আমাদের ছোট্র গ্রাম
নজরুল ইসলাম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমাদের বাংলাদেশ শিক্ষায়, শিল্পে ,ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক এগিয়েছে। এই দেশ গত কয়েক বৎসরে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে, যার ফলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। দেশে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প ,মেট্রো রেল ও পরিবহন ব্যবস্থার অভুত উন্নতি হয়েছে।
২
এক সময় বিদেশীরা বাংলাদেশকে “তলাবিহীন ঝুড়ি” বলে বিদ্রুপ করতো এবং এ থেকে আজ বেরিয়ে দ্রুত (miracle development) অলৌকিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এইতো বেশিদিন আগে নয়, গ্রামে মাটির, ছনের বা টিনের দোচালা কি চার চালা ঘর দেখা যেত। এলাকাতে পুরানো যুগের জমিদার বা প্রতাফশালী লোকদের ভাঙা দালান নজরে পড়তো। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে আজকাল মাটির বা ছনের ঘর নজরে পড়ে না; এমন কি আজকাল কেউ টিনের ঘরও করতে অনাগ্রহী। প্রতি গ্রামে নজরে পড়ে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে রুচির পরিবর্তন ও হয়েছে। সে যুগে ভাঙা রাস্তা দিয়ে গাড়ি থাক দূরের কথা, রিক্সায়ও যাতায়াত করা যেত না। রাতে রাস্তায় সাপ দেখা যেত, চলাফেরায় অসাবধান হলে সাপের দংশনে মানুষ মারা যেত। গ্রামে ছোট ছোট খাল, বাঁশের বা কাঠের সেতু; সুদূর কানাডা থেকে দেশে যাবো; জুতা,প্যান্ট শার্ট পড়ে গ্রামে যেতে পারবো তো? খালের উপর সরু বাঁশ বা কাঠের সেতু ; স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি যেতে পারবো? বিদেশ থেকে দেশে যাওয়ার পূর্বে এ সব ও ভাবতে হতো ; আজকাল এ সব ভাবনায় আসে না। আজকাল ভাঙা কাঁচা রাস্তার পরিবর্তে পাক্কা রাস্তা হয়েছে এবং প্রতিটি বাড়িতে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। প্রতিটি গ্রামে চলাচলের জন্য রিক্সা বা CNG, প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করা যায় ; আবার অনেকে শহর থেকে গাড়ি নিয়ে গ্রামে নিজেদের ইচ্ছানুসারে থেকে বেড়িয়ে আসে। আজকাল অনেকে শহরে না থেকে গ্রামে খোলামেলা সুন্দর পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে; গ্রামে পুকুর কেটে মাছের চাষ এবং সুন্দর দালান ও ফুল ও ফলের বাগান নজরে পড়ে।

৩
আমাদের পরিশ্রমী ছেলেমেয়েরা দেশ বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে টাকা পাঠায় এবং এই পরিশ্রমের টাকা দিয়ে মা-বাবা,আত্মীয়স্বজন গ্রামে ও শহরে সুন্দর সুন্দর রুচিশীল বাড়িঘর করেছে। দেশে না গেলে এই পরিবর্তন ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় না। আমি অনেক দিন পর পর দেশে যাই বলে এই পরিবর্তন বেশি বেশি লক্ষ্য করি।
৪
আজকাল গ্রামে ভিক্ষুক খুঁজে পাওয়া যায় না; আর্থিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ সব উঠে গেছে। তবে শহরে ফকির গিয়ে জড়ো হয়েছে , ঢাকা শহরে ফকির দেখা যায়। গ্রামে অনেক লোক এত গরিব ছিল যারা পরের নিকট হাত পেতে সাহায্য নিতে ইতঃস্ত করতো না ; আজকাল তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে বা দেশে কাজ করে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করেছে, এটা সত্যি গর্বের বিষয়।
৫
দেশে কিছু দিনের জন্য গিয়েছিলাম : আমার মা-বাবা এবং চাচা জেঠাদের মধ্যে আব্দুল মজিদ, আব্দুল আজিজ ছিলেন আমার অতি পছন্দের মানুষ। বাড়ির কথা মনে পড়তেই এদের ছবি আমার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে। গ্রামে যাদের সঙ্গে ছোট সময়ে বেড়ে উঠা, হাঁসি ঠাট্টা,গল্প করে সময় অতিবাহিত করেছি, তাদের প্রায় সবাই নাফেরার দেশে চলে গেছেন। যেখানেই গিয়েছি নতুন প্রজন্মদের সঙ্গে দেখা হয়েছে; এরা কেন জানি আমার সঙ্গে ততটা ঘনিষ্ঠ হতে পারে না, গত ৪০ বৎসরে আমি অনেক আপনজন হারিয়েছি, তাছাড়া নতুনদের কাছ থেকে ও দূরে সরে পড়েছি।
৬
আজকাল গ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে ; কেউ আগের দিনের মতো শুধু লাঙ্গল, গরু নিয়ে মাঠে গিয়ে ধান, পাট চাষ করে না। সে যুগে লোকজন নুতন নিয়মে চাষাবাদ করতে জানতো না বা সুযোগ ছিল না। আজকাল জমিতে কয়েকবার ফসল ফলানো হয়, তাছাড়া পুকুরে, খালে মাছের চাষ করে কৃষক লাভবান হচ্ছে। যেখানে পানি, সেখানেই মাছের চাষ করা হচ্ছে। গ্রামে বা শহরে যেখানে সেখানে মাছ ,তরিতরকারি বা ফলফলাদি কিনতে পাওয়া যায়। শহরে বা গ্রামে বা চলাচলের রাস্তার পাশে নানা জাতীয় ফলের দোকান নজরে পড়ে। মনে হয় অচিরেই গ্রামগুলি ও শহর হয়ে যাবে।
আমাদের সে যুগে নির্দিষ্ট দিনে হাঁটে বাজারে গেলে মাছ মাংস বা তরিতরকারি কিনতে পাওয়া যেত বা পুকুর থেকে মাছ ধরে নিজেরা বা মেহমানদারী করা হতো। আজকাল গ্রামে ও ফেরিওয়ালা বা মাছ ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি মাছ, তরিতরকারি বা ফলফলাদি বিক্রি করে। এখন আর বাজারে না গিয়েও বাড়িতে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনতে পাওয়া যায়। সুযোগ সুবিধার দিক থেকে গ্রামগুলি শহরের মতো হয়ে উঠছে।
৭
সে যুগে গ্রামের খাল দিয়ে বরযাত্রী বা কেউ কলের গান বা গ্রামোফোন (gramophone) বাজিয়ে গেলে আমরা বাড়ির ছেলেমেয়ে বা বয়স্করা গান শুনতে ঘর থেকে বের হয়ে আসতাম আর ভাবতাম যদি আর একটু শুনতে পারতাম। “মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না…” আরও কত ভাটিয়ালি,পল্লী বা আধুনিক গান! সারা গ্রামেও একটা রেডিও খুঁজে পাওয়া যেত না। কেউ হয়তো বিদেশ থেকে রেডিও নিয়ে আসলে লোকজন ভিড় জমিয়ে গান বা খবর শুনতো। গ্রামে বাজারে চায়ের দোকানে গেলে গান শুনে বা খবর শুনে তুষ্ট হতাম। আজকাল ঘরে ঘরে টেলিভশন, তাছাড়া সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন; গান শুনা, খবর শুনা কোনো ব্যাপারই না।
সে যুগে চিঠিপত্র লিখে প্রিয়জনের খবর নেয়া হতো ; এ যুগে মোবাইল ফোন ইমো, হোয়াটস্যাপ এক সেকেন্ডে খবর নেয়া যায়। বিদেশ থেকে চিঠি দেয়া হলে মাসের পর মাস চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় থাকতে হতো; পোস্ট অফিস গিয়ে ধর্ণা দেয়া হতো চিঠি বা মানি অর্ডারের খোঁজে। আপনজনের একটা চিঠি আসলে কত আনন্দ !
৮
সে যুগে মা চাচীরা বা দাদীরা খড়কুটা, শুকনো পাতা, কাঠ, পাটখড়ি দিয়ে মাটির চুলায় রান্না করতো। গ্রামে গঞ্জে মা চাচিদের রান্নার কত কষ্ট, ধুঁয়ায় নাকের পানি, চোখের পানি এক করে রান্না করা কত কষ্ট, সে না দেখলে বুঝানো যাবে না। এ যুগে গ্রামে ঘরে ঘরে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে। তাছাড়া রান্না করা ভাত, মাছ তরকারি সব নষ্ট হয়ে যেত ; পুরানো খাবার চুলাতে গরম করে খাওয়া হতো; শহরে সরকারি চাকুরী জীবিরা বিদেশে ট্রেনিং নিতে গেলে রেডিও, টেলিভশন বা ফ্রীজ নিয়ে আসতো; তাও কত পার্সেন্ট লোক এ সুযোগ পেতো ? এ যুগে ঘরে ফ্রীজে খাওয়া রাখা হয় ; কোনো কিছুই নষ্ট হয় না। এক বেলা রান্না করে কয়েকদিন খাওয়া যায়। সে জন্য বলছি দেশে উন্নতির জোয়ার এসেছে। আজকাল গ্রামেও কারো কারো বাড়িতে গ্যাসের লাইন গিয়েছে; মহিলাদের আর রান্নার ভোগান্তি হয় না। অগ্রহায়ণ -পৌষ মাসে ধান কাটা শেষ হলে কৃষক জমি থেকে খড় এনে বাড়িতে সারা বৎসরের জন্য জমা করে রাখতো রান্নার জন্য। এ ছাড়াও ঝাড়ু নিয়ে গাছের শুকনা পাতা কুড়িয়ে এনে রান্না করতে কত দেখেছি। প্রতিটি বাড়িতেই পাটখড়ি জমা করা হতো রান্নার জন্য।
৯
আমাদের সে যুগে প্রতি উপজেলায় ৩-৪টি গ্রাম মিলে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। শুস্ক মৌসুমে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হলে ও বর্ষার মৌসুমে নৌকা ব্যাতিত যাওয়া যেত না; কি যে কষ্ট করে স্কুলে গিয়েছি, সে আর কি বলবো। প্রতি উপজেলায় ৩-৪টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। আমরা যারা পড়াশুনায় আগ্রহী,শুধু তারাই ভর্তি হতাম; মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে গিয়ে বা কারো বাড়িতে ছাত্র/ছাত্রী পড়াশুনা করানোর বিনিময়ে থাকা খাওয়া ব্যবস্থা করেছি। বর্ষার দিনে নৌকা ব্যতীত যাওয়া যেত না। মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার জন্য আর পড়াশুনা করতে পারতো না। আজকাল গ্রামে রাস্তা ঘাট, রিক্সা, ছেলেমেয়েদের আনা -নেয়ার জন্য টেম্পু গাড়ি আছে এবং প্রতিটি উপজেলায় ৫-৭টা কলেজ এবং টেকনিকাল স্কুল হয়েছে। তাছাড়া গ্রামে ইংলিশ মিডিয়াম (কিন্ডার গার্টেন) স্কুল হয়েছে যেখানে গ্রামের মা-বাবা পয়সা খরচ করে, এমন কি টিউটর রেখে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করায়। সে যুগে গ্রামে ১% মেয়েরাও পড়াশুনা করতে পারতো না; এ যুগে সব মেয়েরাই পড়াশুনা এবং হাতে মোবাইল নিয়ে ঘুরে। কি সব আজগুবি ফেসবুকের দুনিয়া এসেছে -ফেসবুকে বন্ধু খুঁজে বেড়ায়।
১৯৬৩ সনে আমি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে বাড়ি থেকে ২৫ মাইল দূরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে কুমিল্লা/ত্রিপুরা বর্ডারের নিকট থাকার ব্যবস্থা করেছি। পায়ে হেঁটে কলেজে আসা যাওয়া, গোমতী নদীর খেয়া পার হতে দৈনিক ৮ পয়সা বা দুই আনা খরচ করতেও অনেক কষ্ট হতো। আজকাল ছেলে মেয়েরা সুদূর পাড়াগাঁয়ে নিজের বাড়িতে থেকে কলেজে বা টেকনিকাল স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা করতে পারে।
১০
সে যুগে গরিব/ ধনীর মধ্যে একটা ব্যবধান ছিল ; জমিদার, চৌধুরী তালুকদার, যাদের জমিজমা বেশি ছিল ওরাই গ্রামে কুলীন লোক বলে গণ্য করা হতো। ১৯৫৪ সনে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হওয়ার ফলে,“লাঙ্গল যার জমি তার” এই আইন চালু হয়; যার ফলে কৃষক সরাসরি জমির মালিক হয়। আজকাল অতি সাধারণ মানুষ বা ওদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে; যার ফলে সামাজিক ব্যবধান হ্রাস পেয়েছে।
১১
বাঙ্গালীরা আবেগে প্রবণ : অনেক সময় আমাদের বাঙ্গালীরা অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিয়ে বিচার বিবেচনা না করে কাজ করে। একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি; আমরা ছোটকাল থেকে দেখে আসছি, অনেকগুলি পরিবার এক বাড়িতে বাস করতো, যাদের ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ এবং গোয়াল ভরা গরু। আজকাল অনেকেই আলাদা আলাদা পুকুর কেটে বাড়ি করেছে। গ্রামে প্রতিটি বাড়ির চারিদিকে খাল দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা ছিল। আজকাল দেশে গেলে এই খাল আর খুঁজে পাওয়া যায় না ; সব খাল খন্দক ভরাট করে যার যেভাবে খুশি বাড়ি করে ফেলেছে। এমন কি যে সব জমিতে ভালো ফসল হতো এবং সারা বৎসরের ফসল ফলানো হতো তা যার যেভাবে খুশি পুকুর কেটে পুরাতন বাড়িতে না থেকে নতুন বাড়ি করে পুকুরে মাছের চাষ করে ফলফলাদির গাছ লাগিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। গ্রামে প্রতিটি ঘরে কেউ না কেউ মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য কোনো দেশে থেকে কাজ করে টাকা পাঠায়। কারো বাড়িতেই পূর্বের ন্যায় গরু ছাগল দেখা যায় না, গোয়াল শূন্য। আগের দিনে গ্রামে হাঁটে বাজারে খাঁটি গরু দুধ পাওয়া যেত, আজকাল গাভী নাই, তাই দুধ নাই, পাউডার দুধ বা ডেইরি ফার্মের, তাও সর্বত্র পাওয়া যায় না। একটা গ্রামে আমাদের ছোট সময়ে ৭-৮টা বাড়ি ছিল যা আজকাল ১৫-১৬টা বাড়ি হয়েছে। সবাই যার যেভাবে খুশি খাস জমি,খাল ভরাট বা নিজের জমি কেটে বাড়ি করে ফেলতেছে। দেশে অপরাধ ও অনেক বেড়েছে ; জোর জবরদস্তি করে লোকজনের জমি দখল নিচ্ছে। দুর্বল লোকেরা মামলা করেও কোনো ফল পাচ্ছে না ; বৎসরের পর বৎসর মামলা ঝুলতে থাকে।
করিম, রাহিম বা জব্বার সাহেবের নতুন বাড়ি থাকলে আমার থাকবে না কেন ? গ্রামে প্রায়ই পুরানো বাড়ি খালি পড়ে আছে। এর পরিণতি কি ? সমগ্র দেশের লোকসংখ্যা ১৭-১৮কোটি, এক থেকে দেড় কোটি বিদেশে থাকে। বিদেশ থেকে টাকা পাঠায় এবং যার যেখানে খুশি দালান করে ফেলতেছে এবং এটাকে যদি উন্নতি বলা হয়, আমার কিছুই বলার নেই; লোকসংখ্যার অনুযায়ী দেশ অনেক ছোট; হিসাব করে জমি নষ্ট করতে হবে। টাকা পয়সা থাকলেই মন চাইলে একটা নতুন বাড়ি, নতুন পুকুর করে মাছের চাষ করতে হবে। আমরা ছেলেরা সে যুগে মাঠে খাস জমিতে খেলাধুলা করতাম, বাড়ির বাইরে খালে নৌকা রাখা হতো, নৌকা নিয়ে হাঁটে বাজারে বা এখানে সেখানে বেড়াতাম। সে সব খাস জমি বা খাল গেলো কোথায়? সবাই যার যে ভাবে খুশি দখল করতেছে। এ সব দেখাশুনা করার জন্য দেশে কি কোনো আইন কানুন নেই বা থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই ?
১২
আমার কেন জানি পুরানো দিনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে; সেই ছনের ঘর , মাটির বা টিনের ঘর; বৃষ্টি বা একটু ঝড় শুরু হলেই বিপদ,কখন চালা উড়িয়ে নিয়ে যাবে, ঘরে টুপ্ টুপ্ করে বৃষ্টির পানি পড়বে। ঘর উড়িয়ে নিয়ে যাবে সেই ভয়ে “আল্লাহুআকবার” ধ্বনি দিয়ে আজান দেয়া, ঝড় থামলে আম কুড়ানের ধুম, কাঁচা আর পাকা আম আলাদা করে চোকির নিচে রেখে দেয়া। বেশি জোরে বৃষ্টি হলে, পুকুর আর খাল থেকে কই বা টাকি মাছ লাফিয়ে উপরে উঠার দৃশ্য। এক পয়সা, দুই পয়সা জমিয়ে মুরুলী, বাদাম খাওয়া অথবা বায়োস্কোপ দেখা, ওই দিনগুলি অনেক সুন্দর ছিল। কোথায় গেলো সে সব খেলার সাথীরা যাদের সঙ্গে ছিল অন্তরঙ্গতা।
আমাদের ছোট্ট গ্রাম-পর্ব ৭
মিরপুর ১, ঢাকা থেকে সদর ঘাট গিয়ে বরাবরের মতো লঞ্চে- নদীর দুই পাড়ে গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে চাঁদপুর যাবো; রাতে চাঁদপুর আত্মীয় বাড়ি থাকবো, এই আমার পরিকল্পনা। আমার এক আত্মীয় বলেন, দিনের একটা বাজে, রাস্তার এই যানজটের মধ্যে আপনি একা একা সদরঘাট যেতে পারবেন তো? আমি বললাম, কি যে বলেন ? আমার জীবনের একটা বড়ো অংশ তো ঢাকা শহরেই কাটিয়েছি। সে বলে, সে তো বহুদিন আগের কথা, তখনকার ঢাকা শহর এবং আজকের ঢাকা শহর তো এক নয়। আমি বললাম, ১৯৬৫ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত আমি তো ঢাকা শহরেই থাকতাম; পড়াশুনা শেষ করে কাজ করতাম মতিঝিল; ঢাকা শহরে হাঁটতে ভালো লাগতো, তাছাড়া অধিকাংশ সময় পকেট খালি থাকতো যে জন্য পায়ে হেঁটেই আসা-যাওয়া করতাম। বিকেলে অফিস করে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কের দিকে আসলেই জোড়ায় জোড়ায় কলেজ, উনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েদের নজরে পড়তো; কেউবা পড়াশুনা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে, কেউবা গল্প, প্রেমালাপ; ফেরিওয়ালার কাছ থেকে বাদাম নিয়ে খোসা ফেলছে; সে সময় রেসকোর্স ছিল ফাঁকা, এত এত গাছপালা ছিল না, বিকেলে ঘোড় দৌড়, শাহবাগের মোড়ে সন্ধ্যা হলেই গাঁজার আড্ডা বসতো। দুই দিকে দৃশ্য দেখতে দেখতে রেসকোর্স পার হয়ে TSC তে গিয়ে খোঁজ নিতাম, কোনো প্রোগ্রাম থাকলে ভিতরে ঢুকে পড়তাম; নতুবা লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম, এক ফাঁকে বের হয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিছু নিয়ে খেয়ে নিতাম ।
সে পুনরায় বলে ১৯৬৫ -১৯৮২ আর বর্তমান ঢাকা শহর তো এক না। তা ঠিকই বলছেন। চলেন আপনাকে একটা CNG ভাড়া করে দেই; মিরপুর -১ রাস্তার পাশে গিয়ে দুইজনে দাঁড়ালাম। রাস্তায় এত ভিড় যে কোনো খালি CNG পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিপূর্বে উবার কল দিয়ে ও ব্যর্থ হয়েছি, এক ঘন্টার মতো অপেক্ষা করে একটা CNG পাওয়া গেলো, ওনাকে বিদায় দিয়ে CNG তে উঠে বসলাম। দুপুরের দিকে রাস্তা এত ভিড়; রাস্তায় গাড়ি, বাস, রিক্সা পিঁপড়ার মতো গতিতে থেমে থেমে চলছে। মিরপুর -১ থেকে শ্যামলী পর্যন্ত আসতেই এক ঘন্টার মতো লেগেছে যা পায়ে হেঁটে ৩০-৪০ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না। ড্রাইভার একটু ফাঁক পেলেই দুই গাড়ির মাঝখানে বা এঁকেবেঁকে এগুতে চেষ্টা করে। আমি বলি তুমি যেভাবে চালাচ্ছো, এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সে বলে,“একটু ঝুঁকি না নিলে তো আমি সারা দিনেও সদরঘাট যেতে পারবো না।” আমি চুপ করে থাকলাম ; সে ফাঁকফুক খুঁজে busy রাস্তা থেকে শ্যামলীর ভিতর সরু রাস্তা দিয়ে কোথায় যাচ্ছে? দু/একবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি রাস্তা চিনো কি ? সে কিছুই বলছে না। আমি ধৈর্য ধরে চুপ করে থাকা ব্যতীত আর কি করতে পারি ? এলাকার ভিতরের রাস্তা ও এত busy কোনো ক্রমেই এগুতে পারছে না। সে একটু রাস্তার ভিড় দেখে ডানে-বামে একে-বেঁকে এগুচ্ছে ।
এক মহিলা তার স্কুলের বাচ্চা নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে ; ড্রাইভার যেভাবে বেপরোয়া চালাচ্ছে, অল্পের জন্য মহিলা ও তার বাচ্চা বেঁচে গেছে এবং রাস্তার লোকজন মারমূখী হয়ে CNG ঘেরাও দিয়েছে। আমি অগত্যা নেমে অনুরোধ করে ওদের থামিয়ে দিয়ে বলি “তুমি সাবধানে চালাবে; তুমিতো আমাকেও বিপদে ফেলেছিলে। “CNG কোত্থেকে কোথায়, কিভাবে যাচ্ছে ,আমি অধর্য্য হয়েই বা কি করতে পারি। এখানকার রাস্তাঘাট আমি কিছুই চিনি না, এক পর্যায়ে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। সে ধানমন্ডি, কলাবাগান, এলিফ্যান্ট রোড পার হয়ে সেগুন বাগিচা, আব্দুল গনি রোড ধরে নবাবপুর হয়ে সদর ঘাট টার্মিনালে বিকেল ৫টা বাজে আমাকে পৌঁছে দিয়ে বলে এবার নামেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, বললাম, তোমাকে ধন্যবাদ জানাই, তবে সাবধানে গাড়ি চালাবে।
মনে মনে ভাবছি,বৃহত্তর ঢাকা শহরের লোক সংখ্যা কাগজে কলমে কত? তবে লোকমুখে শুনা যায় দুই কোটি বা তার ও বেশি। কাজেই সে অনুপাতে ব্যবসাবাণিজ্য এবং যানবাহন বেড়েছে। রাস্তায় গেলে দামি দামি গাড়ি নজরে পড়ে যা কানাডায়ও অনেকে ব্যবহার করতে সক্ষম না; ঢাকাতে আত্মীয়স্বজনের অনেকেই গাড়ি কিনতে আগ্রহী, প্রতিটি বিল্ডিং এর নিচে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। সারা দেশে এই একটিমাত্র শহর যেখানে রোজগারের জন্য লোকের অত্যধিক ভিড়।
২
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উচ্চ অর্থনৈতিক রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ঢাকা শহরে যে হারে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ,তার সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। যে হারে দেশের দূরদূরান্ত থেকে লোকজন রোজগারের নিমিত্তে এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে,তার সমাধান কি ?
ক ) ঢাকা থেকে শিল্প,অফিস আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে এখানকার যানজট হ্রাস পেতে পারে। খ) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প নগরী গড়ে তুলা যেতে পারে।
গ) উপজেলা শহরগুলিকে শিল্পে, কারিগরি শিক্ষায় এগিয়ে নেয়া হলে, গ্রামাঞ্চলগুলি নুতন প্রাণ পাবে; এবং লোকজনের কর্মসংস্থান বাড়বে, বড়ো বড়ো শহরগুলিতে জনসংখ্যার চাপ হ্রাস পাবে। লক্ষ লক্ষ হতদরিদ্র লোক কাজের অন্নেষণে ঢাকা এসে ভিড় জমাচ্ছে ; কিছু না কিছু করে জীবিকা অর্জন করে বেঁচে আছে। এই জনগণের দিকে তাকিয়ে বিকল্প কিছু বের করতে হবে; ঢাকা বৃহত্তর শহরের সুন্দর পরবিবেশ ও ধরে রাখার দায়িত্ব সরকার এবং জনগণের উপর ।
(চলবে)
নজরুল ইসলাম
টরন্টো