সুফিবাদ ও বাংলাদেশ
অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর
প্রথম অধ্যায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
‘আনাল-হাক্ক’ ও হাল্লাজ
খ্রীষ্টিয় দশম শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত কিংবদন্তি সুফি হলেন হুসেন মনসুর আল-হাল্লাজ (৮৫৮ – ৯২২)। আধ্যাত্মিক সাধনায় পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির পর আত্ম-চেতনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে তিনি সত্যের সন্ধান পান আর তা প্রকাশ করেন ‘আন-আল-হক’ (আমিই সত্য) এই কথা বলে। তিনি নিজেকে ‘খোদা’ দাবি করছেন এই অভিযোগ এনে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিশিষ্ট সুফি দার্শনিক এ.জে. আরবেরী মনে করেন যে, তিনি নিজের মধ্যে ‘খোদাত্ব’ দাবি করেন নি। তবে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার জন্যই তিনি ইতিহাসে অমর নন, বরং তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর ওজিফার জন্যেও। তিনি ফরয নামায ছাড়াও দৈনিক ১০০০ রাকাত নফল নামায পড়তেন এবং এমনকি যেদিন তাঁকে হত্যা করা হয় সেদিনও তিনি ৫০০ রাকাত নফল নামায পড়েছিলেন।
দীর্ঘ ১১ বছর বাগদাদের জেলে রাখার পর তাঁকে জনসম্মুখে ক্রুশে নির্যাতন করে হত্যা করার জন্য ক্রুশের সামনে আনা হলে হাল্লাজ পেরেক, ক্রুশের দন্ড ইত্যাদি দেখে উচ্চস্বরে এমনভাবে হাসতে থাকেন যে তাঁর চোখ থেকে ক্রন্দনের মতো অশ্রু নির্গত হতে থাকে। এরপর জনতার ভিড় থেকে শেখ আবুবকর শিবলীকে (৮৬১ – ৯৪৬) চিনতে পেরে তাঁর নিকট থেকে জায়নামায চেয়ে নিয়ে দুই রাকাত নফল নামায পড়েন। প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা বাক্বারার ১৫৫ থেকে ১৫৭ নং আয়াত ক্বেরাত পড়েন, আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইমরাণের ১৮২ নং আয়াত পাঠ করেন। নামায শেষে সালাম ফিরিয়ে হাল্লাজ আল্লাহর কাছে দীর্ঘ এক দো’আ করেন, যার শেষাংশ এরূপ:
হে আল্লাহ! তোমার ধর্মের জন্য অতি উৎসাহী হয়ে এবং তোমার অনুগ্রহ পাবার আশায় যারা আমাকে আজ হত্যা করার জন্য সমবেত হয়েছে তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করো, কারণ তুমি আমার কাছে যা প্রকাশ করেছো তা যদি তাদের নিকট প্রকাশ করতে তাহলে আজ তারা যা করছে তা তারা করত না। আর তুমি তাদের নিকট থেকে যা লুকিয়ে রেখেছো তা যদি আমার নিকট থেকে লুকিয়ে রাখতে তাহলে আমি সহ্যের যে অগ্নিপরীক্ষায় আজ পতিত হয়েছি তাতে সফল হতাম না। সকল প্রশংসা তোমারই।
এরপর তিনি ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন: ‘আমাকে হত্যা কর, আমাকে হত্যা কর, ও আমার বিশ্বস্ত বন্ধুরা। কারণ, আমাকে হত্যা করা হলো আমাকে বাঁচতে দেয়া। আমার জীবন আমার মৃত্যুর মধ্যে, আর আমার মৃত্যু আমার জীবনের মধ্যে।” এরপর তিনি চুপ হয়ে যান এবং নীরবে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন করেন। এরপর ঘাতক আবুল হারিছ তাঁকে শারিরীকভাবে নির্যাতন শুরু করে এবং পরে হাত-পা কর্তন করে নির্মমভাবে ক্রুশদন্ডে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে।
খ্রীষ্টিয় একাদশ এবং দ্বাদশ শতকে সুফিবাদের বিকাশের স্বর্ণযুগ বলা যায়, কারণ এ সময়ে আল-কুশায়রী, আল-হুযউরী এবং আল-গাযালীর (১০৫৮ – ১১১১) মত দিকপাল সুফি দার্শনিকদের আবির্ভাব ঘটে। গাযালী মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় এ কারণে যে, তিনি শরিয়তের সঙ্গে তরিকতের অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তি ফালাসিফা সম্প্রদায়ের (যেমন, আল-ফারাবী, ইবনে সিনা) দার্শনিকদের মতো গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে ইসলামে মূলনীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছেন। ইবনে খালদুনের মতে, ইমাম গাযালীর সময়ে সুফিবাদ সবচেয়ে সুসংগঠিত রূপ লাভ করে।
ওয়াহেদাতুল ওযুদ ও সর্বখোদাবাদ
আল গাযালীর পর সুফিবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী দার্শনিক হলেন ইবনুল আরাবী (১১৬৫ – ১২৪০), যিনি ‘ওয়াহেদাতুল ওযুদ’ মতবাদের অন্যতম রূপকার ছিলেন। স্রষ্টা ও সৃষ্টি বিষয়ে এটিকে অদ্বৈতবাদ এবং সর্বখোদাবাদ (pantheism) বলে অনেকে সুফিবাদের ওপর বেদান্ত ও নব্য-প্লেটোবাদী দর্শনের প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন। বেদান্ত দর্শন অনুসারে এ জগত মিথ্যা, মায়া, অধ্যাস বা অলীক। অজ্ঞতার কারণে এ জগতকে সত্য বলে মনে হয়। সত্য জ্ঞানের মাধ্যমে জগতের অসারতা জানা যায়। আর এ সত্য জ্ঞানের জন্য শম, দম, রতি, উপরতি অর্থাৎ সম্পূর্ণ বৈরাগ্য সাধনের মাধ্যমে নিষ্কাম কর্ম করতে হয়। কিন্তু ইসলামে আত্ম সংযমের কথা বলা হয়েছে, নফসকে সংযত করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বৈরাগ্য সাধনের বিরোধিতা করা হয়েছে। বেদান্তে এই নশ্বর জগতকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে বলা হয়েছে, কিন্তু ইসলামে এ জগতকে নিয়ন্ত্রণ বা অগ্রাহ্য করতে হয়। কুরআনে আল্লাহ ঈসা নবীর উম্মত অর্থাৎ খ্রীষ্টানদের বৈরাগ্য হওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘আর বৈরাগ্য, সে তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে; এটা আমি তাদের ওপর ফরজ করিনি’ [সূরা আল-হাদীদ (৫৭):২৭]। সুতরাং কুরআনের তৌহিদের ওপর ভিত্তি করে বিকশিত সুফিদের ওয়াহেদাতুল ওযুদের তত্ত্ব বিশ্লেষণে আল্লাহর সঙ্গে যে-জগতের সম্পর্কের কথা বলা হয়, সে-জগত বেদান্ত বা নব্য-প্লেটোবাদীদের জগত নয়।
সর্বখোদাবাদ অনুসারে, সব কিছু আল্লাহর মধ্যে, আল্লাহ সব কিছুর মধ্যে। অর্থাৎ সবকিছই আল্লাহ থেকে উদ্ভুত এবং সবকিছুই আল্লাহর মধ্যে অবস্থিত। ওয়াহেদাতুল ওযুদের মূলকথা কিন্তু তা নয়। কুরআনে বর্ণিত ‘তৌহিদের’ ভিত্তিেেতই ‘ওয়াহেদাতুল ওযুদ’-এর ধারণা বিকশিত হয়েছে। এর অর্থ আল্লাহ থেকে সবকিছু উদ্ভুত হয়েছে, কিন্তু সবকিছু আল্লাহ নয়। যেমন, ইট, পাথর, ঘর, বাড়ি, টেবিল, চেয়ার, আল্লাহ নয়, তবে সবকিছুতে আল্লাহর অস্তিত্বের নিদর্শন আছে। আল্লাহ তাঁর নিজগুণেই অস্তিত্বশীল, যা তাঁর সৃষ্টি জগতের প্রতিটি অনু-পরমাণুর মধ্যে পাওয়া যায়। এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর সৃষ্টি জগতের প্রতিটি ধুলিকণা স্বয়ং আল্লাহ। তবে তাঁর অস্তিত্ব সর্বব্যাপী, কেননা পাক কুরআনে অসংখ্যবার বলা হয়েছে ‘আল্লাহ ওয়াছিআউন আলিমুন’, অর্থাৎ ‘আল্লাহ সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ’। ইবনুল আরাবীর ‘ওযুদ’ শব্দকে তিনভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। যথা- ‘ওযুদ বি শায়িন’ (বস্তুর দিক থেকে অস্তিত্ব), ‘ওযুদ বি লা শায়িন’ (বিমূর্ত অর্থে অস্তিত্ব) এবং ‘ওযুদ লা বি শায়িন’ (কোন বস্তুু প্রসঙ্গে নয়, স্বয়ং আল্লাহর অস্তিত্ব)। ‘ওয়াহেদাতুল ওযুদের’ ব্যাখ্যায় ইবনুল আরাবী উপর্যুক্ত তিনটি বিষয়ের মধ্যে শেষেরটির অর্থে ‘ওযুদ’ কথাটা ব্যবহার করেছেন।
এখন প্রশ্ন ওঠে, ওয়াহেদাতুল ওযুদের ধারণা কি ইসলাম-বহির্ভূত কোন তত্ত্ব? কুরআনের ‘পূর্ব-পশ্চিম সবই আল্লাহর। যে-দিকেই মুখ ফিরাও না কেন, সে-দিকেই আল্লাহ আছেন’ [সূরা বাক্বারাহ (২):১১৫]-এই আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহ সর্বত্র-বিরাজমান ও সর্বশক্তিমান; কোনকিছুই তাঁর অগোচরে নেই। ‘আল্লাহ সবকিছু দেখেন’ [সূরা আল-ইমরাণ (৩):১৫৬]-এই আয়াতের ভিত্তিতে ইবনুল আরাবী বলেন, ‘যে-দিকেই তাকাই, আমার চোখ তাঁকে ছাড়া কিছুই দেখে না; আমার কান তাঁর কথা ছাড়া কিছুই শোনে না।’ কুরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘তিনি আউয়াল (প্রথম), আখের (সর্বশেষ), জাহির (প্রকাশমান) ও বাতিন (অপ্রকাশমান) এবং তিনি সব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত’ [সূরা আল-হাদীদ (৫৭):৩]। সুতরাং আল্লাহ অনাদি, অনন্ত, প্রকাশ্য ও গুপ্তরহস্য। এই দৃশ্যমান জগত তাঁরই জাহিরি প্রকাশের অংশবিশেষ। সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে, ‘আল্লাহর একত্ব’ বা ‘তৌহিেেদর’ ব্যাখ্যায় সুফিরা বেদান্ত বা নব্য-প্লেটোবাদী দর্শন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেন নি, যদিও যুক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজনে উদাহরণ হিসেবে ভিন্ন সংস্কৃতি ও দর্শনের সমার্থক শব্দচয়ন অনেক সময় অনিবার্য হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ‘ওয়াহেদাতুল ওযুদের’ সবচেয়ে বেশী প্রভাব পড়েছে বাউল ও বৈষ্ণব দর্শনে।
পাশ্চাত্যে সুফিবাদ ও রুমি
বর্তমানে পাশ্চাত্যে সুফিবাদের জনপ্রিয়তার পিছনে যাঁর অবদান সর্বাধিক তিনি হলেন পারস্যের মরমী কবি জালাল উদ্দিন বলখী, যিনি মাওলানা রুমি (১২০৭ – ১২৭৩) হিসেবে পাশ্চাত্যে পরিচিত। ‘রুম’ নামক স্থানে বসবাস করতেন বলেই তাঁর নাম ‘রুমি’ হয়। আফগানিস্তানে তিনি ‘মাওলানা’ আর ইরাণে ‘মৌলভী’ হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধ। ‘তৌহিদ’ হলো তাঁর শিক্ষার প্রধান উপজীব্য বিষয়। ঐশি প্রেমের মাধ্যমে পরমসত্তার সঙ্গে পরমমিলনই তাঁর লক্ষ্য ছিল। রুমি প্রেম ও প্রজ্ঞার অনুসন্ধানে আল্লাহর সঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলেন। পাশ্চাত্যে বিশেষকরে আমেরিকায় ইসলাম সম্পর্কে মানুষ যতটা না আগ্রহী তার চেয়ে অনেক বেশী আকৃষ্ট হয় রুমির সুফি কাব্যে। ২০০৭ সালকে ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক রুমি বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত মরমী কবি আবদুল রাহমান জামি (১৪১৪ – ১৪৯২) বলেন যে, তিনি কোন নবী ছিলেন না বটে তবে তিনি ধর্মগ্রন্থ রচনা করেছেন। রুমির মসনবী সম্পর্কে জামি বলেন, “হাস্ত কুরআন দর জবান-এ পাহ্লবী”, এর অর্থ হলো: ‘এ হলো পার্সী ভাষায় কুরআন’। রুমি রাসূলুল্লাহর জীবনধারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। তিনি প্রায়ই তাঁর পরিচারককে বলতেন, ‘ঘরে কোন খাবার আছে?’ সে যদি না-সূচক উত্তর দিত, তবে তিনি তার প্রতি খুশি হতেন এবং আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়ে বলতেন, ‘খুব ভালো হয়েছে। আমার ঘর রাসূলুল্লাহর ঘরের মতো হয়েছে।’ আর যদি সে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিত, তাহলে তিনি বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘ঘর থেকে ফারাও-এর গন্ধ আসছে।’ রুমির জীবনাবসানের পূর্বে অসুস্থ্য অবস্থায় তাঁর সঙ্গিদের বলেছিলেন, “আমার মৃত্যুর পর দুঃখ করো না। তোমরা যে-অবস্থাতেই থাকো না কেন, আমার সঙ্গে থেকো, আমাকে স্মরণ করো যাতে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি, তা সে আমি যেখানেই থাকি না কেন।” তাঁর এ উক্তির প্রেক্ষিতে তাঁর সুফিদর্শনকে অনুসরণ করার লক্ষ্যে মাওলানা রুমির মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা ১২৭৩ সালে ‘মৌলভী’ নামক এক সুফি সিলসিলার প্রবর্তন করেন।
রুমির মধ্যে শৈশবাস্থাতেই এক দূর্বার আধ্যাত্মিক আকর্ষণ ছিল। তাঁর বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ (মৃ. ১২৩০) নিজের হস্তে লিখে গেছেন: “একবার রুমির যখন মাত্র ৬ বছর বয়স তখন পাড়ার কয়েকজন সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে রুমি আমাদের বাড়ির ছাদে উঠেছিল। এদের মধ্যে একজন ছেলে বলল, ‘চল, আমরা এই ছাদ থেকে আর একটা ছাদে লাফ দিয়ে যাই।’ আর একজন বলল, ‘আচ্ছা, ছাদের উপর থেকে লাফ দিয়ে নীচে নামলে কেমন হয়?’ রুমি বলল, ‘ওগুলো হলো কুকুর, বিড়াল এবং জন্তু-জানোয়ারদের চলাফেরা। মানুষের জন্য এরূপ আচরণ লজ্জাস্কর। তোমাদের যদি আত্মিক ক্ষমতা থাকে তবে উর্দ্ধে উড্ডয়ন করো, বেহেস্ত পর্যন্ত পৌঁছাও।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রুমি অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু সঙ্গিদের কান্নাকাটিতে আবার মিনিটের মধ্যে দৃশ্যমান হয়। রুমি ঐ বয়স থেকেই প্রতি তিন বা চারদিন অন্তর রোযা রাখতেন।” এ ঘটনার এক বছর পর রুমি তাঁর পরিবারের সঙ্গে যখন মক্কায় যান তখন প্রখ্যাত সুফি দার্শনিক ফরিদ উদ্দিন আত্তার (১১৪৫ – ১২২১)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হবার সৌভাগ্য ঘটে, যিনি রুমিকে তাঁর আসরার-নামা গ্রন্থটি উপহার দিয়েছিলেন, যা রুমি সবসময় সঙ্গে রাখতেন এবং এ গ্রন্থ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রুমির আধ্যাত্মিক শিক্ষাগুরু ছিলেন শামস্-ই-তিবরিজি (মৃ. ১২৪৮), কিন্তু মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আত্তারও রুমির সুফিবাদে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন। রুমি ফরিদ উদ্দিন আত্তার সম্পর্কে বলেন, ‘আত্তার প্রেমের ৭টি নগরী অতিক্রম করেছেন, আর আমরা কেবলমাত্র একটি রাস্তায় এসে পৌঁছেছি।’
পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিনয়, মমতা, নম্রতা, প্রেম একজন সুফির চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যের প্রধান দিক। ফরিদ উদ্দিন আত্তারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ রুমি তাঁর সুফি রচনায় যেভাবে তাঁকে চিত্রিত করেছেন সে-কারণে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা ফরিদ উদ্দিন আত্তারের রচনার প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর বিশেষ রচনা তাযকিরাত আল-আউলিয়া পাশ্চাত্যের পন্ডিতদের নজর কাড়ে এবং এ রচনার মাধ্যমে বিশিষ্ট সুফিসাধকদের সম্পর্কে পাশ্চাত্য জগত অবগত হয়।
সুফিবাদ ও ইউরোপে একাডেমিক গবেষণা
উপমহাদেশে সুফিবাদের ব্যাপক অনুসরণ হলেও মূলত: উপনিবেশিক যুগে (১৭৫০ -১৯৫০) ইউরোপে সুফিবাদের ওপর আধুনিক গবেষণার সূত্রপাত হয়। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ইউরোপীয় পর্যটক, ইতিহাসবিদ ও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্ণধারগণ উপমহাদেশের সুফিবাদকে ইউরোপের সঙ্গে পরিচিত করেন। উনবিংশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপীয়রা ইসলামকে ‘মোহামেডান’ বা ‘মুহাম্মদের অনুসারী’ ধর্ম হিসেবে জানত। খ্রীষ্টান ধর্মের যেমন প্রতিষ্ঠাতা যীশু খ্রীষ্ট, তেমনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা বা প্রবর্তক হিসেবে মনে করে ইসলামকে ‘মোহামেডান’ বলত। ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের সংবাদ-মাধ্যমের সবসময় একটা নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। এজন্য অবশ্য অনগ্রসর মুসলিম বিশ্বের অজ্ঞ আলেমদের শারিয়া আইনের নামে অমানবিক ‘ফতোয়া’ অনেকটা দায়ী। পাশ্চাত্য মিডিয়ার ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের প্রধান উৎস হলো মুফতিদের এই ‘ফতোয়া’ আর স্বার্থান্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ীদের ‘জিহাদ’ সম্পর্কে বিধ্বংসী ব্যাখ্যা। ইসলাম ধর্মের প্রতি অনিহা আর একপেশে গণমাধ্যমের বিরূপ প্রচারণার জন্যই ইসলামের সঠিক চিত্র আজও পাশ্চাত্যের অনেকের নিকট পৌঁছায় নি। এমন কি বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২ Ñ ১৯৭০) তাঁর ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ‘পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস’ (A History of Western Philosophy, New York: Simon and Schuster; London: George Allen and Unwin) গ্রন্থে ইসলামি দর্শনকে ‘মোহামেডান চিন্তাধারা’ বলে উল্লেখ করেছেন। সেই সময়কার সারা ইউরোপবাসীর কাছে ইসলামকে এই নামে জানার একটা রেওয়াজ ছিল, যদিও রাসেলের এই গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পূর্বেই ইউরোপীয় পর্যটক ও ওরিয়েন্টালিস্টরা ইসলামে মরমীবাদকে নতুন আঙ্গিকে আবিস্কার করেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে যাদের অবদান অগ্রগণ্য তাঁরা হলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬ – ১৭৯৪) [Sir William Jones] এবং স্যার জন ম্যালকম (১৭৬৯ – ১৮৩৩) [Sir John Malcolm]। এরা দুজনই ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ফার্সী ভাষায় বিশেষভাবে পারদর্শি ছিলেন। ফার্সী ভাষা তখন আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক ভাষা হিসেবে ইরাণ, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া ও ভারতের কয়েকটি প্রদেশের সরকারি দপ্তরে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। তাঁরা ইসলামের মরমীবাদের ওপর গবেষণা করে দেখেন যে, এরা মুক্ত মনের ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী উদার ধার্মিক সাধুপুরুষ বা ‘দরবেশ’। তাঁরা ‘অটোম্যান টার্কের’ মতো ছিলেন না, যারা একসময় সমগ্র খ্রীষ্টান অধ্যুষিত ইউরোপ জয় করতে চেয়েছিলেন। আবার, তাঁরা আরব বিশ্বের মুসলমানদের মতো কট্টোর বা গোঁড়া ছিলেন না। ইউরোপীয় পর্যটকরা আরও বলেন যে, এরা ফকির ও দরবেশদের মতো ভবঘুরেও ছিলেন না। যেখানেই মসজিদ, মিনার, মাযার, খানকা সেখানেই তাঁরা এই সব ‘সূফীদের’ (Sooffee) সমাগম ও সমাবেশ লক্ষ্য করেছিলেন। জোন্স এবং ম্যালকম মনে করেন যে, এই সুফিরা ছিলেন মরমী কবি, খোদাভীরু, আল্লাহ-প্রেমী ও সামা-অনুরাগী। তাঁরা বলেন যে, সুফিদের মতের সঙ্গে খ্রীষ্টান ধর্মমত, গ্রিক দর্শন এবং বেদান্ত দর্শনের মরমী ভাবধারার সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। এভাবে অষ্টাদশ শতকের শেষে ‘ওরিয়েন্টাল’ সংস্কৃতির যে অংশটুকু দ্বারা ইউরোপীয়রা আকৃষ্ট হন তা ‘সুফি-বাদ’ শব্দটা হিসেবে আবিস্কৃত হয়।
১৮২১ সালে সর্বপ্রথম সুফিবাদের ওপর ইউরোপে ল্যাটিন ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন জার্মান ধর্মতাত্তিক ফ্রেডরিক অগাষ্ট গোট্রেউ থুলাক (১৭৯৯ – ১৮৭৭) [Friedrich August Gottreu Tholuck। থুলাক বার্লিনে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন Sufismus, sive theosophia Persarum pantheistica (Sufism, or the pantheistic theosophy of the Persians). এ গ্রন্থে থুলাক ‘সুফিবাদ’ (Sufism) নামটা প্রচলন করে পাশ্চাত্য দার্শনিক স্পিনোজার (১৬৩২ – ১৬৭৭) সর্বখোদাবাদের (pantheism) সঙ্গে সুফিবাদের তুলনা করেন এবং সুফিবাদকে গ্রিক বা বেদান্ত দর্শন থেকে উদ্ভুত বলে মনে করেন, যদিও তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম দিকের সাহাবাদের মধ্যেই আজকের সুফিবাদের বীজ খুঁজে পাওয়া যাবে। এটা স্ববিরোধী মতবাদ। একদিকে তিনি বলছেন সুফিবাদ ইসলামবিরোধী গ্রিক ও বেদান্ত দর্শনের ভাবধারা, অন্যদিকে তিনি বলছেন সুফিবাদের বীজ সাহাবা কেরামদের মধ্যে পাওয়া যায়। সুফিবাদকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে ওরিয়েন্টালিস্টরা কুরআন, হাদিস, রাসূলুল্লাহ (সা.), ইসলামি অনুশাসন, ইসলামি ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, ইসলামি রীতিনীতি ইত্যাদির তাৎপর্যকে বেমালুম অস্বীকার করেছেন। ইউরোপীয় ওরিয়েন্টালিস্টরা যাদেরকে ‘সূফী’ (Sooffee) বলে অভিহিত করেছিলেন তাঁরা কি কুরআন মানতেন না? হাদিস পড়তেন না? নামায-রোজা করতেন না? (চলবে)
অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর
টরন্টো