সুফিবাদ ও বাংলাদেশ

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

প্রথম অধ্যায়

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ইসলাম পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। ইসলাম প্রগতিশীল ধর্ম, মানবতার ধর্ম, মানবসেবার ধর্ম। এর অনেক রীতি-নীতি প্রাচীন ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যে ঐতিহ্য আংশিকভাবে ইসলামেরই অংশ। কেননা, ইসলাম কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময় থেকে শুরু হয় নি, বরং পৃথিবীর প্রথম মানুষ, হযরত আদম (আ.) ছিলেন ইসলামেরই প্রথম নবী, আর হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন শেষ নবী। হাদিস অনুসারে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার (মতান্তরে, দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার) নবী-রাসূল একই আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছেন যুগে যুগে। আল্লাহ তাই বলেন, “এবং কোন জাতি নেই, যাদের মধ্যে সতর্ককারী (নবী) যান নি” [সূরা ফাতির (৩৫):২৪]। আল্লাহ রাসূলুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, তাঁর পুর্বে আল্লাহ বহু রাসূল পাঠিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কতক আছেন যাদের কথা আল্লাহ রাসূলুল্লাহকে বলেছেন, আর অনেকের কথা তিনি তাঁর কাছে বলেন নি। কুরআন অনুসারে, এই বিশ্বের সকল সৃষ্টির স্রষ্টা এক আল্লাহ, যিনি সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরও স্রষ্টা। সুতরাং, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রীষ্টান, মুসলমান -সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই আল্লাহর নবী এসেছেন।

১ আল্লাহ বলেন, “ওয়া লাকাদ্ আরসালনা রুসুলাম মিন ক্বাবলিকা মিন হুম্মা মান কাসাস্না আলায়কা ওয়া মিন হুম্মা মাল্লাম নাকসুস আলায়কা” [সূরা মুমিন (৪০):৭৮]।
২ আল্লাহ বলেন, “আর প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক এক জন রাসূল রয়েছেন। সুতরাং তাদের সেই রাসূল যখন এসে পড়েন তখন তাদের মীমাংসা করা হয় ন্যায়ভাবে আর তাদের প্রতি অবিচার করা হয় না।” [সূরা ইউনুছ (১০):৪৭]

১ আল্লাহ বলেন, “ওয়া লাকাদ্ আরসালনা রুসুলাম মিন ক্বাবলিকা মিন হুম্মা মান কাসাস্না আলায়কা ওয়া মিন হুম্মা মাল্লাম নাকসুস আলায়কা” [সূরা মুমিন (৪০):৭৮]।

২  আল্লাহ বলেন, “আর প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক এক জন রাসূল রয়েছেন। সুতরাং তাদের সেই রাসূল যখন এসে পড়েন তখন তাদের মীমাংসা করা হয় ন্যায়ভাবে আর তাদের প্রতি অবিচার করা হয় না।” [সূরা ইউনুছ (১০):৪৭]

তবে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, রাসূলুল্লাহর মাধ্যমে যে ইসলাম আল্লাহ প্রেরণ করেছিলেন সে ইসলামই পরিপূর্ণ ইসলাম,  আর তাঁর পূর্বের নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহর যে বাণী প্রেরিত হয়েছিল তা তখনকার মানুষ আংশিকভাবে গ্রহণ করেছিল। তাই তাঁদের মাধ্যমে ইসলামের খন্ডিত বা আংশিক অংশ প্রচারিত হয়েছিল, কারণ, আল্লাহ বলেন, “অতঃপর আমি আমার রাসূলগণকে পরপর পাঠিয়েছি; যখন কোন জাতির নিকট তার (সে জাতির) রাসূল আসতেন তখন তারা তাঁদেরকে (রাসূলদেরকে) মিথ্যা জানত।” সুতরাং যে পুরানো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রভাব রাসূলুল্লাহর মাধ্যমে প্রচারিত ইসলামের ওপর পড়েছে তা কি পক্ষান্তরে ইসলামেরই পুরানো ঐতিহ্য নয়? একইভাবে, যারা সুফিবাদের ওপর ‘ভিন-সংস্কৃতি’ তথা বৌদ্ধ, বেদান্ত, গ্রিক, পারসিক সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্য করেন, তারা ভুলে যান কেন যে, তা প্রকৃতপক্ষে ইসলামেরই আদি সংস্কৃতির বিচ্ছিন্ন ভাবধারা, যদিও তারা শাব্দিক, বাহ্যিক বা আকারগত সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করেই এরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেন?

আল্লাহ বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামাত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন (ধর্ম) হিসেবে মনোনিত করলাম।” (আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দিইনিকুম ওয়া আতমামতু আলায়কুম নিয়া’মাতি ওয়া রাদিতু লাকুমু আল-ইসলাম দ্বীন) [সূরা মায়েদা’হ (৫):৩]
“ছুম্মা আরসাল্না রুসুলানা তাতরা কুল্লামা জা’য়া উম্মাতার রাসূলুহা কাজ্জাবুহু” [সূরা মুমিনুন (২৩):৪৪]।

প্রতিটি বিষয়ের সদর্থক ও নৈঞর্থক দিক আছে। নিউটনের গতির তৃতীয় সুত্র হলো ‘প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’। তেমনি মন্দের বিপরীতে ভালো, আলোর বিপরীতে অন্ধকার, নারীর বিপরীতে পুরুষ, সাদার বিপরীতে কালো – এটাই জগতের বিধান। জগতের বিষয়বস্তুকে চিনতে হয় তার বিপরীত গুণ দিয়ে। আল্লাহ যুগে যুগে যত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই বাধাগ্রস্থ হয়েছেন। ইসলামের অমীয় বার্তাবাহক স্বয়ং রাসূলুল্লাহকে (সা.) নিজের জন্মভুমি ত্যাগ করতে হয়েছিল। সুফিবাদের ইতিহাসও এরূপ কন্টকময়। সুফিবাদের কিছু সমালোচক আছেন যারা সুফিবাদকে ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণে বিকশিত এক অ-ইসলামি মরমী ভাবধারা বলে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী। আবার আর এক শ্রেণীর ইসলামি চিন্তাবিদ সুফিবাদকে কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে উদ্ভুত এক মরমী অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক চেতনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট। বস্তুত: কুরআন এবং হাদিস যে সুফিবাদের আকরগ্রন্থ এবং রাসূলুল্লাহ যে প্রথম সুফি তার প্রমাণ কুরআনের সূরা ফাৎহ-এর ১০ নং আয়াতে আছে। আল্লাহ বলেন, “ইন্নাল লাযীনা ইয়ুবায়িউ’নাকা ইন্নামা ইয়ুবায়িউ’নাল্লাহা,” অর্থ: ‘(হে মুহাম্মদ) তোমার নিকট যারা আনুগত্যের শপথ করে, তারাতো আল্লাহরই নিকট আনুগত্যের শপথ করে’ (৪৮:১০)। সুফিবাদের বাইয়াত প্রথার সূত্রপাত এখান থেকেই। একজন ‘পীর’ বা  ‘সুফি’  হলেন আল্লাহর রাস্তায় চলার পথের ‘আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক’ (spiritual trainer), যাঁর অছিলা নিয়ে আল্লাহর নিকট কোন সালেক কোনকিছু চাইতে পারেন। পাক কুরআনে আল্লাহ বলেন, “ইয়া আইয়োহোল লাজিনা আ’মানুত্তাকুল্লাহা গুয়াবাতাগু এলায়হেল ওয়াছিলাতা ওয়া জাহেদু ফি ছাবেলিহি লায়ল্লাকুম তুফলিহুন” [সূরা মায়েদা’হ (৫):৩৫]। এর অর্থ: ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর নিকট পৌঁছাতে অছিলা অন্বেষণ কর এবং তাঁর পথে চলতে মেহনত কর যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ সুফিবাদে এই ‘অছিলা’ হলেন ‘ইনসানে কামেল’, যাকে ফার্সী (Persian) ভাষায় ‘পীর’ বলা হয়। কুরআনের এই আয়াত থেকেই সুফিবাদে পীরের বাইয়াত গ্রহণ করার প্রচলন ঘটে। অছিলা বা মাধ্যম শুধু ইসলাম ধর্মে নয়, প্রতিটি ধর্মে, জীবনের প্রতিটি কর্মে, এমনকি আল্লাহর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় অছিলার বিষয়টি জড়িত। আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং তাঁর পাকবাণীর অন্তর্নিহিত অর্থ বের করলে একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, আল্লাহপাক এই দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন রাসূলুল্লাহার অছিলায়, কারণ তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহকে তিনি দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন দুনিয়ার সকল মানুষের (জগতের) রহমতস্বরূপ বা ‘রাহমাতাল্লেল আলামিন’ হিসেবে [সূরা আম্বিয়া (২১):১০৭]। এ-কথার প্রতিধ্বনি হাদিসে পাওয়া যায়। হাদিস-ই-কুদ্সিতে আল্লাহতায়ালা রাসূলল্লাহার জবানে ফরমায়েছেন: “লাও লাকা লামা খালাকতোল আফলাক,” অর্থ: ‘হে মুহাম্মদ! যদি আমি তোমাকে সৃষ্টি না করিতাম তবে আসমান, জমিন ও তন্মধ্যস্থিত কোন কিছুই আমি সৃষ্টি করতাম না’। হাদিস-ই-কুদ্সিতে আরও আছে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন যে, “আল্লাহ বলেছেন: ‘আমি একটি গুপ্ত ভান্ডার ছিলাম, কিন্তু আমি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলাম। আর এই উদ্দেশ্যে আমি কুল-মাখলুক সৃষ্টি করলাম’।” সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টার পরিচয়। আর সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে মানুষ তার রবকে জানতে সক্ষম এবং জানতে চায়। এই জ্ঞানলাভ হলো ইল্মে লাদুন্নি, যা অর্জন না করতে পারলে এ দুনিয়াতে মানুষ অন্ধ, কারণ কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যে দুনিয়াতে অন্ধ সে পরকালেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রান্ত’ [সূরা বনি ইসরাঈল (১৭):৭২]। সুফিরা মনে করেন যে, পরকাল সুখের হবে, যদি ইহকালের এ-জীবন পূণ্যময় হয়। আর সে কারণেই সুফিরা এ পাপ-পঙ্কিলময় নশ্বর জগত থেকেই পূণ্য, বা সদগুণ অর্জনের জন্য তরিকার পথে এত কঠোর সাধনা করেন।

হাদিস-ই-কুদ্সি। হযরত দাউদ (আ.)-এর এক প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহপাক এরূপ উক্তি করেন বলে জানা যায়। দেখুন Ernst, Carl W., The Shambhala Guide to Sufism, Boston, 1997, p. 52

সুফিবাদের মূলনীতি

উপরের বিশ্লেষণ থেকে বলা যায় যে, ঐশি-প্রেমে বিভোর, অন্তরাত্মায় পরিশুদ্ধ এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ দুনিয়াত্যাগী (তবে বৈরাগী নয়) সিদ্ধপুরুষই ‘সুফি’ হিসেবে গণ্য। ‘দুনিয়ার প্রতি বিরাগ আর পরকালের প্রতি অনুরাগ’- সুফিদের এই নীতি ইসলামেরই মর্মবাণী। ইসলাম বলে যে, যারা দুনিয়া নিয়ে বেশী ভাবে, তারা পরকালের চিন্তা করার সময় কম পায়, আল্লাহকে তারা ভুলে যায়। ‘তওবা’ (অনুতাপ), ‘তাকওয়া’ (আল্লাহ-ভীতি), ‘শোকর’ (কৃতজ্ঞতা), ‘ফকর’ (দারিদ্র), ‘তাওয়াক্কুল’ (আল্লাহতে আস্থা), ‘সবর’ (ধৈর্য্য), ‘ওয়ারা’ (মিতাচার), ‘যুহদ’(কৃচ্ছতা), ‘মহব্বত’ (আল্লাহ-প্রেম), ‘মুরাকাবা’ (অনুধ্যান) ইত্যাদি সদগুণ সুফিদের মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। আরবী (Arabic) ‘ফকির’ শব্দের তুর্কি (Turkish) প্রতিশব্দ হলো ‘দরবেশ’, যা পার্সী (Persian) ভাষায়ও ‘দরবিশ’ বা ‘দরবেশ’। ‘ফকির’ শব্দের অর্থ ‘দারিদ্র’ বা ‘আধ্যাত্মিক দারিদ্র’। অর্থাৎ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক বিষয়ে বান্দা ভিখারীর মতো। আবার, ‘দরবেশ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘দরজায় দন্ডায়মান’, অর্থাৎ ‘ফকির’। প্রাথমিক যুগের সুফিদের নিকট এই দারিদ্র আল্লাহপ্রাপ্তির পথে কোন বাধা নয়, বরং দুনিয়ার লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার কার্যকরী উপায়।

সুফি পেইন্টিং । এঁকেছেন মুাহাম্মদ সুলেমান রেহমান (সাচ্চি আর্ট)

সুফিরা যে কঠোর কৃচ্ছতাপূর্ণ (ascetic) জীবনযাপন করেন তা বেদান্ত বা সনাতন হিন্দু ধর্মে নির্দেশিত সাধুদের নিকট থেকে ধার করা কোন রীতি নয়, বরং তাঁরা ইসলাম থেকেই শিক্ষা নিয়েছেন, কারণ কুরআনে অসংখ্যবার এ-সকল সদগুণের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ তথা মানব চরিত্রের উন্নতি সাধনের কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহর সুন্নাহই সুফিদের ‘ফকির’ তথা বিলাসিতাহীন সরল সাদাসিধে জীবনের উৎস। সুফিবাদের ইতিহাসের প্রথমদিকে, অর্থাৎ খ্রীষ্টিয় অষ্টম ও নবম শতকে, সুফিদের মধ্যে অতিমাত্রায় কৃচ্ছতাসাধন লক্ষ্য করা যায়। রাসূলুল্লাহর জীবনের দারিদ্র থেকে সুফিরা দ্রারিদ্রকে ভূষণ বা গর্ব হিসেবে বরণ করতে থাকেন। এ-যুগের সুফিসাধকরা মনে করতেন কৃচ্ছতাসাধন আধ্যাত্মিকতা অর্জনের পূর্বশর্ত।

সুফিবাদে ফানা ও বাকা

সুফিদের একটি অন্যতম মূলনীতি হলো ‘আল্লাহর একত্ব’ (তৌহিদ), যা ইসলামেরই মূলভিত্তি। এ নিয়ে সুফিদের মধ্যে দুটো ভাগ হয়েছে- ‘ওয়াহেদাতুল ওযুদ’ ও ‘ওয়াহেদাতুশ-শহুদ’। ‘ওয়াহেদাতুল ওযুদ’ মতবাদের ধারক হলেন আল জুনায়েদ, মনসুর হাল্লাজ, বায়েজীদ বুস্তামী, আবদুল করিম জিলি এবং ইবনুল আরাবী। অন্যদিকে, ‘ওয়াহেদাতুশ-শহুদ’ মতবাদের ধারক হলেন রুকন উদ্দীন আলাউদ্দৌলা, বাহাউদ্দীন নকশবন্দী ও মুজাদ্দিদ আলফে-সানী। আর এই দুই মতবাদের এক সমন্বয় সাধন করেছেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী। ঊভয় ধারায় ফানা ও বাকা-এর ধারণা থাকলেও ওয়াহেদাতুল ওযুদপন্থীরা ফানার ওপর অধিকমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেন। বিশেষ করে, বায়েজিদ বুস্তামী (৮০৪ – ৮৭৪), আল-জুনায়েদ (৮৩০ – ৯১০) এবং মনসুর আল-হাল্লাজের (৮৫৮ -৯২২) মধ্যে ‘ফানা-ফি-আল্লাহ’ ও ‘বাকা-বি-আল্লাহ’-এর ধারণার বিকাশ লাভ করে। ‘ফানা’ কথাটার অর্থ হলো ‘বিলীন হওয়া’। আর ‘বাকা’ কথাটার অর্থ হলো ‘পৃথক হওয়া’। সুফির সাধনায় যখন পার্থিব জগতের সকল চেতনার বিলুপ্তি ঘটে, এমনকি  নিজের ‘আমিত্বকে’ হারিয়ে ফেলে, বা নিজের সিফাত (গুণ) বিলীন হয়ে আল্লাহর জাতের (সত্তার) রঙে রঞ্জিত হয় তখন তাকে ফানা বলে। ঠিক একবিন্দু বারি যেমন সাগরে মিশে যায়। এটাই হলো সুফির পরমলক্ষ্য। একেই বলে আল্লাহর নৈকট্যলাভ। আর বাকা হলো সাগর থেকে ঐ বারিবিন্দুর পৃথক হওয়া, যাতে সাধক সাগরে মিশে থেকেও তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। 

আল-জুনায়েদ এবং বায়েজিদ বুস্তামীর কিছু মরমী উক্তি এবং শিক্ষার সঙ্গে সনাতন হিন্দু ধর্মের ও বৌদ্ধ ধর্মের কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করে অনুমান করা হয় যে, হিন্দু বা বৌদ্ধধর্মের প্রভাব সুফিবাদে পড়েছে। তাঁরা বিশেষ করে ফানার ধারণা নির্বাণের ধারণা থেকে উৎসারিত বলে মনে করেন। কিন্তু সুফিদের ফানার সাথে বৌদ্ধদের নির্বাণের কোন মিল নেই। কারণ, নির্বাণ মানে ‘নিভে যাওয়া’ বা ‘দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ’, অন্যদিকে ‘ফানা’ হলো পরম করুণাময় আল্লাহর সত্তায় মিশে যাওয়া বা বিলীন হওয়া। বৌদ্ধ নিরীশ্বরবাদী ধর্ম। বৌদ্ধ দর্শনে আল্লাহ বা ঈশ্বরের কোন স্থান নেই, তাই আল্লাহতে বিলীন হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং নির্বাণের ধারণা ফানার ধারণায় কোন প্রভাব ফেলে না। সুফি গবেষকরা বিশেষ করে আল-কুশায়রী (৯৮৬ – ১০৭৪) তাঁর রিসালা আল-কুশায়রিয়া গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, ফানার ধারণা কুরআন থেকে পাওয়া। কুরআনে আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাকে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হতে বলেছেন। ‘ফানা’ শব্দটা কুরআনে আছে। মহান আল্লাহপাক বলেন, “কুল্লু মান আলায়হা ফানি, ওয়া ইয়াব্ক্বা ওয়াজ্হু রাব্বিকা যুউল্ যালালী ওয়াল-ইকরামি” অর্থাৎ ‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই বিলীন (ফানা) হয়, একমাত্র আপনার মহিমায় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া’ [সূরা আর-রাহমান (৫৫):২৬-২৭]।

1Arberry, A. J., op. cit., p. 58

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন Zaehner, R, Hindu and Muslim Mysticism, London: University of London Press, 1960

সুফিবাদে তাওয়াক্কুল

সুফিবাদের ইতিহাসের গোড়ার দিকে যেমন অষ্টম শতাব্দীর শেষে এবং নবম শতকের শুরুর দিকে বৈরাগ্যবাদের (asceticism) আধিক্য লক্ষ্য করা যেত। এ সময়ে সবচেয়ে ত্যাগী এবং বিশিষ্ট খ্যাতনামা সুফি ছিলেন মহীয়সী হযরত রাবেয়া বসরী (৭১৭ – ৮০১), যিনি শৈশবে অনাথ হন, অপহৃত হন, মাত্র ৬টি রৌপ্য মুদ্রায় বিক্রিত হন, ক্রীতদাসী হিসেবে জীবনযাপন করেন (তাঁর মালিক তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার পরিচয় পেয়ে তাঁকে মুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত) এবং আজীবন চরম দারিদ্রের মধ্যে জীবন কাটান। জেরুজালেমের সন্নিকটে তাঁর মাযার অবস্থিত।   আল্লাহর প্রতি তিনি যেভাবে আনুগত্য ও মহব্বত প্রদর্শন করেছেন তা সুফিবাদের ইতিহাসে বিরল। তিনি নামাযে বা দো’আয় কখনও আল্লাহর কাছে আমাদের মতো অর্থ, বিত্ত, বিদ্যা, বুদ্ধি এসব চাইতেন না।

1Farid al-Din Attar, Tadhkirat al-Auliya (Memorial of the Saints), trans. by Arberry, A. J., Muslim Saints and Mystics, Ames, Iowa, Omphaloskepsis, 2000, p. 29

চরম দারিদ্রের মধ্যে জীবনযাপনকারী রাবেয়া বলতেন, ‘আল্লাহ যদি আমার দারিদ্র সম্পর্কে অবগত থেকে থাকেন, তবে তাঁকে তা স্মরণ করিয়ে দেয়ার দরকার কী?’  তাঁর বিখ্যাত একটি দো’আ এরূপ: “হে আল্লাহ! আমি যদি তোমাকে দোযখের ভয়ে ইবাদত করি, তবে আমাকে দোযখের আগুনে পোড়াইও; যদি আমি বেহেস্তের আশায় ইবাদত করি, তবে আমাকে বেহেস্ত থেকে বের করে দিও; কিন্তু যদি আমি তোমার খাতিরে তোমার ইবাদত করি, তবে তোমার চিরভাস্বর সৌন্দর্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না।” এই হলো আল্লাহর প্রতি প্রেম। মুনাফিকদের আত্মা ভন্ডামী, ছলচাতুরী, অসত্য ও অন্যায়ে পরিপূর্ণ। তারা সুবিধাভোগী। সে-ই ঈমানদার, যার বিশ্বাসে আছে আন্তরিকতা। যারা সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, ভাল-মন্দে, সুসময়ে-অসময়ে জীবনে সর্বাবস্থায় শুধু এক আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল ও এক আল্লাহতে আস্থাশীল তারাই প্রকৃত বিশ্বাসী, ঈমানদার। হযরত রাবেয়া বসরী (র.) একবার একহাতে বালতিভর্তি পানি আর অন্য হাতে আগুনের মশাল নিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন। পথে তাঁকে এরূপ আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে, “তিনি পানি দিয়ে দোযখের আগুন নিভাতে আর মশালের আগুন দিয়ে বেহেস্ত জ্বালিয়ে দিতে যাচ্ছেন, যাতে কেউ যেন দোযখের ভয়ে আর বেহেস্তের আশায় আল্লাহকে না ডাকে।” তাঁর মতে, আল্লাহকে পাবার আশায় আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। সুফিবাদে একেই বলে তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর নির্ভরতা), যেখানে বান্দা তার সব ভালো-মন্দের ভার নিঃসংকোচে নিঃশর্তে আল্লাহর ওপর অর্পন করেন। তাওয়াক্কুল বিষয়ে একটি চৈনিক ঘটনার উল্লেখ করা যায়:

1Sakkakini, Widad El, First Among Sufis: The Life and Thought of Rabia al-Adawiyya, the Woman Saint of Basra, trans. by Dr Nabil Safwat, introd. by Doris Lessing, London: The Octagon Press, p. 2
2 “O Allah! If I worship Thee in fear of Hell, burn me in Hell; and if I worship Thee in hope of Paradise, exclude me from Paradise; but if I worship Thee for Thine own sake, withhold not Thine Everlasting Beauty.” (Arberry, A.J., op. cit., p. 42)
3 Sakkakini, Widad El, First Among Sufis: The Life and Thought of Rabia al-Adawiyya, the Woman Saint of Basra, op. cit., pp. 60-61

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। চীন দেশের এক গ্রামে বাস করতেন এক গরীব কিন্তু খুবই ধার্মিক চাষী ও তাঁর একমাত্র ছেলে। তাঁদের সম্বল ছিল পৈতৃকসূত্রে পাওয়া একটি কুঁড়ে ঘর, একখন্ড জমি আর মাত্র একটি ঘোড়া। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চাষী দেখলেন যে তাঁর ঘোড়াটা আস্তাবলে নেই। পাড়া প্রতিবেশীরা চাষীর সততা ও নিষ্ঠার জন্য চাষীকে সম্মান করতেন। ঘোড়া হারানোতে তারা চাষীর বাড়িতে এলেন। সবাই মিলে স্বান্ত্বনা দিতে লাগলেন, “হায় রে! একটিমাত্র ঘোড়া, তাও পালিয়ে গেল! এখন কী হবে?” চাষী তাঁদের ধন্যবাদ দিলেন এবং সাধ্যমত আপ্যায়ন করলেন। কিন্তু তাঁদেরকে বললেন, “আপনারা কী করে জানলেন যে, যা ঘটেছে তাতে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে?” সবাই হতবাক। জলজ্যান্ত ঘোড়া হারিয়ে যাওয়া কি কোন ক্ষতি নয়? যাহোক, সবাই বিড় বিড় করতে করতে চলে গেলেন। দিন যায়, রাত আসে। চাষীর কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। এক সপ্তাহ পর হঠাৎ একদিন ঘোড়াটি ফিরে এল। কিন্তু সে একা নয়। সঙ্গে করে আনল এক ঘোড়ি। প্রতিবেশী বন্ধুরা আবার এলেন। “মারহাবা, মারহাবা! একটার বদলে আপনার এখন দুটো ঘোড়া হলো। আপনি ভাগ্যবান।” চাষী পূর্বের ন্যায় আবারও তাঁদের আপ্যায়ন করলেন। এরপর বললেন, “আপনারা কী করে জানলেন যে, যা ঘটেছে তাতে আমার অনেক লাভ হয়েছে?” সবাই একটু বিরক্তবোধ করলেন। নিশ্চয়, চাষীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে! একটির বদলে দুটি ঘোড়া কি লাভের বিষয় নয়? যাহোক, সবাই চুপচাপ চলে গেলেন।

পরদিন সকালে চাষীর ছেলে ঘোড়া দুটিকে খাবার দেয়ার সময় নতুন ঘোড়াটি (ঘোড়ি) সজোরে এক লাথি মারল। ছেলেটির বাম পা ফেটে গেল। আবারও চাষীর সুখের-দুঃখের বন্ধুরা এলেন। স্বান্ত্বনা দিলেন। চাষী তাঁদেরকে ধন্যবাদ দিলেন, আপ্যায়ন করলেন, কিন্তু বললেন, “আপনারা কী করে জানলেন যে, যা ঘটেছে তাতে আমার মস্ত বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে?” সবাইতো হতবাক, একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। চাষী সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে। তা না হলে একমাত্র ছেলের পঙ্গু হবার পরও বাবা হয়ে কেউ এমন কথা বলে! যাহোক, সবাই চলে গেলেন, আর বলে গেলেন যে, এরপর তারা এ বাড়িতে আর আসবেন না; চাষীকে স্বান্ত্বনাও দেবেন না, বাহবাও দেবেন না। চাষী মনে মনে আল্লাহর কথা স্মরণ করেন: ‘তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটা বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে তা অকল্যাণকর …” [সূরা বাক্বারাহ (২):২১৬]।

একমাস পরের ঘটনা। জাপানী সৈন্য চীনে অনুপ্রবেশ করে। শত্রুর মোকাবেলার জন্য চীনা প্রশাসন শক্ত-সামর্থ যুবক ছেলেদের সন্ধানে চারিদিকে দূত পাঠাল। ঐ গ্রামে পৌঁছানোর পর গ্রামের সকল যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিল, কেবল চাষীর ঐ পঙ্গু ছেলেটি ছাড়া। কয়েকদিন পর গ্রামে খবর এলো ঐ গ্রামের যে-সকল যুবক যুদ্ধে গিয়েছিল তাদের একজনও জীবিত নেই।

চাষীর ছেলে ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠল। ঘোড়ীর বাচ্চা হতে লাগল। আস্তাবল ভরে গেল। বাজারে বিক্রি করে চাষীর দিন দিন আর্থিক অবস্থা ভালো হতে লাগল। যে-সকল প্রতিবেশীরা চাষীর দূর্দিনে-সুদিনে চাষীর বাড়িতে আসতেন, চাষী এবার তাদের বাড়িতে গেলেন। প্রতিবেশীরা জানলেন যে, যে-ব্যক্তি বিধাতার প্রতি পূর্ণ ভরসা করে সে ঠকে না, যদিও আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান কোনকিছু আমাদের কাছে অপ্রতুল মনে হতে পারে। আসলে, প্রতিটি ঘটনার অন্তরালে একটি গভীর অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে, যা কেবল দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আল্লাহর প্রতি যার তাওয়াক্কুল আছে, সে তার ভালো-মন্দ সবকিছু আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করে। কুরআনে আল্লাহ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলেছেন, কারণ আল্লাহ বলেন, “ইন্না আল্লাহা ইউহিব্বুল মুতাওয়াক্কিলিনা,” অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীকে ভালবাসেন’ [সূরা আল-ইমরাণ (৩):১৫৯]।  (চলবে)

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *