নিভৃতে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রীনা গুলশান
৮
জীবন এভাবেই চলে যায় জীবনের মত। একদিন ফাবিয়ানের স্কুলে যাবার সময় আসে। ফাবিয়ান প্রথম স্কুলে যায়। মা আর নানী আবার কাঁদে দুঃখে এবং আনন্দে। তাদের ফাবি এত বড় হয়েছে। দেখতে দেখতে কখন ফাবিয়ান চার বছরের হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ‘বিউটি পার্লারের’ সারার অত্যন্ত সুনাম হয়েছে। খুব দক্ষতার সাথে সে তার কাজ করছে।
তার বস জেনেলিয়া গ্যালাটি খুবই বদরাগী ধরনের মহিলা। কিন্তু মহিলা মানুষ হিসাবে অত্যন্ত ভালো। পঞ্চাশোত্তর বয়স। তবুও দেখলে তিরিশের মত মনে হয়। খুবই কর্মঠ। মহিলা বিধবা। একটি ছেলে একটি মেয়ে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ২ বাচ্চা নিয়ে বিধবা হয়েছে। আর বিবাহ করেনি। ছেলেমেয়ে মানুষ করছে। মেয়ে বিয়ে করে সুইডেনে চলে গেছে। একমাত্র ছেলে ৩১ বৎসরের। স্টিভেন গ্যালাটি খুব হ্যান্ডসাম না হলেও খুউব বুদ্ধিমান। মাকে সাহায্য করার পাশাপাশি নিজের চাকুরিও করে। স্টিভেন একজন অটোমোবাইল টেকনিশিয়ান। একটা অটোমোবাইল কোম্পানিতে চাকুরী করে। ছোটখাটো ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা। তবে স্লিম এবং সুন্দর স্বাস্থ্য। গায়ের রঙ পাকা গমের মত। কিছুটা ট্যান। চোখ ছোট ছোট হালকা বাদামী রঙের। মায়ের মত খুবই কর্মঠ। নিজের চাকুরী থেকে সরাসরি পার্লারে চলে আসে। পার্লারটি বেশ বড় সড়। মোটামুটি সারভিস পারসন এবং সেলস পারসন মিলে ২৫ থেকে ৩০ জন কাজ করে। ক্লায়েন্ট এবং এমপ্লয়িস কারো কাছেই কোন খারাপ রেপুটেশন নাই। ছেলে আবার খুবই মজার। মাকে আবার বিয়ে করবার কথা বলে। জেনিলিয়া হাসে, বলে-
: আমি ভালো আছি। পার্লারই আমার দ্বিতীয় হাসবেন্ড। তুই কার জন্য বসে আছিস? তুইতো বুড়ো হয়ে যাচ্ছিস, তোর তো কোন গার্লফ্রেন্ডও নেইরে?
: আমার গার্লফ্রেন্ড এর কোন দরকার নাই। ওরা লাইফটা হেল করে দেয়। এই বেশ আছি।
: তাই নাকি? দেখা যাক!
হ্যাঁ, দেখা গেল স্টিভেন আস্তে আস্তে পার্লারে থাকবার সময় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এবং প্রায়ই সারাকে ড্রপ করার কথা বলে। পার্লারের সবাই মিটিমিটি হাসে। সারা খুবই অস্বস্তি বোধ করে। এরই মধ্যে সারার এক ছুটির দিনে হঠাৎ করে জেনেলিয়া এবং স্টিভেন সারাদের বাড়ীতে এসে হাজির। সারার মা আমান্ডা দারুণ অপ্রস্তুত। সারাও দারুণ উদ্বেগ বোধ করে। তবু মার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফাবিয়ানকে ডেকে আলাপ করিয়ে দেয়। মা, ছেলে দুজনই ফাবিয়ানকে খুউব আদর করে। স্টিভেন, ফাবিয়ানের হাতে বড় একটা ক্যান্ডির বক্স দেয়। তারপর জেনেলিয়া যেন কৈফিয়ত দিল-
: সারা, সরি- তোমাদের অপ্রস্তুত করলাম নাতো?
: না, না, কি যে বলেন- আমারতো খুব ভালো লাগছে আপনারা এসেছেন বলে।
: তোমার ছেলেটিতো খুউব সুন্দর! তা বয়স কত হলো?
: এইতো এখন ৫ বছর চলছে।
: ওহ্ তাই।
এদিকে আমান্ডা ‘সরি’ বলে উঠে যায়।
এবং রীতিমতো খুব ভালো করেই ডিনারের আয়োজন করে। ওরাতো খুবই বিড়ম্বনায় পড়লো। জেনেলিয়া বললো-
: ওমা! এতো আয়োজন কখন করলেন?
জেনেলিয়া খুবই বিস্ময় প্রকাশ করে-
: না, না এত আর এমন কি? আমান্ডা খুবই বিনীতভাবে বলে-
: মিটবলের পাস্তাটা তো দারুণ হয়েছে।
স্টিভেন খুব আনন্দ সহকারে বলে।
সারা বলল-
: হ্যাঁ, এটা মা সত্যিই খুব ভালো বানায়। আমার বাবাও খুব ভালোবাসতো। আবার ফাবিয়ানও খুব ভালোবাসে।
: আচ্ছা, তা কিসের মিট এটা, বিফ নাকি? জেনেলিয়া জিজ্ঞেস করলো-
: না, এটা টার্কির কিমা দিয়ে করেছি। কিমাও আমি নিজেই বানিয়েছি।
সবশেষে ওদের রেড ওয়াইন দিল আমান্ডা। জেনেলিয়া আবারও বিস্ময় প্রকাশ করলো রেড ওয়াইনের টেস্ট নিয়ে-
: দারুণ টেস্ট তো ওয়াইনটা।
: হ্যাঁ, এটাও আমি নিজেই বানিয়েছি।
আমান্ডা বললো- আমি সারা বছরের রেড ওয়াইন বানিয়ে রাখি। টম্যাটো সস ও সমস্ত বছরেরটা ঘরেই বানিয়ে রাখি।
: ওমা, তাই নাকি? সত্যিই অপূর্ব।
রাত ন’টার মত বেজে গেল। অতপর মা, ছেলে উঠলো। আর যাবার আগে আমান্ডা তাদেরকে ২ বোতল রেড ওয়াইন এবং বড় এক বোতল তার হাতে বানানো টম্যাটো কেচাপ উপহার দিল ওদের। জেনেলিয়া এবং স্টিভেনতো একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল ওদের আকস্মিক আতিথেয়তায়।
ওদের যাবার পর সারাতো খুবই বিস্মিত হলো। আমান্ডা কিন্তু একটুও বিস্মিত হয় নাই। আমান্ডা খুউব পুলকিত। সে তার উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলো না-
: বুঝলি মা সারা, ওরা আসলে তোর ঘরবাড়ি অর্থাৎ তুই কোথায় থাকিস ইত্যাদি দেখতে এসেছিল। তাছাড়া ফাবিয়ানকেও মনে হয় দেখতে এসেছিল।
: হু! তাইতো মনে হলো।
: তোকে কিছু বলেছে নাকি ওরা?
: কি ব্যাপারে মা?
: না, মানে আমার মনে হয় জেনেলিয়া ম্যাডাম আর স্টিভেন তোকে পছন্দ করেছে।
: উম! জানি না, সারা লাল হয়। আর অনেক দিন পর আমান্ডা খুবই স্বস্তি এবং আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে যায়। কিন্তু সারা ঘুমাতে পারে না। সবাই ঘুমিয়ে গেলে সারা বাড়ির পেছনে তার প্রিয় জলপাই গাছের তলায় আসে। তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। একটা জ্বলজ্বলে তারাকে মনে হয় ওর বাবা, আলবার্ট। সারা চুপিচুপি কাঁদে, কথা বলে-
: বাবা, তুমি কোথায়? আই মিস ইউ ভেরি মাচ। আমি জানি স্টিভেন আমাকে অনেক পছন্দ করে। অনেকভাবে আমাকে বুঝিয়েছে। কিন্তু আমি ভয় পাই বাবা। আমার আবার ভালোবাসাতে খুব ভয় হয়। বিয়ে করতে ভয় পাই। আমি যে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না বাবা। তছাড়া আমি যদি স্টিভেনকে বিয়ে করি, আমার ফাবিয়ানের কি হবে?
সারা দিশেহারা হয়। একদিকে স্টিভেনকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। কারণ স্টিভেন চারিত্রীকভাবে ফ্রাঙ্কের ঠিক বিপরীত। খুবই কর্মঠ। আর ফ্রাঙ্ক ছিল মারাত্মক অলস। এবং ফ্লাটি ধরনের ছেলে। তাছাড়া স্টিভেন তত হ্যান্ডসামও নয়। আর নিজের উপার্জনের সে মোটামুটি স্বচ্ছল। বিত্তশালী না হলেও শহরে তাদের নিজেদের বাড়ি আছে। তাছাড়া নিজের গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর খুবই হৃদয়বান পুরুষ।
স্টিভেন খুবই ধৈর্য্যশীল। দিনের পর দিন সে সারাকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করে। তবে তার প্রকাশ খুবই ভদ্রচিত। প্রায়শ বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে সে সারাকে ফুল বা চকোলেট উপহার দেয়। আবার কখনো কখনো তাকে ড্রপ করারও প্রস্তাব দেয়। তবে তার সব প্রস্তাবনাই থাকে খুবই মার্জিত। যেমন গাড়িতে যদি কখনো ড্রপ করেও সে, সারাকে স্পর্শ করবার চেষ্টাও করে না। শুধুমাত্র শুভ রাত্রি বলে উইশ করে। সারা ধীরে ধীরে তার মনের অগোচরেই কখন যেন স্টিভেনের প্রতি আকর্ষিত হয়। তাছাড়া স্টিভেনের ব্যক্তিত্ব তাকে আকর্ষিত করে। অথচ সারা সমস্ত জীবন সুন্দর পুরুষের উপর আকর্ষিত হতো। তবে ফ্রাঙ্কের ধাক্কা তাকে খুবই প্র্যাকটিক্যাল করেছে। ফ্রাঙ্কের বিশ্বাস ভঙ্গতা সারাকে বেশ কিছুটা পুরুষ বিমুখ করেছে। জীবন তাকে এত অল্প বয়সেই প্রচুর শিক্ষা দিয়েছে। এবং সেই শিক্ষা তাকে শরীর এবং মনের উপর কন্ট্রোল করতেও শিখিয়েছে। সারা আগের মত কোন আবেগেই নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারায় না।
এখন ডোরিনও স্কুলে যায়। ফাবিয়ানের স্কুলেই পড়ে। ফাবিয়ানের ১ ক্লাস জুনিয়র। যখন সারার কাজ থাকে না, তখন সারাই ফাবিকে পিকআপ, ড্রপঅফ করে। ওখানেও রোডিকার সাথে দেখা হয়ে যায়। তো রোডিকা রোজই জিজ্ঞাসা করে তার হালচাল। সারা সবই বলে কিন্তু স্টিভেনের কথা বলতে পারে না। একটু লজ্জা বোধ করে। এর মধ্যে সারা বেশ কিছুটা ইতস্তত করে রোডিকে বলল-
: রোডি তোর সাথে কথা আছে।
: বলনা, ব্যক্তিগত?
: হু! কিছুটা, তারপর বেশ লজ্জা লজ্জা করে প্রায় সবই বিস্তারিত বললো স্টিভেন সম্পর্কে। স্টিভেনের মা জেনেলিয়ারও যে খুব আগ্রহ, তাও বলতে ভুললো না। এমনকি সেদিন যে মা-বেটা তাদের বাসায়ও চালাকি করে বেড়িয়ে গেছে, তাও বললো। ফাবিয়ানকে দেখে গেছে। সব বললো। সব শেষে এটাও বললো-
: মা’রও খুব আগ্রহ বুঝলি?
: বলিস কি, এতসব হয়ে গেছে আমাকে বলিসনি? তোকে খুন করে ফেলবো- বলেই সারার পিঠে দুম করে একটা কিল মারে রোডিকা-
: উহ্! লাগছে, পাজী কোথাকার। বলবো কি বল? আমি নিজেই তো সাংঘাতিক কনফিউজড। তাছাড়া দেখতে একদম ভালো না রে।
: আবার চেহারা! বেহায়া, তোর লজ্জা নাই। একটা মাকাল ফলে হয়নি। আবারো মাকাল ফল চাস?
: সেটাই তো! সেটা ভেবেইতো- এখন কি করি বল? তাছাড়া ফাবির কথাও ভাবতে হচ্ছে। ওতো আমাকে ছাড়া কিছুই ভাবে না! বুঝলি নিজের কথা ভাবতে গেলেই ফাবি মাঝখানে এসে যাচ্ছে। কি যে করি!
: না, না এটা ঠিক নয়। এখন তোর নিজের কথাও ভাবতে হবে। এখন তোর বয়স প্রায় ২৫ বছর। আর কত দিন একা থাকবি? এতদিন আমিও ফাবির কথা ভেবে তোকে কিছু বলিনি। কিন্তু এখন তোর নিজের কথা ভাবার সময় এসেছে। আর ফাবিরও বয়স এখন ৫ বছর। তাছাড়া আন্টি আছে না।
: হ্যাঁ রে মাও তাই বলছে। মা, আমার কথা ভেবে সব সময় খুব বিষন্ন থাকে। কিন্তু আমার হয়েছে দু’রকম যন্ত্রণা। আমি কোন ভাবনাই এককভাবে ভাবতে পারছি না।
: কিন্তু তুই এত চিন্তা করছিস কেন? আন্টি আছে? আর আন্টি রীতিমত ইয়াং এবং খুব কর্মঠ মহিলা। তাছাড়া সেতো ফাবিকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না।
: হ্যাঁ, সেটাইতো আরো যন্ত্রণা। আমি যদি বিয়ে করে দূরে কোথাও চলে যেতে চাই। তাহলে মার কি হবে? বল? মারও মাত্র ৪৫/৪৬ বছর বয়স। সেতো বাবার মৃত্যুর পর ফাবিকে বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে।
: হু, সেটা ঠিকই বলেছিস। শুধু কি আন্টি, এখন তো ডোরিনও ফাবিয়ানকে ছাড়া কিছুই ভাবে না। সারাক্ষণই দুটিতে জোড়ে ঘুরছে।
: হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। ডোরিনকে ফাবির থেকে দেড় বছরের ছোট বোঝাই যায় না। মাঝে মাঝে আমি দেখি, ডোরিন ফাবিকে ওদের খেলাঘরে দারুণ শাসন করছে, হি: হি:।
: হা, হা, বলিস কি? আর একটা কথা তুই ভেবেছিস, সারা।
: কিরে?
: জলপাই গাছের তলায় ঐ খেলাঘরে আমরাও খেলেছি। তারপর একদিন বড় হলাম। এখন আমাদের বাচ্চারাও খেলছে। ভাবতেই কেমন জানি লাগে।
: হ্যাঁরে, আমিও মাঝে মাঝে দেখি আর আমাদের ছেলেবেলার কথা ভেবে যেমন মজা লাগে, তেমনিই কান্না পেয়ে যায়। জীবনটা আমার কত সুন্দর ছিল। নিজে হাতে জীবনটাকে কি করে দিলাম বলত?
: আবার, ঐ সব কথা তুলেছিস? বলেছি না তোকে ঐ সব কথা তুলবি না। ঈশ্বর পরীক্ষা করে, আবার তার জীবনে সমস্ত সমৃদ্ধি দান করে।
: কিন্তু দ্যাখ, বাবা কত দুঃখ পেয়ে মারা গেল! আবার আমি এখন স্টিভেনকে বিয়ে করলে জানি না ফাবিয়ান ব্যাপারটি কিভাবে নেবে?
: কিছু হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে। সৃষ্টিকর্তা যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।
এরপর সারার মনের মধ্যে আর তেমন কোন ‘কিন্তু’ থাকে না। সে স্টিভেনের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করে। স্টিভেন তাকে একদিন তাদের বাড়িতেও নিয়ে যায়। অনেক বড় বাড়ি। ওদের ঘরগুলোও খুব সুন্দর করে সাজানো। স্টিভেন ওকে খুউব সুন্দর একটা স্যুপ বানিয়ে খাওয়ায়।
সামনের ২৩শে মে ছিল সারার জন্মদিন। স্টিভেন আগেই ওকে বলে রাখে, ঐ দিনে তোমার বাড়িতে সময় দিবে। তবে রাতের ডিনার আমার সাথে করবে। সারা নিজেও তার এবারের জন্মদিন নিয়ে খুবই উত্তেজিত ছিল। কারণ এবারে তার ২৬ বছরে পড়বে। আর ৮ দিন পরে ৩১শে মে ফাবিয়ানেরও জন্মদিন। ফাবিরও ৬ শেষ হবে ৭-এ পড়বে। মা-ছেলে একই রাশী। জেমিনাই। এ জন্য ওদের চরিত্রগত খুব মিলও আছে! খুব মুডি এবং আবেগপ্রবণ। সারা ঠিক করেছে এবারে ফাবির জন্মদিনও খুব ধুমধাম করে করবে।
সারার আবার লাল খুব প্রিয়। জন্মদিন উপলক্ষে সারার মা নিজেই মেশিন চালিয়ে টকটকে লাল লেসের একটা ড্রেস বানিয়ে দিল। লো-কাট গলা ঝুল হাঁটু পর্যন্ত । ড্রেসটা পরে দেখলো দারুণ ফিটিং হয়েছে। রোডিকা আবার আগেই একটা পার্লের হার লকেট আর কানের দুল দিয়ে গেল। আর বলে গেল-
: সারা এ্যাডভান্স গিফট দিলাম। কারণ এটা তোর ধরতে গেলে প্রথম ‘ডেট’। শোন, যদিও তুই নিজেও হেয়ার স্টাইলিস্ট, তবুও ঐ দিন আমি তোর চুল বেঁধে দিবো।
: ওকে, রোডি। অনেক ধন্যবাদ। তোর গিফটটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুইতো জানিস আমার পিংক পার্ল কত পছন্দ। তবে এত দামী গিফটটা কেনার কোন দরকার ছিল না!
: আচ্ছা, আচ্ছা, অত ঢং করতে হবে না। তাছাড়া টাকাটা কেভিন দিয়েছে, সেতো আবার তোমার ভাই। হি: হি:, আমি দেইনি। আমি দিবো আমার ফাবি বাবাকে।
: না, না, এটা তোর খুব বাড়াবাড়ি। প্রত্যেক জন্মদিনে তোর জ্বালাতনে আমি ফাবিকে কিছু দিতেই পারি না।
: আচ্ছা, আর ডোরিনের জন্মদিনের ড্রেস কে বানিয়ে ফেলে মাস খানেক আগেই? তাছাড়া কেকও কে বানায়?
: সে তো মা! তুই তো জানিস, মাতো বেকিংয়ের মাস্টার।
: তা যা বলেছিস। আন্টির চকোলেট কেক, আপেল টর্টার! চিজ কাপকেক পৃথিবী বিখ্যাত।
: বলিস কি পৃথিবী বিখ্যাত? হি: হি:
: ওকে, তাহলে ঐ কথা রইল!
তারপর দেখতে দেখতে ২৩শে মে চলে এলো। রোডি আর কেভিন ভোর বেলায়ই ওকে উইশ করে গেল। পাশাপাশি বাড়ি হওয়াতে এটাই ওদের সুবিধা। এমনকি ডোরিন নিজেই কতগুলো নানা রকম জংলি ফুল দিয়ে সুন্দর করে ‘তোড়া’ বানালো, তারপর ওকে দিল। সব থেকে মজার উপহার দিল তার ফাবিয়ান। অনেক বড় একটা কার্ড বানিয়েছে। কার্ডের উপর আসল ফুলের পাপড়ি দিয়ে কি সুন্দর ডেকোরেশন করেছে। আর ভেতরে কত কি লিখেছে। সারা তো কার্ড কি দেখবে আর পড়বে, ফাবিয়ানকে জড়িয়ে চুমোয় ভরিয়ে হেসে-কেঁদে অস্থির। আজ ওর ছুটির দিন। ও ছুটি নিয়েছে। ওর মা তার প্রিয় ল্যাম্বের স্যুপ করেছে। আর তার অনেক প্রিয় চিজ পুডিং করেছে। দিনটা খুব সুন্দর করে কাটালো। তার সব কলিগরাও টেলিফোনে উইশ করেছে। এমনকি তার বস্ জেনেলিয়া গ্যালাটিও ফোন করে উইশ করেছে। এমনকি সে বলেছে-
: সারা, তোমার জন্য একটা সুন্দর গিফট অপেক্ষা করছে। আগামীকাল যখন আসবে তখন দেখবে।
: ওহ্! ধন্যবাদ জেনেলিয়া! অনেক ধন্যবাদ।
স্টিভেন অবশ্য তাকে কোন ফোন করেনি। সে বলেছে ঠিক সাড়ে পাঁচটাতে তাদের বাসার সামনে এসে হর্ণ দেবে। সারা জানে যে, সে খুবই পাংচুয়াল। সারা তাই বিকাল চারটে থেকে ড্রেস পরে মেকআপ করছে। ইতিমধ্যে রোডি চলে এসেছে তার চুল ঠিক করতে। রোডি সমস্ত চুল টেনে মাথার মধ্যভাগে নিয়ে ‘ডোনাট’ খোপা করে দিল। শুধু এক গুচ্ছ চুল কারলি করে গালের পাশে ঝুলিয়ে দিল। আবার ডোনাট খোপার পাশে টকটকে একট লাল গোলাপও দিল। ফাবিয়ান সারাক্ষণ মা’র আগুপিছু ঘুরঘুর করছে।
: মাম্ তুমি কোথায় যাচ্ছো? তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন? আমিও যাবো।
সারা রোডির দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ তাকালো।
: ওকে ফাবি, আজ তো ডোরিনের বাবা একটা খেলনা ট্রেন এনেছে, তুমি ওটা দিয়ে ডোরিনের সাথে খেলবে নাকি মার সাথে অফিসের বোরিং পার্টিতে যাবে?
: তাই? আঙ্কেল ট্রেন এনেছে? ওকে, আমি ডোরিনের কাছে যাবো। ওকে মাম্, আমি তাহলে ডোরিনরে কাছে যাচ্ছি। তুমি ঘুরে এসো।
: ওকে সোনা, সারা ফাবিয়ানকে জড়িয়ে ধরে চুমো দ্যায়।
এর মধ্যে বাড়ির সামনে হর্ণ বেজে ওঠে, রোডি সারাকে জড়িয়ে ধরে উইশ করে বলে-
: যা, ঘুরে আয়। আশা করছি আজ তোর জীবনে নতুনভাবে সূর্য উদিত হবে।
: থ্যাঙ্কস রোডি, ওর চোখের পাতা ভিজে ওঠে। গলায় কান্না দলা পাকায়। রোডি বলে-
: উহু, আজ কান্না নয়- আজ শুধু হাসি।
সারা স্টিভেনের সাথে গাড়িতে ওঠে। স্টিভেন সারার দিকে অপলক মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকে। গাড়ির পেছনের সিট থেকে বিশাল আকারের একটা ‘ব্যুকে’ দিল সারার হাতে। সেখানে শুধু হলুদ এবং লাল গোলাপ। তারপর স্টিভেন সারার দিকে তাকিয়ে বলল-
: শুভ জন্মদিন সারা। তারপর সারার হাত ধরে সারার দিকে স্মিত হাস্যে তাকিয়ে বললো-
: মনে হচ্ছে জীবনে প্রথম আমি আজ গাড়ি এক্সিডেন্ট করতে পারি!
: সেকি? এসব কি বলছো?
: সত্যি বলছি, আজ তোমাকে দেখার পর থেকে আমার হার্টবিট ডাবলেরও বেশি হয়ে গেছে।
: ঠিক আছে। এখন চলতো, দুষ্টমি করতে হবে না।
স্টিভেন প্রথমে লং ড্রাইভে বের হলো। এবং বেশ জোরে তার একটা অনেক প্রিয় রোমান্টিক গান চালিয়ে দিল-
‘WHEN THE MOON HITS YOUR EYE LIKE A BIG PIZZA PIE
THAT’S AMORE
’
এই গানটি শুনলে কেন জানি সারার অকারণে চোখে পানি এসে যায়! স্টিভেনকে দেখলে একটুও মনে হয় না, ও এত রোমান্টিক! বরং উল্টোটাই মনে হয়। খুব কাট-খোট্টা স্বভাবের। যে কিনা রাত-দিন বিজনেস অথবা টাকা-পয়সা ছাড়া কিছুই বোঝে না। প্রথম দেখাতে সারার যার জন্য একটুও পছন্দ হয়নি। গাট্টাগোট্টা চেহারা। তার ছোট ছোট চোখের দৃষ্টি তখন মনে হতো, খুবই চতুর। কিন্তু সেই মানুষটার সাথেই যখন সারা অন্তরঙ্গভাবে মিশছে, তখন তাকে একদম অন্য রকম মনে হচ্ছে। খুবই নরম স্বভাবের এবং অসম্ভব রোমান্টিক। যদিও স্টিভেন আসলেই খুব আত্মসচেতন এবং প্র্যাকটিক্যাল ধরনের পুরুষ। বেশ অল্প বয়সে বাবার মৃত্যু হওয়াতে মা-বেটাই সংসারের হাল ধরেছে। অন্যের উপর নির্ভর করা আদতেই শেখেনি। সারার চিন্তার গভীরেই স্টিভেন কখন যেন একটা অনেক বড় রেস্টুরেন্টের সামনে নিয়ে এসেছে। আগেই টেবিল বুক করে রেখেছিল। ওরা যখনই রেস্টুরেন্টের মধ্যে ঢুকলো, তখন উর্দিপরা বেয়ারা ওদের অভ্যার্থনা করে কর্নারের দিকে বেলকোনিতে নিয়ে এলো। সেখানে খুব সুন্দর করে সাজানো। মাঝখানে একটা মিডিয়াম সাইজের গোল টেবিল আর দু’পাশে দুটো চেয়ার। ওরা বসবার সাথে সাথে চারজন লোক এরাও সাদা রঙের ড্রেস পরা ওদের কাছে এসে গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া শুরু করলো-
Happy birthday to you
Happy birthday dear Sara
সারা খুব চমকে স্টিভেনের দিকে তাকালো। স্টিভেন মিটিমিটি হাসছিল। একটু পরেই ওদের গান বন্ধ হবার সাথে সাথেই আর একজন উর্দিপরা বেয়ারা একটা ট্রলি নিয়ে এলো যাতে অপূর্ব একটা হার্ট শেপ চকোলেট কেক। উপরে ভ্যানিলা আইসিং দিয়ে লেখা ‘ Happy birthday Sara’। নিচে ছোট করে লেখা I love you. সারাতো একদম হকচকিয়ে গেল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কেক কাটলো। সবাই তালি বাজালো। ওরা দুজন দুজনাকে দুই টুকরা কেক খাওয়ালো। একটু পরেই মেনু নিয়ে এলো বেয়ারা। সারা মেনু কার্ডটি স্টিভেনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
: প্লিজ তুমি অর্ডার দাও। আজ তো সবই তোমার পছন্দ অনুযায়ী হচ্ছে। এটাই বা নয় কেন?
: তথাস্থ সুইটি।
মজার ব্যাপার স্টিভেন একে একে তারই পছন্দের খাবার অর্ডার দিল। একটু পরেই একে একে সব খাবার আসলো। সারা খাবে কি? আবেগে দিশেহারা। সারার কেন জানি বার বার কান্না পাচ্ছে। এত ভালোবাসা, এত সম্মান, এ যে ওর স্বপ্নাতীত। যে স্বপ্ন ও ফ্রাঙ্ককে নিয়ে দেখেছিল, সে স্বপ্ন তো ধুলিস্ম্যাৎ হয়ে গেল। আর যাকে নিয়ে কখনো কোনো স্বপ্নই দেখেনি সে তার পায়ের কাছে সমস্ত স্বপ্নের বাস্তবতা নিয়ে নতজানু। সারার চকিতে একটা কথা মনে পড়ে। যখন ফ্রাঙ্ক চলে গেল ওর জীবন থেকে, তখন ও সারাক্ষণ মৃত্যুর কথা চিন্তা করতো। একদিন ও ফাবির জন্য বাজারে গিয়েছিল সিরিয়াল কিনতে; তখন ওর স্কুলের খুবউ প্রিয় একজন শিক্ষিকার সাথে দেখা হয়েছিল। ঐ টিচারকে সারা প্রায় তার মায়ের মতন ভালোবাসতো। এই টিচার মিস নাটলি সারাকে গ্রেড ফাইভ থেকে চেনে এবং গ্রেড-১২ সারার টিচার ছিল। সেই টিচার যখন সব শুনলো এবং জানলো সারার মুখ থেকে, তখন সারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। কারণ তখন সারার জীবনে কান্না ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তখন ওর শিক্ষিকা ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল-
THOMAS EDISON -এর একটি বাক্য-
“Many of life’s failures are people
who did not realize how close
they were to success when they gave-up”
সত্যিই সেদিন সেই দারুণ দুঃখের দিনে সে যদি সত্যিই মৃত্যুকেই বরণ করে নিতো, তাহলে আজ এই সুখের মহীমা ও কোথায় খুঁজে পেতো! তাইতো ওর মা সর্বদা বলে, সব সময় ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখো, ঈশ্বর মঙ্গলময়। (চলবে)
লেখক রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।