সুফিবাদ ও বাংলাদেশ
অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব -৫
উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে মূলত: অভিবাসী সুফিসাধকদের মাধ্যমে, যারা আরব, ইয়েমেন, পারস্য, মধ্য এশিয়া থেকে এদেশের মাটিতে এসেছিলেন। এরা সাধারণ মানুষের নিকট পীর, দরবেশ, অলী-আউলিয়া হিসেবে পরিচিত। সাহাবা কেরামদের জীবদ্দশায়ই এ সকল সুফি দরবেশ বিভিন্ন আরব বণিকদের সাথে পৃথিবীর দূর-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে মুসলমান নৃপতিগণের ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক বিজয়ের ছত্রছায়ায় এই সুফিসাধকগণ আরও অধিক সংখ্যায় দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার অবাধ সুযোগ পান। তাঁরা চলে যান ভিন্ন আচার ও ভিন্ন কৃষ্টির মানুষের একেবারে দোরগোড়ায়। ফলে দেশের আনাচে, কানাচে গড়ে ওঠে খানকা, দরবার, মাযার, দরগা ইত্যাদি। স্থানীয় ভাষায় এ-সকল সুফিরা ফার্সী ভাষার আদলে ‘পীর’ নামে অভিহিত। আর ইউরোপীয় ভাষায় তাঁরা ‘সুফি’ নামে পরিচিত।
ঊনবিংশ শতকে ওরিয়েন্টালিস্টরা উপমহাদেশে সুফিদের আবিষ্কার করে ইউরোপে সুফিবাদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স চালু করেন। এভাবে পাশ্চাত্যের ওরিয়েন্টালিস্টরা ইউরোপে সুফিবাদের ওপর একাডেমিক গবেষণার সূত্রপাত করেন এবং সুফিবাদের ওপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সুফিবাদের ওপর আজ যত না মুসলিম স্কলার পাওয়া যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশী অমুসলিম বিদ্বজ্জন পাওয়া যায় এবং তা পাশ্চাত্য দেশে। ইউরোপীয় গবেষক ও পর্যটকরা সুফিবাদকে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত করে দেন। এখানেই পীরবাদ ও সুফিবাদের মধ্যে পার্থক্য। উপমহাদেশের আপামর সরল সাদাসিধে জনগণ বুঝে বা না-বুঝে যা গ্রহণ ও অনুসরণ করে তা স্থানীয় ভাষায় ‘পীরবাদ’ (Pirism) নামে পরিচিত হলেও পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের কাছে তা দার্শনিক বিষয়বস্তু হিসেবে ইসলামি মরমীবাদ (তাসাউফ) বা তাঁদের ভাষায় ‘সুফিবাদ’ (Sufism) হিসেবে গণ্য হয়েছে। সুফি তরিকা বা সিলসিলার উদ্ভব হয়েছে অনেক পরে। একাদশ এবং দ্বাদশ শতকের দিকে সুফিসাধকরা কোন না কোন সংগঠিত সংস্থা বা সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে থাকেন। জন্ম হতে থাকে সিলসিলার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় বা সুপ্রতিষ্ঠিত সুফির নামানুসারে তরিকা বা সিলসিলার নামকরণ করা হয়। বেশিরভাগ সুফি তরিকা সুন্নি ইসলামের সঙ্গে যুক্ত, তবে শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যেও সুফিসাধক আছেন, বিশেষকরে পারস্যে। সুফিদের সামাজিক ভূমিকা যতটা না সমাজ সংস্কারের সঙ্গে জড়িত, তার চেয়ে বেশী অধ্যাত্ম সাধনার (spiritual practice) মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মন জয় করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে সুফিবাদ বলতে মূলত: নকশেবন্দি, মুজাদ্দেদী, চিশতি ও কাদেরী Ñ এই চারটি তরিকার প্রাধান্য দেখা যায়। তবে, এর বাইরেও ছোট বড় অসংখ্য তরিকার প্রভাব আছে। অসংখ্য কামেল অলী-আউলিয়ার পুণ্যভূমি, জন্মভূমি বা দরবার শরীফ এই বাংলাদেশে। এ সকল কামেল পূণ্যাত্মার প্রভাব দেশের আপামর জনসাধারণের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ-দেশ আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থান। অভাব-অনটনে পীড়িত, অন্যায়-অবিচারে নিপীড়িত, দুঃখ-যন্ত্রণায় নিপতিত এবং শোষন-বঞ্চনায় নির্যাতিত এ দেশের আপামর খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণ সর্বদাই অনুসন্ধান করেছে আত্মিক শান্তি, আবদ্ধ হয়েছে কোন না কোন তরিকার শিকলে (সিলসিলায়), আশ্রয় খুঁজেছে আধ্যাত্মিকতার হিম-শীতল শান্তির পতাকাতলে। বাংলাদেশের কামেল অলী-আউলিয়ারা তাঁদের চারিত্রিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের কারণেই সর্বজনবিদিত ও সর্বজনস্বীকৃত। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা অতি পবিত্র, অতি সম্মানিত। তাঁরা ইনসানে-কামেল, কামেল অলি, বা কামেল পীর বলে পরিচিত এবং তাঁদের নামের সঙ্গে যখন ‘পীর’ কথাটা যুক্ত করা হয়, তখন কেউ কোন প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু এর বাইরে ‘পীর’ কথাটার অন্য একটা ব্যঞ্জনা আছে।
বাংলাদেশে ‘সুফিবাদকে’ অনেকে ‘পীরবাদ’ বলেন। আর তাদের কাছে ‘পীরবাদ’ মানেই কোন না কোন মাযার বা দরবার বা দরগা। অনেকে রাতারাতি ‘পীর’ হয়ে যান। কেউবা দাবি করেন যে, রাতে এশার নামাজ পড়ে মসজিদে ঘুমিয়ে পড়েন, আর স্বপ্নে রাসূলুল্লাহকে দেখেন। পরদিন ‘পীর’। আবার অনেকে স্বপ্নে ‘ওষুধ’ পেয়ে যান। পরদিন কবিরাজ। অনেকে আবার নিজের আধ্যাত্মিকতার প্রমাণস্বরূপ বিখ্যাত বিখ্যাত সুফিসাধককে স্বপ্ন দেখার দাবি করেন। পরদিন সাগরেদের সমারোহ। তাদের স্বপ্নকে অপ্রমাণিত করবে কে এবং কীভাবে? ধর্ম নিয়ে ধোঁকা দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু অসাধুর ধোঁকাবাজি বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২০০৭ সালে প্রায় ১০০টির মতো মাযারের ওপর সরেজমিনে জরিপ করে দেখা গেছে যে, এমন অনেক মাযার আছে যাকে কেন্দ্র করে অনেক অলৌকিক ঘটনার কিংবদন্তি আছে, অথচ সেসব মাযারের নেই কোন সুনির্দিষ্ট ইতিহাস বা শরিয়তের আলোকে সুফিবাদের অনুশীলন। জরিপে দেখা গেছে যে, কোন এক সময়ে গড়ে ওঠা বা পৈতৃকসূত্রে পাওয়া মাযারে পারিবারিক ব্যবসাস্থল বলে অনেকে দোষারোপ করেন। এখানে আধ্যাত্মিক সাধনার বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ। যারা প্রতারক তারা কিছু চাটুকার ভক্ত-তোষামোদকারীর মাধ্যমে ‘পীর’ সাজেন বা স্বার্থের জন্য অন্যকে ‘পীর’ সাজান। তরিকতের নামনিশানা বা সিলসিলাবিহীন অসংখ্য নামসর্বস্ব মাযার আছে দেশের আনাচে-কানাচে, যেখানে কোন না কোন ‘খোদাঈ ক্ষমতাসম্পন্ন পীর’ ছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। মাযারের একটা নাম আছে, কিন্তু তরিকার কোন নাম নেই, ইতিহাস নেই। আবার যে নাম পাওয়া যায়, ইতিহাসে তার কোনো স্থান নেই। এমন অনেক আজগুবি মাযার আছে, যেখানে হয়ত কোনোকালেই কোন পীর ছিলেন না। নিছক কিছু কাকতালীয় ঘটনার সাযুজ্যে কিছু অবিশ্বাস্য কাহিনীকে কেন্দ্র করেই হয়ত গড়ে উঠেছে মাযার, যাকে অনেকে ‘কবরপূজা’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
আবার, নামনিশানা, বা ইতিহাস, বা সিলসিলার পরিচয় পাওয়া না গেলেই যে তা আজগুবি মাযার হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। একথা সত্য যে, যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বিরুদ্ধ-মতানুসারীর আক্রোশ ও আক্রমণের কারণে অনেক সুফি-পীরের মাযার কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বা ক্ষয়িষ্ণু প্রদীপের ন্যায় নিভু নিভু শিখায় আজও প্রজ্বলিত আছে। কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক গবেষণাই তা প্রমাণ করতে পারে। আমরা যা দেখেছি তা হলো সত্য বা মিথ্যা যাই হোক প্রতিটি মাযারকে কেন্দ্র করে কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আজও সেখানে বছরে অন্তত: একবার কিছু উৎসাহী ধর্মভীরু মানুষ বাৎসরিক উরস উপলক্ষ্যে মাযার জিয়ারত করে ও মানত করে। প্রায় ৮০ শতাংশ মাযারে দেখা গেছে কোন ধরনের পানিপড়া এবং তাবিজ-কবজ ইত্যাদির প্রচলন নেই। তবে, এর বিপরীতে কিছু মাযার, এমনকি ঢাকার মতো চকচকে শহরে নামিদামি মসজিদের কিছু ইমাম সাহেবকেও রীতিমতো আসর জমিয়ে, জ্বিন-পরী-ভুতের আছর দেখিয়ে পানি-পড়ে, ঝাড়-ফুঁক করে কত শিক্ষিত লোকের নিকট থেকেও পয়সা হাতিয়ে নিতে দেখা যায়। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এরা প্রচার করে যে, অমুক ‘পীর’ অনেক ক্ষমতাশালী, অমুক ‘পীর’ জ্বীন-পরী দিয়ে ‘অসুখ’ সারাতে পারে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু এরা কি পীর? নাকি ভণ্ড কবিরাজ?
আজকাল পত্র-পত্রিকায় একটা খবর প্রায় দেখা যায় তা হলো ‘ভণ্ড পীর’, বা ‘ভণ্ড পীরানী’। বিজ্ঞানের অভাবিত উন্নতির যুগে মানুষের অসুখ-বিসুখে চিকিৎসক কোন না কোন রোগ নির্ণয় করে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। কিন্তু একশ্রেণীর কতিপয় প্রতারক ঐ একই রোগীকে এভাবে দেখেন যে তার ওপর ‘জ্বিন-ভূতের’ আছর হয়েছে। ফলে, জ্বিন-ভূত ছাড়ানোর জন্য তাবিজ, কবজ, পানিপড়াসহ নানা ধরনের চাতুর্যপূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড করে রোগীর জীবন বিপন্ন করে তোলে। আর এই পর্যায়ে যখন প্রতারক ধরা পড়ে, তখন খবর বের হয় যে, ‘ভণ্ড পীরের কারণে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন’। এখন প্রশ্ন হলো: তাবিজ, কবজ, পানিপড়া ইত্যাদি কি পীরের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভূক্ত? এই ভণ্ড বা প্রতারক ব্যক্তিটিকে ‘ভণ্ড চিকিৎসক’ বা ‘ভণ্ড কবিরাজ’ এভাবে না দেখে তাকে “ভণ্ড পীর” হিসেবে কেন দেখা হবে? আমাদের দেশে যে-সকল সুফিসাধক ইসলাম প্রচার করেছেন তারা কি এসব জ্বিন, ভূত, প্রেত, পরীর সাহায্য নিয়েছিলেন? সুফিবাদে পানিপড়া, ঝাড়ফুঁক, বা তাবিজ-কবজের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করার কোন নজির বা বিধান আছে কি? এগুলো ভণ্ড কবিরাজী, বা ভণ্ড ফকিরি কার্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত নয় কি?
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘দারিদ্র আমার অহংকার’। ঈসা নবী (আ.) বলেছেন ‘দরিদ্ররা আশীর্বাদপুষ্ট’। এখানে ‘দারিদ্র’ কথাটাকে রাসূলুল্লাহ অধিবিদ্যক অর্থে ব্যবহার করেছেন, ব্যবহারিক অর্থে নয়। সসীম মানুষ অসীম আল্লাহর অনন্ত ক্ষমতা ও গুণের নিকট আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে কিছুই নয়, শূন্য, অর্থাৎ দরিদ্র। এই দারিদ্রতা আধ্যাত্মিকতার মাত্রার দিক থেকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়। এ অর্থে প্রতিটি মানুষই ‘আধ্যাত্মিক ফকির’। উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশে ও ভারতে কেউ কেউ অতিমাত্রায় মজ্জব হয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছেছেন যে, ‘আধ্যাত্মিক ফকির’ এখন ‘জাগতিক ফিকিরি’ করেন। এদের বৈশিষ্ট্য হলো লম্বা লম্বা দাড়ি, গোঁফ, জটাধারী চুল, ছিন্ন-ভিন্ন পোশাক, সারা শরীরে বিশেষ করে গলায় অসংখ্য লতাপাতা, লোহা-লক্কড়ের মালা, হাতে গাঁজার কল্কে, মুখে নেশা-ভাঙের গন্ধ। প্রায় সারাক্ষণই নাপাক অবস্থায় এদের থাকতে দেখা যায়, নামায-রোজা কখনও করে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ এদের ‘ফকির’ বলে, না হয় ‘পাগল’ বলে। তাদের বদদো’আ কোন ক্ষতির কারণ হতে পারে এই আশঙ্কায় মানুষ তাদের বিরাগভাজন হতে ভয় পায়, কারণ তাদের বিশেষ কেরামতির ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা হয়। আবার একথাও বিশ্বাস করা হয় যে, এই পাগলের মধ্যে হয়ত কোন ‘প্রকৃত আধ্যাত্মিক পাগল’ লুকিয়ে আছেন, যিনি দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, কেননা দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন আধ্যাত্মিক সাধুপুরুষরা ইহজগৎ সম্পর্কে একটু খেয়ালি বা অন্যমনস্ক থাকেন, যা অনেকের নিকট ‘পাগলামি’ বলে মনে হয়। ঢাকার হাইকোর্টের মাযার কিংবা মিরপুরের হযরত শাহ আলীর মাযার প্রাঙ্গণে অগোছালো পাগলবেশধারী লোকের প্রচুর আনাগোনা দেখা যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ নামাজ-রোজা একেবারেই করেন না, কিন্তু নেশা করে ‘যিকর’ করেন। নামাজ মুমিনের মিরাজস্বরূপ। নামাজ ব্যতিরেকে এ ধরনের ‘জিকিরের’ বিধান কোন সুফি তরিকায় আছে কি? এটা কি সুফিবাদ, না পীরবাদ, না ফকিরীবাদ? না বৈরাগ্যবাদ?
মজার ব্যাপার হলো এই সব বৈরাগ্যবাদী, ফকির ও ফিকিরীবাদী, নেশাখোর, ঝাড়-ফুঁক, পানিপড়া, তাবিজ-কবজ, মাদুলি ব্যবসায়ীরাও ‘পীর’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এরা সুফিও নয়, পীরও নয়, কারণ সুফি বা পীর ইসলাম-বহির্ভূত কোন ভিন্নমতাবলম্বী ধর্মগোষ্ঠী বা জাতিগোষ্ঠী নয়। আর তাঁদের প্রথম পরিচয় শরিয়ত, যা ইসলামের ভূষণ। কিন্তু শরিয়তের কোন রীতিনীতি বাংলাদেশের তথাকথিত ফকির, বাউল, বা কারও কারও মতে ‘পাগল’-এর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। তবে সুফিদের ‘প্রেম’ বা বৈষ্ণবদের ‘ভক্তিবাদের’ ছাপ তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এ-সকল ‘ফকির’ বা ‘পাগল’ যখন কোন মাযার প্রাঙ্গণে আশ্রয় গ্রহণ করে তখন সাধারণ ধর্ম-ভীরু মানুষ তাদের সাথে সুফি বা পীরের সামঞ্জস্য আছে বলে ভুল করে। অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, এ-সকল ‘পাগল’ বা ‘ফকির’ পীরের প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে, যারা প্রকৃত পীর তাঁদেরকেও সন্দেহের চোখে দেখার একটা প্রবণতা দেখা যায় অনেকের মধ্যে। এজন্য শাহসুফি খাজা এনায়েতপুরী তাঁর যাকেরদের কামেল অলি দেখে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলতেন, তা না হলে জীবনে ঠকার সম্ভাবনা থাকে। আর তিনি বলতেন ‘মরা ভালো, কিন্তু ঠকা ভালো নয়’।
আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিক উভয় অর্থে ইসলামে ‘ফকির’ কথাটা আছে, কিন্তু শরিয়তবিরোধী ‘ফকিরী’ বা ‘পাগলামী’, কিংবা ‘ফিকিরী’ বা ‘ভণ্ডামি’ নেই। সুফিবাদে আধ্যাত্মিক শিক্ষক হলেন একজন ‘সুফি’ বা ‘পীর’। ‘পীর’ ফার্সী (Farsi) শব্দ। এর আরবী প্রতিশব্দ হলো ‘শেখ’ বা ‘হযরত’, যার অর্থ হলো ‘প্রবীণ ব্যক্তি’। তরিকতের ভাষায় ফার্সী ‘পীর’ আরবী ‘মুর্শিদ’ বা ‘আধ্যাত্মিক গাইড’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে সুফিবাদকে হেয় অর্থে ‘পীরবাদ’ বলে কটাক্ষ করা হয় বলে মনে হয়। ‘পীর’ বা ‘আধ্যাত্মিক শেখ’ ব্যতিরেকে সুফিবাদের চর্চা নিষ্ফল। কিন্তু সুফিবাদের চর্চায় মুর্শিদের প্রয়োজনীয়তাকে ওহাবী বা সালাফী সম্প্রদায় অস্বীকার করে। এ সম্প্রদায়গুলো ইসলামে কেবল বাহ্যিক অর্থাৎ শরিয়ত পালন করে, অন্যদিকে প্রকৃত সুফিবাদ ইসলামে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থাৎ শরিয়ত ও তরিকত উভয় দিকের ওপর সমান গুরুত্ব আরোপ করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ শাহসুফি খাজা এনায়েতপুরীর দর্শন। তিনি তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন এই বলে যে, “শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফত Ñ এই চারটি জিনিস একত্রে আদায় করলেই পুরা শরিয়ত আদায় হইল। শরিয়ত ছাড়িয়া দিয়া তিন জিনিসের যেকোনো একটি আদায় করলে তাহা মূল্যহীন।”
সুফিবাদ ও ওহাবী আন্দোলন
ঊনবিংশ শতক সুফিবাদের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সময়ে ইউরোপে সুফিবাদের ওপর একাডেমিক গবেষণা শুরু হয়। কেবলমাত্র সুফিবাদ নয়, ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে স্থান পায়। এ শতকে সুফিবাদের বিক্ষিপ্ত দর্শনতত্ত্ব সমন্বিত এবং সংগঠিত করা হয় এবং সুফিতত্ত্বসমুহ এক একটি তরিকা বা সিলসিলার রূপ পরিগ্রহ করে। এর পূর্বে সুফিবাদের কোন সংগঠিত ও সাংগঠনিক রূপ পরিলক্ষিত হয় নি। আর এক দিক থেকে ঊনবিংশ শতককে সুফিবাদের ইতিহাসে চরম সংকটপূর্ণ সময় বলা যায়। এ সময় সুফিবাদের ওপর বিরোধিতা চরম আকার ধারণ করে। আর এ বিরোধিতা আসে মূলত: দুই দিক থেকে। এদের একটি হলো ‘আধুনিকতাবাদ’ (Modernism) আর অন্যটি হলো তথাকথিত ‘শুদ্ধিবাদী শক্তি’ (Puritanism), যা ওহাবীপন্থী হিসেবে পরিচিত। এ দুটিই ইসলাম-বহির্ভূত কোন বাহ্যিক পরাশক্তি নয়, বরং ইসলামেরই অভ্যন্তরীণ স্বার্থান্বেষী শক্তি। এই দুই শক্তি প্রকৃতপক্ষে একই মুদ্রার দুই পিঠ। এ দুটিই ইসলামে মৌলবাদ হিসেবে পরিচিত।
আধুনিকতাবাদীরা মনে করেন যে, আট শত বছরের পাশ্চাত্যে মুসলিম শাসনের পতনের অন্যতম কারণ হলো শাসন ব্যবস্থায় সুফিবাদের প্রাধান্য তথা জাগতিক বিষয়ে নিস্ক্রিয়তা, বৈরাগ্যবাদীতা, অ-আধুনিকতা। ইসলামি রাষ্ট্রে অইসলামি রাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির যথার্থ ব্যবহার না হওয়ার কারণে আধুনিকতাবাদীরা সুফিদের দায়ী করেন। সবচেয়ে বড় বাধা আসে তুরস্কের বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক, সামরিক শাসক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি মুস্তাফা কামাল পাশা আতাতুর্কের (১৮৮১ – ১৯৩৮) মাধ্যমে। অটোম্যান শাসনামলে সুফি তরিকাসমূহ, যেমন খালওয়াতিয়া (চতুর্দশ শতকে প্রতিষ্ঠিত), বাইরামিয়া (চতুর্দশ শতকে প্রতিষ্ঠিত), জালওয়াতিয়া (সপ্তদশ শতকে প্রতিষ্ঠিত), বিশেষ করে নকশেবন্দিয়া তরিকা (চতুর্দশ শতকে প্রতিষ্ঠিত) যে পৃষ্টপোষকতা পেয়েছিল তা ১৯২৫ সালে কামাল পাশা আতাতুর্ক তুরস্কের আধুনিকতার প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় সুফিদের বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং এমন কি অসংখ্য সুফিকে হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক এই বিরোধিতার সঙ্গে সুফিবাদের ওপর একাডেমিক এবং তাত্ত্বিক বিরোধিতা শুরু করেন মরমী কবি মুহাম্মদ ইকবাল, যাকে পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়। উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতেও সুফিবাদের যে প্রভাব সরকার বা রাজনীতিতে ছিল তা-ও সেক্যুলারিজমের অভূতপূর্ব উত্থানের ফলে ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে।
তবে ঊনবিংশ শতকে সুফিবাদের ওপর আক্রমণের চরম আঘাতটা আসে ইসলামেরই সুন্নি সম্প্রদায়ের ওহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে। আবদুল ওহাব (১৭০৩ – ১৭৯২) মক্কা, মদিনা এবং বসরায় অধ্যয়ন করেন এবং ইসলামে তাঁর ভাষায় শিরক, বিদাত ইত্যাদি থেকে মুক্ত করার জন্য ইসলামের তৌহিদের নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে সুফিবাদের ওপর প্রবল আক্রমণ গড়ে তোলেন। তাঁর এ আন্দোলন ‘ওহাবী আন্দোলন’ হিসেবে প্রথমে সৌদি আরবে এবং পরে সৌদি সরকারের অর্থায়নে ও পৃষ্ঠপোষকতায় সারা বিশ্বে, বিশেষ করে উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সৌদি আরবে জন্ম ও বিকশিত ওহাবীবাদের আর একটি নতুন নাম হলো ‘সালাফীবাদ’, কারণ এ মতবাদ ইসলামের আদি বা ‘সালাফে’ প্রত্যাবর্তন করার কথা বলে। সালাফী মতবাদ বা ওহাবী আন্দোলন গোঁড়া মৌলবাদী আন্দোলন, কেননা এরা সালাফী মতবাদের বাইরে অন্য কোন মতানুসারীকে স্বীকার করে না এবং বিজ্ঞান, যুক্তি, প্রযুক্তি, প্রজ্ঞা বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদিসের কোন বিষয়ের নতুন কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ গ্রহণ করে না। কেবল তাই নয়, ওহাবীরা ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন মতাবলম্বীদের স্বীকার করে না। পাশ্চাত্যে এরা ইসলামের জিহাদী, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী ও উগ্রবাদী হিসেবে পরিচিত। ওসামা-বিন-লাদেন এই ওহাবী আন্দোলনের কেবল অর্থ-যোগানদাতা ধনকুবের নন, বরং সশস্ত্র জিহাদী জঙ্গি নেতা।
ওহাবীরা ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতকের ইসলামের ইতিহাসকে কেবল সমালোচনাই করে না, বরং সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে এই যুক্তিতে যে, ঐ সময়ের ইসলামি কলা, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, সুফিতত্ত্ব ইত্যাদি ইসলামের মৌলিকত্ব বা মূলনীতিকে খর্ব করে। একইভাবে তারা ঊনবিংশ শতকের মুসলিম সংস্কারবাদীদের ইসলামের কতিপয় বিষয়ের নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, যা পাশ্চাত্যের ধাঁচে নারী স্বাধীনতা, সম-অধিকার, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, পারিবারিক আইন ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তার বিরোধিতা করেন। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সুফিদের মাযার জিয়ারত, মাজারে মানত, কবরের উপর সৌধ নির্মাণ, সুফি-পীরের বাইয়াত গ্রহণ ইত্যাদি পৌত্তলিকতা মাত্র। সুফিরা হযরত মুহাম্মদকে (সা.) যেখানে আল্লাহর প্রিয় হাবিব, আল্লাহর রাসূল, সিরাজুম মনির, রাহমাতাল্লিল আলামিন, শাফিয়াল মুযনেবিল হিসেবে কুরআন ও হাদিস মোতাবেক তাঁর ওপর দরুদ, দোয়া, সালাম বখশিশ করে আল্লাহর অশেষ নেকী অর্জন করেন বলে মনে করেন, সেখানে ওহাবীদের নিকট তিনি নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ; ফলে তাঁর ওপর দোয়া, দরুদ ও সালামের কোনোই মূল্য আছে বলে মনে করেন না। এমন কি রাসূলুল্লাহর মাযারে গিয়ে ভক্তিভরে মাযারের ধূলিকণা স্পর্শ করা, পবিত্র বলে সে ধূলিকণা চুম্বন করা বা কপালে ছোঁয়ানো, ফাতিহা শরীফ পাঠ করে মাযারের দিকে মুখ করে মুনাজাত করা, মাযারের দেয়াল ধরে রাসূলুল্লাহর অছিলায় আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করা ইত্যাদিকে ওহাবীরা ‘শিরক’ বলে মনে করে। ওহাবীদের দৌরাত্ম্যে ও রোশানলে ইসলামের অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মৌলবাদীরা সৌদি আরবসহ সব দেশেই সুফি কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করেছে।
এতৎসত্ত্বেও বিংশ শতকে সুফিবাদ সুদান, মিশর, সিরিয়া, আলজিরিয়া, মরক্কো, সেনেগাল, পারস্য, মধ্য এশিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশে একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পাশ্চাত্যে আধ্যাত্মিক নৈরাজ্যবাদে অতিষ্ঠ হয়ে শিক্ষিত সুধিসমাজ আধ্যাত্মিক শিকড়ের টানে সুফিবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করতে থাকেন। এ ধারা আজও অব্যাহত আছে। বিশ শতকে সুফিবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহের কারণ হিসেবে বলা যায় ইউরোপে ইসলাম ও সুফিবাদের ওপর একাডেমিক গবেষণা, সুসংগঠিত সুফি তরিকার উদ্ভব, সুফিদের স্থানীয় সামাজিক প্রথার সঙ্গে আত্তীকরণ, সুফিদের সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবন, পরধর্মসহিষ্ণুতা ও সামাজিক সম্প্রতীতিতে আন্ত:ধর্মীয় সংলাপে সপ্রতিভ অংশগ্রহণ।
উপসংহারে বলা যায়, ইসলামি জীবন হলো আত্ম-সমৃদ্ধিশীল বৈচিত্র্যের মধ্যে পরিবর্তন। জীবন মানেই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং এগিয়ে নেওয়া। ভাবতে অবাক লাগে রাসূলুল্লাহর সময় ইসলামের ইতিহাসে যেখানে আত্ম-সংরক্ষণমূলক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, আজ সেই ধর্মান্ধতা ইসলামি দুনিয়ায় মুসলমানদের মরণব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ইসলাম গোঁড়ামীশূন্য ধর্ম। আর আজ গোঁড়ামি সবচেয়ে বড় আসন গেঁড়ে বসেছে ইসলামে। কুরআন ইসলামকে ইব্রাহিম (আ.) এবং অন্য ইসরাঈলী নবীদের ধর্ম বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। ইসলাম বলে যে, শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস নয়, বরং তাঁর পূর্বে বিভিন্ন জাতিতে যে সকল নবী-পায়গম্বর আল্লাহর একত্ব এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা প্রচার করেছেন তাঁদেরকেও সম্মান করতে হবে। তবেইতো পরিপূর্ণ মুসলমান হওয়া যায়। আল্লাহপাক এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, “হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করো আল্লাহতে, ও তাঁর রাসুলে, ও কিতাবে যা তিনি নাজিল করেছেন তাঁর রাসুলের কাছে, আর সেই কিতাবে যা তিনি নাজিল করেছিলেন এর পূর্বে। আর যে-কেউ আল্লাহতে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে, তাঁর রাসূলগণে এবং কিয়ামতের দিনে অবিশ্বাস করে, সে নিশ্চয়ই পথভ্রষ্ট হয়েছে” [সূরা নিসা (৪):১৩৬]। এই হলো সমন্বয়বাদী সর্বজনীন ধর্ম ইসলাম। (চলবে)
অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর
টরন্টো