আকাশের ঠিকানায়
ফারহানা পল্লব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৮- সৌম্যর চিঠি, এপ্রিল ১৪ ২০২২
শুভ নববর্ষ রাধা,
আজ কতটা বছর পর তোমাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা দিতে পারছি ভেবে দেখেছো? ভাবছি তুমি লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছো। হাতে লাল চুরি, লাল টিপ তো তোমার নিত্য সঙ্গী। তার সাথে আমি পরিয়ে দিলাম সিঁদুর। এখন তোমার সাজ সম্পূর্ন হল। তুমি আলতা পরা পায়ে নুপুরের রিনিঝিনি তুলে লজ্জায় দৌঁড়ে পালালে। আমি মূগ্ধ নয়নে তোমার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রই- স্বপ্ন যদি মধূর এমন হোক সে মিছে কল্পনা, জাগিয়ো না আমায় জাগিও না।
চট্টগ্রাম শহরের ডি সি হিল পাহাড়ে তখন বৈশাখের অনুষ্ঠান হত। আজো হয়তো হয়। সেরকম এক বৈশাখে দেখেছিলাম তোমাকে। ভোরবেলা তুমি তোমার মা ভাই বোনের সাথে এসেছিলে। লাল পেড়ে সাদা গরদের শাড়ি পরে তুমি দলীয় গানে অংশ নিতে বসেছিলে মঞ্চে। আমি দূরে পেছনের থেকে দেখছিলাম তোমার পরিবারের চোখ এড়িয়ে। কি সাধারণ নিরাভরণ তুমি শুধু একটা লাল টিপ যেন সূর্যোদয়ের সময়ে আধ ফোঁটা ফুলের আভা ছড়াচ্ছিল, নিষ্পাপ চেহারা।
মন দিয়ে গাইছিলে এসো হে বৈশাখ এসো এসো। মাথা টা হেলিয়ে দুলিয়ে, গান ছাড়া আর কোনদিকেই মন নেই। তারপর তোমার একক আবৃত্তির সময়ে আমার হৃদয়টা যেন সত্যি নেচে উঠেছিল- তুমি কোমল কন্ঠে পাঠ করেছিলে – নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ কবিতাটি, আজি প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রানের পর…। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেড়িয়ে তোমাদের সামনের দর্শক সাড়িতে চলে এলাম।
তোমার সাথে চোখাচোখি হতেই তুমি একটু যেন থেমে গিয়েছিলে, কেউ বুঝে উঠার আগেই আবার কবিতার লাইন ধরে ফেল্লে। লজ্জায় নত মাথা, আর দর্শক সাড়িতে তাকালেনা কবিতা শেষ করা পর্যন্ত। শেষ হতেই আমি জোড়ে করতালি দিয়ে উঠলাম বাকী দর্শকদের সাথে, তুমি কৃতজ্ঞতার হাসিতে যেভাবে তাকালে, আমার আবার বিশ্বজয় হয়ে গেল।
একটু পরেই অনুষ্ঠান শেষ হতে তোমার পরিবারের সবার সাথে তুমি চলে গেলে। যতক্ষণ দেখা যায় তৃষ্ণার্তের মত তাকিয়ে রইলাম তোমার চলে যাওয়ার দিকে।
তখন আমার মাথার মধ্যে ঘুরছো শুধু শাড়ি পরা তুমি। তোমাকে সেভাবে বার বার দেখার জন্য হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছিলাম। মনু ভাইদের সেই চকবাজারের বিখ্যাত মিষ্টি বিতানে গিয়ে হাজির হলাম। তাদের ল্যান্ড ফোন থেকে তোমাদের বাসায় কল করলাম। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ, ফোন যেন অন্য কেউ না তুলে। ফোন ধরলো তোমাদের কাজের মেয়ে সালমা। ওকে বল্লাম ছোট আপাকে ডেকে দাও, সে ডেকে দিতেই তুমি দৌড়ে এলে, তোমার হাঁপানোর কন্ঠেই বুঝেছিলাম। বল্লাম কখন ফিরলে, তুমি বল্লে এখনি সিঁড়ি দিয়ে উঠেই শুনি সালমা ডাকলো।
তারপর চুপচাপ, তুমি বল্লে বাসায় এলে না কেন? আমি বল্লাম, ছুটির দিন সবাই বাসায়, তোমাকে একা পাওয়া যাবে না তাই যাইনি।
তারপর আবার চুপ, তোমার পাশে মনে হয় লোকজন। তাই তুমি কথা বলছিলে না। তখন সাহস করে বলে ফেল্লাম বেড় হতে পারবে? তুমি জিজ্ঞেস করলে কোথায়? আমি বল্লাম এমনি রিক্সা করে ঘুড়বো। তুমি যেন সে ডাকেরই অপেক্ষায় ছিলে। বল্লে আচ্ছা, বান্ধবীকে একটা কল দিয়ে জানিয়ে আসি, বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি বলে বেড় হতে হবে তো। ফোন রাখার আগে বল্লাম, শাড়ি পরেই এসো। তুমি বুঝি একটু লজ্জা পেলে, বল্লে -ঠিক আছে।
তারপর আমি রিক্সা নিয়ে নির্ধারিত রাস্তার মোড়ে অপেক্ষায় রইলাম। তখন অপেক্ষা যেন যুগ যুগ লম্বা মনে হচ্ছিল। তুমি আসোনা আসোনা, আমি রিক্সা থেকে নেমে পায়চারী শুরু করলাম। ভাবছিলাম আবার মিস্টি বিতানে ফিরে গিয়ে একবার ফোন করবো কিনা। তখন দেখি তুমি ধীর পায়ে হেঁটে আসছো। মোড় ঘুরেই আমাকে দেখে হাসলে। একটু বাতাসে তোমার শাড়ির আঁচল উড়তেই মনে হচ্ছিল হেঁটে নয় তুমি যেন উড়ে উড়ে আসছিলে, সাদা ডানায় ভর করা এক গাঙচিল।
আমরা রিক্সা করে সারা দুপুর ঘুড়ে বেড়ালাম। সে ছিল তোমায় প্রথম শাড়িতে দেখা। তোমার সাথে আমার প্রথম ও শেষ বৈশাখ। তার পরেই চৈত্রের দাবদাহ আমাদের সম্পর্কটা যেন স্থবির করে দিয়েছিল।
আমি সেই এক্সিডেন্ট থেকে কিভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম সে এক মিরাকেল। আমার মাথাটা বাসের নিচে পরেছিল। বন্ধু আমাকে নিকটবর্তি হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার আমার চোখটা বাঁচিয়ে দেন। পরে ঢাকার ডাক্তার বলেন মাথার খুলি ভেঙে গিয়েছে, তারা ইন্ডিয়াতে পাঠানোর পরে অনেকগুলো অস্ত্রেপচারের পর তারা আমাকে বাঁচিয়েছেন। প্রায় মাসখানেক চিকিৎসা আরো বছরখানেক বিছানায় পরে থেকে শুধু তোমার কথাই ভেবেছি। মনে হয়েছিল তোমার পূজা প্রার্থনা এবার কাজে দিয়েছে। আমি মৃত্যুর এত কাছে থেকে ফিরে এসেছিলাম, মনে হত তোমাকে পাওয়ার জন্যই আমার এ পূনর্জন্ম।
আমি তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি রাধা, কোন হদিস পাইনি। আমি মনে মনে হেরে যাচ্ছিলাম। বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলছিলাম। তখন তোমার চাচাত ভাইদের কাছ থেকে জানতে পেলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে তুমি আমেরিকা চলে গিয়েছো স্বামীর সাথে। একটু ধাক্কা খেলাম তবুও ভাবলাম যেখানে যেভাবেই থাকো, তুমি যেন ভাল থাকো।
৯-রাধার চিঠি
সৌম্য,
আমি জানতাম তুমি আছো। আশ্চর্য হয়েছি এতবছর পর যখন জানলাম, ঈশ্বর আমার এ প্রার্থণাটা রেখেছেন। একই জনমে যে আবার দেখা হবে সে ছিল আমার ভাবনার বাইরে। কত না খুঁজেছি তোমাকে, কোথাও পাইনি। শুধু মন বলেছে তুমি আছো। আমার সাধ ছিল একটিবার যদি দেখা পাই বলবো আমি দু:ক্ষিত, তোমাকে কষ্ট দিয়েছি তাই। সেজন্যই বুঝি জীবনে আর সুখী হতে পারিনি। ভালবাসা খুঁজেছি হন্যে হয়ে, মন ভরেনি, কোথাও। বিশ্বাসের অভাব, সম্মানের অভাব, বা ভালবাসারই অভাব বোধ করেছি। মনের হাহাকারটা যায়নি কখনো। তারপর এ নিয়ে ভাবনাই ছেড়ে দিয়েছি। জীবনটা উত্থান পতনের পাহাড় বয়ে নিয়ে যখন সমঝোতা করে স্থিরতার কাছে, তখন তুমি এসে বল্লে – আমায় চিনতে পেরেছো?
আমার রাত দিন আকাশ পাতাল এক হয়ে গেল। কত কত কথা, কত গল্প, কত প্রশ্ন সব জলোচ্ছাসের মত আমার সব কথা ডুবিয়ে দিয়েছে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখি ঝড়, তুমি আমি হাত ছাড়া। উত্তাল ঢেউ কালো সমুদ্র, আমি তলিয়ে যাই- ঘুম ভেঙে যায়। আমি যত তোমাকে দেখি মনে হয় কত জনমের চেনা মুখটা। স্বপ্নে সে জনমের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা আবছা চোখে ভাসে। আমরা আগেও ছিলাম।
তবে আমাদের নিয়তি দেখো। আবারো আমরা পাশাপাশি দুই দেশে। দুই পরিবারে। এতশত দুই নিয়ে কি কখনো এক হওয়া যায় বলো?
আমি বিয়ের পরে আমেরিকা চলে আসি। তারপর ক্যানাডায়। দুই পূত্র কন্যা নিয়ে ভালই সংসার করছিলাম। হঠাৎ ঝড়ের পরে ঝড় এসে সংসার ভেঙে গেল। সে গল্প অন্যদিন হবে। চার বছরের শিশু পূত্র আর ১০ বছরের কন্যা নিয়ে যুদ্ধ করে গিয়েছি একাই। ভালবাসা পেয়েছি অনেকের, তবে হাত ধরে আবার সংসার করার সাহস হয়নি। দীর্ঘ নয় বছর একা সংগ্রামের পরে পরিবারের ইচ্ছায় আবারো সংসার সাজিয়েছি। সে সংসারে ভালবাসার চাইতে সমবেদনা বেশী। আবেগের চাইতে সমঝোতা। আমার মনের মত করে পূত্র কন্যা মানুষ করেছি।
কন্যা আমার জিবনী শক্তি আর পূত্র আমার ভালবাসার ধন। সব কিছুর পরেও ভালবাসার হাহাকার বোধ করতাম। যখনি জীবন যাপনে হয়রান হয়েছি, তোমাকে খুঁজেছি। যখন খুব বিপর্যস্ত ছিলাম একটিবারও তোমাকে খুঁজিনি, ভেবেছি এ যুদ্ধে তোমাকে টেনে লাভ কি। এই ভেবে ভাল লাগতো যে তুমি হয়তো সুখে আছো।
যখন একটু একা লাগতো। জীবনের হিসেব নিয়ে ভাবতাম, ঠিক তোমার চেহারাটা চোখের সামনে ভাসতো। ভাবতাম তোমার সাথে হিসেবটা মিটানো হয়নি। আমার চাচাত ভাইর কাছে শুনেছিলাম তুমি আমেরিকাতে। তারপর থেকে খুব ফেইসবুকে খুঁজতাম। তোমার নামের কত যে বন্ধু অনুরোধ পাঠিয়েছি। আজো দেখ এই নামের কত ফেসবুক ফ্রেন্ড আমার, হাহাহা।
তারপর একদিন হঠাৎ আমার একটা ক্রিসমাস পার্টির ছবিতে একটা লাইক দেখি তোমার নামে। রান্নার ফাঁকে ফেসবুক দেখছিলাম। চুলা বন্ধ করে তারাতারি সেই লাইকের পেইজে চলে গেলাম এ কোন সৌম্য তা খুঁজে দেখতে। কিছু বয়স্ক ছবির পরেই তোমার প্রফাইলে সেইসময়ে নীল কলার দেয়া পোলো শার্ট পড়া ছবিটা পেলাম। আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলাম। হাতটা অবস হয়ে এলো। ফোন যেন পরে না যায় তাই সোফার উপরে হাত রেখে ফোন ধরে রইলাম। কয়েক মুহুর্ত এভাবে কেটে যাবার পর তাড়াতাড়ি ইনবক্স করার জন্য তোমার ম্যাসেন্জারে গেলাম। গিয়ে দেখি তুমি আগেই ম্যাসেজ পাঠিয়ে রেখেছো-
‘ আমি সৌম্য, চিনতে পেরেছো?
৩৫ বছর পর দেখলাম তোমায়।’
সেই প্রথম চিরকুটের মত।
তুমি তখনি কল করলে। কন্ঠস্বর শুনে বুঝলাম একটুও বদলাওনি।
সেদিন থেকে যোগাযোগ শুরু।
আমাদের পূর্বজনমের কত যে কথা জমে ছিল সব প্রশ্ন একসাথে মাথায় ভীড় করলো। আমি কথা হারিয়ে ফেল্লাম। তারপর টুকটাক ম্যাসেন্জারে লেখা। আমি তোমাকে বুঝতে চাচ্ছিলাম বড় হয়ে কেমন হলে। আমার মনেই ছিলনা আগে তোমাকে তুমি ডাকতাম নাকি আপনি। তবে এবার যেহেতু লেখা বেশী, খুব সহজেই তুমিতে চলে গেলাম। বয়সের একটা কনফিডেন্সও আসে। তখন বয়সের পার্থক্যের চাইতে সম্পর্কের আন্তরিকতায় তুমিতে চলে যাওয়া যায় সহজে।
আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। আমি আনন্দে আত্মহারা। জীবনটা নিমেষেই পরিপূর্ন হয়ে উঠলো।
এভাবে হারানো ধন বুঝি সত্যি পাওয়া যায়?- ‘দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি– পেয়েছি আঁধার রাতে।’
১০- সৌম্যের চিঠি
অনুরাধা,
রাত জাগার অভ্যেসটা তোমার গেল না। এত রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। আবার তো সকাল থেকে কাজে দৌঁড়াতে হবে। সেহেরী না খেয়ে রোজা করছো। আজো তুমি আমার সাথে রোজা করো, যেমন ৩৪ বছর আগে করতে।
তুমি হয়তো জানোনা আমিও নবরাত্রির উপবাস বাদ দেই নি কখনো, তোমাকে যেদিন হারিয়েছিলাম সেদিন থেকে তোমাকে আরো বেশী ধারন করেছি। তোমার সব কথা শুনে চলেছি। মনে হত শুধু এরকম তোমাকে খুশী করলে একদিন ঠিক তোমার খোঁজ পেয়ে যাবো।
আমি যেন বাইরে যতটাই সৌম্য ভেতরে তার চাইতে বেশী অনুরাধাকে বহন করেছি। আমি আমার ধর্মকে পালন করছি তাকে জানার চেষ্টা করেছি। সকল নামাজে তোমাকে এতটাই চেয়েছি যে খোদা বুঝি আমার চাওয়া কবুল করেছেন, তোমাকে ফিরে পাওয়া আমার জন্য কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়, এ যেন অবধারিত ছিল, তোমার আমার আবার দেখা হবেই। শুধু সেই অন্তরদৃষ্টি নেই বলে আমরা সবটা দেখতে পাই না।
তোমাকে ফেসবুকে দেখেছিলাম সেই অনেক বছর আগেই। তোমার আর তোমার কন্যার ছবি। কিন্তু ভেবেছিলাম সুখে সংসার করছো, এখন আর পুরানো সম্পর্ক মনে করিয়ে কি লাভ। তাছাড়া আমার যে মানসিকতা আজো তোমাকে নিয়ে, তোমার হয়তো সেরকম না ও থাকতে পারে। এসব নিজের সাথে বোঝাপড়া করে আর যোগাযোগের চেষ্টাও করিনি। ভেবেছিলাম ভুলে গেছো, ভাল আছ। কিন্তু আজ বার বার মনে হয় যেগাযোগ করা উচিৎ ছিল, তুমি কেমন আছ জানতে চাওয়া আমার উচিৎ ছিল। আর ঐ সময়টা তুমি একা যুদ্ধ করছিলে। আমি কেন যে বুঝলাম না, নিজের কাছে অপরাধী লাগে এজন্য। এত বড় বড় দূর্যোগ পেরিয়ে দুজনা যখন শক্ত মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছি, নিশ্চই তার পেছনে কোন কারণ আছে।
তোমার আর তোমার রাজকন্যার ছবি দেখে ফেইসবুকে মনটা ভরে গিয়েছে। তোমার একটা অপরূপ সুন্দর পুতুল ছিল মনে আছে? অনেকটা সেরকম বা তার চাইতেও রূপসী তোমার কন্যা। তথাকথিত পুতুল খেলার বয়স পেরিয়ে সেই ১৭/১৮ বছর বয়সেও তুমি একটা সুন্দর পুতুল নিয়ে সাজাতে। তোমার এসব ছেলেমানুষি গুলো আমার মজাই লাগতো। তোমার পুতুলটার কপালে আমি নাম লিখে দিয়েছিলাম- ‘প্রিয়তী’। কবে কোথায় যেন নামটা শুনেই খুব ভাল লেগেছিল। তাই মনে হয়েছিল আমাদের কন্যার নাম প্রিয়তী হতে পারতো। তুমিও সযত্নে নামটি মেনে নিয়েছিলে পুতুলের কপালে লেখা নামটায় চুমু খেয়েছিলে। বহুবছর পরে তোমার ফেইসবুকে সেই প্রিয়তীকে যেন দেখলাম। আমাদের সেই পুতুলটাই বুঝি তোমার গর্ভে জন্ম নিয়েছে। তুমি মনের মত করে বাসন্তী ঘাগড়া পড়িয়ে সাজিয়েছো। সুখের যে সুন্দর রূপ তোমাদের ছবিতে দেখেছি তা আর এলোমেলো করতে ইচ্ছা করেনি। মনে হয়েছে দূর থেকেই তোমার সুখের ছোঁয়া নিতে থাকি। তাই যোগাযোগ করিনি।
কিন্তু মনে হয় যোগাযোগ না করে সেই না পাওয়া তোমাকে, আবারো যেন হারিয়েছি। তখন তুমি একা ছিলে, আমার মনে হয় তখন তোমার পাশে থাকা প্রয়োজন ছিল আমারো। তোমার পূত্র হয়েছে তার মামার কপি। তোমার ভাই ছিল আমার ভাল বন্ধু, তার সাথে তোমার ছেলের চেহারা আর চরিত্রে খুব মিল পাই, যতটুকু তোমার কাছে শুনি। তোমার মা, বোন এমন কি ভাগ্নিকেও মনে পরে। তারা ভাল আছেন তো? আমার কথা কি তাদের মনে আছে? তোমার বাবা যেমন রাশভারী মানুষ ছিলেন, তোমার প্রতি তেমনি নরম।
তোমাদের বাসার প্রতিটি মানুষ, নিয়ম কানুন, আনন্দ উৎসব আমার মনে পরে। এত কম সময়ের স্মৃতি কিকরে আমার স্মৃতিপটে গাঁথা হয়ে গেল জানিনা। তুমি হয়তো আমাদের পরিবারের সবাইকে ঠিকমত চেনোও না। অথচ আমি তোমার সাথ সাথে তোমার পরিবারকেও ভালবেসে আপন করে নিয়েছিলাম মনে মনে। তাদের সম্মান করতাম, ভালমন্দ চিন্তা করতাম, নিজেকে ঐ পরিবারের অংশ ভেবে নিয়েছিলাম। পাছে উনাদের কোনভাবে অসম্মান হয় তাই আমি কখনোই তোমাকে কোন বিষয়ে জোর করতাম না। যদিও দুষ্ট বন্ধুরা মনে করে তোমাকে জোর করিনি বলেই হারিয়েছি। আমি তেমনটা মনে করিনা। জোর করে হয়তো ক্ষনিকের জন্য তোমায় পেতাম। কিন্তু বার বার হারিয়ে জনম জনমের জন্য যে তোমাকে হৃদয়ে ধারন করে আছি, সে পাওয়ার মর্ম ওরা কি করে বুঝবে? চমকে দিয়েছো তোমার কন্যার নাম প্রিয়তী রেখে। তোমার ঘরে যে আমার প্রিয়তী জন্মেছে সেরকম পাওয়া কয়জনা পায়?
১১-রাধার চিঠি
সৌম্য,
ম্যাসেন্জারে তোমার সাথের কথোপকথন বার বার পড়ি। মনে হয় সেই কোভিড পূর্ব তোমার সাথের পুনরায় যোগাযোগের সময়টা। আমরা ম্যাসেন্জারে লিখতাম। আর হোয়াট্সএপে দেখে দেখে কথা হত মাঝে মাঝে। এতে করে একটা বিষয় ভাল হয়েছিল যে, তোমার আগের সেই কম বয়সের চেহারাটা ভুলে নতুন এই তুমিকে মেনে নিতে পেরেছি। তবে ঐ একরকম শান্তি যে তোমার কথা বার্তা, মন মানসিকতা সরলতায় কোন পরিবর্তন আসেনি। আমার ব্যাপারেও তুমি এরকমই বল্লে। তবে আমি এখন পুরাদস্তুর গৃহিনী, ঘর সংসার রান্না, বাজার, ব্যবসা এতসব কাজ দেখে তুমি অবাক।
আমার নিজেকে তোমার কাছে অপরাধী মনে হয়। তুমি কোন অভিমানে আর সংসার করলে না। আমি বেঁচে আছি কিনা তোমার তো জানা ছিল না। তোমার জীবনটা যেন ঐখানেই থেমে গিয়েছে। আমি যে জীবন চালিয়ে নিলাম। তুমি বেঁচে আছো-মন বলতো, তারপরেও ঘর সংসার করলাম। আমার জীবনের চাকা থেমে থাকেনি। বাস্তবতা মেনে আমি তো সংসার করে গিয়েছি। কিন্তু তোমার যে সংসার করা হল না। শুনে আমার খুব মন খারাপ করেছে। চেষ্টা করলে তুমি হয়তো সুখী হতে। তোমার ভালবাসার কাছে আমি চিরদিন হেরে গিয়েছি।
আমরা দুজনা দুজনকে ২০২০ এ খুঁজে পাওয়ার পর যখন একটিবার দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি, তখন করোনার তান্ডব লীলা শুরু হয়ে গেল। বিমান, জল বা স্থল সকল যোগাযোগের পথ বন্ধ হয়ে গেল। সারা পৃথিবী লক ডাউনে। শুধু ফোনের পথ খোলা। আমরা চাইলেও দেখা করতে পারলাম না। আমাদের নিয়তিতে কি লেখা জানিনা তবে খুঁজে পেয়েও দেখা হলনা সেও দুই তিন বছর পার হয়েছে। অথচ তুমি দেশে গেলে কোভিড শুরুর আগে। আমিও গিয়েছি তবে তুমি ফিরে আসার পরে। তখন মনে দ্বিধা ছিল। দেখা হলে আবার কি থেকে কি হয়। আমাদের দুজনার পথ দুইদিকে চলে গেছে। আর তো ফেরানো সম্ভব না, তাই আর দেখা করে ঝামেলা বাড়াতে চাইনি। খুব হিসেব করে জীবন চলছে নিজের নিয়মে।
কিন্তু তারপর তোমার জীবনের চড়াই উৎড়াই শুনে মনে হল যদি আর কখনো দেখা না হয়! তোমার শরীর খারাপ করেছে কতবার। ওপেন হার্ট সার্জারী হয়েছে। অনেকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছ বিভিন্ন শারিরীক অসুস্থ্যতা নিয়ে, জীবন মরনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছো। তুমি মনে কর এ বেঁচে থাকার কারণ একটাই, সেটা হল আমাদের আবার দেখা আর মিল হওয়া। আমি বলি পাগল, এখনো পাগলামী গেল না।
দেখ কি ভাগ্য, যখন দেখা করতে মন চাইলো তখন করোনার কারণে সারা পৃথিবী বন্ধ হয়ে গেল। পাশাপাশি দুই দেশে থেকেও আমাদের দেখা হলনা। ভেবেছি এ বয়সে দুজন দুজনের শুভাকাঙ্খী হয়ে তো দেখা করাই যায়। আমার পরিবারের সকলেই আসলে তোমার বিষয়টা এমনকি তোমার নামটাও জানে। আমি গোপন করিনি কখনো কিছুই। কিন্তু তোমাকে খুঁজে পাওয়াটা বলতে চাইনি, মনে হয়েছে কাউকে কষ্ট দেয়া ঠিক হবেনা। যদিও তোমার প্রতি সেই ছোটবেলার অনুভুতি ছিল ছাঁই চাপা আগুনের মত।
অসমাপ্ত সম্পর্কও একটা উপযুক্ত বিদায়ের দাবী রাখে। তাই তোমাকে খুঁজেছিলাম। কিন্তু তুমি যে সেই হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ককে ওভাবেই বুকে নিয়ে বসে আছ সে ছিল আমার ধারনার বাইরে। তাই তোমার মুখোমুখি হতে দ্বিধা করছিলাম। পাছে আমার মন গলে যায়। আমি যদি এই পরিনত বয়সে আবার সেই কিশোরী হয়ে ভেসে যাই। সমাজ, সংসার, স্বামী, সন্তান কত শত বাঁধ আমাকে সংযত রেখেছে। বহুদিনে অর্জিত সম্মান, অবস্থান সব ভেবে আমি নিজেই দেখা করতে চাইনি শুরুতে। কিন্তু তোমার সাথে কথা বলে দিনে দিনে মনে হচ্ছিল, তুমিও নিজের সামাজিক অবস্থান আর আমার সম্মান সকল দিকে লক্ষ্য রেখেও আমাদের দেখা করাটা কোন অপরাধ মনে করো নি। তোমার কথায় আমারো মনে হল তাইতো, দুজন হারিয়ে যাওয়া খুব কাছের মানুষ তো বহুবছর পরে দেখা করতেই পারে। এতে দোষের কি আছে। এভাবে নিজে যখন নিজের সাথে বোঝাপড়া করে দেখা করায় মন সায় দিল তখন করোনার কারণে তা সম্ভব হলনা।
তখন ফোনে কথাই একমাত্র যোগাযোগের পন্থা। হঠাৎ করে আবার সে যোগাযোগটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কি যে হল, তোমাকে ম্যাসেন্জার, ফোন বা হোয়াট্সআপ ইমেল কোন উপায়েই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এরকম চেষ্টায় মাস ছয়েক কেটে গেল। তোমার পরিচিত কারো নম্বর আমার কাছে নেই। কি করে যে খুঁজি, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তোমাকে কি আবার হারিয়ে ফেল্লাম?
ইতি
তোমার রাধা
(চলবে)
লেখক পরিচিতি
কানাডা প্রবাসী ফারহানা পল্লব একজন লেখক, সঙ্গীত শিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং গ্রাফিকস্ শিল্পী। বর্তমানে তিনি অন্টারিও বাঙ্গালী কালচারাল সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক।