কানাডার স্কুলগুলোতে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক শিশুই বুলিং এর শিকার
বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বলেছে তারা স্কুলে বর্ণবাদী আচরণ লক্ষ্য করেছে অথবা নিজেরাই বর্ণবাদের শিকার হয়েছে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪ : গত কয়েক দশকে কানাডা আরো বেশী বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে নানান দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের কারণে। তবে দেশটিতে নতুন প্রজন্মের শিশুরা এমন একটি বাস্তবতায় নিমজ্জিত হচ্ছে যা দেখতে তাদের পিতা-মাতা বা দাদা- দাদির আমলের চেয়ে অনেক আলাদা।
সন্দেহ নেই কানাডার স্কুলগুলোতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিশুদের উপস্থিতির কারণে ডাইভার্সিটি বা বৈচিত্র্য এখন একটি স্বীকৃত এবং আরামপ্রদ সত্য। কিন্তু নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে মূলধারার শিশুদের তুলনায় দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুরা বেশি সংগ্রাম করে যাচ্ছে এই পরিবেশে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে।
সত্যিকার অর্থে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে (যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭) কথা বলে দেখা গেছে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুদেরকে bullying বা নিপীড়ন ও অপমানের শিকার হতে হচ্ছে দেশের এমন এলাকাগুলোতেও যেখানে তাদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে।
University of British Columbia এবং Angus Reid Institute এর যৌথ গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা শে^তাঙ্গ শিক্ষার্থীদের তুলনায় তিনগুণ বেশী ব্যক্তিগত নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে। অন্যদিকে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে দ্বিগুণ।
আরও দেখা গেছে প্রতি দশজন শিক্ষার্থীর মধ্যে নয়জন এ সব বিষয় নিয়ে তাদের বাবা-মা বা পরিবারের অন্য কোন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে থাকে। অন্যদিকে নির্যাতনের শিকার প্রতি দশজন শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনজন জানায় তাদের স্কুলের স্টাফরা হয় এ সম্পর্কে অবগত নন বা তারা বিষয়টিকে উপেক্ষা করেন।
গবেষণায় বলা হয়, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বলেছে তারা তাদের স্কুলে বর্ণবাদী আচরণ লক্ষ্য করেছে অথবা নিজেরাই বর্ণবাদের শিকার হয়েছে। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজন (৫৮%) বলেছে তারা অন্য শিক্ষার্থীদেরকে নির্যাতন বা অপমানের শিকার হতে দেখেছে তাদের বর্ণ বা এথনিসিটির জন্য। আর ১৪% শিক্ষার্থী বলেছে তারা নিজেরাই তাদের বর্ণ বা এথনিসিটির জন্য নির্যাতন বা অপমানের শিকার হয়েছে।
করোনা মহামারির সবচেয়ে কুৎসিত প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হলো এশীয় বিরোধী বৈষম্য তীব্রতর হওয়া। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা এই ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে তারা জানায় এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। জরিপে যারা অংশ নিয়েছে তাদের মধ্যে অর্ধেকই বলেছে বৈষম্য তাদের জন্য বেদনাদায়ক ছিল এবং বেদনার এই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে বিরাজমান রয়েছে।
জরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে যারা বর্ণবাদের শিকার হয়েছে তাদের ৯২% জানায় এটি তাদেরকে বিরক্ত করেছে এবং ২৮% জানায় তিক্ততার এই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে বিদ্যমান অবস্থায় রয়েছে।
জরিপে আরো বলা হয় স্কুলে যারা বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছে বা প্রত্যক্ষ করেছে তাদের অর্ধেকই জানায় সাধারণভাবে শিক্ষার্থীরা এই ধরনের আচরণকে নিরুৎসাহিত করে। আর ৪৪% শিক্ষার্থী বলেছে অন্যরা এগুলোকে মোটেও গুরুত্ব দেয় না বা এরকম ভান করে যে কিছুই ঘটেনি। অবশ্য অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী বলেছে, অন্য শিক্ষার্থীরা এই বর্ণবাদী আচরণকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করে।
জরিপে আরো যে সব তথ্য উঠে এসেছে তার মধ্য আছে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের লড়াই। যে সকল শিক্ষার্থী স্কুলে বর্ণবাদী আচরণকে প্রত্যক্ষ করেছে বা নিজেই বর্ণবাদের শিকার হয়েছে তারা জানায় প্রায়শ শিক্ষকরা এই ধরনের আচরণকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেন এবং এটি নিয়ে বর্ণবাদী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। আর দশজনের মধ্যে তিনজন শিক্ষার্থী জানায় যারা বর্ণবাদী আচরণ করে তাদেরকে সাধারণত শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় বা সাসপেনশন করা হয় অথবা আটকে রাখা হয়। তবে প্রায় এক চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী জানায় শিক্ষকরা বর্ণবাদী আচরণকে উপেক্ষা করেন বা এটা সম্পর্কে অবগত নন।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, বুলিং এর শিকার হয়ে টরন্টোতে ১২ বছর বয়সী এক বাঙ্গালী বালক অর্ক চক্রবর্তী আত্মহত্যা করেছিল ২০১৯ সালের ২১ জুন। ঘটনার পর পুলিশ টরন্টোর মিডটাউন এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর পাশে অবস্থিত এক ঝোপ থেকে বালকটির লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, সে ঐ বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ঝাপিয়ে পড়ে। আর এটি যে আত্মহত্যা ছিল সেই খবর পুলিশ নিশ্চিত করে প্রায় চার মাস পর। ঐ সময় গ্লোবাল নিউজ তাদের এক খবরে এই তথ্য প্রকাশ করে। তবে এই আত্মহত্যার পিছনে বুলিং এর ভূমিকা ছিল এমন দাবিই করেন বালকটির মা দূর্বা মুখোপধ্যায়।
টরন্টো স্টার জানায়, যেদিন অর্ক ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সেদিন সে একটি সুইসাইড নোট লিখে বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। ঐ নোটে লেখা ছিল, “ I have been a disappointment to you. I have not been popular at school. No one will miss me if I‘ m gone..”
অর্ক মেধাবী ছাত্র ছিল। কিন্তু স্কুলে সে বুলিং এর শিকার হচ্ছিল। একদিন সে বুলিং এর শিকার হয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে শারীরিকভাবে আহত হয়ে। মৌখিকভাবেও সে বুলিং এর শিকার হতো।
দূর্বা মুখোপধ্যায় সন্দেহ করছেন এই বুলিং এর কারণেই হয়ত তার ছেলে অর্ক আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
অর্ক তার স্কুলে প্রায় ছয় মাস ধরেই নানাভাবে বুলিং এর শিকার হয়ে আসছিল। একবার আহত হয়ে বাড়ি ফিরলে তাকে নিয়ে সানিব্রুক হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। পুলিশকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছিল। কিন্তু যারা অর্ক-কে আঘাত করেছে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
সাম্প্রতিক কালে সাইবার বুলিং নামে আরেক আপদ এসে হাজির হয়েছে। সাইবার বুলিং এর শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে এমন ঘটনার নজিরও ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। সাইবার বুলিং পরিচালিত হয় অনলাইনের মাধ্যমে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে রিটেয়া পারসনস্ নামে এক কানাডিয়ান টিনএজ ছাত্রী সাইবার বুলিং এর শিকার হয়ে গত ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। ঐ সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল এটি। সাইবার বুলিং এর শিকার হওয়ার আগে সেই মেয়েটি তার এক বন্ধু ও সেই বন্ধুর আরো তিন সহযোগী কর্তৃক গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। পরে সেই ধর্ষণের চিত্র অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অনেক শিশু আবার বুলিং এর শিকার হলেও বাবা-মায়ের কাছে তা গোপন করে যায়। এমনকি স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও তারা নালিশ করতে ভয় পায়। তাদের ভয়- নালিশ করার পর যদি বুলিং এর মাত্রা আরো বেড়ে যায়? কোন কোন শিশু আছে যারা বুলিং এর শিকার হওয়াটাকে লজ্জাজনক বলে মনে করে এবং এই লজ্জা তারা প্রকাশ করতে চায় না।
উল্লেখ্য যে, আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় সে দেশে এশিয়ান-আমেরিকান স্টুডেন্টরা অন্যান্য এথনিক গ্রুপের চেয়ে অনেক বেশী মাত্রায় বুলিং এর শিকার হয়। শতকরা ৫৪ জন এশিয়ান-আমেরিকান স্টুডেন্ট বলেছে তারা ক্লাসরুমে বুলিং এর শিকার হয়েছে। সাইবার বুলিং এর ক্ষেত্রেও এশিয়ান-আমেরিকান স্টুডেন্টরা বেশি মাত্রায় ভুক্তভোগী। শতকরা ৬২ ভাগ এশিয়ান-আমেরিকান স্টুডেন্ট বলেছে তারা সাইবার বুলিং এর শিকার হয়েছে।
উপরের চিত্রটি কানাডার ক্ষেত্রে খুব একটা ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। উল্লেখ্য যে, নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহটি অন্টারিওতে “এন্টি বুলিং অ্যাওয়ারনেস উইক”। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় কানাডায় বুলিং রেট অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় অনেক খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
৩৫ দেশের মধ্যে কানাডার অবস্থান ২৬ তম!
বুলিং সম্পর্কে এখানে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো :-
– বুলিং সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যে সকল শিশু-কিশোর বুলিং এর শিকার হয় তারা মাথা ব্যথা, পেটে ব্যথা, ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ইত্যাদিতে ভুগতে পারে। বুলিং এর কারণে সৃষ্ট মানসিক সমস্যা ছাত্রজীবনের পরেও অব্যাহত থাকতে পারে।
– যারা বুলিং করে এবং যারা বুলিং এর শিকার হয় তারা উভয়ই অধিকতর মাত্রায় আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকে।
– যারা বুলিং করে এবং যারা বুলিং এর শিকার হয় তাদের উভয়ের ক্ষেত্রেই স্কুলে উপস্থিতির হার কমে যেতে পারে, লেখাপড়ায় মনোযোগ কমে যেতে পারে এবং বছর শেষে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হতে পারে।
– যারা বুলিং করে তাদের ক্ষেত্রে ড্রাগ ও এ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে উঠার ঝুঁকি বেশী। নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও এদের ক্ষেত্রে বেশী। এক জরীপ তথ্যে দেখা যায় যারা স্কুল জীবনে বুলিং করে বেড়ায় তারা ২৪ বছর বয়সের মধ্যেই কোন না কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
– বাধাপ্রাপ্ত না হলে এই শিশু বা কিশোর যখন যৌবনপ্রাপ্ত হবে বা তারও পরে কর্মজীবন ও সংসার জীবনে প্রবেশ করবে তখনো তার এই বুলিং করার অভ্যাস থেকে যায়। নতুন নতুন কৌশলে তখন তারা তাদের বুলিং চালিয়েই যেতে থাকে। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, প্রতিবেশীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ডেটিং ভায়োলেন্স, সেক্সচুয়াল হ্যারেজমেন্ট, ম্যারিটাল অ্যাবিউজ, চাইল্ড অ্যাবিউজ, এল্ডার অ্যাবিউজ এই সকল অপকর্মই তারা করে যেতে থাকে জীবনভর।
Ñ বুলিং একটি মানবাধিকার ইস্যু। যারা বুলিং এর শিকার হয় তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। জাতি সংঘের শিশু অধিকার সনদে কানাডা স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর একটি। সুতরাং বুলিং এর কারণে কোন শিশুর মানবাধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয় সেটি দেখার দায়িত্ব রয়েছে সরকারের।
সূত্র : www.prevnet.ca/bullying
শিশুরা বুলিং এর শিকার হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে বিশেষ নজর রাখার দায়িত্ব রয়েছে বাবা-মা’র। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিশুরা অনেক সময় লজ্জায় বা আরো বুলিং এর শিকার হতে পারে এই ভয়ে বিষয়টি বাবা-মা অথবা শিক্ষকের কাছে প্রকাশ করে না। তাই নিচের বিষয়গুলোর উপর বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে : –
১. তারা কি স্কুলে যেতে অনীহা প্রকাশ করছে?
২. পেটে ব্যথা করে এরকম অভিযোগ করছে?
৩. শরীরের কোন স্থানে আঘাতের চিহ্ন বা চোখের নিচে কালো দাগ অথবা কাপড়ের কোন অংশ ছিন্ন থাকলে সে সম্পর্কে অদ্ভুত বা আজব ব্যাখ্যা দিচ্ছে?
৪. তাদের ব্যক্তিগত কোনো জিনিস খোয়া গেছে কিনা?
৫. নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা বা বিরাগ প্রকাশ করে কি না?
শিশুরা বুলিং এর শিকার হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নজর রাখা যেমন বাবা-মা’র কর্তব্য, তেমনি কর্তব্য শিশুরা অন্য শিশুর উপর বুলিং করছে কি না সে বিষয়েও নজর রাখা। আর এর জন্য নিচের বিষয়গুলোর উপর বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে :-
১. কোন শিশু কি কাউকে নির্দেশ দিচ্ছে কি না বা বসী আচরণ করছে কি না।
২. অল্পতেই কোনো বিষয়ে হতাশ হয়ে পড়ছে কি না বা রাগান্বিত হয়ে পড়ছে কি না।
৩. হিংসাত্মক বা উগ্র কোনো খেলা অথবা টিভি শো দেখে চমৎকৃত হচ্ছে কি না।
৪. অন্যের প্রতি সহানুভূতির কমতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কি না।
৫. বাবা-মা, ভাই-বোন বা অন্য কোন ব্যক্তি কিংবা গৃহপালিত কুকুর বিড়াল ইত্যাদির প্রতি নির্দয় আচরণ করছে কি না।
যদি এরকম হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
– সূত্র : হাফিংটন পোস্ট।