হৃদয়ে বাংলাদেশ : আমাদের ছোট্র গ্রাম
নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশে ৬৪ হাজার গ্রাম রয়েছে তন্মধ্যে “এনায়েতপুর” একটা ছোট্ট গ্রাম। কয়েকটি বাড়ি নিয়ে এই গ্রামটি এবং ২০/২৫ মিনিট হাঁটলে সব ক’টা বাড়ি ঘুরে আসা যেতো। এ গ্রামে হাতে গনা কিছু লোক, মনে হতো একটি একান্ন বর্তী বড় পরিবার। কেউ দাদা, কেউ চাচা, কেউ ভাই- সবার মধ্যে রয়েছে একটা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। ঘর থেকে বের হলে একে অপরের সঙ্গে দেখা, খোঁজ খবর না নিয়ে উপায় নাই। কারো জন্ম দিন, মৃত্যু দিন, বিবাহ, মেজবানি এসব আলাপ আলোচনা হতো একত্রে। পুরা গ্রামকে মনে হতো একই পরিবার, একই সূত্রে গাঁথা।
মৌলানা গফুর চাচার খানকায় মাসে একবার জিকির আজকার এবং এর সঙ্গে খাওয়া দাওয়া এসব হতো। গফুর চাচা কুমিল্লা (শাওয়াল পুর) বড়ো পীরের মুরিদ, প্রতি বৎসর পৌষ -মাঘ মাসে ওরস হলে আমাদের গ্রামের এবং আশেপাশের ভক্তরা পায়ে হেঁটে ২৫-৩০ মাইল গিয়ে দুই দিন আল্লাহর ধ্যানে জিকির করে পুনরায় পায়ে হেঁটেই চলে আসতো। সে যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো উন্নতি ছিল না, সবাইকেই পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হতো। উনি নিজের গ্রামে মাসে এক বৃহস্পতিবার এলাকার লোকদের ডেকে জিকিরের ব্যবস্থা করতেন। ওনার ভক্ত কিছু লোক এলাকার বাড়িবাড়ি গিয়ে নেয়াজের চাল উঠিয়ে নিয়ে আসতেন। এ করেই লোকদের সাহায্যে খানকার মাসিক খরচ চলে যেত। আমাদের মতো ছেলেদের জিকির আজকার তো নাম মাত্র, মজার মজার খাওয়া, মাংশ, চিকন চালের পোলাও, শেষে হবে দুধের ফিরণি- ওটাইতো আকর্ষণ, সারারাত ঘুম মেরে জিকির আজকারের মূল কারণ।
গফুর চাচা প্রাইমারি স্কুল টিচার ছিলেন; রোজ সকালে লুঙ্গি বা পাজামা, লম্বা জামা, মাথায় টুপি এবং গলায় মাফলার ঝুলিয়ে গ্রাম থেকে হেঁটে বা বর্ষার দিনে নৌকা নিয়ে স্কুলে যেতেন, বিকেলের দিকে বাড়িতে ফিরে আসতেন। এই গ্রামে বা পথে ওনাকে যেই দেখতেন, সালাম দিতেন। উনি এলাকার বুজুর্গ লোক ছিলেন,স্কুল সংলগ্ন মসজিদে এবং মাঝে মধ্যে গ্রামে ও ইমামতি করতেন। এক পর্যায়ে উনি নিজেকে এলাকার পীর হিসাবে অসংখ্য মুরিদকে তালিম দিতেন। ওনার মৃত্যুর পর ছেলেরা গফুর চাচার কবরকে দরগাহ বানিয়ে বড়ো ছেলে পীর হিসাবে দায়িত্ব নেন। এখানে দরগাহ, এতিমখানা এবং হাফেজিয়া মাদ্রাসা তৈরি করেছেন।
২
পুরা গ্রাম গাছ গাছড়ায় ভর্তি, সন্ধ্যা হলেই পাখির কিচিরমিচির সারা গ্রামকে মুখরিত করে তুলতো। একেতো নিজেদের দেশীয় পাখি ,তার উপর শীতের মৌসুমে অতিথি পাখি, মনে হতো পাখির রাজত্ব। সন্ধ্যা হলেই মনে হয় এত পাখির জগতে আমরা বাস করি। অগ্রহায়ণ ,পৌষ মাস শীতের মৌসুম, প্রতিটি ঘরে নতুন ধান, সবাই কম বেশি ফসল ঘরে উঠানো নিয়ে ব্যস্ত। সবার মনে আনন্দ নতুন ফসল নিয়ে। সকাল বিকাল গরু দিয়ে ধান মাড়ানি, প্রতিটি ঘর কর্মরত মহিলারা ধান সিদ্ধ করা, ধান শুকানো, ঢেঁকি দিয়ে চাল করা ও গোলা ভর্তি নিয়ে মহা ব্যস্ত। নতুন ধান ও খড়ের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে পুরুষ মেয়েলোক ধান কাটা, গরু দিয়ে মাড়ানো নিয়ে ব্যস্ত। ভোর হলেই মহিলারা নারিকেল, গুড় ও নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে ভাপা পিঠা তৈরি করতো। এক দিকে চারিদিকে শীতের আমেজ, প্রতিটি ঘরের সামনে খড়কুটা দিয়ে আগুন জ্বালানো এবং কি ছেলে, কি বুড়ো সবাই আগুনের চারিদিকে বসে পিঠা খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। রাতে খেজুরের রস দিয়ে মিষ্টি পায়েসের সাধতো আজ ও ভুলতে পারছি না। খেজুর গাছের নলিতে আঠা দিয়ে পাখি শিকার, মাঠে বক শিকার তা ভুলে গেলে কি ভাবে চলবে। গ্রামে কোনো বিদ্যুৎ নাই, তাতে কি, হারিকেন, টর্চ অবশ্যই আছে। আলো নাই বলে এ বাড়ি, সে বাড়ি বেড়ানো বন্ধ হবে কেন?
আমাদের যুগে গ্রাম বাংলার কাছারি ঘর ছিল আদবকায়দা, কোরআন শিক্ষা, নামাজ শিক্ষা সহ সকল নৈতিক শিক্ষার মূল কেন্দ্র। যা এক সময় প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে ছিল। এখন আর দেখা যায় না। সে যুগে আমরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সকাল হলে কাছারি ঘরে গিয়ে হুজুরকে সালাম দিয়ে গোল হয়ে বসে নামাজের সূরা-কেরাত, নিয়মকানুন, কায়দা, আমপারা, কোরান শিক্ষা করতাম। বাড়ির হুজুর কোরানিয়া, হাফেজিয়া বা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র, থাকা খাবার বিনিময়ে আমাদের পড়াশুনা করাতো। এই কাছারি ঘর থেকে আমরা শিক্ষা নিতাম, “সদা সত্য কথা বলিবে।” এক ঘণ্টা কি দেড় ঘণ্টা পড়ার পর ঘরে এসে স্কুলের হোমওয়ার্ক ও পড়াশুনা করতাম। কিন্তু আজকাল এ সব বিলীন হওয়ার পথে।
আমাদের চাঁদপুর সে যুগে পাটের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সেকালে দেখেছি জমিতে কীভাবে পাটের বীজ বুনতে হয়। পাটের জমিকে ধানের জমির চেয়ে মাটি বেশি গভীর, নরম ও বেশি সার দিতে হয়। ছোটকালে আমি নিজে ধান ও পাটের জমিতে কাজ করেছি, সে জন্য আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি। আমি জানি পাটের বীজ বোনার আগে বেশি বেশি লাঙ্গল দিয়ে বার বার মাটিকে মিহি করতে হয়। জমিতে পাটের বীজ থেকে চারা উঠার পর আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। এরপর পাটের চারাকে ফাঁক ফাঁক করে দিতে হয় যাতে গাছ বেড়ে উঠতে পারে। জমিতে সমান ভাবে চারা বেড়ে উঠছে কিনা খেয়াল রাখতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় যে কোনো কোনো অংশে চারা হলুদ রঙের হয়ে উঠে। সে জন্য আমি গোবর সার দিয়ে মাটিকে নরম করে দিতাম। মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে পাট গাছের গোড়া নরম করে দিলে তাড়াতাড়ি গাছ বেড়ে উঠে। কচি পাটের পাতা জমি থেকে উঠিয়ে নিলে মা- চাচীরা শাক রান্না করলে খেতে ভালোই লাগতো।
চাঁদপুরে পানি বেশি হয় এবং প্রতিটি চাষি ধানের পাশাপাশি পাটের চাষ করে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে পাটের চাহিদা বেশি ছিল। আমার সব চেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, সে যুগে বন্যা হলে ধান, পাট পানির নিচে তলিয়ে যেত, এ অবস্থায় কৃষক ডুবে ডুবে পাট কেটে তিন সপ্তাহ পানির নিচে পচানোর জন্য রেখে দিতো। পাট পচলে তারপর আঁটি থেকে সোনালি আঁশ হাত দিয়ে আলাদা করে ধুয়ে শুকানো এবং পরে বিক্রি করে ধান, চাল বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হতো। সে যুগে আমি নিজেও নিজের জমির পাট কেটে পানিতে ভিজিয়ে রেখে তিন সপ্তাহ পর উঠিয়ে পাটখড়ি থেকে পাট আলাদা করে পানিতে ধুয়ে উঠানে রোদে শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করেছি।
জমি থেকে পাট কেটে ভেলা তৈরি করে ভিজিয়ে রাখলে ও তা পানির নিচে যায় না। পাটের ভেলাতে ভারী কিছু দিতে হয় এবং ভালোভাবে না পচলে আঁটি থেকে আলাদা করা যায় না।
পাট শুকানো হলে বসত ঘরে বা কাছারি ঘরে রেখে দেয়া হতো। আমাদের কাদের কাকা বর্ষা মৌসুমে পাটের ব্যবসা করতেন, উনাকে খবর দিলে টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে হাজীগঞ্জ পাটের গুদামে বিক্রি করতেন। আবার অনেক সময় ব্যাপারীরা বাড়ি বাড়ি এসে কিনে নিয়ে যেত। অথবা চাষীরাই বাজারে নিয়ে বিক্রি করতো। পাট মৌসুমে পাটের বিচি রাখা হতো পরবর্তী মৌসুমে জমিতে বুনার জন্য। আমরা বাড়ির ছেলেপেলেরা পাট চুরি করে বিক্রি করে নিজেদের প্রয়োজনীয় এটা-সেটা কিনে নিতাম।
আমার জীবনের ধান কাটা, পাট কাটার অভিজ্ঞতা ভুলার মতো নয়। অগ্রহায়ণ মাসে ধানের আঁটি মাথায় করে বাড়ি এসে উঠানে রেখে দিতাম। বিকেলে বা সকালে গরু দিয়ে ধান মাড়ানো হতো, সে ধান মা চাচীরা সিদ্ধ করে উঠানে শুকিয়ে ঘরে ঢেঁকিতে চাল করে মটকা ভর্তি করে সারা বৎসরের জন্য রেখে দিতো।
দেশে অল্প অল্প শীতে সকালে ঘুম থেকে উঠে পুকুরে ঠান্ডা পানিতে হাতমুখ ধোয়া বা অজু করা অনেক কষ্ট। সে জন্য সকালে মা-চাচিরা চুলায় গরম পানি করে দিলে ওই পানিতে অনেকে অজু করে মসজিদে নামাজ পড়তে যেত। আমরা ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা ঠান্ডা পানিতে সব সেরে নিতাম। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ঘরে আসলে দেখতাম উঠানে খড় কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে, চারিদিকে গোল করে বসে সকালের মুড়ি খেজুরের গুড় দিয়ে খেতে কতই না ভালো লাগতো। তাছাড়া সকলে খেজুরের গুড়ের শিন্নি, পোয়া পিঠা, বা নারিকেলের বিভিন্ন রকম পিঠা খেতে কত ভালো লাগতো যা বলার অপেক্ষা রাখে না। নারিকেল কোরানো, চাউলের গুড়া, লবণ পানি মিশিয়ে ডুবো তেলে ভাজা পিঠা কতই না খেয়েছি যা আজও চিন্তা করলে ভালো লাগে।
মাঠের ধানকাটা শেষ হলে কৃষক জমিতে সরিষার বুনে দিতো। ভিজা মাটি, কেবলই ধান কেটে নেয়া হয়েছে; ধানগাছের বাকি অংশ পরিষ্কার করার প্রয়োজন নেই, ওখানেই সরিষার চাষ হয়। ৬০ দিনের মধ্যে সরিষার ফুল দেখা যায়। কি অপরূপ সুন্দর হলুদ রং ছড়ানো রূপ।
একদিকে শীত এসেছে, মাঠে মাঠে হলুদ সরিষার ফুল। হলুদ ফুলের চাদরে ঢেকে গেছে বিস্তৃত মাঠ। এ যেন এক ফুলের রাজ্য, হালকা হাওয়ায় প্রান্ত জুড়ে দোল খাচ্ছে শিশির ভেজা সরিষা ফুলের গাছগুলো। শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকিমিকি করছে সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুলগুলো। চোখ ধাঁধানো এ দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়েই যাবে পল্লি কবি জসীমউদ্দীনের কবিতা-
‘দুধারে অথই সরিষার বন
মাঝখান দিয়ে সরু বাঁকা পথখানি,
দোষ নিওনাক ফুলেরা তোমার
ধরিলে আঁচল টানি।’
মৌমাছিরা গুনগুন শব্দে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ছুটছে। ফুলেরাও যেন মৌমাছিদের জন্যই অপেক্ষা করছে নিজেকে উন্মুক্ত করে। বাতাসে মৌ মৌ করছে ফুলের ঘ্রাণ, যেদিকে চোখ যায় দিগন্ত জুড়ে শুধু সোনালি হলুদ সরিষা ফুল। এমন দৃশ্যে মন ভালো হয়ে যেতে বাধ্য।
সেই সরিষা গাছ সহ জমি থেকে উঠিয়ে বাড়ির উঠানে শুকিয়ে কাঠের উপর পিটিয়ে সরিষা আলাদা করে পান শুকিয়ে ঘানিতে গরু দিয়ে তেল করে সারা বৎসরের জন্য ঘরে জমিয়ে রাখা হতো। এ হলো খাঁটি সরিষার তেল যা বাজারে কোচিত পাওয়া যেত। এই একই প্রকারে তিসি-ও জমিতে বুনা হতো এবং একই সময় একই প্রক্রিয়ায় তেল করে চাষীরা ঘরে জমা করতো। তবে গরুকে যেভাবে কষ্ট দিয়ে ঘানি থেকে তেল করা হতো সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না।
বর্ষার রাতে আলো জ্বালিয়ে নৌকায় পুকুর আর খালে মাছ ধরা যে কত আনন্দ তা ভুলে গেলে চলবে কীভাবে। মাছ রাতে পুকুর বা খালে ভেসে থাকে এবং এল দিলে নড়াচড়া করে না; ভাসা মাছ এটা সেটা দিয়ে ধরা বেশ সহজ। অগ্রহায়ণ, পৌষ এবং মাঘ মাসে সন্ধ্যা হলে পুকুরে কলা গাছে ছোট মাছ দিয়ে বড়শি পেতে পানিতে ভাসিয়ে দিতাম। ভোরে গিয়ে দেখতাম মাছ কলা গাছের ভেলা নিয়ে টানাটানি করছে। ধারে নিয়ে এসে মা-চাচীকে দিলে কত আনন্দ করতো। রাতে ধরা জ্যান্ত মাছ মা চাচীরা রান্না করবে আর সে না খেয়ে ঘুমাবো? চুলার কাছেই বসে থাকতাম, গরম ভাত আর ফ্রেশ মাছের দোপেয়াজা, তার স্বাদই আলাদা, এ কি করে ভুলি?
জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টি আর ঝড়ে আম কুড়ানোর ধুম,পাকা আম, কাঁচা আম আলাদা করো, কার গাছের আম কত মিষ্টি এতো মুখস্ত। রাতে প্রচন্ড ঝড়ে ছনের ঘর, টিনের ঘর এবং গাছের ডাল ভেঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সে দিকে খেয়াল নেই, আলো নিয়ে আম কুড়ানোর যে আনন্দ, তা কি করে ভুলে যাই। বাড়িতে কাঁচা-পাকা আম মাটিতে পড়ে আছে, ডুলা ভর্তি করে ঘরে নিয়ে আসলে মা অনেক খুশি হতো।
বর্ষার দিনে পাট শাক, শাপলা, আর শালুক উঠানো সে তো আর এক দৃশ্য,তবে পানিতে জোঁক আছে সে কথা ভুলে গেলে চলবে কেন। জোঁকে ধরেছে, কিন্তু ওতো রক্তচোষা,লবণ না দিলে ছড়ানো যাবেনা। মা-বাবা বা দাদুর তর্জন গর্জন,“খবরদার আর কোনোদিন মাঠে পানিতে যাবেনা।”
নৌকা বা তালের কোন্দা নিয়ে জমি থেকে শাপলা আর শালুক উঠানো সে কি করে ভুলি? শাপলা দিয়ে কৈ মাছ বা সরিষা বাটা দিয়ে মা রান্না করতো এবং মায়ের হাতের সে রান্না কত সুস্বাদু, আজ ও মনে পড়ে। ভোর হলে আমি কোন্দা নিয়ে মাঠে গিয়ে কইয়া জাল উঠিয়ে কৈ মাছ এবং মাঠ থেকে শাপলা উঠিয়ে ঘরে আসলে মা কত খুশি হতো। আমি আজও সেই দিনগুলোতে চলে যেতে চাই। শৈশবের সেই দিনগুলোতে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে মাঠে গিয়ে কইয়া জাল, বড়শি পেতে মাছ ধরার যে আনন্দ ছিল সেটা আজও ভুলতে পারি না।
ভাদ্র আশ্বিনে মাজিদ চাচা, হাকিম আর রাশিদ ভাইকে নিয়ে নৌকায় করে মাঠে মাছ ধরা সেতো আর এক কাহিনি। বর্ষায় রুই আর মৃগেল মাছ পুকুরের নালা দিয়ে বের হয়ে ধান আর পাটের জমিতে নড়াচড়া করতো, কৌচ দিয়ে সেই মাছ ধরার আনন্দ সে কি ভুলতে পারি? মাছ কটা পাওয়া গেল সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু নৌকা নিয়ে মাঠে যাওয়া সে এক চমৎকার দৃশ্য। সেই দিন কি আর ফিরে পাবো?
মেহরণের জেলেরা প্রতি বৎসর বর্ষায় আমাদের বাড়ির পুকুরে জাল পেলে মাছ ধরে আমাদের তিনভাগ এবং ওরা একভাগ নিতো। বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই মাছ ধরার দৃশ্য পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। একবার জেলেরা কিছু মাছ লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে। অনেক কথা কাটাকাটির পর ওদের ছেড়ে দেয়া হয়।
আমাদের ছোট্ট গ্রাম-পর্ব ২
কল্পনাতে আমার ছোট্ট গ্রাম: চোখ বন্ধ করলেই দেখি আমার এই গ্রামের মেঠো পথ,পথের দুইদিকে গাছগাছালি, পাখির কাকলি, কৃষকের আনাগোনা, পল্লীবালাদের ঘোমটা টেনে একটু হাঁসি, গাছের আড়ালে বা ঘরের কোনে দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকিমেরে পর্দার আড়ালে চলে যাওয়া। এই মেঠোপথ ধরেই দাদা, চাচা, ভাইবোনদের নিত্য আসা-যাওয়া; ভোর হলেই কাকের কলরব,গরুর হাম্বা হাম্বা এবং মসজিদ থেকে ভেসে আসা “আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান্নাউম”। ঘুম থেকে নামাজ ভালো ধ্বনি। কাকের চিৎকার শুনে দাদি করিমুনের বুলি, “এইরে দেখ কাকটা এই ভোরে গাছের ডালে বসে কেমন কাতর সুরে ডাকতেছে, কার যেন কি দুঃসংবাদ নিয়ে আসছে।” একটু চুপ থেকে বলে, “ওই দেখ সঙ্গে সঙ্গে টিক্-টিকি ও ডাকছে। কি জানি কি খারাপ খবর?” দাদি সঙ্গে সঙ্গে জোরে জোরে কাঠের উপর আঙুল দিয়ে তিনবার ঠকঠক করে এবং আমরা জিজ্ঞেস করলে বলে “এতে খারাপ কিছু থাকলে কেটে যায়।” আমরা ছোট ছেলেমেয়েরা হেঁসে হেঁসে বলি “দাদি, জোরে জোরে কাঠে আওয়াজ করলেই বালা মুছিবত দূর হয়ে যাবে?”
কিছু বললেই দাদি রাগ করে ঘরের ভিতর চলে যেত। আমরা বলতাম, শুনো দাদি, ভোরে আমাদের যেমন মুড়ি, পান্তা ভাত খেতে হয়, ওরাও সারা রাত না খেয়ে থাকে, ওদেরও খিদা লাগে এবং কিছু খেতে হয়। সে জন্য ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে কাকা করে চিৎকার করে। দাদী তখন বলতেন, “আরে তোরা কেবল না বুঝে তর্ক করিস। এগুলি শনির দশা তোরা বুঝবি না।”
ওই দিনই দুপুরে ঘাগরা গ্রামের আমাদের ফুফাতো ভাই আনিস খবর নিয়ে এসেছে, ফুফু কাল রাতে পুকুরের ঘাটলায় পড়ে পা ভেঙেছে। দাদি ঘর থেকে চিৎকার করতে করতে বের হয়ে বলে ,“এই যে দেখ আমি সকালে কাকের ও টিকটিকির ডাক শুনেই বলছি কি জানি কি খারাপ খবর? তোরা কেবল আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করিস। শুনলি তো, কি সর্বনাশ!”
হ্যাঁ! দাদি তুমি তো গণক, সব বলতে পারো। দাদি আবার রাগে বিড়বিড় করতে করতে ঘরে গিয়ে আনিসকে বলে, “তোমার মায়ের এখন কি অবস্থা ?”
“পায়ে ব্যথা, নড়াচড়া করতে পারে না, কান্নাকাটি করে। বাবা দক্ষিণ বাড়ির জসিম কবিরাজকে ডেকেছে, ও লতা ঔষধ, কলাপাতা দিয়ে পা শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে। মা এখন পা নড়াচড়া করতে পারে না।” শুনে দাদি চোখের পানি ফেলে,বলে আমাকে কেউ পছন্দ করে না। সকলে আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। আমরা সবাই উঠে গিয়ে বলি, “দাদি এই কানে ধরলাম, আর তোমাকে বিরক্ত করবো না।” দাদি একটু হেঁসে বলে, “থাক এইবারের মতো মাফ কইরা দিলাম।” এইবার সবাই দাদিকে জড়িয়ে ধরে আদর, দাদির তো খুশিতে দুই চোখ দিয়ে পানি এসে গেছে।
দাদি বলে আমি কুলসুমকে দেখতে যাবো। আমরা বলি ঠিক আছে দাদি তুমি আনিস ভাইয়ার সঙ্গে গিয়ে কয়েক দিন থেকে আসো। দাদি সাদা ধুতি ও এক জোড়া চপ্পল পরে বলেন, “তোরা আমার পানের ডিব্বা ঠিক কইরা দে।” মা বলে “এক খিলি পান হাদা দিয়া খাইয়া যান, এখান থেকে ঘাগরা যাইতে লাগবে আধ ঘণ্টা, কুলসুমকে দেখতে গেলে সে আপনাকে পান দিবে।”
ঠিক আছে, এ কথা বলে দাদি রওনা দিলেন। দাদির পিছু পিছু আমরা সবাই ছুটলাম, বাড়ির পুব দিকে কিছুদূর গিয়ে দাদিকে বিদায় দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের জন্য দাদির এত আদর, এত মায়া মমতা, কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে তাকায়, আবার হাঁটে,আবার ফিরে তাকায়।
দাদির সঙ্গে ঝগড়া করি, তবে রাতে দাদি আমাদের ঘুমের সাথী। দাদির সেই ছোট্ট বয়সে বিয়ে হয়েছে ; দাদা ছিল দাদির জীবনের জীবন। দাদা মাঠে লাঙল নিয়ে কাজ করতো, বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে ঘরে ফিরে আসতো, দাদিকে কাছে টেনে নিয়ে আদর না করে কি পারা যায়? এইখানে মসজিদের পাশে দাদার কবর। দাদি রোজ রোজ মসজিদের কাছে গিয়ে দাদার কবরের দিকে তাকিয়ে কি যেন মুখ নেড়ে নেড়ে বলে ? জিজ্ঞেস করলে বলে তোমার দাদার জন্য দোয়া করলাম।
সে যুগে বর্ষার মৌসুমে সকাল বিকাল অবিশ্রাম ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনে গ্রামের ঝোপ জঙ্গল পার হতাম। বিশেষ করে দিনে বা রাত্রে ব্যাঙের ডাক শুনলে দাদি করিমন বলতো বৃষ্টি হবে। দাদির মতো অনেকে বিশ্বাস করতো ব্যাঙের “গান গাওয়া” মানে বৃষ্টি নিয়ে আসা। বর্ষার মৌসুমে খেত খামারে বিভিন্ন জাতের ব্যাঙ গান গায়। খেতে খামারে, জঙ্গলে,পুকুর পাড়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। সাপ গর্ত থেকে বের হয়ে ব্যাঙ ধরে। মুখে নিয়ে না পারে গিলতে,না পারে মুখ থেকে ফেলে দিতে; এ অবস্থায় লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সাপ মারা সহজ।
আমাদের বড় পুকুরের আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমি এবং আমার সমবয়েসি আরো কয়েকজন পুকুরে ঢিল ছুড়ছি, কে কতদূর নিতে পারে এই প্রতিযোগিতা খেলায়। হঠাৎ এক সাপ পুকুরে এ দিক থেকে অপর পারে জঙ্গলের দিকে সাঁতার কেটে যেতে নজরে পড়লে আমরা চিৎকার শুরু করি। আমাদের চিৎকার শুনে হাকিম ভাই লাঠি নিয়ে দৌড়ে এসে বলে কোথায় সাপ? ততক্ষণে সাপ জঙ্গলে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। অনেক খোঁজ করে ও আর সাপ পাওয়া যায় নি।
মা-দাদি বলতো “ভোর হয়েছে, ঘুম থেকে উঠ।” কিন্তু সব মা-দাদি জানে, ছোট-ছোট শিশুরা রাতে প্রস্রাব করে বিছানা ভিজিয়ে রাখে। আমরা দুই জন দাদির দুই দিকে ঘুমাতাম, দাদি মাঝ রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে আমাদের বাহিরে নিয়ে প্রস্রাব করাতো। এত ঘুম, চোখ খুলতে পারতাম না। দাদি চিৎকার দিয়ে বলতো “পেশাব কর”। ঘুমে ঢুলু ঢুলু করে পড়ে যাই। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হতো না, রাতে বিছানা নষ্ট করবোই। দাদি সকালে চিৎকার করে বলতো, এই দেখ তোরা রাত প্রস্রাব করে আমার কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিস। আমি এখন ফজরের নামাজ পড়তে পারবো না। মা রাগ করে বেত নিয়ে এসে বলতো প্রতিদিন কেন বিছানায় প্রস্রাব করা? দাদি আমাদের জড়িয়ে ধরে বলতো, থাক ওরা ছোট, মারতে হবে না। দাদির আদর আজও পেতে ইচ্ছে করে। শুধু কি তাই? মা রাগ করতো, কাঁথা ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতো। দাদি অতি চমৎকার কাঁথা সেলাই করতে জানতো; চোখে পুরু চশমা দিয়ে কাঁথা সেলাই,নামাজের বিছনা, বালিশের কভারে ও পাখায় ফুল তৈরি করতে জানতো। তার কাজের জন্য সবাই প্রশংসা করতো।
আমরা তখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি; প্রতিদিন বাড়ির পূর্ব দিকের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে এসে যা কিছু পেতাম তাই খেয়ে আবার দৌড় দিতাম, কে কার আগে দৌড়াতে পারে এ ছিল আমাদের প্রতিযোগিতা।
আমাদের গ্রামের হতো দরিদ্র মানুষগুলি খড়ের চালার কুঁড়েঘরে থাকতো। আর অবস্থা সম্পন্ন লোক দুচালা/চারচালা টিনের ঘরে। এই সব ঘরের চারপাশে গরু, ছাগল, কুকুর, বেড়াল এবং গাছে কাক, প্যাঁচা ও নানাপ্রকার পাখি বাস করতো। প্রতি ঘরের পাশে হাঁসমুরগী পোষা হতো, রাত হলে শিয়াল এসে মুরগির লোভে ঘোরাঘুরি করতো এবং কুকুর ওদের দেখলে তাড়া করতো। শিয়াল এতই ধূর্ত যে একত্রে কয়েকটা এসে আক্রমণ করতো। কুকুর আওয়াজ করলেই দাদি ঘুম থেকে উঠে শিয়াল তাড়াতে যেত।
আমরা দুই ভাই দুই দিক থেকে দাদিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকি ; দাদি বলে আরে তোরা ছাড় আমারে, আমি শিয়াল তাড়া করে আসি। ততক্ষণে আমাদের ও ঘুম ভাঙছে, আমরা দুই ভাই উঠে দাদির পিছন পিছন গিয়ে দেখি শিয়াল ততক্ষণে মুরগি নিয়ে দৌড়। দাদি বলে তোদের জন্য পারলাম না। বাইরে অন্ধকার, তেমন কিছুই দেখতে পেতাম না। কুকুর ৫-৬টা করে বাচ্চা দিতো এবং রাতে শিয়াল এসে আক্রমণ করে বাচ্চা নিয়ে যেত। সকালে দাদি বলে শিয়াল কুকুরের বাচ্চা নিয়ে যায়। রাতে পলো দিয়ে কুকুরের বাচ্চা ঢেকে রাখ। মা বলে রাতে কুকুরের বাচ্চা ঢেকে রাখলে কুকুর মুখ দিয়ে পলো সরিয়ে বাচ্চা বুকে নিয়ে ঘুমায়।
রাতের অন্ধকারে আমরা সে যুগে যখন বাজার বা দূরে কোথাও থেকে আসতাম, হাতে হয়ত কোনো আলো নেই। এ অবস্থায় জোনাকি পোকার আলো পথ দেখার কাজে সাহায্য করতো। এই জোনাকি পোকার আলো এই নিভে, এই জ্বলে এবং এর মধ্যে আমরা পথ দেখে বাড়ি আসতাম। কিন্তু এই নিভে এই জ্বলে মিটিমিটি আলোয় পথ ভালো দেখা যেত না। ফলে আমাদের অন্ধকারে হাঁটতে হতো। হাতে একটা লাঠি থাকতো এই জন্য যে পথে সাপ শুয়ে থাকলে লাঠির আওয়াজে পথ থেকে সরে পড়তো। সাপ রাতে ইঁদুর ধরার জন্য গর্ত থেকে বের হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকে, লাঠির আওয়াজে এরা মাঠের দিকে সরে যায়। বর্ষা হয় হয়, আমি একবার আমাদের পাট খেত দেখতে গিয়েছি, এক সাপ পাট খেতে দেখে ভয়ে চিৎকার শুরু করি। বাংলাদেশ গরম আবহাওয়া এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়, গরমে সাপ গর্ত থেকে বাইরে খাবারের জন্য বের হয়। তাছাড়া বন্যা হলে, সাপ থাকার জায়গা নেই, হয়তো গাছের ডালে বা মানুষের ঘরে চলে আসে। বাংলাদেশে বন্যা হলে, সাপ ঘরে উঠে, সাপের দংশনে লোক মারা যায়। (চলবে)