আমাদের ছোট্র গ্রাম

নজরুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমাদের সে যুগে সবাই রাজনীতি করতো না। ১৯৫৪ যুক্ত ফ্রন্টের ইলেক্শনের কথা আজও কিছু মনে পড়ে।  তার পরে ও অনেক ইলেকশন দেখেছি, শ্রীরামপুরের মুজিবুল হক (MLA) ইলেকশন এ পাশ করেছেন। তার পরে ও ১৯৭০ এর ইলেকশন আব্দুল আউয়াল (MP) পাশ করেছেন। এ সব ইলেকশন এ কোনো রকম দাঙ্গা, মারামারি হতে দেখি নি, কে কাকে ভোট দেবে? ওটা ব্যক্তিগত। আজকাল সবাই রাজনীতি করে এবং সবাই বড়ো নেতা।

লাঙ্গল যার জমি তার: ব্রিটিশ আমলে ভারতের জমিজমা জমিদার, উপ -জমিদারদের হাতে চলে যায়। হিন্দু ও মুসলমান জমিদার তাদের পছন্দের লোকদের জমিজমা দিয়ে খাজনা আদায় করে ব্রিটিশ রাজকোষে একাংশ জমা দিয়ে বাকি নিজেরা ভোগ করতো। তাতে এক শ্রেণীর লোক জমি থেকে উপকৃত হলেও অধিকাংশ লোক প্রতারিত হয়। ব্রিটিশদের  বিরুদ্ধে তিতুমীর, হাজি শরীয়তুল্লাহ, এ কে ফজলুল হক, আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আরো ও অনেকেই আন্দোলন করেছেন। কয়েক শত বৎসরের আন্দোলনের ফলে জমিদারি উচ্ছেদ হলেও ভূমির প্রকৃত মালিকানা থেকে গরিব কৃষরা বঞ্চিত। গ্রামে গঞ্জে আজও তাকালে দেখা যাবে এক শ্রেণীর লোক জমিজমার মালিক, গরিব কৃষক ভূমির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। সে যুগে যারা একটু পড়াশুনা জানতো, চালাক-চতুর এবং জমিদার বা উপ- জমিদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে, ওরাই ভূমি বেশি দখল করেছে।  আশেপাশের গরিব কৃষকদের দিয়ে চাষাবাদের কাজ করিয়ে ফায়দা লুটেছে এবং যুগের পর যুগ এই কৃষি জমির সঠিক মালিকানা না দিয়ে নিজেরা জমিদার, উপজমিদার সেজে অসহায় কৃষকদের ভূমি থেকে বঞ্চিত করেছে। এ নিয়ে সে যুগে অনেক আন্দোলন যেমন “লাঙ্গল যার জমি তার” হলেও ব্রিটিশ সরকার কর্ণপাত করে নি। এ সব আন্দোলনের অগ্রদূত এ কে ফজলুল, তিতুমীর, মওলানা ভাসানী, হাজি শরীয়ত উল্লাহ এবং ভারতের অসংখ্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। এ সব জমিদার ব্রিটিশ সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে তিতুমীরের মতো লোকদের বিরুধ্যে যুদ্ধ করিয়েছে। ১৯৪৭ সনে ভারত ভেঙে দুই ভাগ হলেও কৃষকদের ন্যায্য দাবির কোনো মীমাংসা হয় নি। ধীরে ধীরে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলেও ন্যায্য মালিকানা অবহেলিত কৃষকরা পায় নি। আজও গ্রাম গঞ্জে গেলে দেখা যায় ভূমিহীন গরিব খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছে। 

আমাদের আশেপাশেও সেই চিত্র দেখে আমি অনেক সময় দুঃখ পেতাম। একই বাড়ি ৫ কি ৭ পরিবার বাস করে, দেখা যায় ৩-৪টি পরিবার অনেক জমিজমা, গোয়াল ভর্তি হালের গরু, চাকর,  কামলা সবই আছে। পুকুরের ৯০% তাদের, বাকিদের কিছুই নেই বা যা আছে এ দিয়ে ভরণপোষণের ব্যবস্থা হয় না এবং কাজ করে কোনো রকমে খেয়ে/ না খেয়ে বেঁচে আছে। আমাদের গ্রামে করিমন ও কলিম এর  মতো বহু পরিবার আজও আছে যাদের দু’বেলা খাওয়া জুটে না। কিছুদিন আগের কথা, এই গ্রামেরই এক ছেলে সহায় সম্বলহীন, ঢাকা শহরে ঠেলা  গাড়ি চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে পিছনে স্ত্রী, অসহায় ছেলেমেয়ে রেখে। তার অসহায় ছেলেমেয়েরা আজ ও কোনো রকমে খেয়ে/না খেয়ে বেঁচে আছে।      

বাংলাদেশের গ্রামীন জীবন। ছবি : লার্নিং টু ফ্লাই.অর্গ

গ্রাম ভর্তি গাছপালা, সন্ধ্যা হলে মনে হতো যেন অনেক রাত্রি। বিদ্যুৎ থাক দূরের কথা অনেকের হারিকেন ও ছিল না। রাতে প্রাকৃতিক কাজের জন্য বাইরে যেতে হলে, হয় লণ্ঠন (চেরাগ) বাতি বা এই অন্ধকারে পা টিপে টিপে যেতে হতো। কাঁচা পায়খানা, এতো ছিল দোজখ (হেল)। বৎসরের পর বৎসর পরিষ্কারের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া লোকজন রাতের অন্ধকারে এখানে সেখানে পায়ে চলার পথের পাশে পায়খানা করে রাখে। সে যুগে গ্রাম তো দূরের কথা, ছোট ছোট শহরগুলিতেও সেনিটারি সিস্টেম ছিল না। পুকুরে নিজেরা গোছল করা থেকে শুরু করে, মাছ ধরা,কাপড় ধোয়া,গরু গোছল করানো, এবং এই পানি দিয়ে রান্না,খাওয়া সবই হতো। সে যুগে আমাদের ছোট্ট গ্রামে কোনো টিউবয়েল ছিল না। এই পুকুরের পানির উপর সবাইকেই নির্ভর করতে হতো। 

সুদিন মৌসুমে আমরা আধ কিলোমিটার দূরে “গান্দার  আন্দি” থেকে কলসি ভর্তি করে খাবার পানি নিয়ে আসতাম। তার একমাত্র কারণ হলো এই দীঘির চারিদিকে কোনো বাড়ি ঘর  ছিল না। দীঘির চারি পাড়ে ভিটা ও অসংখ্য আম গাছ ছিল এবং সন্ধ্যা হলেই পাখির কিচির মিচির শুরু হতো। কিন্তু এই দীঘির পানি কতটা পানের উপযোগী তা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন ছিল না। এই দীঘিতে গরু, মানুষ গোছল করতো।

কলেরা শুরু হলে  এই গ্রাম, সেই গ্রাম ছড়িয়ে পড়তো।  লোক জনের মলমূত্র সহ কাপড়, কাঁথা সবই পুকুরে ধোয়া হতো এবং পুকুরের পানি দিয়ে রান্না খাওয়া সবই হতো। ভয়াবহ কলেরা শুরু হলে দ্রুত এই ঘর/ সেই ঘর ছড়িয়ে পড়তো। এই মহামারীর কোনো চিকিৎসা নেই, লোকজন মারা যাচ্ছে। গ্রামের কবিরাজি আর হুজুরের পানিপড়া,তাবিজ দিয়ে চিকিৎসা করানোর উপর অন্ধ বিশ্বাস তো ছিলই। নিকটে কোনো হাসপাতাল ছিল না, মতলবের (ICDDRB) কলেরা হাসপাতাল তখনও হয় নি। তাছাড়া আমাদের গ্রাম থেকে ৮ মাইলেরও অধিক দূরত্ব এবং বর্ষায় নৌকা বা সুদিনে পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। গ্রামের মানুষের রাত/দিন চিৎকার করে বলতে শুনেছি:

“আলী আলী জুলিফিকার ,

মারবো হাতের তীর,

যাই পথে আয়েছত বালা  ,

হেই পথে গির ,

লাইলাহা ইল্লাল্লাহু। ”

এই স্লোগান  হলো মহামারী কলেরার চিকিৎসা, লোকজন মনে করতো কলেরা গজবি বালা, এই বালা আলীর নাম নিলে ভয়ে চলে যাবে। তারও অনেক পরে ১৯৬০ দিকে আমেরিকার সাহায্যে প্রথম কলেরা হাসপাতাল মতলবে (চাঁদপুর) স্থাপিত হয়। এত এত রোগী হাসপাতালে নেয়া হতো, রোগী জায়গা দেয়া হাসপাতাল কতৃপক্ষের সম্ভব হতো না; রোগী নৌকায় এবং বাইরে তাবু খাটিয়েও চিকিৎসা করানো হতো।   

গুটি বসন্ত : সে যুগে গুটিবসন্ত শুরু হলে সারা গ্রাম ছড়িয়ে যেত, রোগীকে মশারি খাটিয়ে রাখা হতো যাতে মাছির দ্বারা এই রোগ ছড়াতে না পারে ; শরীরে গুটি বসন্তের দাগ কখন ও মুছে যায় না। কলেরার মতো এটা ও মহামারী যা শুরু হলে গ্রাম কে গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। সে যুগে গুটি বসন্তের টিকা ছিল না, তুকতাক চিকিৎসা করানো হতো এবং ব্যাথায় জ্বর এবং শরীরে ক্ষত হলে সহজে শুকাতে চাইতো না। এই গুটিবসন্তে বহু লোক মারা যেত।   

আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র, সেই প্রথম থানা থেকে হেলথ ইন্সপেক্টর এসে প্রতিটি ছেলেমেয়েকে টিকা দিতে দেখলাম। আমার দুই হাতে দুইটি করে চারটি টিকা দেয়া হয়েছে, ঘা শুকাতে তিন/চার মাস লেগেছে। মারে বাবারে বলেও রক্ষা নেই, মা তো গ্রামের বনাজী বা কবিরাজি  চিকিৎসা একটার পর একটা করে যাচ্ছে। কিন্তু আরোগ্য হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না। জ্বর এবং টিকার দাগ তুকতাক পাউডার দিয়ে ঘা শুকাতে অনেক দিন লেগেছে। আমার দুই হাতের কালো দাগ আজও স্পষ্ট দেখা যায়।    দ্বিতীয় বার আমি স্কুলে দরোজার কাছে বসেছি, ইন্সপেক্টর সর্ব প্রথম আমার বিপরীত দিক থেকে টিকা দিতে শুরু করে।  আমি বই খাতা নিয়ে দরজা দিয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে দৌড় আর দৌড়, পিছনে তাকানোর সময় কোথায়?   

গ্রামে শীতের আমেজ অন্যরকম

সে যুগে, শীতের মৌসুমে, ভোরে খেজুরের রস দিয়ে মা -চাচীরা চাউলের ফিরণি বা পায়েশ রান্না করে খেতে দিতো। ভোরে আমরা চুলার নিকট বসে দেখতাম, মা কি ভাবে এই ফিরণি রান্না করে। কাঁচা খেজুরের রস মা আমাদের খেতে দিতেন এবং রান্না হলে সঙ্গে সঙ্গে হাড়ি থেকে প্রথমে খেতে দিতেন। আমি যদি বলতাম,”স্বাধ হয়েছে”, মা খুশি হতেন। তাজা খেজুরে রসের অতি উত্তম স্বাধ ও সুগন্ধ তার সঙ্গে মুড়ি মিশিয়ে খেতে বেশ ভালো লাগতো। গ্রামে সবার খেজুর গাছ ছিল না, প্রতিবেশীদের থেকে সকালে খেজুরের রস কিনে এনে রান্না করে দিতেন। তা ছাড়া গ্রামের বাজারে সকালে এই রস পাওয়া যেত। যাদের বেশি গাছ, খেজুরে রস দিয়ে গুড় করে মাটির হাঁড়িতে সারা বৎসরের জন্য রাখা হতো। গ্রামের বাজারে মাটির কলসিতে এই গুড় সারা বৎসর পাওয়া যেত। আমাদের গ্রামে ওই যুগে প্রতিটি বাড়িতে খেজুর গাছ ছিল এবং বিকেল হলে গাছে নলিতে ছোট ছোট মাটির কলসি দেয়া হতো এবং ভোরে রস নিয়ে মা-চাচিদের দিলে ফিরনী বা গুড় করতো। মাঝেমধ্যে আমরা গ্রামের ছেলেরা রাতে তাজা খেজুরের রস দিয়ে ফিরনী রান্না করে খেতাম।

আমরা বাড়ির ছেলেরা বাংলা ঘর বা কাচারীতে রাতে ঢালাও করে ঘুমাতাম এবং খেজুরের রস দিয়ে ফিরণি করে একত্রে খেয়ে হৈচৈ করতাম। এ ছাড়া হরেক রকমের শীতের পিঠা তো অবশ্য থাকতো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে উঠানে কাঠ খড়ি বা খড় কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে আগুনের চারিদিকে গোল হয়ে আগুন পোহানের হিড়িক এবং সবাই মিলে নিজেদের শীতের পিঠা বা খেজুরের রসের শিন্নি খাবার কথা আজ ও ভুলে যেতে পারি না।

গ্রামের কৃষক মাঠের ধান কাটা শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে জমিতে সরিষা বুনে দিতো, যার জন্য কোনো আলাদা জমি চাষ করতে হতো না; আবার অনেকে চাষ করেও বীজ বুনতো। নাড়ার উপর সরিষা ফুলে ফুলে চারিদিকে সুন্দর সাজে সাজিয়ে থাকতো; দেখতে কতই মনোরম দেখাতো। গ্রামের মেয়েরা এই ফুল উঠিয়ে মাথায় চুলের বেনিতে দিয়ে সেজেগুজে পাড়া বেড়ানো আর এক দৃশ্য। সরিষার ক্ষেতে মৌমাছি ফুল থেকে মধু আহরণ করে গাছে চাকে সংগ্রহ করে রাখতো এবং এক দুইমাস পর পর রাতে মধু সংগ্রহ করা হতো। আমার মা নিজের খাঁটি মধু আমার জন্য যত্ন করে রেখে দিতেন; যখনই বাড়ি যেতাম, মা আমাকে খেতে দিতেন এবং সঙ্গে করে শহরে নিয়ে আসতাম।

ভোর হলে কৃষক গরু, লাঙ্গল, জোয়াল আর মই নিয়ে মাঠে যেত জমি চাষ দেয়ার জন্য। প্রতিটি বাড়িতে গোয়াল ঘর ভর্তি ছিল গরু; সকালে গোয়াল থেকে গরু বের করে ধানের খড়, ধানের ভুসি, ভাতের মাড় পানি দিয়ে খেতে দিতো। রাত্রে বাছুর আলাদা করে রাখা হতো যাতে দুধ খেতে না পারে এবং কৃষক নিজের গোয়ালের গাভীর দুধ নিজেরা খেত এবং বাজারে নিয়ে বিক্রি করে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে নিতো। কিন্তু আজকাল এ সব সুদূর স্বপ্ন, গ্রামে গরু নেই, গরুর পরিবর্তে মেশিন চিলিত কলের লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করা হয়। আজকাল গ্রামে পুরানো দিনের মতো, দুধ পাওয়া যায় না, পাউডার দুধ ব্যবহার করে। কিন্তু সে যুগে গোয়ালা খাঁটি দুধ, দধি ও মিষ্টি তৈরী করে বিক্রি করতো।

বৃষ্টি না হলে জমিতে ভালো ফসল হয় না, সে জন্য গ্রামের মুরুব্বিরা মাঠে খালি গায়ে বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তো আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। অনেকে বলতে শুনেছি, বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কেউ মাঠ থেকে বাড়ি ফিরত না। কিন্তু আজকাল সেচের মাধ্যমে জমিতে পানি দিয়ে এক জমিতে তিন ফসল ফলানো হয়।

আমরা চাষীদের দেখতাম মাঠের ধান কেটে মাথায় করে বা গরুর গাড়ি দিয়ে বাড়ি নিয়ে এসে গরু দিয়ে মাড়িয়ে ধান আলাদা করা হতো, খড় থেকে ধান আলাদা করার কাজে মা-চাচী বা গ্রামের মহিলারা সাহায্য করতো। আজকাল গ্রামে গরু নেই, তার পরিবর্তে মেশিন দিয়ে এ সব কাজ করানো হয়।

ডিঙি নৌকা: বর্ষার মৌসুমে (আমাদের ছোটকালে) নৌকা ব্যাতিত বাড়ির বের হওয়া যেত না, এমন কি, এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি যেতে হলেও নৌকা দরকার হতো। গ্রামে কত রংবেরঙের এর নৌকা মাঠ এবং খাল দিয়ে যাতায়াত করতো তার হিসাব দেয়া কঠিন : কোসা নৌকা, ঢুসা নৌকা, বিভিন্ন রকমের ছইয়া যেমন পালকি বা টিনের ছইয়া বর্ষার মৌসুমে বাদাম টেনে খাল দিয়ে যাতায়াত করতো। এ ছাড়া যারা পাটের ব্যবসা করতো, তাদের নৌকা বড়ো এবং খাল বা ছোট ছোট নদী দিয়ে বাদাম টেনে যাতায়াত করতো। নৌকার মাঝিদের ভাটিয়ালি সুরের গান শুনলে প্রাণ ভরে যেত। বেদেরা বর্ষার মৌসুকে পরিবার নিয়ে অনেক দূর-দূরান্তরে গিয়ে ব্যবসা করে রাতে নৌকাতে ঘুমাতো। মাঝিরা খাল দিয়ে কত রংবেরঙের নৌকা পাল তুলে দূরদূরান্তরে যেত এবং মনের আনন্দে গান গেয়ে লোকদের মন মাতিয়ে তুলতো। অনেকে নৌকাতে কলের গান লাগিয়ে মনের সুখে লোকজনকে আনন্দ দিতো; তারই দুইটি লাইন মনে পরে গেলো।

“মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে

আমি আর বাইতে পারলাম না।”

সে যুগে গ্রামের মানুষ মাটির কলসি, হাড়ি পাতিল ব্যবহার করতো। আমাদের পাশের গ্রামে কুম্ভকার সারা বৎসরের জন্য মাটির কলসি, থালা, ভাতের পাতিল, বদনা ইত্যাদি তৈরী করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতো। এমন কি গ্রামে বাড়ি বাড়ি নিয়ে ও বিক্রি করতো। সে যুগে গ্রামে এ সবের প্রচলন বেশি ছিল।

বিয়ের অনুষ্ঠানের পর পাত্রীকে পালকি দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর সময় মাটির কলসি বিভিন্ন সাজে সাজিয়ে মিষ্টি সহ পাঠানো হতো। মাটির কলসির জল বেশ ঠান্ডা থাকে এবং কৃষক মাঠে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে এই কলসির পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করতো। গৃহিণীরা ঘরের শিকায় বিভিন্ন রং বেরংয়ের হাড়ি ঝুলিয়ে রাখতো। মাটির হাড়িতে আজও আমাদের দেশের মিষ্টির কারিগর দই, খির এবং বিভিন্ন রকমের মিষ্টি তৈরী করে বিক্রি করে। এখন ও আমাদের দেশে এ সবের প্রচলন রয়েছে।

আমাদের মা-চাচীরা সে যুগে শিলপাটা ব্যবহার করে মশলা গুঁড়া করে রান্না করতো। আজকাল ও দেশ থেকে এ সবের প্রচলন সম্পূর্ণ ভাবে উঠে যায় নি। এই সুদূর কানাডাতে আমাদের দেশীয় মহিলারা শীল পাটা নিয়ে এসে মশলা পিষে রান্না করে। আমাদের দেশীয় অভ্যাস পরিবর্তন হয় নি।

কাঠের ঢেকি যা দিয়ে প্রতিটি পরিবার ধান থাকে চাল, চাল থেকে পিঠার আটা, মরিচ, হলুদ গুঁড়া করা আজকাল উঠে গেছে এবং এ সব বাজার থাকে কেনা হয়। এই কাঠের ঢেকি অনেক মূল্যবান, ধান কে সে যুগে চাল করার জন্য একমাত্র ঢেকি ব্যবহার করা হতো। ১৯৬০ এর দিকে আমাদের রঘুনাথপুর বাজারে একটা চাউলের কল বসানো হয়েছিল; তা ও লোকজন বড়ো বেশি এই কলে ধান নিয়ে যেত না। সবাই নিজেদের বাড়িতে ঢেকিতে চাল তৈরী করতো। স্কুল ছুটির পর, আমরা এই চালের কল দেখার জন্য গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, এ কত বড়ো আবিষ্কার।

আমাদের সে যুগে প্রতিটি গ্রাম বাজারে পালকি দেখা যেত, যত বিয়ে শাদী হত, তাতে এই পালকি ব্যবহার হতো। পালকি বহনকারী দের আমাদের এলাকায় বাছার বলা হতো, এই বাছারা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বর-কনেকে নিয়ে যাতায়াত করতো। বিয়ের দিনে পালকি দেখলে আমরা ছেলেমেয়েরা বর দেখার জন্য দৌড়ে যেতাম। আর বিয়ের যাত্রীরা পালকির পিছনে পিছনে হেঁটে বরের বা কনের বাড়ি যেত। অনেকে সে যুগে জুতা স্যান্ডেল ও ব্যবহার করতো না। বরের বা কনের বাড়িতে গেলে পানি, কাঠের খড়ম দেয়া হতো এবং মেহমান হাত পা ধুয়ে কাচারী ঘরে গিয়ে গোল হয়ে চাদরের উপর বসতো এবং চিনেমাটির বাসনে খাওয়া দেয়া হতো।

বর কারুকাজ করা সুতার রুমালে মুখ ঢেকে রাখতো; এ সব প্রচলন আজকাল সমাজ থেকে উঠে গেছে।

গ্রামে বিয়েবাড়িতে গীতের আসর বসতো। গ্রামের মহিলারা গায়ে হলুদ ও বিয়ে আসরে গান গেয়ে গরম করতো।

গ্রামে মসজিদ, মন্দির বা মেজবানীতে হোগলা বিছিয়ে ঢালাও সবাইকে বসানো হতো এবং মাটির থালা বা কলা পাতায় খাওয়া দেয়া হতো।

আমাদের দেশে সে যুগে এবং এ যুগেও ঠেলাগাড়ির প্রচলন আছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বড়ো, ছোট সব শহরেই এই ঠেলা গাড়ি পাওয়া যেত এবং পাওয়া যায় মালামাল বহন করার জন্য। কন্সট্রাকশনের এবং বাড়ি ঘরের মালামাল বহনের জন্য এই সস্তা যানবাহন সবাই ব্যবহার করে।

সে যুগে রাত জেগে আমাদের দেশে মহিলারা চিঠি লিখতো; গ্রামে বেশি লোক লেখাপড়া জানতো না। যারা জানতো তাদের কাছে অনেকেই চিঠি লেখার জন্য যেত এবং সুন্দর করে প্রিয়জনকে ইনিয়ে বিনিয়ে চিঠি লেখা হতো। চিঠি পাঠানোর পর প্রিয়জনের কাছে থেকে প্রত্যুত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে থাকতো। এক সময় চিঠির উত্তর পেয়ে কখন লুকিয়ে পড়তে চাইবে, আবার মাবাবা বা শশুর শাশুড়ির আড়ালে চিঠি খুলে বার বার পড়ে মনে হবে যেন পড়া শেষ হয় নি। “চিঠি দিও প্রতিদিন চিঠি দিও…”,আজকাল এই চিঠি লেখা দেশগ্রাম থেকে উঠে গেছে। তাছাড়া গ্রামের বাজারে পোস্ট অফিস আজকাল থাকলেও অকেজো। দেশ থেকে মানি অর্ডার সিস্টেম উঠে গেছে, বিদেশ থেকে মনিগ্রামের মাধ্যমে টাকা পাঠালে ১৫ মিনিটে পৌঁছে যায়।

সে যুগে আখ গ্রামে গরু দিয়ে মাড়িয়ে গুড় তৈরী করা হতো। আমি ১৯৬৪ সনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ি, থাকি মাঝিগাছা, এই গ্রাম থেকে কলেজ প্রায় দুই মাইল। এ সব এলাকায় প্রচুর আখের চাষ হতো। আমি এবং কলেজের বন্ধুরা বিকেলে নদীর পাড়ে বসে জমি থেকে আখ নিয়ে বসে বসে চিবিয়ে রস খেতাম। চাষীরা গরু দিয়ে মাড়িয়ে রস বের করে চুলায় গুড় করতো। আমরা মাঝে মধ্যে চুলা থেকে রস নিয়ে খেতাম।

গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে বাংলা বা কাচারী ঘরে মাদ্রাসা বা স্কুলের ছাত্র রাখা হতো ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করানো জন্য। এ ছাড়া এ সব বাংলা ঘরে গ্রামের দেন দরবার, বিয়েশাদি হতো। আজকাল অনেকের বাড়িতে বাংলা ঘর দেখা যায় না। এই প্রচলন গ্রাম থেকে উঠে গেছে।

তামাক ,হুক্কা, বিড়ি সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে। কৃষক নিজেদের জমিতে তামাকের চাষ করতো এবং নিজেরা ঘরে তৈরী করে হুক্কাতে বা কাগজের বিড়ি তৈরী করে নিজেরা বা অতিথি আপ্যায়ন করতো। আজকাল সমাজ থেকে এ সব বিদায় নিয়েছে এবং সবার পকেটে সিগারেট দেখতে পাওয়া যায়। যারা চাষ করতো না, বাজার থেকে তৈরী তামাক কিনে নিয়ে এসে সকাল বিকেল নারিকেলের হুক্কায় আগুন দিয়ে টেনে নেশা করতো এবং অনেকে আবার বাজার থেকে বিড়ি কিনে এনে পকেটে রেখে দিয়ে নিজে এবং বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়ন করাতো ।

আমার ছোটকালে গ্রামে বেড়ে উঠা যে সব ভাইবোন, বন্ধুদের সঙ্গে দিনরাত উঠাবসা, খেলাধুলা যথা হাডুডু, গোল্লাছুট,পুকুরে সাঁতার কাটা, এক সঙ্গে স্কুলে যাওয়া আসা, আম চুরি, নারিকেল চুরি, লিচু চুরি, রাত জেগে খেজুরের রসের শিন্নি খাওয়া, এ গ্রামে সে গ্রামে জারি গানের আসরে যাওয়া, বাতাসা, জিলাপির লোভে পূজা পার্বনে দল বেঁধে যাওয়া হতো; ছোটকালের একত্রে বেড়ে উঠা বন্ধুদের অনেকেই আজ আর জীবিত নেই। দু’চার জন যারাই বা জীবিত আছে, তাদের ও শারীরিক সমস্যা রয়েছে।

আমার গ্রামের সহজ সরল মানুষ; যেখানে রয়েছে একে অপরের সঙ্গে প্রাণের মিল; গ্রামের সেই মেঠো পথ ধরে হাঁটা,পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে বসে গল্পের আসর, ভাটিয়ালি গান গাওয়া। সেই যে শাহনাজ রহমতুল্লার কণ্ঠে বিখ্যাত গান:

“একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে”

আমাদের গ্রাম বাংলার সুন্দর মনের মানুষ, যাদের মধ্যে ছিল না কোনো বিদ্বেষ, সুখে/ দুঃখে সবাই অংশ নিতো । এই গ্রামে যা কিছু ভালো মন্দ, সবাই মিলেমিশে একত্রে করতো । এই গ্রামে সে যুগে ছিল না কোন দালান, ছিল টিনের বা ছনের ঘর, রাতে মাটিতে হোগলা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো।

আজ যুগের পরিবর্তনে মানুষের মধ্যে আগে বাড়ার প্রবণতা এসেছে এবং তার সঙ্গে অশান্ত পরিবেশের ও সৃষ্টি হয়েছে। এ আমাদের গ্রাম এবং এ গ্রামের মানুষ, আপন জন, এদের উন্নতি, গ্রামের উন্নতি এবং দেশের উন্নতি । গ্রামের উন্নতি হলে দেশের উন্নতি হবে। (চলবে)

নজরুল ইসলাম

টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *