জীবনের বহু রং

সাইদুল হোসেন

(তেইশ)

An advertisement in Bangladesh
(DUA ON SALE)

রাস্তার পাশে বড় একটা poster-এ মাথায় পাগড়ীবাঁধা এক মুল্লার ফটো, তিনি দু’হাত তুলে দোয়া করছেন। তার নীচে লেখা রয়েছে :

দোয়ার বিজ্ঞাপন। ছবি : আনোয়ার সিকদার/ইনস্টাগ্রাম

এখানে SSC/HSC পরীক্ষার্থীদের জন্যে দোয়া করা হয়।

     নরমাল দোয়া ২৫০/-

     হালকা কান্না করে দোয়া ৫০০/-

     চিৎকার দিয়ে কান্না করে দোয়া ১,০০০/-

দোয়া সরাসরি কুরিয়ার সার্ভিস, ইমো, বিকাশ, নগদ, রকেটের মাধ্যমে পাঠানো হয়। প্রয়োজনে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমেও পেমেন্ট করতে পারবেন।

বিঃ দ্রঃ মাটিতে গড়াগড়ি করে দোয়া ৫,০০০ টাকা।

From the Internet

(বত্রিশ)

অতীতের স্মৃতিচারণ

জুলাই ২২, ২০২৪

বহু বছর, বহু যুগ, বহু ঘটনাপূর্ণ জীবন পেছনে ফেলে এসেছি। সুখময় এবং দুঃখময়- দুইই দেখেছি। বহু ঘটনার বিশদ অথবা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমার ইতিপূর্বে প্রকাশিত ৫টি গল্পগ্রন্থের পাতায় পাতায় পাওয়া যাবে।

বয়স ৯১ বছর অতিক্রম করেছে। দায়িত্ব-কর্তব্য বলে কিছু নেই। অখন্ড অবসর। দিনের ২৪টা ঘন্টাই আমার। রাতেদিনে ঘুমের কয়েকটা ঘন্টা বাদ দিলে দিনের অধিকাংশ সময়টুকু কাটে বইপত্র পড়ে, টিভি-ইন্টারনেট দেখে, এবং অতীতের স্মৃতিচারণ করে। বহু কথা-কাহিনী অতীতে বলেছি বটে কিন্তু সব কথা বলা ফুরিয়ে যায়নি, সেগুলোও স্মৃতির বন্ধ দরজায় ঘা মারে কখনো কখনো, জনসমক্ষে প্রকাশিত হতে চায়। সেরকমই কিছু বাছাই করা টুকরো টুকরো ঘটনা, যাদেরকে ইংরেজী ভাষায় বলা হয় anecdotes, একে একে বলছি। নানা বৈচিত্র্যের কারণে পাঠকপাঠিকারাও হয়ত আনন্দ পেতে পারেন।

অতি সম্প্রতি ১০৪ বছর আগের ১৯২০ সনের এক হজযাত্রীর ডায়েরীর কিছুটা অংশ একটা বাংলা সাপ্তাহিকে পড়লাম। কিছু তথ্য তুলে ধরলাম পাঠকদের অবগতির উদ্দেশ্যে। Very informative. তথ্যগুলোর একটা ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

(এক)

পারাম (PARAM)- ১

২০১০-২০১১ সনের কথা। তখন আমরা স্বামীস্ত্রী দু’জন টরন্টো সিটির নর্থ ইয়র্কে বসবাস করতাম। আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশয়ানের ক্লিনিকে তাঁর একটা রিসার্চ ইউনিটও ছিল। ডাক্তার আমাকে একদিন সেই ইউনিটে পাঠালেন কিছু কনসালটেশানের উদ্দেশ্যে। গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি বেশ ছোটখাট ইন্ডিয়ান রং ও চেহারার অল্পবয়সী এক মেয়ে চেয়ার দখল করে বসে আছে, সামনের চেয়ারটা খালি। তার ইশারা অনুসারে সেই খালি চেয়ারটাতে বসলাম। বললাম, “আমার ফ্যামিলী ফিজিসিয়ান আমাকে পাঠিয়েছেন Dr. PARAM-এর সংগে একটা বিষয় আলোচনা করতে।”

আমার কথা শুনে সেই মেয়েটি হেসে দিলো। বললো, “আমিই ডঃ পারাম। কোন বিষয়ে আলোচনা করতে চান?”

আমি কোন উত্তর না দিয়ে কিছুটা অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনিই ডঃ পারাম? আপনাকে দেখে তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”

আমার কথা শুনে মহিলা অসন্তুষ্ট হলেন না, বরং হালকা হাসি মুখে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, আমিই ডঃ পারাম। আমার ছোট আকৃতি ও চেহারা দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে একা আপনিই নন, আরো বহু ভিজিটর আপনার মত দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। আমি অবাক হই না।”

তারপর যোগ করলেন, “জন্মগতভাবেই আমি দেখতে এমন হলেও বয়স আমার কম নয়। অল্প বয়সের ছাপ আমার চেহারাতে। আমার বয়স ৩৪ বছর, ৮ এবং ৬ বছরের দুই ছেলের মা আমি। আমার জন্ম ইন্ডিয়ার পাঞ্জাবে, সেখান থেকেই ডাক্তারী পাস করে ক্যানাডায় ইমিগ্রেশান নিয়ে এসেছি। এবং এখানে কাজ করছি।”

তাঁর খোলামেলা আচরণে আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে শুকরিয়া (ধন্যবাদ) জানালাম। আমার কাজকর্ম শেষ হলে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। এরপর আরো কিছুদিন ডঃ পারাম-এর সংগে আমার যোগাযোগ ছিল। অতি চমৎকার মহিলা।

পারাম (PARAM)- ২

২০০৪-২০১৮ এই দীর্ঘ ১৪টি বছর আমি টরন্টো সিটির নর্থ ইয়র্কে হাম্বার রিভার হসপিটালে একজন ভলানটিয়ার হিসাবে কাজ করেছি। সেই সময়কার ঘটনা।

হসপিটালের কোন এক ক্লিনিকে এডমিনিসট্রেটিভ পজিশানে কর্মরত অতি চমৎকার অমায়িক ব্যবহারসম্পন্ন এক মহিলার সংগে পরিচয় হয়েছিল। নিয়মিত দেখাশুনা হতো, তার ব্যক্তিগতসহ নানা প্রসংগ নিয়ে আলোচনা হতো। তিনিও ইন্ডিয়ান, পাঞ্জাবের অধিবাসী, তারও নাম ছিল পারাম।

কথা প্রসংগে একদিন জানতে পারলাম যে সে একজনকে ভালোবাসে দীর্ঘদিন ধরে এবং খুব শিঘ্রই তাদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

কয়েকদিন পর তার অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম যে পারাম তার বিয়ে এবং হানিমুন উপলক্ষে দু’মাসের ছুটি নিয়েছে।

দুমাস পর হাসপাতালের করিডোরে পারামের সংগে দেখা। হেসে বললাম, “বিয়ের সুখবরটা পেয়েছি। “Congratulations!”

কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে মলিন মুখে পারাম বললো, “আপনার ‘Congratulations’-টা accept করতে পারছি না। ভেরী সরি। পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও যে জীবনটা এমন অভিশপ্ত এবং বেদনাময় হতে পারে সেটা ছিল আমার কল্পনাতীত। সুখের আশায় ঘর বেঁধেছিলাম অথচ পেলাম চরম অবহেলা ও আঘাত। আমার সব স্বপ্ন ধূলিষ্মাৎ হয়ে গেছে। রাস্তা খুঁজছি আবার আমার একক জীবনে ফিরে আসার, বাকি জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগেই।”

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে থামলো সে এখানে এসে। সব শুনে আমি তো বোবা! আর কথা বাড়ালাম না।

বললাম, ”Sorry to hear that. May God give you peace. See you later.”

এটুকু বলেই আমি আমার অফিসের দিকে পা পাড়ালাম।

পারাম (PARAM)- ৩, ৪, ৫

পরবর্তী কালে নানা বিষয়ে বিভিন্ন অফিসে ফোন করে খবর নিতে গিয়ে একে একে আরো তিন জন “পারাম”-এর সংগে আমার কথা হয়েছে যাদের প্রত্যেকেই ছিল ইন্ডিয়ার পাঞ্জাবের শিখ কমিউনিটির মহিলা। সর্বশেষ “পারাম”কে জানিয়েছিলাম যে তাকেসহ পাঁচ জন পাঞ্জাবী “পারাম”-এর সংগে আমার কথা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “আচ্ছা পারাম, বলতে পার তোমাদের পাঞ্জাবী শিখ কমিউনিটিতে এই পারাম নামটা এত পছন্দ কেন?”

শুনে সে বললো, “আমি সঠিক জানি না। তবে আমার অনুমানটা তোমাকে বলছি। শুনো।”

“আমাদের পাঞ্জাবী ভাষায় “পারাম” কথাটার অর্থ হলো Highest degree of anything good. তাই মেয়ে সন্তান ঘরে জন্ম নিলেই আমাদের মাবাবারা সেই কন্যাটির নাম রাখে পারাম মনেমনে এই কামনা/প্রার্থনা নিয়ে যে ভগবান যেন সেই শিশুটিকে এমন  সব গুণ/মনোবৃত্তি দেন যাতে সে একজন উত্তম কন্যা, উত্তম স্ত্রী ও উত্তম মাতা হয়ে ঘরে শান্তি আনতে পারে।”

ওর কথাটাতে খানিকটা যুক্তি আছে সেকথাটা স্বীকার করতে হবে।

লক্ষ্যণীয় যে আমাদের বাংলা ভাষাতেও এই শব্দটি আছে যাকে আমরা বলি “পরম”, এবং পরম কথাটা সর্বদাই অতি উত্তম ভাব প্রকাশে সাহায্য করে। যথা, পরম  বন্ধু, পরম শুভাকাংখী, পরম দয়ালু, পরম সুন্দরী ইত্যাদি।

(দুই)

“ধানিয়াবাদম!”

আমাদের কমিউনিটি বিল্ডিংটাতে কিছুদিন ধরে renovation-এর কাজ চলছে। কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কারদের উপর নজর রাখার জন্য একজন সিকিউরিটি গার্ড কাজ চলাকালীন সর্বক্ষণ ওদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই সিকিউরিটি গার্ডটি হচ্ছে একজন ইন্ডিয়ান যুবতী, ইউনিফর্ম পরে এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। সর্বক্ষণ তার হাতে থাকে একটা সেলফোন। ঘনঘনই সে সেলফোনে কথা বলে।

একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার নাম কি?”

“সাই”, সে জবাব দিল।

“সাই? ইংলিশ বানান কর,” বললাম আমি।

”SAI”, বলল সে।

“কোন ভাষায় কথা বল তোমরা? সেই ভাষায় তোমার নামের অর্থ কি?”, জানতে চাইলাম আমি।

“আমি ইন্ডিয়ার তেলেংগানা স্টেইটের লোক। আমাদের ভাষা তেলুগু। তবে আমার এই “সাই” নামটার কোন অর্থ নেই, শুধুই একটা শব্দ মাত্র, মাবাবা কেন এই নাম রেখেছে সেটা আমার অজানা,” জানালো সে।

তারপর আমি জানতে চাইলাম, “তোমাদের তেলুগু ভাষায় Thank you জানাতে কি বল?”

“আমরা বলি “ধানিয়াবাদম”। তবে শুকরিয়া-ও বলে থাকি কখনো কখনো কারণ আমাদের তেলেংগানা স্টেইটে দু’টি ভাষা পাশাপাশি চালু আছে- তেলুগু এবং উর্দু,” জানালো সাই। বললাম, “তোমাকে অনেক বিরক্ত করলাম, অনেক প্রশ্নের জবাব দিলে তুমি। ধানিয়াবাদম।”

শুনে হেসে দিল সাই। বললো, “ধানিয়াবাদম”।

(তিন)

“বিয়ে করতে চাই  কিন্তু কোন নারী রাজী হচ্ছে না”

মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, অনাকর্ষণীয় চেহারার এই অদ্ভুত চরিত্রের Black মানুষটির  সংগে আকষ্মিকভাবে একদিন পরিচয় হয়েছিল কোন এক বিশেষ প্রয়োজনে অন্য  একজনের মাধ্যমে মিসিসাগা সিটির কোন এক স্থানে। বড় জোর বিশ মিনিটের স্থায়ী আমাদের আলাপের মাঝে বেশীর ভাগ সময়টাই কাটিয়েছিল সে তার আত্মকথা বলে। বাচাল প্রকৃতির লোক।

“আমার নাম Garcia. Spanish name. আমার দেশ Trinidad. আমার দেহে তিন ধরনের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমার বাবা ছিল একজন Black Jamaican; মায়ের blood ছিল mixed- তাঁর বাবা ছিলেন Spanish, মা ছিলেন French.”

“আমার ৯টি সন্তান, ওরা সবাই Trinidad-এ বসবাস করছে। আমার ওয়াইফ নেই। একাকী জীবন। আমার বয়স এখন ৭৫ বছর। আবার বিয়ে করতে চাই। আমি ক্যানাডাতে একজন ইমিগ্র্যান্ট বহুদিন ধরেই। সিটিজেন। বহু চেষ্টা করেছি, এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, আবার বিয়ে করার জন্য কিন্তু কোন নারীই রাজী হচ্ছে না।”

তারপর হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করে বসলো, “তোমার খোঁজে তেমন কোন ব্ল­্যাক লেডি আছে কি যাকে আমি approach করতে পারি?”

পাঠক, এবার বুঝে দেখুন কেমন একজন সুপাত্র এই Mr. Garcia.

(চার)

সহৃদয় মারাঠি মুসলিম যুবক

গিয়েছিলাম এক diagnostic centre-এ আমার severe arthritic pain-এ প্রায় অকেজো দু’টি হাঁটুর X-Ray করাতে বহু দূরে বাসে চড়ে। সংগে ওয়াইফও ছিল, কারণ এধরনের কাজে কখনো একাএকা বাড়ির বাইরে যাই না। প্রচন্ড ব্যথায় ভুগছি বহু বছর ধরেই। Walker-এর সাহায্য ছাড়া দু’পা-ও হাঁটতে পারি না।

বহু কষ্টে X-Ray করাটা শেষ হলে টেকনিশিয়ান যুবকটি আমাকে উদ্দেশ করে বললো, “চলতে ফিরতে আপনার খুব কষ্ট হয় দেখতে পাচ্ছি। যদি কিছু মনে না করেন আপনার বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য একটা ট্যাক্সি ডাকি? ভাড়াটা আমিই দেবো। আপনি তো একজন অতি বৃদ্ধ সিনিয়র সিটিজেন। এই সম্মানটুকু তো আপনার প্রাপ্য আমাদের কাছ থেকে।”

যুবকটির সহৃদয়তায় আমি মুগ্ধ হলাম, তবে তার প্রস্তাবে আমি রাজী হলাম না। বললাম, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যাবাদ। ট্যাকসি ডাকতে হবে না। কষ্ট হলেও বাসে চড়েই আমি চলাফেরা করি।”

তারপর জানতে চাইলাম ওর নাম এবং কোন দেশের লোক সে।

যুবকটি বললো, “আমার নাম আতিক। আমি মুসলিম, ইন্ডিয়ার মহারাষ্ট্র স্টেইটের লোক। আমি একজন মারাঠি মুসলিম।”

শুনে বললাম, “খুব খুশী হলাম আপনার সংগে পরিচিত হয়ে। আল্ল­াহ আপনার উপর রহমত করুন। আসসালামু ’আলাইকুম।”

(পাঁচ)

শিখ সর্দারজি ও তার সাফল্যের কাহিনী

“মিসিসাগা সিটিতে আমার দু’টি বাড়ি আছে। প্রতিটির বাজারমূল্য ২ মিলিয়ন ডলার।”

“আমার দু’টি গাড়ি আছে। প্রতিটির বাজারমূল্য ১ লাখ ডলার।”

“আমার তিন সন্তান, তিনটিই কন্যা সন্তান। বড়টা একজন ডাক্তার, দ্বিতীয়টা ডাক্তারী পড়ছে, আর তৃতীয়টা হাইস্কুলে পড়ে।”

“বিবি (অর্থাৎ স্ত্রী) গৃহিনী, কোন নোকরি (চাকরি) করে না, ঘরবাড়ি সামলায়।”

“আমি নিজে একজন ট্যাকসি ড্রাইভার।”

উপরের বৃত্তান্তটা শোনলাম একজন ট্যাকসি ড্রাইভারের মুখে একদিন একটা মেডিক্যাল এপয়েন্টমেন্ট শেষে বাড়ি ফেরার পথে।

সর্দারজি আরো জানালেন যে-

তিনি একজন ইন্ডিয়ান পাঞ্জাবী শিখ। ক্যানাডায় (টরন্টোতে) আগমণ ২২ বছর বয়সে ১৯৮৮ সনে। মূলধন : 20 US dollars only.

তার ভাষায় : “সির্ফ হিম্মত (শুধুমাত্র সাহস), সততা এবং উচ্চাকাংখা সম্বল করে রাস্তায় নেমে পড়লাম একটা ভাড়া করা ট্যাক্সি নিয়ে টরন্টো সিটিতে Driver’s Licenceটা হাতে আসতেই। দেশওয়ালী পাঞ্জাবী কমিউনিটিই সব ব্যবস্থা করে দিলো।

“ইংলিশ তেমন জানতাম না। লেকিন দেমাগ বহুত সা-ফ থা (অর্থাৎ স্মৃতিশক্তিটা খুব প্রখর ছিলো), তাই অল্প দিনেই ইংলিশটা আয়ত্বে এসে গেলো। ভাষাগত সমস্যাটা মিটে গেলো।”

“রাতদিন, সপ্তাহে সাতদিন বিরামবিহীন ট্যাকসি চালাই। একটাই মক্সদ্ (আকাংখা)- আগে, আউর আগে বাড়না অর্থাৎ সামনে, আরো সামনে এগিয়ে যেতে হবে। Canada is a gold mine for the hardworking and smart guys. আমি সব সুযোগ কাজে লাগিয়েছি কিন্তু সততা থেকে কখনো সরে যাইনি। বিলাসিতাকে কখনো প্রশ্রয় দিইনি। সুফলও পেয়েছি হাতেহাতে।

“বয়স তো মাত্র ৫৮ বছর। এখনো দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। স্বাস্থ্যটা ভালো আছে। আরো আগে বাড়তে হবে।”

“ভাগওয়ানের উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা আছে। ডর কিস বাৎকি? ভয় কিসের?”

থামলেন সর্দারজি।

চমৎকার একটা success story শুনিয়ে গেলেন। কথাবার্তা সব হিন্দিতেই হলো। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাত মিলিয়ে বিদায় নিলাম আমাদের বিল্ডিংয়ের entrance-এর সামনে দাঁড়িয়ে। আমি একজন বাংলাদেশী জানার পর খুশী হয়ে মন্তব্য করলেন, “আরে ওয়াহ! আপ ইক বাংলাদেশী হো, ফিরভী ইতনী আচ্ছি হিন্দী জুবান কেইসে কবজা কারলিয়া? বাহাদুর আদমী হ্যায় আপ!”

বাংলা অনুবাদ : আপনি একজন বাংলাদেশী হয়েও এত উত্তম হিন্দি কি করে আয়ত্ব করলেন? আপনি তো একজন অতি প্রশংসনীয় লোক দেখছি!

শুনে বললাম, “শুকরিয়া।”

(ছয়)

DHARMIK (ধার্মিক)

একটা Walmart store- এ গিয়েছিলাম কিছু কেনাকাটা করতে কয়েক মাস আগে। সেখানে স্টোরের অল্পবয়সী যুবক যে ওয়ার্কারটি আমাকে জিনিসপত্র খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল ওর ইউনিফর্মের বুকে দেখলাম name tag-এ লেখা রয়েছে DHARMIK. ইন্ডিয়ান বলে চিনতে কোন অসুবিধা হয় না। ছেলেটি খুব ভদ্র। এক পর্যায়ে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ইন্ডিয়াসে হো না?” সে বললো, “জী, ইন্ডিয়াসে হুঁ।”

তারপর আমাদের কথোপকথনটা এই রূপ নিলো :

প্রশ্ন : কৌন স্টেইটসে? (কোন স্টেইটের বাসিন্দা তুমি?)

উত্তর : গুজরাট।

প্রশ্ন : কেম্চ তুমি কেমন আছ?)

উত্তর : মজামা। (ভালো আছি।)

প্রশ্ন : নাম তো “ধার্মিক” দেখতাহুঁ। ধরমকরম কুচ করতে হো কেয়া? (নাম তো দেখতে পাচ্ছি ধার্মিক। ধর্মকর্ম কিছু কর কি?)

উত্তর : জী, থোড়াবহুত। (জী, কিছুকিছু করি বৈকি!)

প্রশ্ন : For example? (দৃষ্টান্ত দাও।)

উত্তর : সাচ বাৎ বোলতা হুঁ, ঝুট কভি নেহী। মাতাজী-পিতাজী কো ইয্যত কারতাহু। ভাগ্ওয়ান পর পুরী ভরোসা হ্যায়। কিসিকো cheat নেহি কারতাহুঁ। দারু নেহী পীতাহু, সিগরেটভী নেহি। ধেয়ানসে স্টোরকা সব কাম কারতাহুঁ।”

এখানে এসে ওকে থামিয়ে দিলাম। বললাম, বাস করো, ঔর জরুরত নেহি। (এবার থামো, আর অধিক বলার দরকার নেই।)

এতক্ষণ সে যা বললো তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে ঃ সে সদা সত্য কথা বলে, কখনো মিথ্যা বলে না। মাবাবাকে সম্মান করে। ভগবানের উপর পূর্ণ আস্থা/বিশ্বাস আছে। সে কাউকে ঠকায় না। মদ বা সিগারেট খায় না। মনোযোগ দিয়ে স্টোরের সব কাজ করে।

এর থেকে উত্তম ধর্মকর্ম আর কি হতে পারে?

সবকিছু শুনে ওকে বললাম, “হাঁ, তুম সাচ্মুচ্হি ধার্মিক হো। কোশেশ জারী রাকখো। ভাগওয়ানসে প্রার্থনা কারতাহুঁকে আগলে জীবনমেঁ ভী তুমকো এয়সাহি ধার্মিক রাকখে।  জীতা রাহো।”

(হ্যাঁ, সত্যিই তুমি একজন ধার্মিক লোক। চেষ্টা চালিয়ে যাও। ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাই তিনি যেন তোমাকে ভবিষ্যতেও এমনি ধার্মিকই রাখেন। দীর্ঘজীবী হও তুমি।”

আমার কথা শেষ হলে ওর মাথাটা নুইয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ভংগীতে হাত দু’টি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললো, “শুকরিয়া”।

(সাত)

মক্কায় গিয়ে শতবর্ষ আগের (১৯২০ সন)

হাজ্জ সংক্রান্ত কিছু খবর

(বর্তমান) আমার এক পরিচিতজন গত জুন মাসে (২০২৪ সন) টরন্টো থেকে বাংলাদেশে গিয়ে বাংলাদেশী এক Hajj Operator Group-এর মেম্বার হিসেবে মক্কা শরীফে গিয়ে হাজ্জ করে এসেছেন স্বামীস্ত্রী দুজনে মিলে। মাথাপ্রতি খরচ পড়েছে সাড়ে আট লাখ টাকা, তিনি আমাকে জানালেন।

অতীত : এবার শুনুন আজ থেকে ১০৪ বছর আগে ১৯২০ সনে বাংলাদেশ (তখনকার BENGAL Province of India) থেকে মক্কা শরীফে গিয়ে হাজ্জ করা একজনের প্রকাশিত ডায়েরী থেকে কিছু খবর। সূত্র : টরন্টো থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা ভোরের আলো, ২০২৪ সনের ২৫ জুন সংখ্যায় আন্দালিব রাশদীর প্রবন্ধ : “হেজাজ ভ্রমণ।” লেখক ও প্রকাশক হাজী খান বাহাদুর আহছানউল্লা।)

খান বাহাদুর আহছানউল্লা তার পীর সৈয়দ গফুর শাহ আল হোসসামি আল ওয়ারেসির সংগী হয়ে ১৯২০ সনের জুলাই মাসে মক্কা শরীফে হাজ্জ করতে গিয়েছিলেন।

১৯২০-১৯২১ সালের জন্য প্রযোজ্য সুনির্দিষ্ট কোন জাহাজ ভাড়া ছিল না। তবে হজ্জযাত্রী পরিবহনকারী টার্নার মরিসন কোম্পানির জাহাজে বোম্বাই অথবা করাচি থেকে জেদ্দার ভাড়া ছিল-

              প্রথম শ্রেণী         ৫৫০ টাকা

              দ্বিতীয় শ্রেণী       ৪৫০ টাকা

              তৃতীয় শ্রেণী       ২৬০ টাকা

কলিকাতা থেকে তৃতীয় শ্রেণী অথবা ডেকের (Deck) ভাড়া ছিল ২০৫ টাকা।

রির্টান টিকেট কেনাটা বাধ্যতামূলক ছিল। রির্টান টিকেটের মেয়াদ ছিল ১৮ মাস।

সাধারণ জাহাজযাত্রীদের প্রতিদিনের খাওয়া খরচ ছিল ১৩ আনা। কলেরা ও স্মল পক্সের টিকা নেয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক। Vaccination Certificate দেখাতে হতো।

আহছানউল্ল­া প্রত্যেক হজযাত্রীকে ৯০০ টাকা সংগে নেয়ার পরামর্শ দেন এবং ঐ অংকের মাঝে ৮৩০ টাকা ৮ আনা খরচের একটা ফর্দ (list) ও দিয়েছেন।

তখনকার দিনের প্রচলিত আইন অনুসারে জাহাজ কোম্পানি জাহাজে থাকাকালীন সময়ের জন্য যাত্রীদের খাবার সরবরাহ এবং জাহাজে মৃত্যু হলে দাফন-কাফনের খরচ বহন করতে বাধ্য ছিল।

সেকালে হজ করাটা অতি কষ্টকর ছিল। রাস্তাঘাটের অভাব ও দুর্দশা ছিল প্রকট। উট  অথবা ঘোড়ায় চড়ে, অথবা পায়ে হেঁটে হজ করতে যেতে হতো। জেদ্দা পর্যন্ত পৌঁছতে অসুস্থ হয়ে বহু যাত্রী মৃত্যুবরণ করতো। রাস্তায় চলাকালীন অসুস্থতা ও মৃত্যু ছিল অতি সাধারণ ব্যাপার। সেকালে হজ করতে তিন মাস সময় লাগতো।

৩রা জুলাই, ১৯২০

আহছানউল্লা ৩রা জুলাই, ১৯২০ সনে কলিকাতা বন্দরে “হুমায়ুন” নামক জাহাজে চড়ে যাত্রা শুরু করেন। জেদ্দা বন্দরে পৌঁছলেন ১৭ই জুলাই বিকাল ৪টায়।

২০ জুলাই, ১৯২০

জেদ্দাতে পানীয় জলের বন্দোবস্ত সন্তোষজনক নয়। বর্ষাকালে কূপে-তালাবে যে পানি জমিত হজ্জের সময় উহাই বিক্রি করে স্থানীয় লোকেরা। এক মশক পানির মূল্য দুই আনা থেকে বারো আনা পর্যন্ত উঠে যায়। বহু লোকের সমাগম হেতু সেই পানি পংকিল হয়ে উঠে।

২২ জুলাই, ১৯২০

উটের পিঠে এক মাসের উপযোগী চাউল, ডাউল, ঘৃত ও চা বোঝাই করে মদীনা

শরীফের উদ্দেশ্যে ১৮০টি উটের একটি কাফেলা যাত্রা করল। পথিমধ্যে চরম সূর্যতাপ, গরম, ডাকাতের আক্রমণ, লুণ্ঠন ইত্যাদি সহ্য করে ২রা আগষ্ট, ১৯২০ মদীনা পৌঁছলাম। কাফেলার কিছু যাত্রী ডাকাতের আক্রমণে ও তাদের মালপত্র লুঠ হয়ে যাওয়ার কারণে মাঝ রাস্তা থেকে জেদ্দায় ফিরে যেতে বাধ্য হলো। হজ করাটা তাদের ভাগ্যে জুটলো না।

৫ই আগষ্ট, ১৯২০

মদীনাতে নবীর রওজা জিয়ারত করার পর জেদ্দায় ফিরে আসার জন্য প্রায় এক হাজার লোক নিয়ে কাফেলা যাত্রা করলো।

পথিমধ্যে সূর্যের তাপ, ডাকাতের আক্রমণ, কয়েকজনের মৃত্যু ও তাদের দাফন-কাফন, পানির অভাব ও পথচলাজনিত কষ্ট সহ্য করে ১৭ই আগষ্ট, ১৯২০ জেদ্দা নগরীতে ফিরে এলাম।

আগষ্ট ২০, ১৯২০ – আগষ্ট ৩১, ১৯২০

মক্কা-মীনা-আরাফাত এবং আবার মক্কাতে করণীয়/পালনীয় হজের সব অনুষ্ঠান শেষ করলাম। দুইটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ছাগল কিনে কুরবানী দিলাম। অতঃপর ইহরামের পোশাক পরিত্যাগ করলাম। ৩১শে আগষ্ট সন্ধ্যাবেলা হারাম শরীফ তাওয়াফ শেষ করলাম।

৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯২০ – ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯২০

৪ঠা সেপ্টেম্বর জেদ্দাতে জাহাজে চড়ে ১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯২০, বোম্বাই বন্দরে পৌঁছে জাহাজ থেকে নেমে “বোম্বে মেইল” নামক ট্রেইনে চড়ে কলিকাতা পৌঁছলাম। (১৫ই সেপ্টেম্বর), ১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯২০ ট্রেইনে চড়ে চট্টগ্রাম পৌঁছলাম। (চলবে)

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা