কানাডায় নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে বাচ্চাদের কাছে শিখেছেন এমন বাবা-মায়েদের পাঁচটি গল্প

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসীরা জানিয়েছেন কীভাবে তাদের সন্তানেরা এই নতুন দেশে আসা এবং নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাদেরকে সাহায্য করেছে।

প্রবাদে কথিত অপেক্ষাকৃত সবুজ-সমৃদ্ধ চারণভূমি খুঁজে পাবার আশায় প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার কানাডায় অভিবাসী হয়ে আসে। কিন্তু এই সুবিধা পাবার জন্য বিশ্বের একেবারে আরেক প্রান্তে পরিবার সরিয়ে আনতে তাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হয়। এই দামটা কেবল যে বাবা-মাকেই দিতে হয় এমন নয়, দিতে হয় সন্তানদেরও।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ইতিপূর্বেকার এত তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছর মোটামুটিভাবে দুই লাখ ৩৫ হাজারের মত অভিবাসী এদেশে আসেন। সম্প্রতি অবশ্য এই সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই অধিকতর উন্নত জীবনের সম্ভাবনায় প্রলুব্ধ হয়ে এদেশে আসেন। উন্নত জীবনযাত্রার নানা উপকরণের মধ্যে রয়েছে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, সন্তানের জন্য বিশ্বমানের পড়ালেখার সুযোগ এবং অধিকতর বহুসংস্কৃতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের সুযোগ নিতে পারা।

কিন্তু এর বাইরেও অনেক কিছু আছে। কানাডার শীতকাল তার মধ্যে অন্যতম। এটি অনেকের কাছে মনে হতে পারে ভয়ংকর একটি ব্যাপার বিশেষত যখন কোথাও কোথাও তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। এটি হলো হিমশৈলির ক্ষুদ্র মাথাটি। অনেক পরিবার তাদের নিজেদের বর্ধিত পরিবার, বন্ধু-স্বজনদের থেকে মহাদেশের দূরত্বে অবস্থান করে এখানকার ভাষা, জীবনযাত্রা প্রণালী অথবা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে।

ফালাক শেখ ভারত থেকে কানাডায় আসেন। তিনি মনে করেন ভালোবাসা সীমানা ছাড়িয়ে যায়। ছবি : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া

অবশ্য, সবাই জানেন, সাধারণভাবে শিশুরা নতুন পরিবেশের সঙ্গে খুব দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তবে সব শিশুই সহজে মানিয়ে নিতে পারে এমন নয়। কারও কারও জন্যে খাপ খাইয়ে নেয়ার কাজটা অন্যদের চেয়ে বেশি  কঠিন হতে পারে। নতুন অভিবাসীদের খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তার জন্য বাবা-মা এবং শিশুদের জন্য আলাদা কর্মসূচি নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর মত অনেক সংগঠন এবং সামাজিক কেন্দ্র কানাডায় আছে।

কানাডায় নবাগতদের শিশু প্রযত্ন নামের সংগঠনটির কাছে অভিবাসী ও শরণার্থী পরিবারগুলোকে সাহায্যকারী  সামাজিক কর্মসূচিগুলোর একটি তালিকা আছে। সিএমএএস-এর {CMAS (Childminding Monitoring, Advisory and Support)} মত অনেক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ভাষায় লেখা সামাজিক কর্মসূচিগুলোর তালিকা বাবা-মায়েদের কাছে সরবরাহ করে।

অনেক স্কুল নবাগত শিক্ষার্থীদের সাহায্যের জন্য বন্দোবস্তকারী কর্মীদের নিয়োগ দেয়। নবাগতরা যাতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সেজন্যে তাদের সহায়তা করতে কর্মীরা বাবা-মায়েদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। অন্য অনেকে অনলাইনে প্যারেন্টস গ্রুপের পক্ষ থেকে সহায়তা এনে দেয়ার ব্যবস্থা করে।

কানাডার নতুন জীবনে দ্রুত ও সহজে থিতু হবার মূল চাবিকাঠি হলো সহায়ক লোকেদের কাছে পৌঁছতে পারা। কানাডায় যেহেতু প্রতি বছর হাজার হাজার লোক অভিবাসী হয়ে আসছে, তাই মনে রাখবেন, আপনি ও আপনার পরিবার একা নন।

কানাডায় থিতু হতে গিয়ে নিজের সন্তানদের কাছে কিছু না কিছু শিখেছেন এমন

অভিবাসী বাবা-মায়েদের কিছু গল্প সংগ্রহ করেছে নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া। এখানে তারই কয়েকটি তুলে ধরা হলো:

“ভালোবাসা সীমানা ছাড়িয়ে যায়।”Ñ ফালাক শেখ

ফালাক শেখ ২০১৮ সালে ভারত থেকে কানাডায় আসেন। দেশের জন্য মন খারাপের সঙ্গে সঙ্গে কানাডার চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় নতুন জীবনে থিতু হতে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন তিনি। তিনি বলেন, “তারা (বাচ্চারা) শীতের তীব্রতা নিয়ে কোনও অভিযোগ করেনি।” তার ভাষায়, “বরং জীবনে প্রথম তুষারপাত দেখে তারা যারপরনাই আনন্দিত হয়েছে।”

তার চার বছরের ছেলেটা ফেলে আসা জীবনের কথা খুব একটা মনে রেখেছে বলে মনে হয়নি। ফালাক বলেন, “সে খুব দ্রুত সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে।” ছেলেটি নতুন বহুসংস্কৃতির পরিবেশে যেভাবে দ্রুত নতুন বন্ধুদের জুটিয়ে নিয়েছে সেটি বিস্ময়কর মনে হয়েছে ফালাকের কাছে। সে প্রথম প্রথম সামান্যই ইংরেজি বলতে পারতো, কিন্তু পর্তুগিজভাষী একটি ছেলের সঙ্গে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ফালাক বলেন, “কিভাবে ‘নতুনকে’ আবিষ্কার করতে হয় সেটা তার কাছে শিখেছি এবং সে-ই আমাকে শিখিয়েছে, ভালোবাসার কোনও ভাষা থাকে না।”

“পার্থক্য যত বড়ই হোক মানিয়ে আপনাকে নিতেই হবে।” Ñজুদিন মিকল

জুদিন মিকল দু’বছর আগে জ্যামাইকা থেকে কানাডায় আসেন। প্রথম দিকে শীতের তীব্রতার কারণে তার কঠিন সময় কেটেছে। তবে তার মেয়ে কত দ্রুত ব্যাপারটার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে তা দেখে তিনি অভিভূত। তিনি জানান, তার মেয়ে “সব সময়ই ঘরের বাইরে থাকতে ব্যাকুল থাকতো।” ছোট্ট মেয়েটি যদিও স্কুলের কাউকে চিনতো না তবুও তার মনোভাবের কারণে সে ক্লাসে সবার মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, “নতুন জায়গায় চলে আসাটা কখনই সহজ নয়। এখানে আপনি হয়তো ভালো চাকরি, পরিবারের সমর্থন, সমাজে সক্রিয় হবার মত সুযোগ পেতে পারেন কিন্তু তারপরও দেশের কথা ভুলতে পারবেন না। কিন্তু আমার মেয়ে আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছে সেটি হলো, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন অথবা যতই ভিন্ন হোক না কেন, আমাদেরকে এখানে খাপ খাইয়ে নিতেই হবে।”

জুদিন মিকল আরও বলেন, “কোথায় বাস করবেন, কোন স্কুলে বাচ্চারা যেতে পারবে সেখানে শিশু প্রযত্নের কি সুবিধা আছে এসব বিষয়ে আগে থেকে পরিকল্পনা করলে তা সহায়ক হয়।” “বাচ্চাদেরকে নতুন দেশে যাবার ব্যাপারে প্রস্তুত করতে হবে। সেখানকার নতুন বিশ্ব ও নতুন বন্ধুদের বিষয়েও বাচ্চাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে।”

“ইতিবাচক মনোভাব সব সময় সহায়ক।” Ñ আহমেদ আলবাস্তি, ইউএই

আহমেদ আলবাস্তি ২০১৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অভিবাসী হিসাবে কানাডায় আসেন। তিনি মনে করেন, নতুন কোনও দেশে যাবার ব্যাপারটা বিশেষ করে একটু বেশি বয়সের বাচ্চাদের জন্য খুবই দুরূহ হতে পারে, কারণ তাদেরকে নিজের দেশে অনেক বন্ধু-বান্ধব ও স্মৃতি ফেলে রেখে যেতে হয়।

তিনি আরও বলেন, “নতুন একটি দেশে চলে যাওয়া শুধু প্রাপ্তবয়স্ক লোকেদের জন্যই কঠিন নয়। বাচ্চাদের জন্যও তা দুরূহ হতে পারে বিশেষ করে ছয় বছরের বেশি বয়সের বাচ্চাদের জন্য।” বাচ্চারা তাঁকে শিখিয়েছে যে, নতুন একটি ভাষা শেখার মত এমনকি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতেও, ইতিবাচক

মনোভাব সহায়ক হতে পারে। তিনি বলেন, “শিশুরা বড়দের চেয়ে অনেক দ্রুত নতুন ভাষা শিখতে পারে তাই এ নিয়ে বাবা-মায়ের চিন্তিত হবার কোনও কারণ নেই।

“বিদেশযাত্রা যখন কঠিন হয়ে ওঠে তখন বাবা-মাকেও কঠিন হতে হয়।” Ñ জেনি সিমন

জেনি সিমন ২০১৯ সালে ফ্রান্স থেকে কানাডায় আসেন এবং বাচ্চা হবার পর তিনি কিছু শিক্ষা লাভ করেন। “আমি তখন সাত মাসের অন্তঃসত্তা (যখন তিনি কানাডায় আসেন), কিন্তু আমাদের থাকার মত কোনও অ্যাপার্টমেন্ট ছিলো না। জেনি হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন বিশেষ করে টরন্টোতে নতুন এসে অ্যাপার্টমেন্ট জোগাড় করা কত কঠিন! বাড়ির মালিকরা ক্রেডিট কার্ডের রেটিং এবং চাকরির তথ্য জানতে চায় যেসব তথ্য নবাগতদের প্রায়ই থাকে না। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমার সন্তান রাস্তায় ভূমিষ্ঠ হবে এমন ভাবনায় আমি দিশেহারা ও ভীত হয়ে পড়েছিলাম। ব্যাপারটা আরও গুরুতর ছিলো একারণে যে আমি তখন কোনও ধাত্রী বা ডাক্তারকে চিনি না এবং সে সময় আমার কাছে ওএইচআইপি কার্ডও ছিলো না। তিনি বলেন, “কিন্তু শুধু বাচ্চার কারণে আমি নিজেকে দশগুণ বেশি শক্তিমান হিসাবে করে তুলতে বাধ্য করি এবং নিজের উদ্বেগ জয় করতে সক্ষম হই।”

শেষ পর্যন্ত জেনি একটি অ্যাপার্টমেন্ট জোগাড় করতে সক্ষম হন এবং সেখানেই স্বাস্থ্যবান শিশুর জন্ম দেন। বাবা-মায়েদের জন্য তার পরামর্শ হলো, “যে শহরে থাকতে চান সেটি সম্পর্কে (এখানে আসার আগেই) ভালো করে জেনে নিন এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকুন।

“ছেলে আমাকে শিখিয়েছে, কানাডায় সমঅধিকারের ধারণা মেনে নিতে।” Ñদেশ সান্তোস

২০১৫ সালে ফিলিপিন্স থেকে আসা সান্তোস তার ছেলের বক্তব্য শুনে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছেন।

“আমার ছেলে যখন সপ্তম গ্রেডে পড়ে তখন আমি তাকে স্কুলের ‘পরিচারকের’ কাছ থেকে তার বুটজোড়া নিয়ে আসতে বলি।” সে আমাকে জবাব দেয়, “বাবা, আমরা স্কুলে তাকে ‘পরিচারক’ (লধহরঃড়ৎ) বলি না; আমরা তাকে বলি ‘অভিভাবক’ (পঁংঃড়ফরধহ)।” কানাডীয়রা প্রত্যেককে কিভাবে সমান সম্মানের চোখে দেখে সেটি সে আমার কাছে ব্যাখ্যা করে। এখানে যার অবস্থান যা-ই হোক না কেন, প্রত্যেককেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে দেখা হবে এমনটাই সবাই আশা করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও অবস্থান নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে আমরা কীভাবে সম্বোধন করবো এবং তাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবো সে বিষয়ে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, “এই উপলব্ধিটা কানাডার সব রকম কর্মপরিবেশে এবং সার্বিকভাবে এদেশের সমাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত।” তার ভাষায়, “কানাডায় নবাগতদেরকে কখনও নিজের সংস্কৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে স্বাজাত্যবোধ থেকে এবং কখনও স্থানীয় সংস্কৃতি অনুসরণে এখানকার দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগে প্রস্তুত থাকতে হবে। বাবা-মাকে অবশ্যই তাদের সন্তানদের কাছে নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার প্রয়োজন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে হবে।”

সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ