কানাডার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ জোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করেন!
খুরশিদ আলম
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে ‘জ্যোতিষশাস্ত্র হলো এমন একটি শাস্ত্র, যা নভোমণ্ডলে বিভিন্ন জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদির অবস্থান বিবেচনা করে মানুষের ভাগ্যগণনা তথা ভাগ্য নিরূপণ করে। যারা এরূপে ভাগ্য গণনা করেন তাদের বলা হয় জ্যোতিষ।’
ভারতে এরকমই এক জ্যোতিষ এক নিম গাছের তলায় বসে মানুষের ভাগ্যগণনা করতেন। অনেক বছর ধরেই তিনি এই কাজটি করে আসছিলেন। হয়তো দূর দূরান্ত থেকেও তার কাছে আসতেন অনেক মানুষ।
কিছু দক্ষিণার বিনিময়ে এরকম এক জ্যোতিষীর কাছ থেকে যদি নিজের ভবিষ্যতটা জানা যায় তবে মন্দ কি? ভবিষ্যতটা জানা থাকলে আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা যেতে পারে। পরিহার করা যেতে পারে বিপদের রাস্তা। ভাগ্য উন্নয়নে নেয়া যেতে পারে নানান পদক্ষেপ। রোগ-বালাই বা দুর্ঘটনার হাত থেকেও রেহাই পাওয়া যেতে পারে আগে থেকে সবকিছু জানা থাকলে। এমনকি বিশাল অংকের লটারীও জয় করা যেতে পারে জ্যোতিষীর বাছাই করা নাম্বার দিয়ে।
তো সেই জ্যোতিষী ভদ্রলোক মানুষের ভাগ্যগণনার কাজটি করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন একটি নিম গাছের তলাকে। নিম গাছের নাকি অনেক গুণাগুণ আছে। সকল রোগের মহৌষধ নামেও এটি বেশ পরিচিত। ঔষধি গাছ হিসেবে এর ডাল, পাতা, রস সবই নাকি মানুষের কাজে লাগে। সম্ভবত এই কারণে তিনি এ স্থানটি বেছে নিয়েছিলেন। নিম গাছের ছায়ায় ভাগ্য গণনার কাজ করলে মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ইত্যাদি বৃদ্ধি পাবে এমন আশাও হয়তো ছিল ঐ জ্যোতিষীর।
কিন্তু একদিন এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল ঐ জ্যোতিষীর জীবনে। ফলে তাকে সেদিন দিতে হয়েছিল চরম মূল্য।
ঘটনাটি ভারতের একটি শহরের। সম্ভবত কোলকাতার। বেশ কয়েক বছর আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম খবরটি। সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানের কারণে ঘটনার সবটা মনে নেই। যেটুকু মনে আছে তা হলো – একদিন এক ঝড়ের কবলে পড়ে সেই নিম গাছের একটি বড় ডাল ভেঙ্গে পড়েছিল ঐ জ্যোতিষীর মাথায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে।
এখন প্রশ্ন হলো, যিনি ভাগ্য গণনা করে সবার ভবিষ্যত বলে দিতে পারতেন বলে দাবী করতেন, সেই তিনি নিজের ভাগ্যটি কেন গণনা করতে পারেন নি? ঐ দিন তার কপালে শনি আছে অর্থাৎ নিম গাছের ডাল তার মাথায় ভেঙ্গে পড়বে এবং তিনি সেই ঘটনায় মৃত্যুবরণ করবেন এই তথ্যটুকু কি তার জানা থাকার কথা ছিল না?
অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, এইরকম জ্যোতিষীদের কাছেই সাধারণ মানুষদের অনেকেই যাচ্ছেন তাদের নিজেদের ভবিষ্যত জানার জন্য। কি অগাধ বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা তাদের! যে ব্যক্তি নিজের ভবিষ্যত কি সেটাই বলতে পারেন না। সে নাকি বলে দিবে অন্যের ভবিষ্যত!
তবে দেখা গেছে কেবল ভাগ্যবিড়ম্বিত লোকেরাই যে এই জ্যোতিষীদের কাছে নিজের ভবিষ্যত জানার জন্য বা সেটি বদলানোর জন্য ধন্না দেন তা কিন্তু নয়। সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি, সেলিব্রিটিও আছেন এই তালিকায়। এমনকি কানাডার মত এমন একটি আধুনিক রাষ্ট্রেও বিপুল সংখ্যক মানুষ এই জ্যোতিষীদের কাছে যান ভাগ্য জানতে বা ভাগ্য বদলাতে।
জরিপে দেখা গেছে জ্যোতিষীদের মধ্যে অনেকের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এমনটি বিশ্বাস করেন শতকরা ৫১ ভাগ কানাডিয়ান! Angus Reid Institute পরিচালিত এক জরিপে এই তথ্য উঠে আসে।
কানাডিয়ানদের কুসংস্কারের বিষয়ে এরকম আরো কিছু চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে বিভিন্ন জরিপে। এর মধ্যে আছে :-
– অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাস: কানাডিয়ানদের মধ্যে শতকরা ৪৬ ভাগ লোকের বিশ্বাস রয়েছে ভূত বা অতিপ্রাকৃত বিষয়ের উপর। Ipsos এর জরিপে এই তথ্য উঠে আসে।
– জ্যোতিষীশাস্ত্রে বিশ্বাস : Angus Reid Institute কর্তৃক পরিচালিত অন্য এক জরিপে দেখা গেছে শতকরা ৩৫ ভাগ কানাডিয়ান জ্যোতিষীশাস্ত্রে বিশ্বাস করেন।
– জ্যোতিষীরা ভবিষ্যত বলতে পারেন এরকম বিশ্বাসীদের সংখ্যা শতকরা ২৮ জন।
প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা গেছে শতকরা ২০ ভাগ কানাডিয়ান জ্যোতিষীদের সঙ্গে দেখা করে তাদের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। যদিও বিজ্ঞান বলছে জ্যোতিষীদের এ জাতীয় কোন শক্তি বা ক্ষমতা নেই যা ব্যবহার করে তারা ভবিষ্যতবাণী করতে পারে। জ্যোতিষীরা যা করছেন তাকে অপবিজ্ঞান বা প্রতারণা হিসাবে আখ্যায়িত করছেন বিজ্ঞানিরা।
এই জ্যোতিষীদেরই একজন সম্প্রতি মারীয়া (ছদ্ম নাম) নামের এক কানাডিয়ান মহিলার কাছ থেকে ৪৬ হাজার ডলার বাগিয়ে নিয়েছিলেন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে। অন্টারিওতে বসবাসকারী ঐ মহিলা সিটিভি নিউজকে জানান, সম্প্রতি তিনি এক ধরণের মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তখন একদিন সড়ক পথে এক বিলবোর্ডে এক জ্যোতিষীর বিজ্ঞাপন দেখতে পান। ঐ বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল ‘৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জ্যোতিষী ও হস্তরেখাবিদ আপনার যে কোন সমস্যার সমাধান দিতে পারেন।’ ঐ বিজ্ঞাপনের ভাষায় আকর্ষিত হয়ে তিনি একদিন ঐ জ্যেতিষীর সাথে যোগাযোগ করেন। তার আশা ছিল ঐ জ্যোতিষ তার সমস্যা সমাধানে ভাল খবর দিতে পারবেন। কিন্তু জ্যোতিষ তাকে জানান যে তিনি মন্দ আত্মা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন। এ কথা শুনে মারীয়া বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। জ্যোতিষী তখন তাকে আরো জানান, ‘আপনি যদি এখন আমার কথামত না চলেন তবে বিপদে পড়বেন। আর আপনার ছেলেরাও প্রাণ হারাতে পারেন।’
সিটিভি নিউজ জানায়, সেই জ্যোতিষীর নাম মহাদেব। স্কারবরোর ৪৫১০ কিংস্টন রোডে অবস্থিত তার (মর্নিংসাইড রোডের কাছাকাছি) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি।
মারীয়া জানান জ্যোতিষী মহাদেব তার কাছে প্রথমে ১০ হাজার ডলার দাবী করেন তাকে মন্দ আত্মার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। এই মন্দ আত্মার কারণেই মারীয়া বর্তমানে নেতিবাচকতায় ভুগছেন। আর এখনই এই মন্দ আত্মার মোকাবিলা করতে হবে কালো যাদুর মাধ্যমে। নয়তো খারাপ কিছু ঘটবে।
মারীয়া জানান, মহাদেবকে দশ হাজার ডলার দেওয়ার পর সে আরো অর্থ দাবী করেন। মহাদেব বলেন মন্দ আত্মাগুলো বেশ শক্তিশালী। পরে মারীয়া কয়েক দফায় মহাদেবকে মোট ৪৬ হাজার ডলার প্রদান করেন।
মহাদেব মারীয়াকে বলেছিলেন ডলার শপ থেকে একটি বয়ম কিনে আনার জন্য। কারণ যাদু বিদ্যার মাধমে মন্দ আত্মাকে ঐ বয়মের মধ্যে আবদ্ধ করতে হবে। এরপর এই বয়ম নায়েগ্রা ফলস এলাকায় নিয়ে মন্দ আত্মাকে হত্যা করতে হবে।
মহাদেব আরো বলেছিলেন তার কথা অনুসরণ করলে মারিয়া সবচেয়ে বড় ‘লটো’ও জয় করতে পারবেন যার পরিমাণ সত্তর-আশি মিলিয়ন ডলার হতে পারে। সেই অর্থ দিয়ে তিনি লেকের ধারে বাড়ি কিনতে পারবেন।
এই সকল আশ্বাস আর কালো যাদু করার পর মহাদেব মারীয়ার কাছে আরো ২০ হাজার ডলার দাবী করেন। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, মন্দ আত্মা আবার ফিরে এসেছে। একে দূর করার জন্য এই অর্থ লাগবে।
এই পর্যায়ে এসে মারীয়া অনুধাবন করতে পারেন যে তিনি আসলে বড় ধরনের একটি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মহাদেব একজন বড় ধরনের ভণ্ড।
তিনি বলেন, আমি বেশ বিব্রত বোধ করি তখন। আমার আরও স্মার্ট হওয়া উচিত ছিল।
পরবর্তীতে সিটিভি নিউজের একজন প্রতিবেদক মারীয়াকে সাথে নিয়ে মহাদেব এর আস্তানায় যান। কিন্তু মহাদেবের আস্তানার দরজা তখন বন্ধ ছিল। মহাদেবকে না পেয়ে ঐ প্রতিবেদক তার বিজনেজ নাম্বারে কল করেন। মহাদেব ফোন ধরেননি। প্রতিবেদক তখন ভয়েস ম্যাজেস রাখেন এবং জানতে চান তিনি মারীয়ার কাছ থেকে ৪৬ হাজার ডলার নিয়েছেন কি না। পরে মহাদেব কলব্যাক করে বলেন, তার কোন ধারণা নেই এই মারিয়া কে এবং তিনি তার কাছ থেকে কোন অর্থ গ্রহণ করেননি।
তবে সিটিভি নিউজের ফোন কল পেয়ে মহাদেব বুঝতে পারেন তার প্রতারণার বিষয়টি মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে গেলে সে মহা বিপদে পড়বে। তাই নিজেই দিন কয়েক পরে মারীয়াকে ফোন দেন এবং তার সমুদয় অর্থ ফেরত দেন। মারীয়ার জন্য এটি ছিল একটি বিরাট স্বস্তির বিষয়।
প্রায় একই রকম প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন ২১ বছর বয়সী টরন্টোর আরেক মহিলা যার নাম জেসিকা (ছদ্ম নাম)। তিনি পড়েছিলেন প্রতারক এক মহিলা জ্যোতিষীর পাল্লায়। খুইয়েছেন ১১ হাজার ডলার। এবং সেই অর্থ আর ফেরত পাননি যেমনটা পেয়েছিলেন উপরে উল্লেখিত মহিলা মারীয়া। মারীয়ার প্রতারক জ্যোতিষী ছিলেন টরন্টোর বাসিন্দা। কিন্তু জেসিকার প্রতারক জ্যোতিষী ব্যবসা করেন আমেরিকার টেক্সাসে বসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টিকটক এর মাধ্যমে সেই জ্যোতিষীর সন্ধান পেয়েছিলেন জেসিকা। এই তথ্য জানা যায় সিটিভি নিউজের আরেক খবরে।
জেসিকার সৎ পিতা মৃত্যুবরণ করার পর সেই শোক কাটিয়ে উঠার জন্য তিনি আধ্যাত্মিক নিরাময় এর পথ খুঁজছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে সামান্য কিছু অর্থও পেয়েছিলেন তিনি তার সৎ পিতার কাছ থেকে। এই অর্থ দিয়ে কি করা যায় সে ব্যাপারেও পরামর্শ চাচ্ছিলেন তিনি। তখনই টিকটকের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় টেক্সাসের সেই জ্যোতিষীর সঙ্গে। সেই জ্যেতিষীও জেসিকাকে বলেন, হ্যা আমি দেখতে পাচ্ছি আপনার চারপাশে অনেক নেতিবাচকতা আছে। এই নেতিবাচকতাকে দূর করতে হবে।
জেসিকা সিটিভি নিউজকে বলেন জ্যোতিষী শুরুর দিকে প্রতি ‘রিডিং’ এর জন্য ২০ ডলার করে চার্জ করতেন। কিন্তু পরে তিনি দ্রুতই তার চার্জ বাড়াতে শুরু করেন। সেটার পরিমান ছিল শত শত ডলার। পরবর্তী দুই মাসে আরো বেশী করে চার্জ করতে শুরু করেন তিনি।
জ্যোতিষী নাকি জেসিকাকে বলেছিলন, তার কাছে থাকা অর্থের মধ্যেও নেতিবাচকতা আছে। তাই সেটিও দূর করতে হবে। তবে আশ্বাস দিয়েছিলেন নেতিবাচকতা দূর হওয়ার পর সেই অর্থ আবার জেসিকাকে ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু সেই অর্থ আর ফেরত দেননি সেই প্রতারক জ্যোতিষী।
জেসিকা বলেন, এই ঘটনা আমাকে বেশ রাগান্বিত করে তুলেছিল। আমি কেউ একজনকে বিশ্বাস করলাম আর সে আমার সাথে প্রতারণা করলো! আর আমিই বা কি করে এরকম সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তিকে এতগুলো অর্থ দিলাম সরল বিশ্বাসে? নিজেকে তখন খুব বোকা লাগছিল।
নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন Better Business Bureau’র মতে কানাডায় জ্যোতিষীদের প্রতারণার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই জ্যোতিষীদের টার্গেট থাকে প্রধানত তরুণ বয়সীরা। বিভিন্ন স্যোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে জ্যোতিষীরা এই তরুণদের টার্গেট করে থাকেন।
Canadian Anti-Fraud Centre-ও বলেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শত শত কানাডিয়ান এই জ্যোতিষীদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন। আর প্রতারিতদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৫ জন বিষয়টি পুলিশের নজরে আনেন।
উল্লেখ্য যে ২০২৩ সালে ৫৭ বছর বয়সী কানাডার এক ডুয়েল সিটিজেনকে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয় নিউ ইয়র্ক ফেডারেল কোর্ট। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি জ্যোতিষী সেজে প্রতারণার মাধ্যমে গত কয়েক দশকে প্রায় ১৩ লক্ষ আমেরিকান নাগরিকের কাছ থেকে ১৭৫ মিলিয়িনেরও বেশী ডলার হাতিয়ে নেন। সাবেক মন্ট্রিয়লবাসী এই প্যাট্রিস রানার কানাডা ও ফ্রান্সের দ্বৈত নাগরিক। তার আর কোন পেশা ছিল না। প্রতারণা করাই ছিল তার একমাত্র ফুটটাইম পেশা।
প্যাট্রিস রানার মন্ট্রিয়লসহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বসে তার এই প্রতারণার ব্যবসা চালাতেন। সর্বশেষ তিনি স্পেনে বসে এই প্রতারণার ব্যবসা চালানোর সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এবং প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় ২০২০ সালে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া হয়।
প্যাট্রিস বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অর্থ নিতেন জ্যোতিষী সেবা প্রদানের নাম করে। কিন্তু তিনি আসলে কোন সেবাই দিতেন না। যা দিতেন তা হলো একেবারেই সস্তা দামের কিছু জাল তাবিজ-কবজ।
কানাডায় এই জ্যোতিষীবিদ্যা বা জাদুবিদ্যার প্রসার ঘটার পিছনে কিছু কারণ রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হলো, এ দেশে এর অনুশীলন বেআইনি নয়। তবে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন :-
– প্রতারণামূলক অনুশীলন : কাউকে প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে এসব যাদুবিদ্যা, জ্যোতিষীবিদ্যা, ভাগ্যগণনার অনুশীলন করা যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, অর্থ বা সম্পত্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে আত্মা বা ইশ্বরের সাথে যোগাযোগ করার দাবী করাকে প্রতারণামূলক বলে মনে করা হয়।
– বিশ্বাস প্রকাশ করা : কোন বিশ্বাস ব্যবস্থা প্রকাশ করা অবৈধ নয় কানাডায়।
– ভাগ্য বলা : বিনোদনের জন্য ভাগ্য গণনা করা বা বলা বৈধ।
– কেউ যদি মনে করেন যে তিনি জ্যেতিষী বা ভাগ্যগণনাকারী দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন তবে তিনি পুলিশ কল করতে পারেন। আবার কোন জ্যোতিষীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হলে তিনি প্রতিরক্ষার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন।
অর্থাৎ কানাডার ফৌজদারি কোডের ৩৬৫ ধারা অনুয়ায়ী এই জ্যোতিষী বা জাদুবিদ্যার প্র্যাকটিস তখনই বেআইনী যখন কেউ প্রতারণার উদ্দেশ্যে এগুলো ব্যবহার করেন। তবে এখানে প্রতারকদের সুবিধাটি হলো জ্যোতিষী বা জাদুবিদ্যার মাধ্যমে প্রতারণা করে কারও কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করার পর যদি ধরা পড়েন এবং পরে সেই অর্থ ফেরত দিয়ে দেন তখন তিনি পাপমুক্ত হয়ে যান। অর্থাৎ বেকুসুর খালাস হয়ে যান।
কানাডায় এই জ্যোতিষী বা হস্তরেখা গণনাকারীদের মধ্যে বেশীরভাগই সম্ভবত ভারত থেকে এ দেশে আসা। কারণ, অনলাইনে টরন্টোর জনপ্রিয় পত্রিকা ‘মেট্রো টরন্টো’র ডিসেম্বর ৫, ২০১৬ সংখ্যায় দেখলাম মোট ১২ জন হস্তরেখাবিদ বা জ্যোতিষীর বিজ্ঞাপন ছাপা রয়েছে। এবং এই বিজ্ঞাপনদাতাদের সবার নামই ভারতীয়। যেমন পণ্ডিত রাঘুরাম, গৌতম গুরুজী, পণ্ডিত শ্রী সাই, পণ্ডিত হনুমান গুরুজী, ভীষ্ণু সাশ্রী, বাবু স্বামী, পণ্ডিত বরুণ বাবা, মাস্টার জয় গনেশ, পণ্ডিত সর্বেশ্বর জী, হরে কৃষ্ণ ইত্যাদি। এসব বিজ্ঞাপনে সম্ভাব্য ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা রক্ষার শতভাগ নিশ্চয়তাও দেওয়া আছে।
বিজ্ঞাপনের ভাষাগুলো এরকম : –
MOST POWERFUL INDIAN SPIRITUALIST; BORN TO SERVE PEOPLE; VERY POWERFUL SPIRITUALIST, MEDIUM AND HEALER WITH A SPECIAL GIFTED POWER TO…; MEET RIGHT PSYCHIC, TAKE RIGHT DECISION; IF YOU HAVE PROBLEM, HE HAS SOLUTIONS; I WILL REJOIN LOVERS IN A DAYS; SPECIALIST IN BRINGING BACK GOOD HEALTH IN A DAYS; EXPERT IN BRINGING LOVED ONES BACK; I CAN CLEAR ANY KIND OF PROBLEMS; YOUR WORRIES END HERE.
এসব বিজ্ঞাপনে অন্যকেউ যাদু-টোনা করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়া আছে। আছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধের মীমাংসা করিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি, প্রেম-ভালবাসাজনিত সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি। আরও আছে পারিবারিক সমস্যা, ডিভোর্স, এডুকেশন, লটারী, ডিপ্রেশন, মামলা মোকদ্দমা, যৌন সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, রোগ-বালাই, ব্যবসা ইত্যাদি বিষয়ে কোন সমস্যা থাকলে তা সমাধানের প্রতিশ্রুতি। এমনকি ইমিগ্রেশন পাইয়ে দেয়ার কথাও রয়েছে বিজ্ঞাপনে।
আর শুধু পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই নয়, এই জ্যোতিষীদের উৎপাত লক্ষ্য করা যায় টরন্টোর রাস্তাঘাটেও। পার্কিং লটে পার্ক করা গাড়ির গ্লাসের ফাঁকে তারা রেখে যান ফ্লায়ার বা বিজনেস কার্ড। কখনো কখানো দেখা যায় বড় বড় গ্রোসারীর প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে থেকে ফ্লায়ার বা বিজনেস কার্ড বিলি করছেন তারা। প্রকাশ্যেই তারা এই প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের প্রচারণায় কিন্তু কোথাও লেখা থাকে না যে, বিনোদনের জন্য আপনার ভাগ্য গণনা করা হবে।
এই পণ্ডিতদের ‘পাণ্ডিত্য’ মানব জীবনের এমন কোন সমস্যা নেই যার সামধান দিতে পারে না। এরা শুধু বলতে বাকি রেখেছেন যে মানুষের মৃত্যুও তারা ঠেকাতে পারেন। এরা দুনিয়ার সব দেশে সব সমাজে এবং সব ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যেই বিরাজ করেন। আর সেই সব দেশের অনেক শিক্ষিত লোকও আছেন যারা এই জ্যোতিষীদের মান্য করেন, শ্রদ্ধা করেন, অগাধ বিশ্বাস রয়েছে এদের উপর। কোন যুক্তি তর্ক দিয়ে বা বিজ্ঞানের অকাট্য প্রমাণ দেখিয়েও এদেরকে জ্যোতিষীদের বিপক্ষে দাঁড় করানো যাবে না। এমনকি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা জ্যোতিষীদের কথায় আস্থা রাখেন। এরা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রাশিফল দেখেন নিয়মিত। এই জ্যোতিষীদের দেয়া তাবিজ-কবজ অত্যন্ত ভক্তিসহকারে ব্যবহার করেন। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে গণকের গণনা ও তার কাছে যাওয়া দুটোই হারাম ও নিষিদ্ধ। মাওলানা আখতার হোসাইন নামে বাংলাদেশের একজন হাফেজ তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন “রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্যোতিষীর কাছে গেল, অতঃপর তার কাছে কোনো কিছু জানতে চাইল, ৪০ দিন পর্যন্ত তার তাওবা কবুল হবে না। আর যদি সে তার কথা বিশ্বাস করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে’- (তারগিব তারহিব : ৪৫৯৮)।”
আসলে সব সমাজেই এক দল ভণ্ড থাকে যারা সবসময় সাধারণ মানুষের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটার চেষ্টা করেন। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ভণ্ডদের ভবিষ্যতবাণী বা প্রতিশ্রুতিগুলো বিশ্বাস করার লোকও আছে প্রচুর প্রতিটি সমাজে। এবং এদের কারণেই জ্যোতিষশাস্ত্রের মত এরকম একটি হাস্যকর, অবৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভট ব্যবসা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে মানব সমাজে। এদের খপ্পরে পড়ে মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন এর প্রমাণতো আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাচ্ছি। আরো আশ্চর্য লাগে যখন দেখি সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর বিশাল একটি অংশও জ্যোতিষশাস্ত্রের ফাঁদে পড়ে আছেন।
সবশেষে কানাডিয়ান আইনের কথায়ই ফিরে আসি। বলা হচ্ছে এদেশে কাউকে প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে এসব যাদুবিদ্যা, জ্যোতিষীবিদ্যা, ভাগ্যগণনার অনুশীলন করা যাবে না। তবে বিনোদনের জন্য ভাগ্য গণনা করা যাবে। এখন প্রশ্ন হলো, এই জ্যোতিষীরাতো বলছেন না যে তারা নিছক বিনোদনের জন্য কারো ভাগ্য গণনা করছেন। বরং তারা এমন সব সিরিয়াস সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নানান মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন যা রীতিমত অবাক করার বিষয়। তারা ডিপ্রেশন, মামলা -মোকদ্দমা, যৌন সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, রোগ-বালাই, ব্যবসা ইত্যাদি বিষয়ে যে কোন সমস্যা থাকলে তা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আর শুধু প্রতিশ্রুতিই নয়, গ্যারান্টিও দেন তারা। এমনকি ইমিগ্রেশন পাইয়ে দেয়ার কথাও রয়েছে তাদের বিজ্ঞাপনে। প্রশ্ন হলো, এগুলোর মধ্য বিনোদন কোথায়? মামলা-মোকদ্দমা কি বিনোদনের বিষয়? ডিপ্রেশন কি বিনোদনের বিষয়? যৌন সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, রোগ-বালাই এগুলো কি বিনোদনের বিষয়?
একজন রোগীকে সঠিক মানের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একজন ডাক্তারকে কতটা প্ররিশ্রম ও সময় ব্যয় করে এবং কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ডিগ্রি নিতে হয় সে কথাতো সবাই জানেন। আর এগুলোর কোন কিছুই না করে একজন জ্যোতিষী জটিলসব রোগের চিকিৎসা করে রোগীকে ভাল করে দিবেন!
জ্যোতিষী ব্যবসা যে বাস্তবিক অর্থেই একটি সিরিয়াস প্রতারণা এটি তো তাদের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখেই বোঝা যায়। তাহলে কোন যুক্তিতে কানাডায় এদেরকে বছরের পর বছর এভাবে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে?
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ