আমার বাংলাদেশ তুমি কেমন আছ!

জসিম মল্লিক

অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য এ পর্যন্ত অনেকগুলো চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো সবই ব্যর্থ হয়েছে। সবশেষ দেখলাম সচিবালয়ে আগুন। এটা একটা ভয়াবহ ঘটনা। লোমহর্ষক। এর সাথে যারা জাড়িত তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া গত একমাসে আমার অভিজ্ঞতা ভাল। সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা চমৎকার কাজ করছেন। অনেক পরিবর্তন দৃশ্যমান হচ্ছে। দীর্ঘদিনের অনিয়ম দূর করতে সময়তো লাগবে। কিন্তু এই সময়টাই অনেকে দিতে চায় না। পান থেকে চুন খসলেই হৈহৈ রৈরৈ করে উঠছে। এতোদিন কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। আইন করে সব বন্ধ করা হয়েছিল, শুধু প্রশংসাই করা যেতো। এখন মন খুলে সবাই বলতে পারছে। যতখুশী সমালোচনা করতে পারছে। গাল মন্দ করছে। কেউ কেউ উপদেষ্টাদের চরিত্র হননের চেষ্টায় ব্যস্ত আছে। মহা ব্যস্ত। দেশ বিদেশে এটা চলছে। দুর্নীতির লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে প্রচারণায়। দেশের সাথে সম্পর্ক নাই এমন সব লোকরাই দেশ নিয়ে বেশি মাতামাতি করছে। বিশেষজ্ঞের মতামত দিচ্ছে। সভা সেমিনার করছে। আলোচনায় থাকতে চাইছে।

বেশিরভাগই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অনুমাননির্ভর, হাস্যকর। তাদের উচিত বিদেশের নিরাপদ জায়গায় বসে গাল গল্প না করে কাছ থেকে দেখা। দেশকে জানা। মানুষকে জানা। সত্যকে ধারণ করা। বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। দেশের সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করা। বিদেশের কিছু গণমাধ্যম অপপ্রচারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু কার্ড খেলছে এতোদিন। এইসব প্রচারণা অবশ্য হালে পানি পায়নি। আমার যারা হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান বা পাহাড়ি বন্ধুরা আছে তাদের সাথে আগের মতোই আড্ডা দিচ্ছি, খাচ্ছি, গাল গল্প করছি। এমনকি আমার কোলকাতার বন্ধুদের সাথে নিয়মিত কথা হয়। এইসব প্রচারণাকে তারা বলছে রাজনীতি। তবে কিছু ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে যা ছিল লজ্জার। গত পনেরো বছর বা তারও আগে এমন ঘটনা ঘটেছে। সব ঘটনার বিচার হতে হবে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।আমার শৈশব কৈশোর থেকেই মিলেমিশে বসবাস করে আসছি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এখন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী হচ্ছে। নির্বাচনের দাবী জোড়ালো হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা বা নির্বাচন কমিশনার বলেছেন নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। হয়ত আগামী এক বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে সবার কাঙ্খিত সংস্কারের কাজ চলছে। শীঘ্রই কমিশনগুলো তাদের মতামত দেবেন। সবাই অপেক্ষায়। রাজনৈতিক সরকারও দরকার আবার সংস্কারও দরকার। নির্বাচন ছাড়া গণন্ত্রের ফেরার কোনো উপায় নাই। গতানুগতিক ধারায় এ দেশ চলতে পারে না। সবকিছু নতুন হতে হবে। নতুন বাংলাদেশ। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ।

জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার দৃশ্য। ছবি : যুগান্তর

আমলাতন্ত্র একটি কঠিন বেড়াজাল। কঠিন শৃঙ্খল। এই শৃঙ্খল কেউ ভাঙ্গতে পারছে না। এই যে দেশে একটা অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান হলো। যে অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী থেকে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত পালিয়েছেন। তারপর থেকে মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখা শুরু করল। কিন্তু আমলাতন্ত্র একটুও বদলায়নি। শুধু মানুষ বদলেছে। চেহারা বদলেছে। কিন্তু সিস্টেম বাদলায়নি। সিস্টেম বদলাতে হবে। যতই আন্দোলন করি, যতই মানুষ প্রাণ দিক. যতই ক্ষতিপূরণ দিন কোনো লাভ নাই। সাধারণ মানুষ প্রাণ দেয়, রাজনীতিবিদরা জেলে যায় কিন্তু আমলারা থাকে বহাল তবিয়তে। তাদের কখনও কিছু হয় না। ফুলের টোকাটাও লাগে না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী না হয়ে তারা জমিদার হয়ে বসে আছে। যুগ যুগ ধরে একইভাবে চলছে। যতই অপরাধ করুক বড়জোর চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়, এর বেশি কিছু না। দেশ মূলত আমলাই চালায়। তাদের হাতেই চাবিকাঠি। এখনও তাই। মন্ত্রী বলি আর উপদেষ্টা বলি, তাদের হাতেই বন্দী। আমলাতন্ত্রের কাছে সবাই অসহায়।  কঠিন এক বেড়াজাল। এই বেড়াজাল ভাঙার কোনো যন্ত্র নাই মানুষের কাছে।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে জামায়াতে ইসলামী। আর সবচেয়ে বিপদে আছে আওয়ামী লীগ। তারা অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। আর বাংলাদেশ জাতীয়াতাবাদী দল যতটা ভাল অবস্থায় ঠিক ততটাই চাপে আছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার সংস্কার সম্পন্ন করেই নির্বাচন দিতে চায়। জামাত বা ছাত্রদেরও তাই চাওয়া। আর বিএনপি চায় সংস্কারের নামে কালক্ষেপন না করে দ্রুত নির্বাচন। অন্তত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হোক। এটা ঠিক যে ছাত্ররাই আন্দোলনের মূল স্টেকহোল্ডার হলেও বিএনপি গত পনেরো বছরে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত রাজনৈতিক দল। তারা আপোষের পথে না গিয়ে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরোধিতা করেছে, প্রহসনের নির্বাচন বয়কট করেছে এবং নির্যাতন, গুম, খুনের শিকার হয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বিনাদোষে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। বিএনপি ছাত্রদের যে দাবীর সাথে কিছুটা একমত হতে পারছে না সেটা হলো আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা বা নিষিদ্ধ করা নিয়ে। ছাত্রদের অনড় অবস্থানে বিএনপি একধরণের চাপ অনুভব করছে বলে মনে হয়। এই ইস্যুতে চাপে আছে সরকারও। বিএনপি অবশ্য বলেছে কেউ দোষি সাব্যস্ত হলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে কিন্তু সামগ্রিকভাবে নিষিদ্ধের পক্ষে না। বিএনপি বড় দল। তাদের দিকে জাতি তাকিয়ে আছে। তাদের ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।

আমরা প্রচণ্ড রাজনীতি সচেতন। প্রচন্ডভাবে ব্যক্তি ও দলের প্রতি আনুগত্য আমাদের। দেশ সেখানে একটি জাষ্ট ধারণা মাত্র। একটা মিথ। অথচ বিদেশেীদের মধ্যে আমি এই প্রবনতা একদম দেখিনা। এটাই আমাকে অবাক করে। আমি নিজেও এর উর্ধে না। কারো পছন্দমতো কিছু না হলেই আপনাকে ন্যাংটো করে ছাড়বে। পরিবার, স্ত্রী, সন্তানকেও রেহাই দেবে না। মোদ্দাকথা অন্যের মতামত সহ্য করার মতো সহনশীলতা নাই আমাদের। ফরটিন জেনারেশন নিয়ে টানাটানি শুরু করবে। আর রাজনীতির মধ্যে ধর্ম হচ্ছে একটি রসাগোল্লার মতো। অতি সুখাদ্য। যা খুবই একটি ঘৃণিত চর্চ্চা। বিদেশে বেড়ে উঠা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি বা ধর্ম নিয়ে কোনো মাতামাতি নাই। আমার ছেলে মেয়ের সাথে দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলি না আমি। আর হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এই ভেদাভেদই এখানকার তরুণরা বোঝে না। অথচ বুকের মধ্যে ঘৃণার বিষ নিয়ে এদের সাথেই আমরা বসবাস করি। কি জঘন্য মানসিকতা! কি নিষ্ঠুর হিপোক্রেসি! আমার সহকর্মীদের মধ্যে ষাট ভাগ ভারতীয়। তারমধ্যে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান সবই আছে। অবাক কান্ড ওরা এসব নিয়ে কখনো কথাই বলে না। জানেও না হয়ত। এসব কুৎসিত রাজনীতি পাত্তাও দেয় না। পাকিস্তানি তরুণদের মধ্যেও আমি এগুলো দেখিনি। তারা এসব বোঝেও না। তরুণদের চমৎকার সহাবস্থান। অথচ আমরা একজাতি হয়েও কি চরম ভেদাভেদ, কি চরম ঘৃণা একে অন্যের প্রতি। আসুন বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচি, দেশকে ভালোবাসি। অন্য জাতির মতো নিজের দেশকে মহান করে উপস্থাপন করি।

অর্ক ড্রাইভ করছে। আমি পাশে বসেছি। জেসমিন পিছনে বসে কথা বলেই যাচ্ছে। আমাদের চারজনের কথা সব জেসমিন একলাই বলে। আমরা এটা মেনে নিয়েছি। আমার মতোই কম কথা বলার মানুষ অর্ক আর অরিত্রি। আমরা হাইওয়ে ৪০১ দিয়ে যাচ্ছি। গন্তব্য পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। আমি সময় মতোই বের হয়েছি।  বিজি টাইমে আমার বাসা থেকে ঘণ্টাখানেক লাগে এয়ারপোর্ট যেতে। না হলে চল্লিশ মিনিট। সাধারণত ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে তিন ঘণ্টা আগেই রিপোর্ট করা উচিত। আমি তাই করি। এটা নিয়ে আমার ছেলে মেয়েরা হাসাহাসি করে। ওরা বলে বাবা অনেক টেনশন করে। আমার ফ্লাইট ১৭.৩০ এ। এর মানে ২৪ ঘণ্টার ২৪ ঘণ্টার ক্লক টাইম কনভারভেশন টেবিল। আমার মাথার মধ্যে সময়টা গেঁথে আছে। কারণ টরন্টোর হাইওয়েতে ২৪/৭ ট্র্যাফিক থাকে। আর এই সময়তো কথাই নেই। তখন ঘড়িতে সোয়া তিনটা। হঠাৎ ব্লুটুথে অরিত্রির ফোন বেজে উঠলো।

বাবা তুমি কোথায়!

এইতো ৪০১ এ! ৪০৯ নিতে পারিনি। ট্র্যাফিক আছে এক্সপ্রেসওয়েতে।

ওহ। আমিতো মনে করেছি তুমি চেক ইন করে ফেলেছো।

না আম্মা ফ্লাইট তো দেরি আছে সাড়ে সাতটায়। অনেক আগেই বের হয়েছি।

বাবা কি বলো আমিতো তোমার আইটেনারিতে দেখলাম সাড়ের পাঁচটায়।

নাতো!

তুমি আবার চেক করো।

হঠাৎই আমি আমার ভুলটা ধরতে পারলাম। ১৭.৩০ মানে তো ৭.৩০ না! এটা হবে ৫.৩০!

ও মাই গড! ভুল হইছে আমার।

অরিত্রি হেসে বলল, ইটস ওকে বাবা। টেনশন করোনা। হাতে এখনও টু আওয়ার্স আছে। সমস্যা হবে না। অরিত্রি অর্ককে বলল ট্রাফিক কেমন!

অর্ক প্রবলেম নাই।

জেসমিন এমন সুযোগই খুঁজছিল! আমি ভুল করেছি মানে বিশাল অন্যায়। অন্যায়। আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অন্যায়। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। এদিকে আমি ভিতরে ভিতের নার্ভাস। আমি দুঘণ্টা পিছিয়ে থাকলাম!

জেসমিন ঝাঁজের সাথে বলল, এতো ট্রাভেল করো আর জানো না ১৭.৩০ মানে কি! আমার জ্ঞান গম্যি যে কম সেটা নিয়ে আরো কিছু কথা শোনাল। আমি প্রতিবাদ না করে বাইরের ট্রাফিক দেখছি। শহরটা যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে। এতো গাড়ি কোথা থেকে আসে! ট্রুডোকে বকছি আরো কেনো হাইওয়ে করে না।

এবার মাঠে নামল অর্ক, ইটস ওকে মামনি। এমন কিছু দেরি হয়নি। পৌঁছে যাব। দশ মিনিট লাগবে।

ঠিকমতোই পৌঁছে গেলাম। ওরা আর ভিতের গেলো না। আমাকে ড্রপ দিয়ে চলে গেলো। টেনশনের সময় মাথা কাজ করে না। আমি চলে গেলাম উল্টোদিকে। বিমানের কাউন্টার খুঁজে পাইনা! একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। আবার ঘুরে গেটে গেলাম। ৩ নম্বর টার্নালের একদম শেষে বিমানের চেকইন কাউন্টার। বিরাট বড় লাইন। আমার পিছনেও ততক্ষণে কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেলো। মনে মনে খুশী লাগছে ‘যাউকগা’ আমি একলা দেরি করে আসিনি। আমার মতো অনেকেই আছে। হাতে অবশ্য  যথেষ্ট সময় আছে। ফ্লাইটও অনটাইম। আর আমার যেহেতু প্রিমিয়াম ইকোনমি তাই বেশি অপেক্ষাও করতে হলো না। চেকইন হয়ে গেলো ধ্রুত। বেশ দক্ষতার সাথে বিমানের কমীরা কাজ করছেন। স্টেশন ম্যানেজার সাহেবও খুবই তৎপর। খোঁজখবর নিচ্ছেন সবার। আমার সাথেও হাই হ্যালো হলো।

ইস্তানবুলে ঘন্টাখানেক থাকল বিমান। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আবার উড়াল দিল। আমার পাশে বসেছে একজন সুদর্শন তরুণ। বেশ হাসিখুশি ও সাবলীল। আমার সহযাত্রী সবসময় মেয়ে হয়। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। সাধারণত যাত্রাপথে বাঙ্গালি মেয়েরা একটু গম্ভীর থাকে। পুরুষের পাশে বসলে গুটিয়ে রাখে নিজেকে। এ মেয়েটি তেমন না। এক পর্যায়ে মেয়েটি কথা জুড়ে দিল। টরন্টোর ওকভিলে থাকে। সদ্যই বিয়ে হয়েছে। হাজবেন্ডের ছবি দেখাল। দারুণ হ্যান্ডসাম দেখতে। ঢাকায় বাসাও আমার বাসার কাছাকাছি। তাই আমার এবারের জার্নি বোরিং মনে হয়নি। তাছাড়া খাওয়া দাওয়া ভাল ছিল, মেন্যুতে একঘেয়েমি ছিল না, এন্টারটেইনমেন্ট ভাল। অনেক নতুন নতুন মুভি ছিল।

ঢাকায় পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট সময়েরও বিশ মিনিট আগে। ড্রাইভারকে ফোন দিলাম ল্যান্ড করেই। মিজান বলল, স্যার লাগেজ পেলেই ফোন দিয়েন। ১ নম্বর টার্মিনালে চলে আসব। ইমিগ্রেশেন হয়ে গেলো দ্রুত। অন্যান্য সময়ের মতো ‘খাজুইরা’ প্রশ্ন করল না অফিসার। থ্যাংক ইউ স্যার বলে বের হয়ে আসলাম। ওমা ইমিগ্রেশন থেকে বের হয়েই দেখি লাগেজ কনভেয়ার বেল্টে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এতো তাড়াতাড়ি! অবাক কান্ড। আগে ট্রলির জন্য কাড়াকাড়ি লাগত। এবার দেখলাম যে বেল্টের সাথেই ট্রলি সাজানো। গ্রীনচ্যানেল দিয়ে বের হওয়ার সময় দেখলাম মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রীদের অহেতেুক হয়রানী নাই কোনো। বাইরে বেড়িয়েই দেখি দালালদের কোনো তৎপরতা নাই। লাগেজ নিয়ে টানাটানি নাই। মিজান এসে গেছে যথাসময়ে। রাস্তায় বের হয়েই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। আহা নিজের দেশ। জন্মভুমি, মা জননী। ওয়ালে ওয়ালে জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতি। হঠাৎ আবিষ্কার করি আমার চোখে পানি। আজব!

নারী দুর্বল বা শারীরিক শক্তির তুলনা একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। শুধু ভুল না মারাত্মক ভুল। এক ধরনের মিথ। মনে আছে আমরা যখন প্রথম কানাডায় আসি তখন হিথ্রোতে আমাদের ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ডিলে ছিল। লন্ডন থেকে টরন্টোর ফ্লাইটের সময় কোনো বোর্ডিং ব্রিজ দেয়নি আমাদের। বিশাল এয়ারবাসে উঠতে হয়েছে ক্যারিঅন ব্যাগ হাতে নিয়ে। অরিৎত্রি তখন পিচ্চি। সে তার ব্যাগ কাউকে দেয়নি। নিজেই গট গট করে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে যায় ফ্লাইটে। কানাডা এসে নিজের চেষ্টায় ১৬ বছর বয়সে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়, পড়ার ফাঁকে জব শুরু এবং গাড়ি কেনে। সবকিছু সে একলা করেছে। আমার কোনো সাহায্য ছাড়াই। আমি একবার টরন্টো থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে প্রিমিয়াম ইকোনমি ক্লাসে ঢাকা আসছিলাম। যথারীতি আমার বাঁ পাশের আসনে একটি মেয়ে বসেছে। আমি আইল সীট। সে মাত্র টরন্টোর একটি ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্টগ্রাড শেষ করে ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছে। অতি সুশ্রী মেয়ে। আমার সামনের সীটে এক দম্পতি এবং পিছনের সীটেও এক দম্পতি বসেছে। দুজনেরই একটি করে শিশু সাথে। শিশুরা ফ্লাইটে খুব কাঁদে। ৩৮ হাজার আলটিচুটে কানে এক ধরনের চাপ অনুভব করে বাচ্চারা তাই কাঁদে। এই শিশু দুটিও খুব কাঁদছিল। বেশ কয়েকজন যাত্রী আমাকে বলল, আপনি জসিম মল্লিক না! আপনার লেখা পড়ি। তারমধ্যে এই দুই দম্পতিও আছে। এক পর্যায়ে আমার পাশের মেয়েটি বলল, আপনি লেখক! আমি হাসলাম। মেয়েটি বলল এমেজিং। আমার বাবাও খুব পড়তে ভালবাসে। লম্বা পথ। জার্নিটা বোরিং এবং কষ্টের। তাই চুপচাপ থাকাটা কেমন দেখায় না! আমি যদিও একটু অসামাজিক তাও কথা হতে দোষ নাই। আমি মেয়েটির সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। এতো কথা কেনো বলছি সেটা বলি। পুরো জার্নিত দেখলাম বাচ্চা দুটিকে নিয়ে মা দুজন কতখানি পেরেশান হচ্ছিলেন। সেই তুলনায় বাবা দুজন তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। মায়েরা এমনই। আমি মেয়েটিকে বললাম, দেখেছো মায়েরা সন্তানের জন্য কত অনন্ত ত্যাগ স্বীকার করে! মেয়েটির সদ্য বিয়ে হয়েছে। সে বলল, আঙ্কেল আমার মাও এমন। আমরা দুইবোনই টরন্টো থাকি এবং মা প্রতিবছর কানাডা আসেন, বাবা জার্নির ভয়ে আসেন না। আমি বললাম, তুমিও একদিন এমন হবা।

৩.

মিষ্টি জাতীয় খাবার আমার বেশি পছন্দ না। ঝাল জাতীয় খাবার পছন্দ। আমার পছন্দগুলো একটু সেকেলে ধরনের। যেখানেই যাই আমার চোখ খুঁজে ফেরে গতানুগতিক ধরনের খাবার। আমার খাদ্যাভ্যাস যারা জানেন তারা আমার জন্য কিছু আলাদা আইটমে করেন দাওয়াত দিলে। আমি খাবার নিয়ে বেশি এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি না। জীবনে আমি যতবার রেস্টুরেন্ট যেয়ে খাবার অর্ডার করেছি ততবারই তা খাবার অযোগ্য হয়েছে। এমনকি ফাস্টফুডের দোকানে গিয়েও আমি ঠিকমতো খাবার অর্ডার করতে পারি না। হয়ত লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, বেশি চিন্তা করার সময় নাই, মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সেলস পারসন। আমি কি অর্ডার করব তা গুলিয়ে ফেলেছি। আমি একটু নার্ভাস! যা মনে মনে ভেবেছিলাম তা না করে এমন একটা অর্ডার দিলাম যা নিজেই খেতে পারছি না। টীম হর্টনসের ড্রাইভ থ্রুতেও এটা হয় আমার। হয়ত ক্ষুধা পেয়েছে কিন্তু গাড়ি থেকে নামার সময় নাই। চা বা কফির সাথে কিছু একটা নিতে চাই যা ড্রাইভ করতে করতে খেতে সুবিধা হবে। কি নেবো! ব্যাগল না মাফিন! ব্যাগল কি হোল হুইটের নেবো, সিসিমি ব্যাগল, এভরিথিং ব্যাগল না জাষ্ট প্লেন ব্যাগল নেবো! ডাবল টোষ্টেড এবং সাথে সামান্য বাটার বা ক্রিম চীজ কি থাকবে! মাফিনেরও নানা জাত পাত আছে। কম মিষ্টি বেশি মিষ্টি। আমার তো আবার ডায়াবেটিস। বাছ বিচার করতে হয়। চা হবে স্মল সাইজ। কফি আমি খুব কম খাই। চা তাও স্টিপ টী, সাথে হাফ সুইটনার।

খবার নিয়ে আমি বেশ কষ্টে থাকি। যথেষ্ট বিরক্তিকরও আমি। বিদেশে প্রতিদিন নতুন নতুন আইটেম বা ফ্রেশ খাবার তৈরী করা এতো সহজ না! তাইতো এদেশের মানুষ প্রচুর রেস্টুরেন্ট খায়। শুক্র শনিবার সব ধরনের খাবার দোকান রমরমা। ডেলিভারিম্যানরা ভাল টিপস পায়। কিন্তু আমি সেই মান্ধাতা আমলেই পড়ে আছি। আলু ভর্তা, ঘন ডাল, ডিম ভাজা, করল্লা ভাজি, ঢেঁড়স, পটল, ঝিঙ্গা, ডাটা, শিম বা পুঁইশাক এইসব আমার পছন্দ। গুলশা, কাজরি, ইলিশ, বাইলা, মেনি, শোল বা পাবদা মাছ সবসময় পছন্দের তালিকায়। কৈ এবং শিং মাছও পছন্দ। তবে কাঁটার ভয়ে কৈ মাছ খাই না। বড় মাছ একদম খেতে পারি না। দেশ থেকে মাছের যে ব্লকগুলো আসে তা থেকে কেমন বোটকা গন্ধ পাই। কানাডিয়ান মাছ খুবই সুস্বাদু কারণ কানাডার পানি খুবই সুপেয়। এখানে বোতলের পানির চেয়েও ট্যাপের পানি পানের জন্য রিকমন্ডেড। কিন্তু হলে কি হবে এদেশীয় মাছ আমার মুখে রোচে না সহসা। আমি দেশের মাছই খেতে চাই। জেসমিন আমার খাওয়া নিয়ে চরম বিরক্ত..

– তোমারে কে কানাডা আসতে বলছে!

– কেনো কি করছি আমি!

– যে দেশে থাকো সেই দেশের খাবার খেতে অভ্যস্ত হও। প্রতিদিন তোমারে কে দেশি খাবার রান্না করে দেবে!

– প্রতিদিন কই। মাঝে মাঝে করলেই হবে।

– নিজেরটা নিজেই রান্না করে খাও। অনেক ছেলেরাই করে।

– নিজেই করব দেইখো।

– বাইশ বছর ধরে তাই শুনতেছি, একদিনও দেখলাম না। আর খালি খুঁত ধরতে পার। কিছু মানুষ আছে খুঁত ধরনের ওস্তাদ..।

ইশ্ কত কথা যে শোনাবা খাওয়া নিয়ে!

লেখার প্রসঙ্গ আসলে পিঠা। মায়ের হাতের পিঠা। মা লেখাপড়া জনতেন না বলে সিদ্দীকা কবিরের ’রান্না খাদ্য পুষ্টি’ গ্রন্থে কি কি রেসেপি আছে তাত মায়ের জানা নাই। ইউটিউব দেখেও রান্না শেখার প্রশ্ন নেই। তখন গুগলের জন্মই হয়নি। মা যা কিছুই করেছেন সবই ম্যানুয়াল। নিজের ক্রিয়েশন। তখন ওভেন ছিল না, টোষ্টার ছিল না, রাইস কুকার ছিল না, একসাথে চার/ পাঁচটা বার্নারের গ্যাসের বা ইলেকট্রিক চুলা ছিল না। মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে প্রচুর ধোঁয়ায় চোখের জলে নাকের জলে একাকার হয়ে রান্না করতেন মা। তখন তো আর একজষ্ট ফ্যান ছিল না! তবুও এখন পর্যন্ত আমার কাছে সেই সব রান্নাই শ্রেষ্ঠ। জীবনে অনেক দামি রেস্টুরেন্ট খেয়েছি। দেশে বিদেশে, লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিও, প্যারিস, টরন্টো, লসএঞ্জেলেস কিন্তু মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ সব কিছুর চেয়ে আলাদা ছিল। মা ছিলেন পৃথিবীর সেরা শেফ। নিউজার্সি থেকে একজন কিছু পিঠার ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করেছেন। বরিশালের মেয়ে বলেই হয়ত।

আমাদের অঞ্চলে এই পিঠা খুব জনপ্রিয়।

পিঠাটার নাম পাকওয়ান পিঠা। আমরা বলতাম পাক্কান পিঠা। এই পিঠাটা মা বানাতেন। খুব স্বাদ ছিল। মা মারা যাওয়ার পর এই পিঠা খেয়েছি বন্ধু পত্নী আইভির হতে বানানো। আইভির রান্নার হাত অনন্য। এখন অনেক নতুন নতুন খাবার সম্পর্কে জানছি আমরা। বিজ্ঞান অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। ইনগ্রিডেন্ট বদলে গেছে। সবই প্যাকেটে পাওয়া যায়। শান, রাধুঁনি বা প্রাণের মসলা জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু মা কোনোদিন সেই সুবিধা পাননি। মসলা পাটা পুতায় বাটতেন। হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, আদা, রসুন এই সব। জিনজার বা গারলিক পেষ্ট কি মা জানতেন না। এতো মসলার ব্যবহারই জানা ছিল না তার। প্রয়োজনও বোধ হয়নি। সামান্য লবন, তেল, মরিচ, হলুদ আর পেয়াঁজ দিলেই খাবার হয়ে উঠত অতি সুস্বাদু। এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, কর্ণ অয়েল, ভেজিটেবল অয়েল কি মা জানতেন না। সরিষার বা সোয়াবিন তেল ছিল যথেষ্ট। কত ধরনের গরম মসলা এখন। তখনও হয়ত ছিল। মা জানতেন না। দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, পেস্তা, জিরা, তেজপাতা, জয়ফল এসবের ব্যবহার ছিল কদাচিৎ। ডীপ ফ্রিজ কাকে বলে মা জানতেন না। যেদিনের খাওয়া সেদিনই শেষ করতাম আমরা। শীতের দিনে হয়ত দু’একদিন বেশি রাখা যেতো গরম করে করে।

ব্রেকফাষ্ট নিয়েও কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। চায়ের সাথে মুড়ি বা গরম ভাত খেতাম। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে একটু ঘি হলে ফাইভস্টার হোটেল ফেল। পান্তা ভাতও খেতাম। কনকনে ঠান্ডার দিনে পান্তার সাথে জিওল মাছের তরকারি বা কাঁচা মরিচের সাথে পিঁয়াজ দিয়ে ডলে খেয়ে নিতাম। এখন যেমন নানা পদের খাবার খাই আমরা। ডায়াবেটিস আছে বলে কত বাছ বিচার করি। তখনও মানুষের ডায়াবেটিস ছিল। হোল হুইটের ব্রেড, টুয়েলভ গ্রেন, মাল্টি গ্রেন, প্লেন কত ব্রান্ডের ব্রেড। বিভিন্ন টাইপের সিরিয়াল, ওটমিল, ওমেগা থ্রি ডিম, এক, দুই বা তিন পার্সেন্ট বা স্কিম মিল্ক, অর্গানিক কলা, মা এসব কিছুই জানতেন না। গুরুর দুধ খেতাম আমরা। দুধের সর খেতাম। কি সুন্দর ঘ্রাণ ছিল সেই হলুদ রঙের সরের। এখনও নাকে লেগে আছে। মা প্রায়ই ছিটা পিঠা বা চিতই পিঠা ভাজতেন মাটির সাজে। মনে হয় এগুলো গরিবের খাবার ছিল, বানানোও সহজ। খুদের ভাত করতেন মা। কখনও কখনও চাপটি। একটু হলুদ, পিয়াঁজ আর কাচা মরিচ দিলেই রংটা ফুটত। এপিটাইজার, মূল কোর্স বা ডেজার্ট সার্ভ করার কথা মা জানতেন না। চা, কফি, রেড ওয়াইন, হোয়াইট ওয়াইন এসবও জানা ছিল না।

মুড়ি ভাজতেন নিজেই। আট দশ টিন মুড়ি বা খই ভেজে ফেলতেন। কোনো সার দিতে হতো না। জানতেনও না। বছরব্যাপী সেই মুড়ি খই খেতাম আমরা। সব্জিতো সবই মায়ের হাতের লাগানো। মাচানে মাচানে লাউ, ঝিঙা, ধুল, শিম, বিন ধরত। আলু দিয়ে শিমের লাবড়া ছিল তুলনাহীন। শিমের বিচি খুঁটে খুঁটে খেতাম। কাঁঠালের বিচির ভর্তা করে দিতেন পোড়া মরিচ দিয়ে। হলুদ কুঞ্জলতায় ছেয়ে থাকত কাঁটাঝোপের বেড়া। কলইর শাক খেতাম। আরো কত এলেবেলে খাবার খেতাম। ঢেঁকির শাক জিনিসটা কি দেশে এখন পাওয়া যায়! খোঁজ নিতে হবে। লবঙ্গ লতা মেয়ের মতো মোলায়েম ছিল সেই শাক। বনে জঙ্গলে হতো।

খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমার মধ্যে একটা গ্রাম্যতা রয়ে গেছে আজও। আমি কি একটু আনস্মার্ট! এখন যেমন আমরা অর্গানিক খুঁজি, তখন সবই ছিল অর্গানিক। হেলথি খাবার। ফরমালিন কি জিনিস কেউ জানতে না। খাদ্যে ভেজাল ছিল না। মা সবই করেছেন রেসিপি ছাড়া কিন্তু সবকিছুতে ছিল মায়ের হাতের স্পর্শ আর কষ্টের ঘাম..।

ঢাকা ২৯  ডিসেম্বর ২০২৪

জসিম মল্লিক

লেখক ও সাংবাদিক

টরন্টো

jasim.mallik@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *