জাস্টিন ট্রুডোর ৯ বছর : উত্থান পতনের নানান কাহিনী

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : অনেক জল্পনা-কল্পনার পর কানাডার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অবশেষে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন জাস্টিন ট্রুডো। গত ৬ জানুয়ারি তার নিজ বাসভবনের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, দল নতুন নেতা নির্বাচন করার পর দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেবেন তিনি।

লিবারেল পার্টির নেতা ট্রুডো প্রায় একদশক ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৫ সালে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডোর বিস্ময়কর বিজয়ের পর কানাডাসহ বিশ্ব মিডিয়ায় তাকে নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কানাডার টপ ক্যাটাগরির নিউজ মিডিয়া কানাডিয়ান প্রেস, ম্যাকলিন ম্যাগাজিনসহ দেশের বেশ কয়েকটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান তাকে নিউজমেকার অব দ্যা ইয়ার হিসাবে ঘোষণা করেছিল। লিবারেল সমর্থকদের মধ্যে তখন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা বা সমর্থন বাস্তবিক অর্থে ছিল আকাশচুম্বী। ফোরাম রিসার্চের হিসাব অনুযায়ী লিবারেল দলের সমর্থকদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা তখন ছিল ৯০%। কিন্তু EKOS এর জরিপে দেখা গিয়েছিল এই জনপ্রিয়তা ছিল আরো বেশী। শতকরা ৯৮ ভাগ।

জাস্টিন ট্রুডোর সেই উত্তেজনাপূর্ণ বিজয় তাকে এনে দিয়েছিল আরো কিছু খ্যাতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিভিন্ন নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও ডিরেক্টরদের কাছে তিনি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব।

দলের নতুন নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেবেন জাস্টিন ট্রুডো। ছবি : গ্লোব এ্যান্ড মেইল

শুধু রাজনৈতিকভাবেই যে জাস্টিন ট্রুডো কানাডা ও অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমের নজর কেড়েছেন তা নয়। তার ব্যক্তি ইমেজ ও সুদর্শন অবয়বও নজর কেড়েছিল অনেকের। আমেরিকার খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘ভোগ’ এর কভার ম্যান হিসাবেও এসেছেন তিনি। ভোগ ম্যাগাজিনের কভারে সাধারণত মুভি স্টার বা ফ্যাশন স্টারদেরকে আনা হয়। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডোর বেলা সেই রীতি ভঙ্গ করা হয়েছিল।

কানাডার রাজনীতিতে নাটকীয় সব পরিবর্তনের ছোঁয়াও লাগিয়েছিলেন জাস্টিন ট্রুডো। কৃতিত্বে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন অনেক কিছুতেই। তিনি পাল্টে দেন মন্ত্রীসভার গতানুগতিক চেহারা। মন্ত্রী সভায় তিনি যাঁদের ডেকে নেন তাদের অর্ধেকই মহিলা এবং এথনিক কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত বেশ কয়েকজনও ঠাঁই পান তার মন্ত্রী সভায়। এদের কেউ কেউ পান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।

কিন্তু দিনে দিনে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এর মধ্যে অবশ্য গোটা পৃথিবী অভাবনীয় এক ঘটনার সাক্ষী হয়। সেটি হলো কভিড-১৯ বা করোনা মহামারি। গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি এক বড় রকমের ধাক্কা খায় সেই মহামারির কারণে। অর্থনীতিতে দেখা দেয় মহামন্দা। সেই মহামন্দার ধাক্কা খায় কানাডাও। তবে জাস্টিন ট্রুডো সেই যাত্রায় দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যান। সে কারণে কানাডিয়ানরা তাকে সেরা নেতা হিসেবে বিবেচনা করছিলেন তখন। দি কানাডিয়ান প্রেস-এ তখন এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল। জরিপে অংশ নেওয়া ভোটাররা তখন ট্রুডোকে বেশ বড় ব্যবধানে অন্যতম দৃঢ়সংকল্প, বুদ্ধিদীপ্ত ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা এবং সবচেয়ে সেরা যোগাযোগকারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে বর্ণনা করেন। তাকে তখন দেখা হয় অন্যতম যত্নশীল এবং দরদি মানুষ হিসাবেও।

তবে রাজনীতি বড়ই বিচিত্র জিনিস। সেই দৃঢ়সংকল্প, বুদ্ধিদীপ্ত, ক্যারিশম্যাটিক ও দরদি মানুষটা এখন আর বেশির ভাগ কানাডিয়ানের পছন্দের তালিকায় নেই।

জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা এখন অনেকটাই অনুজ্জ্বল। গত নির্বাচনেও ট্রুডো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পরবর্তীতে নির্ভর করতে হয়েছিল তৃতীয় অবস্থানে থাকা বিরোধী দল এনডিপি’র উপর।

গত বছর অক্টোবরে প্রকাশিত এক জরিপেও দেখা গেছে, কানাডিয়ানরা মনে করছেন, ট্রুডো হলেন গত ৫৫ বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে কম পছন্দের প্রধানমন্ত্রী। রিসার্চ কো. নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জনমত জরিপে এমনটাই জানা গেছে।

তবে জরিপ রিপোর্ট যাই বলুক, ট্রুডোর দাবি ছিল তিনি দেশটিকে সঠিক পথেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তার দলের ভিতরই কেউ কেউ তখন বলছিলেন এখন সময় এসেছে তার সরে দাঁড়ানোর। এদের মধ্যে কয়েকজন দলীয় এমপিও আছেন। কিন্তু ট্রুডোর সাফ কথা ছিল, তিনি নিজে নিজে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন না।

তবে শেষ পর্যন্ত তিনি তার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। দলের নতুন নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেবেন তিনি।

কানাডার রাজনীতিবিষয়ক সাংবাদিক এবং ‘জাস্টিন ট্রুডো অন দ্য রোপস’-এর লেখক পল ওয়েলস সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন ‘একজন ফলপ্রসূ’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রুডো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন, জলবায়ু নীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে জন্য তাঁকে স্মরণ করা হবে। কিন্তু তিনি আবার এমন একজন মানুষও, যিনি ক্রমশ জনমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলেন না।

খুব সম্প্রতি দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতিকে কেন্দ্র করে বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন ট্রুডো। ওয়েলস মনে করেন, বড় বড় প্রতিশ্রুতি পূরণ না করতে পারা নিয়ে ট্রুডোর প্রতি জনগণের হতাশা আছে। অভিবাসনের মতো বিষয়গুলো সামাল না দিতে পারা নিয়েও তাদের হতাশা আছে।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর কানাডার ফেডারেল পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে উত্থাপন করা হয়েছিল এক অনাস্থা প্রস্তাব। কিন্তু ঐ যাত্রায় বেচে যান তিনি। কারণ অপর দুই বিরোধী দল এনডিপি ও Bloc Québécois এই অনাস্থা প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানায়নি। অনাস্থা প্রস্তাব পরেও আনা হয়েছি কয়েকটি। কিন্তু সেগুলোও টিকেনি। 

এদিকে বিভিন্ন জরিপ বলছে, এই সময়ে যদি কানাডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তবে লিবারেল পার্টির প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভরাডুবি ঘটবে। আর বিপুল ভোটে জয়ী হবেন প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান ও বিরোধী দলীয় নেতা পিয়েরে পোইলিয়েভ। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারবেন তিনি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন জরিপ ফলাফলের গড় রিপোর্টে এমন ভবিষ্যদ্বাণীই করা হচ্ছে। রিপোর্ট সিবিসি নিউজ এর।

গত বছর সেপ্টেম্বরে ট্রুডোর ক্ষমতা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ওই সময় আইন পাসের ক্ষেত্রে লিবারেলদের প্রয়োজনীয় সমর্থন দেওয়ার নিশ্চয়তা থেকে সরে আসে জাগমিত সিং এর নেতৃত্বাধীন নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি।

এরপর গত ডিসেম্বরে উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড আচমকা পদত্যাগ করেন। এটি ছিল ট্রুডো সরকারের জন্য এক বড় ধাক্কা। কারণ, ক্রিস্টিয়া ছিলেন ট্রুডোর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহযোগীদের একজন। তিনি ট্রুডোর দেওয়া ব্যয়বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করার পর তাঁর বিরাগভাজন হয়ে পড়েন।

ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করে যে চিঠি লেখেন, তাতে অভিযোগ করা হয়, ট্রুডো দেশের জন্য ভালো কিছু করার দিকে মনোযোগ না দিয়ে ‘রাজনৈতিক ছলচাতুরী’র আশ্রয় নিচ্ছেন।

এখন অপেক্ষার পালা লিবারেল পার্টির পরবর্তী নেতা কে নির্বাচিত হন তা দেখার জন্য। ফ্রন্টরানার হিসাবে আছেন ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ও ব্যাংক অফ কানাডার সাবেক গভর্নর মার্ক কার্নি।

তবে দলনেতার দৌড়ে যেই জিতুক, আগামী জাতীয় নির্বাচনে লিবারেল পার্টির অবস্থান খুব সুবিধার হবে এমনটা মনে হচ্ছে না। কারণ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে পিয়ের পলিয়েভের নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টি জনপ্রিয়তার দিক থেকে অনেক এগিয়ে আছে। তবে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি। এখন অপেক্ষার পালা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *