আমাদের ছোট্র গ্রাম
নজরুল ইসলাম
আমাদের সে যুগে গ্রামে সিঁদেল চোর সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে চুরি করতো। কাঁচা মাটি ও খড়ের বেড়া, চোর বেড়া কেটে বা বেড়ার নিচে সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে চুরি করে সোনা গহনা, মালামাল নিয়ে পালিয়ে যেত। সে যুগে প্রতিটি গ্রামেই চোরের উপদ্রব হতো। ১৯৫৮, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান গ্রামে গ্রামে (অবৈতনিক) রক্ষিবাহিনী নিয়োগ করেছিলেন। গ্রামের মানুষ পর্যায়ক্রমে রাতে গ্রাম পাহারা দিতো আর স্লোগান দিতো “বস্তি জাগোরে”। আমাদের মজিদ কাকা এক রাতে টের পেয়ে চোরের পিছু পিছু গিয়ে এক চোর ধরে পিটিয়ে থানায় পাঠিয়ে দেয়। সে যুগে রাতে চোর ধরা পড়লে গ্রামের লোক পিটিয়ে মেরে ফেলতো।
আমাদের ছোট সময়ে, গ্রামে মানুষ জুতা-স্যান্ডেল পরতো না, কাঠের খড়ম ব্যবহার করতো, কুমিল্লার কাঁঠাল কাঠের খড়ম সবাই পছন্দ করতো, আর বলতো এই দেখ কাঁঠাল কাঠ, টেক সই, অনেকদিন পরা যাবে। সে যুগে গ্রামে লোকজন জুতো পরতো না বা কদাচিৎ পরতো ।
বিয়ের অনুষ্ঠানে মেহমান বাড়িতে আসলে পানি খড়ম বাইরে রাখা হতো পা ধোয়ার জন্য। বাড়িতে বৈঠকখানা বা কাচারী ঘর যেখানে মেহমানদের মাটিতে বিছানার, চাদর, ফুলতোলা বালিশ, ফুলতোলা হাতের পাখা দেয়া হতো এবং ঘন ঘন মেহমানদের খোঁজ খবর নেয়া হতো। বর-দুলা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতো এবং ওটাই প্রচলন ছিল।
সে যুগে মেয়েরা পর্দা করে থাকতো এবং বাইরে পর-পুরুষকে দেখলে গুনাহ হবে ভেবে বড়ো বেশি ঘর থেকে বের হতো না। মুসলমান মহিলারা বেশি রক্ষণশীল, অনেক পরিবার মহিলাদের ঘরের চার দেয়ালের বাইরে যেতে দিতো না।
কুয়াশা ভরা ভোরে গ্রামের লোক ধান কাটতে মাঠে যেত ; গ্রামের ছেরু ধানকাটার সর্দার। সকাল হলেই ছেরু চেঁচামেচি,“কইরে তোরা সবাই চল”। কে কার খেতে ধানকাটতে যাবে এ দায়িত্ব ছেরুর। উনি বলাবলি শুরু করতেন কে কার খেতে যাবে। বিকেল হলে ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে বাড়িবাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওদের দায়িত্ব শেষ। ভোর ৭টায় কাজ শুরু, একটা দেড়টা বাজে কাজে বিরতি নিয়ে নামাজ ও খাওয়া শেষে ২ ঘন্টা কাজ করার পর কাজ শেষ হয়ে যেত।
ছেরু ভূমিহীন একজন মজুর ছিলেন। শেষ জীবনে বিনা চিকিৎসায় দিন কাটাতেন। দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতেন কিনা সন্দহ। তার দুই ছেলে ঢাকা শহরে ঠেলাগাড়ি চালাতো। বালু, সিমেন্ট দোকান থেকে ঠেলা করে নিয়ে মালিকের বাড়ি পৌঁছে দিত বা কোম্পানির বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন সাইটে দিয়ে আসতো। ছোট ছেলে ঠেলা গাড়ির কাজ করতে গিয়ে রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। বড়ো ছেলে অকালে স্ট্রোক করে মারা যায়। তাদের ছেলেমেয়েরা করুণ অবস্থার মধ্যে কোনো রকমে বেঁচে আছে।
এই গ্রামেই আর এক ভূমিহীন অসহায় মোস্তফার (৬ জনের) সংসার। মাছ ধরে সংসার চালায়। সে গ্রামে খালে, ডোবা নালাতে মাছ ধরে গ্রামের বাজারে বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চালায়। যেদিন মাছ ধরতে পারে, বিক্রি করে চাল, ডাল কিনে ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়। ছেলেমেয়েরা কোনোদিন খেয়ে, কোনোদিন না খেয়ে বেঁচে থাকে। ধান কাটা মৌসুমে চলে ধান মাড়ানো আর ভোরে ধান সেদ্ধর কাজ। গরু দিয়ে ধান মাড়ানো, সেদ্ধ করা, ধান শুকানোর দিনগুলো উৎসব মনে হতো। মহিলাদের দায়িত্ব ধান সেদ্ধ এবং ঢেকিতে চাল ও বড়ো মটকাতে চাল রাখা। ধান কাটা শেষ হলে সবাই একটু আনন্দ করে শেষ করতো। ধান কাটা শেষ হলে ঘরে ঘরে হরেক রকমের পিঠা, মুড়ি, চিড়া বানানোর ধুম লেগে থাকতো ; এই সঙ্গে জামাই/নাইয়ুরী বেড়ানোর সময়। নুতন জামাই হলে তো কথাই নেই, ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরে মেয়ে/ জামাই, দরজা বন্ধ, শরম, ওই ঘরে যাওয়া যাবে না। মাসের পর মাস জামাই আতিথিয়েতা চলছে।
সে যুগে মা-চাচীরা ধান সিদ্ধ, উঠানে শুকানো, ঢেকিতে চাল করা, গোলাভর্তি,রান্না ও ঘর সংসারের এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে ব্যাস্ত, এই ছিল কর্মমুখুর জীবন। মহিলারা উঠানে কাজ করলেও চারিদিকে পাটখড়ির বেড়া দিয়ে পর্দা করা হতো যেন অপর বেগানা পুরুষ না দেখে। কোনো পুরুষ বাড়িতে ঢুকলে আগে থেকেই গলা খাকরা দিয়ে আওয়াজ করা হতো যেন সময়মতো মহিলারা উঠান থেকে ঘরে পর্দার আড়ালে যেতে পারে। এটাই ছিল সে যুগের ইসলামী প্রথা। ঘরের প্রতিটি রুম কাপড়ের পর্দা দিয়ে আলাদা করা হতো।
মেয়েমানুষের অসুখ, ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতাল নিয়ে যাবে? মেয়েরা বেপর্দা হয়ে বাহিরে যাবে? সে তো পাপের কাজ। আমাদের সে যুগে হিন্দু কবিরাজরাই গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতো- যেমন আমাদের এলাকাতে -ললিত,শচীন্দ্র,পূর্ণ, গোবিন্দ আরোও অনেকেই কবিরাজি চিকিৎসা করতো। মুসলমান কবিরাজ বলতে সে যুগে খুব কম ছিল। কবিরাজদের বাড়িতে সব ধরণের ঔষুধি গাছগাছরা পাওয়া যেত এবং ওরা মূলতঃ সবই বাড়িতে তৈরী করে রোগীদের দিতো। কবিরাজ হাতে ঔষুধের টোল নিয়ে বাড়িবাড়ি যেত এবং রোগীদের রোগের অবস্থা বুঝে বড়ি দিতো। কবিরাজি বড়ি খেতে হলে, লতাপাতা -তুলসী পাতা, কচি আম পাতা,জায়ফল,দারচিনি আরো কত কিছু সংগ্রহ করে পাটায় পিষে বড়ির সঙ্গে যোগ করে খেতে হতো। আবার এদের অনেকেই কবিরাজির সঙ্গে এলোপ্যাথি চিকিৎসাও করতো। এ সব হিন্দু কবিরাজগন মুসলমান বাড়ি গেলে দুই হাত তুলে আদাব নমস্কার বলে প্রণাম করতো। আমাদের মুসলমানগণও ওদের আদাব নমস্কার বলে সাদরে ঘরে নিয়ে রোগী দেখাতো। বাড়িতে হিন্দু কবিরাজ আসলে পর্দার আড়াল থেকে মুসলমান মহিলারা অসুখের বিবরণ দিতো এবং সে মতে কবিরাজি ঔষুধ দেয়া হতো। অনেক সময় পর্দার আড়াল থেকে রোগী একটা হাত বের করে দিলে কবিরাজ শিরা দেখে রোগ নির্ণয় করতো। এটাই ছিল সে যুগের প্রথা।
পরপুরুষের চোখে চোখে চাহনি, মহিলাদের মুখ ও মাথার চুল দেখা, নব্য বিবাহিত মহিলাদের পায়ে ব্যাবহৃত গোলখারু বা হাতে রেশমি চুড়ির আওয়াজ পরপুরুষ শুনবে “হায় আল্লাহ” এতো পাপের কাজ। আমাদের হুজুররা বলেন, না জানি কত কাল দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে যদি আল্লাহ মাফ না করেন। হুজুরেরা বলেন মেয়ে-মানুষের সৌন্দর্য্য দেখা একমাত্র তার স্বামীর জন্য জায়েজ। অপর পুরুষ যেমন বাবা,শ্বশুর ব্যতিত কারো জন্য জায়েজ নাই। গলার স্বর নামিয়ে কথা বলতে হবে, যেন বাইরের লোক শুনতে না পান। যত দূর গলার আওয়াজ যাবে,ততোদূর দোজগের গভীরতা বাড়বে। সে যুগে আমাদের মেয়েদের বাইরে যাওয়া দূরের কথা, ঘরের চারিদিকে উঁচু বেড়া দিয়ে রাখতো যাতে বাহির থেকে কেউ দেখতে না পারে। অনেক মহিলারা সে যুগে বিনা চিকিৎসায় মারা যেত। আমাদের বাড়ির এক মহিলার সন্তান হবে, এক সপ্তাহ প্রসব ব্যাথা, বাচ্চা প্রসব হচ্ছে না। বাড়ি থেকে দেড় থেকে দুই মাইল দূরত্বে থানা হাসপাতাল। মহিলা এক সপ্তাহ পর্যন্ত প্রসব ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছে। ওকে হুজুরী চিকিৎসা, পানিপড়া, মাটিপাড়া,আরোও কতরকম তুকতাক গ্রামের চিকিৎসা করানো হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে নেয়া হয় নি, অবশেষে সে বাচ্চা প্রসবের ব্যাথায় মারা যায়। মৃত্যুর পূর্বে ওর স্বামী হুজুরের কাছে গিয়ে এর তদবিরের কথা বললে, হুজুর ওকে বলেছে একটা সাদা মোরগ নিয়ে যেতে। হুজুর নিজের পরিবার নিয়ে আয়েশ করে মোরগের মাংস ভক্ষণ করেছে- মোরগের মাথা দিয়ে তাবিজ বানিয়ে রোগীর গলায় দিয়েছে, একবার ও বলেনি -রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
সে যুগে ১০-১২ বৎসরের মেয়েদের বিয়ে হতো। ছেলে পক্ষের লোকজন যথা ছেলে স্বয়ং, বাবা,ভাই, চাচাসহ কনে বাড়ি গিয়ে এই মেয়েদের হাতপা, দাঁত, চুল, মুখের রং দেখে বিভিন্ন প্রশ্ন করতো যেমন সূরা কেরাত, নামাজ, হাতের কাজ- ফুল তোলা পাখা তৈরী জানে কিনা বা রান্নাবান্না শিখেছে কিনা জিজ্ঞেস করতো। এই ছোট্ট মেয়ে কিছু বলার পূর্বেই তার মুরুব্বি যথা দাদি, নানী সব ফরফর করে বলে দিতো, “আমার নাতিন সব রান্না করতে পারে।” অনেক সময় প্রতারণা হতো -যেমন এক মেয়ে দেখিয়ে অন্য মেয়েও বিয়ে দিতো।
আমাদের সে যুগে গ্রামে অনেকেই লেখাপড়া জানতো না। লোকজন তাদের স্ত্রীদের বাড়িতে রেখে চিটাগাং, ঢাকা, ময়মনসিং বা অন্যান্য শহরে কাজ করতো। ওরা চিঠি লিখতো, কিন্তু প্রাপক লেখাপড়া জানে না, এই চিঠি পড়তে জানতো না। আমি প্রাথমিক বা হাই স্কুলে পড়ি, ওদের চিঠি পড়ে দিয়ে উত্তর ও লিখে দিতে হতো। মেয়ে লোকের প্রেমের চিঠি ও আমাকে লিখতে হতো। মহিলা তার মনের দুঃখ স্বামীকে ইনিয়ে/ বিনিয়ে চিঠির ভাষায় বলতো, আমি শুধু লিখে দিতাম। আমি ভাবতাম, এই মহিলা তো লেখাপড়া করে নি। কিন্তু তার ভাষাগত জ্ঞান এত প্রখর। চিঠি লেখার পর আমাকে পড়ে শুনাতে হতো এবং সে থেকে আমার লেখার অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে। আজ আমি যা কিছু লিখি; এই লেখা স্কুল জীবন থেকেই হাতেখড়ি।
১০-১২ বৎসরের মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে আসার অর্থ পুরুষ, (স্বামী) দ্বারা ভয়ভীতি ও শারীরিক অত্যাচারিত হওয়া ব্যাতিত আর কিছুই আনন্দের থাকতো না। যে জন্য ওরা স্বামীর বাড়ি আসার কথা শুনলেই কান্নাকাটি করতো। কেন কান্নাকাটি করতো ওটা তাকে কেউ জিজ্ঞেস করতো না বা করলেও গুরুত্ব দিতো না; বরং জোর করে পাঠানো হতো, যেতে না চাইলে হুজুরের তাবিজ ও জিনের আছর থেকে রক্ষার জন্য তদবির করাতেন। মেয়েদের বর দেখে পছন্দ হয়েছে কি ? এই প্রশ্ন অভিবাবক মহলের কেউ জিজ্ঞেস করতো না বা ওর মতামতের উপর কেউ নির্ভর করতো না।
আমাদের ছোট্ট গ্রাম-পর্ব ৩
সে যুগে এই ছোট্ট গ্রামটিতে একটিমাত্র বিল্ডিং ছিল। আমরা বলতাম “বড়ো বাড়ি” এই নামেই প্রসিদ্ধ ছিল, আবার কেউ কেউ বলতো “বাগল বাড়ি”। মূলত বাড়িটা বড়োই, বাড়িতে প্রকান্ড এক বট বৃক্ষ, নিচে গ্রামের ঈদগাহ মাঠ, পাশেই বিশাল পুকুর, এক পাশে পায়ে চলার পথ, গোয়াল ঘর ও খড়ের পারা, বৈঠক খানা বা কাচারী ঘর, মসজিদ এবং ওপর দিকে সারি সারি ছনের ও টিনের ঘর, মাঝখানে খুরশিদ সাহেবের একটি মাত্র দালান।
খুরশিদ সাহেব বাবামায়ের একমাত্র ছেলে, চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করেন। সংসারে অভাব অনটন নেই, চাকুরী করার কি দরকার? বাবামা এবং গ্রামের লোকজনের ইচ্ছা তিনি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইলেকশন করবেন। ইলেকশনে পাশ করে উনিয়নে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছেনও বটে।
সন্ধ্যা হলে বট গাছের নিচে দাঁড়ালে কত রংবেরঙের পাখি, সকাল হলে ওরা কোথায় চলে যায় এবং বিকেলে ফিরে আসে। পাখিদের মধ্যে আবার একে অপরকে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণও হয়। কিছু সময় কিচিরমিচির করে শেষে চুপচাপ কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাতের অন্ধকারে মনেই হবে না যে এই বট গাছে কোনো পাখি আছে। মনে হয় যেন খালি হাতেও পাখি ধরা যাবে, দুই/এক বার চেষ্টা করেছি; তবে এতটা আবার সহজ না। ভোর হলো, আহারের সন্ধানে খাল বিলে চলে যায়। অনেক ধরণের পাখি এই গাছে রাতে আশ্রয় নিয়ে থাকে তন্মধ্যে বক উল্লেখযোগ্য, জলাভূমিতে বিচরণকারী গোত্রের কয়েক প্রজাতির পাখি, যাদের দীর্ঘ পা, গলা ও মাথা সরু ও লম্বা এবং ঠোঁট চোখা। এদের পালক সাধারণত সাদা, শুনেছি এক সময়ে রাজকীয় পোশাকে এবং মহিলাদের টুপিতে এর পালক ব্যবহূত হতো। বক শিকারের কত রকম কলাকৌশল যে আছে, বিশেষত আমাদের গ্রামের ছেলেপেলেরা ফাঁদ পেতে বড়শি দিয়ে বা পালা বক দিয়ে শিকার করতো,বক ধরার অপূর্ব দৃশ্য দেখার মতো। বক শিকার ঝুঁকি পূর্ণ, আমাদের গ্রামের এক ছেলের এক চোখ ঠোক্কর দিয়ে কানা করেছে।
নিজেদের জমিতে ধান,পাট, বিবিধ শস্য সরিষা, মুঘ, কালাই, তিসি, তিল, এবং সবজি হয়। এ ছাড়া পুকুর, খালে মাছ, নিজের গরু দুধ, মুরগি,হাঁস ও ডিম্ সবই বাড়িতে পাওয়া যায়। মৌসুমী ফল আম,জাম,কাঁঠাল, গোয়াভা, লিচু হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।
সকাল হলেই গ্রামের পাশে ফতেপুর আড়ং (বাজার), না গিয়ে কি কোনো উপায় আছে? কেনাকাটার নাম করে দোকানে চায়ের আড্ডা, ছোটোখাটো দেন দরবার, এ গ্রাম সে গ্রামের লোকজনের দেখাশুনা, কুশল বিনিময় প্রতিদিনের রেওয়াজ। প্রয়োজন আছে বা নাই, এটাসেটা বাজার থেকে নিয়ে আসা, অনেকেই চাল বিক্রি করে বাজার করে, তাছাড়া চায়ের দোকানের আড্ডা, এই দোকানে গ্রামীণ দরবারের রিহার্সেল ও হয়। গ্রামের কিছু মাতবর শ্রেণীর লোক দেন দরবারের অজুহাতে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা জমানো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাছাড়া সাপ্তাহিক বাজার তো রয়েছে যেখানে পাট, ধান বিক্রি করে বাজার ও নগদ টাকা পয়সা নিয়ে ঘরে আসে। ভাবলে আজ ও আমার হাঁসি পায়, বাজারে ডিম্ ব্যবসায়ী কি ভাবে হাতে ডিম্ নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে বলে এই ডিম্ নষ্ট, সে সময় বুঝতে কষ্ট হতো।
একটি ঘটনা আজ ও মনে পড়ে, ফতেপুর গ্রামে, গ্রাম্য প্রধান বা মাতবরের ছেলেরা এক বাড়িতে দিনে রাতে গাছের আম পেড়ে নিয়ে যায় এবং উঠতি বয়স্কা মেয়েদের উত্যক্ত করে। বাড়ির কর্তা ব্যক্তি ভীতু, কোনো কথা বলতে রাজি না; মেয়ের মা ঝাড়ু নিয়ে ছেলেদের তাড়া করেছে, সে বিচার হবে। চায়ের দোকানে এ নিয়ে কথাবার্তা, রিহার্সেল চলছে, বাজারের পর ও বাড়ি গিয়ে বিচার করবে, জরিমানা হবে। সে দিন আমি আড়ং বাজারে গিয়েছিলাম, কয়েকজন মাতবর শ্রেণীর লোক বলে চলো, আজ বড়ো বিচার হবে। বিচারকদের দেখেই মহিলা ভয়ে কান্না কাটি শুরু করেছে। গৃহকর্তা হেবলার মতো তাকিয়ে আছে, মুখে কোনো কথা নেই। অনেক কথা কাটাকাটির পর দরবারীদের এক তরফা বিচারে সিদ্ধান্ত হলো, মহিলা দোষী এবং ঝাড়ু নিয়ে তাড়া করা অপমান, ৫০০ টাকা জরিমানা হবে। আমার বুঝতে বিন্দুমাত্র ও অসুবিধা হলো না যে এই অন্যায় বিচারে মহিলা বখাটে ছেলেদের হাত থেকে মেয়েদের নিয়ে অসুবিধায় পড়বে। আমি রেগে মহিলাকে বললাম, “তোমার উচিৎ ছিল, ওদের ঝাড়ু দিয়ে পিটানো,তা না করে তাড়া করেছো, পরের বার দেখলে ঝাড়ু পিটা করবে। দরবারে হইচই শুরু হয়েছে” অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছে আমার জন্য জরিমানা আদায় করতে পারে নি। কিসের জরিমানা? পরে শুনেছিলাম এই পরিবার বাড়িঘর বিক্রি করে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে।
সচরাচর আমাদের গ্রামের বৃদ্ধরা ভোর হলে সকালের নাস্তা, মুড়ি,পিঠা খেয়ে হুক্কা টানবেন এটাই সকালের নিয়ম। গৃহকত্রী হুক্কা সাজিয়ে দিলে, মুরুব্বি টান দিয়ে ধুঁয়া ছেড়ে দিলে নেশা জাতীয় তামাকের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ; আমি নিজেও শৈশবে কোনো কোনো সময় দুই/একবার হুক্কা টেনে এর স্বাদ কেমন দেখেছি। আমাদের রাহিম চাচার হুক্কা টানার অভ্যাস ছিল; সম্ভবত উনি তাঁর বাবার কাছ থেকে এই অভ্যাস পেয়েছিলেন।
এক সময় টরন্টো শহরে কোনো এক ইরাকী ব্যবসায়ীর একাউন্টস ও ইনকাম ট্যাক্স আমি দেখাশুনা করতাম। তাঁর দোকানে অনেক পিতলের হুক্কা এবং মশলা তামাক বিক্রি করে। ওদের ব্যবসা দেখতে গেলে আমি পূর্বের অভ্যাসানুসারে ওদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে মশলা তামাকের স্বাদ গ্রহণ করতাম। মালিক আমাকে একটা পিতলের পাইপ সহ হুক্কা এবং তামাক পুরস্কার হিসাবে দিয়ে বলে এটা তোমার জন্য; বেশ মূল্যবান, বর্তমান বাজার মূল্য ২০০ ডলারের মতো হবে, এটা আমার বাড়ির নিচের তলায় নিজের কম্পিউটারের ডেস্কের পাশে সাজিয়ে রেখেছি। আমার স্ত্রী কয়েকবার বলেছে সরিয়ে ফেলতে। আমি বলি যতদিন আমি আছি,এটা আমার ডেস্কের পাশে থাকবে। তবে হুক্কা টানার অভ্যাস আমার নেই, এত সুন্দর হুক্কা প্রতিদিনই তাকিয়ে থাকি।
বড় বাড়ির কাদের হাজি ইয়া লম্বা,ফর্সা এবং সুদর্শন, গ্রামের দেনদরবার ভালো জানতেন, যে কোনো দরবারে বা বিয়েশাদিতে সবার সঙ্গে অতি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতেন। তাছাড়া আবিদ বড় দরবারী, চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করতেন, সামাজিক মানুষ, ছুটিতে বাড়ি আসলে গ্রামের জমানো দেনদরবার নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন। গ্রাম্য দরবার যারা করতেন, তাদের অনেকের পড়াশুনা তেমন ছিল না, যেভাবে কথা বলতেন, মনে হতো যেন পাশ করা উকিল। এই গ্রামের রাজ্জাক, মোহাম্মদ আলীর মতো অনেকেই সালিসি করতেন। এরা কথাবার্তায় ছিলেন পারদর্শী, সুন্দর ভাবে গ্রামের সমস্যা মীমাংসা করে দিতেন এবং সবাই মান্য করতেন। কাদের হাজির নিজের কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না, পাটের ব্যবসা করতেন, বর্ষা মৌসুমে এই বাজার সেই বাজার গিয়ে পাট কিনে হাজীগঞ্জ পাটকলে সাপ্লাই দিতেন এবং সমাজ সেবক ছিলেন।
এই যে বড়ো বাড়ির ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিং, আমরা ছোট সময় শখ করে ওই বিল্ডিঙের চার দিক ঘোরাঘোরি করতাম, মনে মনে ভাবতাম, হায়! এমন একটা বিল্ডিং যদি আমাদের থাকতো। বাকি গ্রাম ভর্তি টিনের চার চালা, দো‘চালা বা ছনের ঘর। সে যুগে প্রায় প্রতিগ্রামে ছনের চাষ হতো, আজকাল গ্রামে গেলে এ সব চোখে পড়ে না। এ সব ঘরের খুঁটি হয় বাঁশ বা কাঠের, প্রতি বৎসর ঝড়ে ঘরের চালা উড়িয়ে নিয়ে যেত। ঝড় হলে কি আমার, কি আর একজনের, কোনো চয়েস নেই, উড়িয়ে কোথায় নিয়ে যায়? ঝড়ে আমরা ঘরের দরজা, বেড়া ধরে রাখতাম এবং ঘর থেকে আজান (আল্লাহ হু আকবার) দিয়ে শেষ রক্ষা পেতে চেষ্টা করতাম। তবে আল্লাহ সবার কথা শুনতো কি না জানিনা, অনেকের ঘরের চালা উড়িয়ে পুকুরে, বাগানে বা উঠানে এমন ভাবে পরে থাকতো যে পুনরায় মেরামতের অবস্থা থাকতো না। যাদের ঘর শক্ত/খুঁটি দেয়া হয়েছে, তারাই একমাত্র রক্ষা পেতো। বাকিদের চালা বাতাসে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যেত, আল্লাহ মালুম। পরদিন সকালে শুরু হতো বাঁশ, ছন, কাঠ খোঁজ করে ঘর মেরামত করার পালা। চার চালা টিনের ঘর গুলি অবস্থা সম্পন্ন লোকদের যারা ভালো কাঠ, টিন ও মুলি দিয়ে শক্ত করে তৈরী করেছে ,তাদের ভয় কম; যত ঝামেলা গরিবের যারা কোনো রকমে দিন এনে দিন খায়, “সৈয়ালের ভাঙা ঘর” অর্থাৎ যে অন্যের ঘর মেরামত করে, তার ঘর-ই আগে ঝড়ে উড়িয়ে নেয়। এদের ঘরের অবস্থা নড়েবড়ে এবং একটু জোরে বাতাস আসলে ঘর উড়িয়ে নিয়ে যায়। পর দিন থেকে ভাবনা, ঘর মেরামত করতে হবে। নিজের গ্রামে চন, বাঁশ পাওয়া যায় না, দূর দূরান্তর ফতেপুর,তুলপাই থেকে ও মাথায় বা কাঁদে করে এ সব এনে মিস্ত্রিকে সাহায্য করেছি।
সে যুগে কি গরিব, কি অবস্থা সম্পন্ন, সবার রুজি রোজগার এই জমির উপর ছিল। সবাই সবার সুখ- দুঃখের খোঁজ খবর নিতো, কেউ গ্রামে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে, সবাই গিয়ে খোঁজ খবর নিতো, কারোর মৃত্যু হলে দেখা যেত সবার চোখে পানি,কবর দেয়া হবে, সবাই এসে সাহায্য করতো। অপর দিকে কারো বিয়েশাদি, বাড়ির লোকজন পুকুরে জিয়ানো মাছ মেরে,ঘরের চাল, ডাল, পিঠা বানিয়ে মেহমানদারী করিয়ে বুঝিয়ে দিতো,“আমরা সবাই এক পরিবার”, আর এর-ই নাম আন্তরিকতা।
লোকজন ছনের ঘরে বাস করতো, কারো মনে কুটিলতা ছিল না। সন্ধ্যা হলে খেয়ে মাটিতে হোগলা বিছিয়ে বা চকিতে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তো। মাবাবা ছেলেমেয়ে সবাই একত্রে ঢালাও ঘুমিয়ে পড়তো।
বাবা/চাচাদের আমলে লোক অল্প শিক্ষত ছিল, কেউ গুরু ট্রেনিং নিয়ে শিক্ষকতা, বা অফিস আদালতে ছোট খাটো কাজ করতো, বেতন বেশি না, নিজেদের বেতন ও জমি জমার ইনকাম সহ কোনো রকমে সংসার চলে যেত, কারো কোনো অভিযোগ নেই।
আমাদের যুগে এসে পড়াশুনা শুরু হলো, লোকজনের মধ্যে আগে বাড়ার চিন্তা ভাবনা বাড়লো, কেউ পড়াশুনার জন্য, কেউ পয়সা রোজগারের জন্য বিদেশে পারি জমিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে মাটির, ছনের, টিনের ঘর সরিয়ে দালান করার খেয়াল হলো। মানুষের মধ্যে আগে বাড়ার খেয়াল আসলো, তার সঙ্গে অশান্তি ও দেখা দিলো। আস্তে আস্তে লোকজন আরোও পড়াশুনা প্রতিযোগী হয়ে দেশ বিদেশে পারি জমিয়ে বা দেশে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আরো ও অন্যান্য পেশায় এগিয়ে রোজগারের ধ্যানে মনোযোগ দিলো এবং তার সঙ্গে দুর্নীতি ও অশান্তি ও দেখা দিলো।
এই যে আমরা বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গ্রামে পুরাতন নিয়মের পরিবর্তন করে জমি জমা নষ্ট করে পুকুর আর দালান করে বিলাসী জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আজকাল গ্রামে গেলে অনেক পরিবর্তন নজরে পড়ে, কোথায় সে খাস জমি যেখানে গরু ছাগল ছড়ানো হতো, আমরা ছুটাছুটি এবং খেলাধুলা করে সময় কাটাতাম। বাড়ির চারিদিকে খাল যেখানে বর্ষায় নৌকা দিয়ে এখানে সেখানে বেড়াতে যেতাম, সে সব চিহ্ন আজকাল নজরে পড়ে না। এমন কি জিজ্ঞেস করলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা সে সম্পর্কে কোনো কিছু বলতেও পারে না, বলতে গেলে ওরা মনে করে এ সব গল্প। ফসলি জমি নষ্ট করে বিদেশ থেকে পয়সা নিয়ে যার যার খেয়াল খুশি মতো বড়ো বড়ো দালান উঠাচ্ছে। খোঁজ নিলে জানা যাবে মানুষ আজকাল এত এত দালান করলেও রাতে ভালো ঘুম হয় না। ছেলেমেয়েদের নিজেদের আলাদা কামরা চাই, দরজা বন্ধ, ফেইসবুক মোবাইল, রঢ়যড়হব কার কত বন্ধুর সংখ্যা বাড়লো, এ নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত। মাবাবা, আপনজন রুমের দরজা নক না করে রুমে ঢুকা অভদ্রতা। কি পড়াশুনা করতেছে,কার সঙ্গে যোগাযোগ করে , কোথায় যাচ্ছে ? লাইব্রেরি ? গ্রুপে পড়াশুনা? খোঁজ নিতে গেলে বলে,“ও ধস ধফঁষঃ”। সে যুগে এ সব ছিল না, মাবাবা শান্তিতে ঘুমাতো, এ যুগে মাবাবার ঘুম নেই, রাত কত ? রাত ১২টা/১টা,মেয়ে/ছেলে ঘরে আসে নি। একদিন রেজাল্ট আউট হলো,অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিছুই করার নেই।কার সঙ্গে কোথায় ঘোরাঘুরি করছে কিছুই বলা যাবে না। কিছু বলতে গেলে’ “আব্বু/আম্মু তোমরা আউটডেটেড লোক”। একের সঙ্গে অন্যের দূরত্ব বেড়েই চলেছে, মানুষ যেন যন্ত্রের মতো দ্রুত চলছে। (চলবে)
নজরুল ইসলাম
টরন্টো