদের মতন তারাও চীন সরকারে বৃত্তি নিয়ে আন্ডারগ্রেড করতে যাচ্ছে। পরবর্তীতে তাদের সাথে আমাদের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বেইজিং-এ।
আমরা সবাই বাস থেকে নেমে সিঁড়ি উঠে গেলাম বিমানের দোরগোড়ায়। আবারো সেই এয়ারহোস্টেসদের সাদর সম্ভাষণ – ‘সা-ওয়াত-ডি কা’। আমরাও বিনয়ের সাথে মাথা নুইয়ে তার প্রত্যুত্তর দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমাদের নির্দিষ্ট সিটের দিকে। যেহেতু দুইদিন আগে আমাদের প্রথম বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে তাই এবার হাবভাব এবং চালচলনে আমরা সবাই বেশ কনফিডেন্ট। যথা সময়ে বিমান যাত্রা শুরু করলো বেইজিং-এর উদ্দেশ্যে। (চলবে)
(কাজী সাব্বির আহমেদ বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বাংলাদেশে কলেজ ম্যাগাজিনে নিয়মিত কবিতা এবং সায়েন্স ফিকশন লিখতেন। চীনে অবস্থানকালে প্রবাসী জীবন নিয়ে বিচিত্রার ‘প্রবাস থেকে’ কলামে লিখতেন।)