ছায়া মানব

এ কে এম ফজলুল হক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চার

ক’দিন থেকেই শাশুড়ি আমার বাসায়। ছেলেকে মানে শফিক ভাইকে তার ভীষণ পছন্দ। কিন্তু মেয়েকে বোধ হয় আরেকটু বেশি। মা’রা সাধারণত ছেলেদের ঘেঁষা হয়। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার শাশুড়ি এ’র ব্যতিক্রম। উনি নানা ছুতায় মেয়েদের বাড়িতেই থাকতে পছন্দ করেন। এখন তিনি হিমির চিকিৎসার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। দেশে খবর দিয়েছেন যারা ভূত প্রেতের চিকিৎসা করে এমন লোকের সন্ধান করতে। ভালো লোক যেন হয়, ভন্ড নয় এমন। আমার এসবে বিশ্বাস কম। আবার চারদিকে যা দেখছি- তাতে অবিশ্বাসও করতে পারছি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম “হিমির যে অবস্থা এটা কি মনে করেন”? বললেন -অশরীরী কিছু।

বললাম -কিভাবে বুঝলেন ?

-আমি উইচক্রাফট নিয়ে কিছু বই টই ঘেঁটেছি। শুনে আমার বুক শুকিয়ে গেলো, বলে কি। পাশ্চাত্যে তাহলে এসব ও আছে?

উনি বললেন “তুমি কি ফ্রি মেসনের এর কথা শুনো নি”

আমি বললাম “হা শুনেছি”।

“এ ফ্রি মেসন কিন্তু এ’দেশে স্বীকৃত যারা উইচক্রাফট ম্যাজিক এসব নিয়ে চর্চা করে”।

আমি আর কথা বলতে পারলাম না- তাই তো’ এ’সব নিয়ে তো হর হামেশা-ই পত্রিকায় দেখছি – আমি কথা বাড়ালাম না।

সে রাতে ঘুমুতে যাবো এমন সময় আমাদের বেইজমেন্ট’এ ‘দুড়ুম’ করে শব্দ হলো। ‘কিসের শব্দ’ শুনে- আমার মেয়েরা ভয়ে একশা। শাশুড়ি বললো “চলতো একটু দেখে আসি”। আমরা সিঁড়ি বেয়ে নামছি এমন সময় শাশুড়ি বলে “সাবধান কোন শব্দ করো না”। বেজমেন্টের আলো জালানো হলো। দেখি আমার মেয়েদের- কান্ড বেখেয়ালে ডাম্বেল রেখে দিয়েছে দাঁড়ানো সুটকেসের উপর- ও’টা আর ভার রাখতে পারে নি, কাত হয়ে পড়ে গেছে। শুনে সবার কি হাসি! এ হাসাহাসির মধ্যে আমি জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা আপনি ওইদিন ফরিদকে এ’টিকে যেতে নিষেধ করেছিলেন কেন ?

-তোমার ওই কথা এখনো মনে আছে ?

-আমি বললাম “আছে”।

-করেছি কারণ ও’কে খুব এগ্রেসিভ মনে হয়, মনে হয় এখনি এটাক করবে-এমন!” 

আমি বললাম “আপনার কথা ঠিক না, এখনো বয়স কম তো তাই এরকম করে বয়স হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বললেন “কি জানি- হয়তো তাই”।

শফিক ভাই গেছেন আমেরিকা বেশ কয়েকদিন হলো। এখনো ফেরার নাম নেই- এতদিন ও’খানে কি করেন কে জানে? বেড়াতে গেলে’তো এতদিন থাকার কথা না। এ’র মধ্যে একদিন অবশ্য তার বোনের সাথে কথা হলো –‘বললেন তিনি নাকি কোন রহস্য উৎঘাটন করছেন’। কি এমন রহস্য আমার মাথায় ঢুকছে না; এফ, বি, আই’র সাথে কোন কাজ ? না তো- সে রকম ও কিছু মনে হয় না, কারণ তিনি চাকরি করেন এক অয়েল কোম্পানিতে। “সানকোর”। সানকোর তাকে অনেক বড়ো পদ দিয়েছে। সাথে বড় অফিস টরোন্টো’তে। এখন অবশ্য অফিস ও করতে হয় না, অনলাইন’ই কাজ করতে পারেন। এ সুযোগে তিনি দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাহ্ কি সুযোগ! তার এ সুযোগে আমরা দিশেহারা। তার বাসার গাছে পানি দেয়া, মেইল বক্সের মেইল চেক করা এসব করে যাচ্ছি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ও কিন্তু এ’রচেও জরুরী কাজ রিশাদকে নিয়ে সেটা তাকে কে বুঝাবে ?

রিশাদ ভীষণ টানা হেচড়ার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। একদিকে গার্মেন্টেসের ব্যবসা আরেক দিকে মেয়ের অসুস্থতা এ’দুয়ের মাঝে এক অস্থির সময় যাচ্ছে তার। শুনে ‘আমি বললাম চিন্তা করো না কোন কিছুর দরকার হলে আমরা তো আছি’। একথা বলতে না বলতেই একদিন রিশাদের ফোন ‘ভাই তাড়াতাড়ি আসেন’। ‘কি হয়েছে’? ‘সংক্ষেপে বলা যাবে না’। ‘এক্ষুনি আসেন’। ‘কোথায় আসবো ‘হিমির স্কুলে’ ।

হিমির স্কুল আমার অফিস থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটারের মতো। তার উপরে জ্যাম। টরোন্টোর জ্যাম, দুপুরের। গাড়ির পিছে গাড়ির লাইন। এ জ্যাম ঠেলে স্কুলে গিয়ে দেখি ফরিদ ও সেখানে উপস্থিত। হিমি রিশাদের হাতে ধরা, কাঁপছে। যেন ঝড়ে পড়া  কোন পাখির ছানা। আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। তাদের সামনে প্রিন্সিপাল হম্ভি তম্ভি করছেন। আমার স্কুলের সুনাম গেলো। সব গেলো। আমি এখন প্যারেন্টসদের মুখ দেখাবো কি করে ?

কি হয়েছে- আজ সকালে হিমি ঘুম থেকে উঠে বলে -স্কুলে যাবে। শাহানা বলে “না থাক। এখন যেও না। আগে পুরাপুরি সুস্থ হও, তারপর।

সে বলে ” না আমি সুস্থ। আমি যাবোই আর ডাক্তার ও তো বলেছে যেতে।

শুনে শাহানা বলে” ঠিক আছে তুমি যখন যেতে চাচ্ছ, যাও, কিন্তু সাবধানে থেকো”।

মেয়েকে ক্লাসে দিয়ে রিশাদ বসে থাকে অফিসে। লাঞ্চ ব্র্যাকের পরের ঘটনা। স্কুলের কোণার দিকে একটা বাথরুম। বাথরুমের পাশে একটা বিশাল পাইন গাছ। গাছটার ঢাল পালা অনাহূতের মতো এসে বাথরুমটা ছায়া করে রাখে। তাই বাথরুমের ভিতরটা দিনের বেলায় ও আলো কম। কিছুটা ভুতুড়ে বলে এই বাথরুমে কেউ যেতে চায়না। ক্লাস সিক্সের একটা মেয়ে কি মনে করে সে বাথরুমে যায়। আর চিৎকার ও চিৎকার করতে করতে বাইরে এসে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। তার চিৎকারে আশপাশের ক্লাসের সবাই জড়ো হয়ে যায়। সবাই জিজ্ঞেস করে ‘কি হয়েছে’, ‘কি হয়েছে’? সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ‘বাথরুমের গ্ল­াসে ভয়ঙ্কর চেহারার একটি মেয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে, তার চোখ দুটো পাথরের, পুরো শরীর সাদা, কোপাল জুড়ে ফাটার দাগ, চুল উস্কো খুশকো’। সে পিছন ফিরে দেখে হিমি। রিশাদের কথা শুনে আমার মাথায় হাত। এটা অনেক বড়ো ঘটনা। সাংবাদিকরা শুনলে পুরো রাষ্ট্র করে ফেলবে। এখনি থামাতে হবে এ’টা।

তারপর ওই মেয়েটিকে প্যারামেডিক এসে নিয়ে যায় হাসপাতালে। আর প্রিন্সিপাল বলে “ছেলেমেয়েরা তোমরা সবাই বাড়ি চলে যাও আজকের জন্য স্কুল ছুটি। কিন্তু কেউ যাবে না। তাদের অভিযোগ স্কুলে নাকি প্রায়ই ভূত দেখা যায় ‘শেষ কিছুদিন আগে’ও একজন দেখেছে’। সে নাকি টিচার’কে বলে নি ভয়ে টিচার বিশ্বাস করবে না তাই। আর দশটা স্কুলে যে’রকম বাচ্চারা কোন কিছু পেলে এ’র শাখা প্রশাখা বের করতে থাকে- এখানেও তাই, ভূত দেখার ঘটনা ওদিক ওদিক ছড়িয়ে যাচ্ছে। উপায়ান্তর না দেখে প্রিন্সিপাল পুলিশে খবর দিলেন। পুলিশের কথা শুনে ‘ভূত দেখা’ মেয়েটিকে আর আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ও এখন এ’কে এ’কে সবাই স্কুল ছেড়ে যাচ্ছে, আমরা শুধু বসে আছি পুলিশ আসার অপেক্ষায়।

পুলিশ আসছে না দেখে প্রিসিপাল বেশ বিরক্ত। তার পাশে বসা হিমির ক্লাস টিচার। ক্লাস টিচার মেয়েটাকে দেখে আমার ভরসা হলো। অল্প বয়স্ক ছিম ছাম চেহারা। কেমন একটা মায়া মায়া ভাব চেহারায়।

প্রিন্সিপালের মুখে কটু বাক্য “হোয়াট দা হেল, আই কান্ট্ বিলিভ”। এ কথা শুনে ফরিদ বললো “দেখো আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। ওকে নিয়ে আমরা একটা কঠিন সময় পার  করছি । ওর চিকিৎসা চলছে; তুমি তো নিশ্চয়ই জানো”

বললো “হা জানি, আমি ডক্টর’স নোট পেয়েছি”

“পেলে এমন করছো কেন, ও তো একটা বাচ্চা মেয়ে ওর প্রতি তো তুমি নির্দয় হতে পারো না”

“আমি তো নির্দয় হচ্ছি না, কিন্তু আমি কি করবো?”

“তুমি সবাইকে বোঝাবা সে মানসিক রোগী। ও’র চিকিৎসা চলছে”

“এটা মানুষ মানবে?”

“অবশ্যই মানবে”।

“কিন্তু সবাই তো বলাবলি করছে- সি ইজ অবসেস্ড (ভূতগ্রস্থ)” আমরা সে কথার জবাব দিলাম না। সময় যাচ্ছে আমরা অধোমুখে বসে আছি কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না। প্রিন্সিপাল এ’কে ও’কে কল করছে। বাইরে মনে হয়। কারণ ভেতরে কেউ নেই, স্কুল ফাঁকা।

এই সময় হিমির ক্লাস টিচার কথা বলা শুরু করলো।

“স্যার, আমি ও’কে এ স্কুলের প্রথম থেকে চিনি। সে খুব ভালো মেয়ে; শান্ত শিষ্ট। রেজাল্ট’ও ভালো। কোন কারণে সে এখন অসুস্থ। এরকম অসুস্থ’ত যে কেউ হতে পারে; পারে না! আমরা মাথা নাড়ালাম ‘পারে’। সে আরো বললো “তাহলে আমরা একটা কাজ পারি -ওকে বরং স্কুলে আসতে নিষেধ করি। সুস্থ হয়ে সে অন্য স্কুলে জয়েন করুক।”

‘ভালো প্রস্তাব’ এ কথায় দেখলাম-প্রিন্সিপাল ও সায় দিলো। ‘ব্যাস’ আমাদের আর পায় কে সাথে সাথে লুফে নিলাম এ প্রস্তাব। ঠিক হলো ‘আমরা হিমিকে নিয়ে যাবো এখনই’। ওর লকার খুলে বই খাতা নিয়ে নে’য়া হলো। লাইব্রিয়ান চলে গেছে তাই লাইব্রেরির বই দেয়া গেলো না, পরে এসে দিতে হবে। অফিসের কাজ ও শেষ। বিদায় নেবো, দেখি ক্লাস টিচার মেয়েটা কাঁদছে। এতো কিছুর পরও সে হিমিকে জড়িয়ে ধরলো, মাথা মুছে দিতে দিতে বললো “তোমার কোন দরকার হলে আমাকে কল করো কেমন” তার চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো হিমির খড়শুষ্ক চুলের উপর – আ হা কি হৃদয়কাড়া দৃশ্য! তা’হলে একেই কি বলে ‘মায়া’, সুস্থ অসুস্থ বুঝে না পৃথিবীর আদি থেকে অদ্য পর্যন্ত মানুষকে বুকে ধরে আছে এভাবে! কান্ডজ্ঞানহীন এ মায়ায় কতজন জীবন ফিরে পেয়েছে, তার হিসাব কে রাখে?

স্কুল থেকে আমরা শাহানার বাসায়। এসে দেখি পুলিশ উপস্থিত। পুলিশ বললো আমরা স্কুল থেকে এসেছি। কিছু কথা বলবো। কিছু কথা না তারা অনেক কথা বললো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করলো, অথচ তাদের কাছে হান্টসভিল পুলিশের রেকর্ড (কটেজের ঘটনা) আছে। আমরাও তাদের কথার জবাব দিলাম তোতা পাখির মতো। কারণ কিছু এলোমেলো বললেই বাচ্চাকে নিয়ে যাবে ছুতা ছাতা দিয়ে। যে করে হোক বাচ্চাকে ধরে রাখা চাই। ভাগ্গিশ অস্কার থানার রেকর্ডে একটা কথা লিখে রেখেছিলো ‘এবনরমাল বেহেভিওর’। সেটাই আমাদের সহায়ক হলো। আমরা সে কথার রেশ ধরে আগালাম। দেখলাম -পুলিশ দু’টো কেমন রুক্ষ, টরোন্টোর পুলিশ বলে কি’না কে জানে অথবা আমরা ব্রাউন পেরেন্টস বলে হয়তো এমন করছে। তাদের ভাবখানা যেন নির্যাতন করে বাচ্চাকে অসুস্থ করে ফেলেছি; যতবারই বলা হচ্ছে অসুস্থতার কথা কেবলি তারা হিমিকে জিজ্ঞেস করে “তোমার বাবা মা কি তোমাকে বকা দেয়”। হিমি উত্তরে বলে “আমার বাবা তো এখানে থাকেই না। আর মা আমাদের দু’বোনকে মাথায় তুলে রাখে” “ও আচ্ছা।” এ ধরো কোন কিছুতে রাগ হয়ে তোমার গায়ে হাত তোলে এ রকম কিছু’। বললো “কক্ষনো না” “তাহলে স্কুলের বাথরুমে অমন করলে কেন? বললো ‘আমার যখন খারাপ লাগে তখন ও’রকম করি, কেন করি জানি না, প্রথমে সব ঝাপসা দেখি। হিমি কথা শেষ করে না, আমরা দেখলাম এর মধ্যে যদি আবার ওসব হয়ে বসে তখন মহা সর্বনাশ। বললাম ” ভাই শুনো; বাচ্চা এতো অসুস্থ তোমরা তাকে এবার ওকে একটু রেহাই দাও, ওর রেস্ট দরকার”। ‘ও আচ্ছা আচ্ছা’ বলে তারা উঠে গেলো । 

এতো এতো ঘটনা শফিক ভাই আমেরিকা বসে শুনছেন তারপর ও আসছেন না – কারণটা কি ? আমি জানতে যাবো কি হয়েছে এই সময়ে দেখি তার ফোন ও তিনি ফোনে বললেন “রেডি থাকো নেক্সট সপ্তায় আসছি, আমরা আবার কটেজে যাবো’। আমি বললাম ‘ভাই আমি আর যেতে পারবো না, আর সেখানে যেয়ে কাজটা কি?’ বললো ‘কাজ আছে; ও তুমি বোধহয় ভয় পাচ্ছ, ভয় পেয়ো না আমরা এবার চারজন পুরুষ আছি’। চারজন মানে?

আমি, তুমি, ফরিদ আর জন।

এই জনটা কে?

জন হলো এ বাড়ির অরজিনাল মালিকের ছেলে। আমি ওকে খুঁজে বের করেছি। অনেক কথা আছে সাক্ষাতে বলবো। আমি বললাম ‘জন’ আসবে কিভাবে ?

বললো ‘ আমার সাথে। গাড়িতে’।

শফিক ভাইয়ের মাথা বোধ হয় পুরা আউট। না হলে কোথাকার কোন জন তাকে ধরে নিয়ে আসছে। বাড়ির মালিকের ছেলে বুঝলাম কিন্তু সে এসে করবে টা’কি? ভূত ঝাড়বে। আমি অপেক্ষায় রইলাম ‘কি হয় দেখি’! (চলবে)

এ কে এম ফজলুল হক

লেখক পরিচিতি :

কানাডা প্রবাসী এ কে এম ফজলুল হক একজন  সাবেক ব্যাংকার। অবসরে লেখালেখিও করেন। বর্তমানে টরন্টোর নিকটবর্তী পিকারিং এ পরিবার নিয়ে বাস করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *