চিঠির আবেদন কি হারিয়ে যাবে!

জসিম মল্লিক

ডাকবিভাগ কি বন্ধ হয়ে যাবে? আজকাল এই প্রশ্নটি উঠছে। একমাত্র অফিসিয়াল চিঠি আর পার্সেল আদান প্রদান ছাড়া ডাকবিভাগের আর কি কোনো ভূমিকা থাকবে? ইন্টারনেটের যুগ এসে এই প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে উঠেছে। ফেসবুক বা টুইটারের মতো বিশাল স্যোশাল নেটওয়ার্কের কারণে হাতে লেখা চিঠির কথা মানুষ ভুলতে বসেছে। আমি নিজেই একসময় হাজার হাজার চিঠি লিখেছি। আমার ছিল অসংখ্য পত্রবন্ধু। পত্র লেখক হিসাবে আমার একটা খ্যাতি হয়েছিল। কই এখনতো আর আমি ডাকবিভাগের মাধ্যমে চিঠি লিখি না! এখন আমার দিনের অনেকটা সময় চলে যায় ফেসবুকের পিছনে। এমনকি আমার লেখালেখিরও ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক। হয়ত একসময় ফেসবুকও তার আবেদন হারিয়ে ফেলবে। আবার যেন মানুষ হাতের লেখা চিঠিতে ফিরে যায়। নতুন প্রজন্মতো জানেই না একসময় মানুষ হাতে চিঠি লিখত!

প্রশ্ন উঠতে পারে মানুষ চিঠি লেখে কেনো? চিঠি হচ্ছে ব্যক্তিমানুষের প্রকাশ। মানুষ তার নিঃসঙ্গতা, অনুভূতি তার মনোভাব অন্যের সাথে শেয়ার করতে চায়। চমৎকার বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যকে মুগ্ধ করতে চায়। কথার আবেদন চিরকালই থাকছে। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীতে অনেক কিছু বদলে যায়। এগিয়ে চলে বিশ্ব। হাইটেকের বিশ্ব আজ গ্লে­াবাল ভিলেজ। ই-মেইল, ইন্টারনেট আর চ্যাটবক্সেরই এখন যুগ। হাইটেকের বিশ্ব অবশ্য গতি আর বেগ দিয়েছে, কিন্তু আবেগের জন্যে আজও মানুষকে বেছে নিতে হচ্ছে ডাক বিভাগকেই। মনস্তাত্ত্বিকরা গবেষণা করে দেখেছেন এখনও পর্যন্ত হাতে লেখা পত্রটিই মানুষের কাছে লিখন এবং পঠনগত দিক থেকে অধিক আবেগপূর্ণ। মনস্তাত্ত্বিকদের ধারণা, অন্য কোন মাধ্যম দ্বারা খবর আদান প্রদান অনেক বেশী কার্যকর কিন্তু আবেগ আর মানসিক সম্পর্কের জন্যে এখনো পত্র নামক বস্তুটিই বিশ্বের জনপ্রিয়তায় এগিয়ে।

চিঠি কখনো কখনো হয়ে উঠেছে পত্র সাহিত্য। সেই সাহিত্যের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন কোন কোন মনীষী লেখক। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র একটি উঁচুদরের সাহিত্য। ১৮৮৭-১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ শ্রীমতী ইন্দিরা দেবীকে যে-সকল চিঠি লিখেছিলেন ছিন্নপত্র প্রধানত তারই সংকলন। বহু চিঠিই রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপ্রত্রে অর্ন্তভুক্ত করেননি। অনেক চিঠির কোন কোন অংশ সাধারণের সমাদরযোগ্য নয় মনে করে বর্জনও করেন। বর্জিত অনেকগুলো পত্র এবং পত্রাংশ মূল খাতা দু’খানি অবলম্বনে ১৯৬০ এর অক্টোবরে ’ছিন্ন পত্রাবলী’ নামে যে গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়, তাতে পাওয়া যায়।

স্যোশাল মিডিয়ার কারণে হাতে লেখা চিঠির কথা মানুষ ভুলতে বসেছে।। ছবি : ভোরের কাগজ

’কথা বলার অভ্যাস যাদের মজ্জাগত, কোথাও কৌতুক-কৌতুহলের একটু ধাক্কা পেলেই তাদের মুখ খুলে যায়.. চারদিকের বিশ্বের সঙ্গে নানা কিছু নিয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় আমাদের মোকাবিলা চলছেই। লাউড স্পিকারে চড়িয়ে তাকে ব্রডকাস্ট করা যায় না। ভিড়ের আড়ালে চেনা লোকের মোকাবিলাতেই তার সহজ রূপ রক্ষা হতে পারে।’ ছিন্নপত্র প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এ কথাগুলো লিখে গিয়েছেন। সে সময় ছিন্নপত্রের ৬৭ নং পত্রে যে লেখা হয়েছে, ‘তখন আমি এই পৃথিবীর নতুন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম’ এর প্রকাশযোগ্যতা সম্পর্কে কবি নিজের অভিমতটি ব্যক্ত করেছেন।

নজরুলের নিজের হাতের লেখা চিঠি এখনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ডে তেষট্টিটি চিঠি রয়েছে, যার প্রতিটিরই রয়েছে সাহিত্য মূল্য। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২৬  ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যায় নজরুল ইসলামের ’মুক্তি’ শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হয়। মুক্তি প্রকাশের পর বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকাটির সম্পাদককে একটি পত্র লেখেন নজরুল। পত্রখানি প্রায় ১০ বছর পরে সাপ্তাহিক সওগাতে প্রকাশিত হয়।

বালিকা কন্যা ইন্দিরার উদ্দেশে রচিত পিতা জওহরলাল নেহেরুর পত্রাবলীর বৃহৎ সংকলন এমনই ইতিহাস সমৃদ্ধ যে, আমরা অনেক সময়ই ভুলে থাকি সর্বার্থে বড় এই গ্রন্থটির মূল বৈশিষ্ট্য। পোশাকি নাম ’গ্লিমসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’। এটি রচিত হয়েছিল কন্যা ইন্দিরার উদ্দেশ্যে কারান্তরাল থেকে প্রেরিত পিতার…পত্রধারা মাধ্যমে। কিন্তু ব্যক্তি ও সমসময়কে ছাপিয়ে এ গ্রন্থের আবেদন এমনই সার্বজনীন ও সর্বকালীন যে ফিরে ফিরেই পড়তে হয় এই পত্রাবলী। এসব চিঠিতে বিভিন্নকালে বিভিন্ন যুগে ইতিহাস প্রসিদ্ধ নরনারীর প্রতিবেশী হয়ে নেহরু বসবাস করেছেন। কোথাও আবার অতীতের ঘটনা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পুরাতনের জীর্ণ কঙ্কালকে রক্ত-মাংস দিয়ে জীবন্ত রূপে সাজিয়ে তুলেছেন।

বুদ্ধদেব গুহর পত্রোপন্যাস ’সবিনয় নিবেদন’ একটি অসাধারণ গ্রন্থ। শুধুমাত্র পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে রচনা করা একটি পূর্ণাঙ্গ ও কৌতুহলকর উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে অভিনব সংযোজন। শুধু আঙ্গিকগত নতুনত্বের জন্যেই এ উপন্যাস বিশিষ্টরুপে নন্দিত হবে না, হবে এ সামগ্রিক আবেদনের জন্যও। বুদ্দদেব গুহ এর উপন্যাসে দীর্ঘকাল ধরেই চিঠিপত্রের একটা আলাদা স্থান। ’একটু উষ্ণতার জন্য’র ছুটি ও সুকুমারের অথবা ’মাধুকরী’র পৃথু ও কুর্চির চিঠির কথা উল্লেখ করা যায়। ব্যক্তিজীবনেও চমৎকার চিঠি লেখেন বুদ্ধদেব গুহ। কিন্তু এই উপন্যাসে পত্রবিলাসী কথাকার যেন নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে উঠেছেন।

পুরীর পোস্ট মাস্টার একদিন তার অফিসে ’ভগবান/জগন্নাথের মন্দির/ পোস্টাপিস পুরী’ এই ঠিকানায় লেখা কয়েকটি চিঠির সন্ধান পান। ভগবান নামে কোনো লোককে পিয়ন খুঁজে পাননি। কৌতূহলী হয়ে তিনি একটু কুন্ঠার সঙ্গে খাম ছিঁড়ে চিঠিগুলো পড়ে দেখেন যে সেগুলো খোদ ভগবানকেই লিখেছে কলকাতা থেকে ওরফে পোনু নামের একটি ছোট ছেলে। ভগবানের কাছে পোনুর কাতর মিনতি, তিনি যেন তার সমস্যাগুলো মিটিয়ে দেন। পোনু তখন বাংলা বানান শুদ্ধভাবে লিখতে পারে না। সেই ভুল বানানেই চিঠিগুলো একের পর এক সাজিয়ে দিয়েছেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় তার  ’পোনুর চিঠি’  বইয়ে। সব বয়সের পাঠক এই চিঠিগুলোর কৌতুক রস সমানভাবে উপভোগ করে থাকেন।

যামিনী রায়ের চিঠির মূল্য অসীম, কারো চিঠি ছাড়া অন্য কোন লিখিত ভাষ্যে নিজের মনের কথা নথিবদ্ধ করেননি তিনি। যামিনী রায়ের শিল্পী সত্তাকে বুঝতে হলে মানুষটিকেও সম্যকরুপে জানতে হবে। সে উদ্দেশ্য সাধনে চিঠিই একমাত্র সহায়। বুদ্ধদেব বসুকে লেখা যামিনী রায়ের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ-বিজয়চন্দ্র সম্পর্কেও ইতিহাস রচনার অসম্পূর্ণতা দূর করা সম্ভব নয়। এর প্রধান কারণ বিজয়চন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের সমস্ত চিঠি-পত্রাদির অভাব। কালিদাস নাগ প্রবাসী পত্রিকায় চারখানি চিঠি সংকলন করেন তখন (১৩৫০ বঙ্গাব্দ)। তিনি আট ন’খানির বেশী চিঠি লেখেন নি। সূচনাতে তিনি লেখেন ’…তার কন্যা সুলেখিকা সুনীতি দেবী যে চিঠিগুলো রক্ষা করেছেন সেগুলো নকল করে আমাদের পাঠান…।

ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৫-১৯৬১) বাংলা সাহিত্য জগতে বিভিন্ন দিক থেকে এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। প্রমথ চৌধুরীরর সঙ্গে ধূর্জটি প্রসাদের গল্পগ্রন্থ ’রিয়ালিস্ট’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে দীর্ঘ চিঠি দেন, তা প্রকাশিত হয়েছে ’পরিচয়’. বৈশাখ ১৩৪১ সংখ্যায়।

সাহিত্যের সঙ্গে চিঠিপত্রের একটি নিবিড় সংযোগ রয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে চিঠিপত্রের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অনেক সাহিত্যিকই বিভিন্ন সময়ে চিঠি লিখেছেন আপনজনদের। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই বেশী পত্র যোগাযোগ করেছেন। এখনো তাঁর লেখা চিঠি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেটি চিঠির আবেদন চিরন্তন বলেই।

বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে পত্র বিনিময় বা একে অন্যের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে শাহাদত চৌধুরীর অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রা। বিচিত্রার জন্মের শুরু থেকেই ’পাঠকের পাতা’ জনপ্রিয় হতে থাকে। এই বিভাগের মাধ্যমে পাঠকদের মধ্যে একধরনের যোগাযোগ সূত্র তৈরী হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে যখন ’ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন’ বিভাগটি শুরু হয় তখন একটি প্রচন্ড আলাড়ন তৈরী হয়। এটাকে বলা যায়, সে সময়ের চ্যাট বক্স। বিভাগটি তখন আর একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে উঠে সব বয়সীদের পত্রালাপের বা বিজ্ঞাপনালাপের বিষয়।

মায়েরা কেনো যে হারিয়ে যায়!

এভাবেই সময় চলে যায়। কিছুতেই সময়ের রাশ টেনে ধরা যায় না। মনে হয় এইতো সেদিন কানাডা আসলাম। চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে প্রথম দিনের স্মৃতি, দৃশ্যপট। অথচ দেখতে দেখতে বাইশ বছর হয়ে গেছে! যেদিন পীয়ারসন এয়ারপোর্টে নামলাম সেদিন অদ্ভুত একটা ফিলিংস হয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল কীভাবে নিজের শিকড় উপরে ফেলে মানুষ! প্লেনে বসেই আমার বরিশাল, আমার মা, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, আমার সংগ্রামময় জীবন যে ঢাকা শহর সব ভিড় করে আসতে লাগল। কেবলই আমাকে পিছু টানছিল। প্লেনের সুস্বাদু খাবার বিস্বাদ লেগেছিলো। টরন্টো নেমে আমরা সোজা অটোয়ার পথে রওয়ানা হলাম। ঢাকা থেকে হিথ্রো তারপর টরন্টো। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে।

হিথ্রোতে তিন ঘন্টা ফ্লাইট ডিলে ছিল মনে আছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে নামলাম নতুন এক দেশে, নতুন এক পরিবেশে। ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি শেষ করে যখন সকাল দশটায় এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম তখন টরন্টোর আকাশ রৌদ্রকরোজ্জল। ফুরফুরে বাতাস। চারিদিকে সবুজের সমাহার। ২৮ জুন ছিল সেটা। কানাডায় তখন তুমুল সামার। দুটো গাড়িতে আটটা বড় লাগেজ (প্রতিটি ৭০ পাউন্ড) এবং চারটা ক্যারিঅন ব্যাগ নিয়ে আমরা অটোয়ার পথে রওয়ানা হলাম। টরন্টো থেকে আরো চার ঘণ্টার ড্রাইভ।

সুশৃঙ্খল হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। দুপাশে সবুজ দৃশ্য দ্রুত অপশ্রিয়মান হচ্ছে। একশ বিশ কিলোমিটার স্পিড। হাইওয়ের নাম ৪০১। গাড়ি শহর ছাড়িয়ে পূবের দিকে ছুটে চলেছে। একটার পর একটা শহর পার হচ্ছি। পোর্ট ইউনিয়ন, পিকারিং, এজাক্স, হুইটবি, অশোয়া, বোমেনভিল। দূরেই দৃশ্যমান হচ্ছে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। লেক অন্টারিও। দুর থেকেই দেখতে পেলাম লেকের জল রৌদ্রের আলো পড়ে চিক চিক করছে। অর্ক অরিত্রি দীর্ঘ প্লেন ভ্রমণে গাড়ির মধ্যে ঘুমে ঢুলু ঢুলু। জেসমিনের চোখে বাইরে। এক গভীর অনিশ্চয়তা সেখানে।

জেসমিন আসতে চায়নি কানাডায়। অর্ক অরিত্রি সব পরিবেশেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আর আমি কখনো কখনো আগুনে ঝাঁপ দিতেও দ্বিধা করি না। পূর্বাপর ভেবে সবকিছু করা যায় না। আমার পুরো জীবনটাই এমন। আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমি। জীবন নিয়ে আমার কোনো উচ্চাভিলাষ নাই। সারা জীবন লড়াই সংগ্রাম করেছি। বিদেশের জীবন হবে আরো বেশি প্রতিকূল সেটা জানা আছে। আমি শুধু চাই আমার সন্তানদের সুখী করতে সেটা যেকোনো জায়গায়ই হোক না কেনো।

এতো বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। ছেলে মেয়েদের নিজেদের জীবন হয়েছে, সংসার হয়েছে। আরো কত কি বদলে যাবে। আমি এসব টের পাই। আমার অবজারভেশন খুউব ভাল। আমি আগাম টের পাই বলে জীবনে আমি অনেক অঘটন থেকে রেহাই পেয়েছি। তারপরও আমি ভুল করি। সবচেয়ে বড় ভুল হয় মানুষ চিনতে। মানুষকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করি এবং প্রায়শই ঠকি। কষ্ট পাই। কিন্তু সেসব নিয়ে আমার কোনো অনুতাপ হয় না। দেশে বিদেশে সবজায়গায়ই আমি মানুষের কারণে আমি অনেক যন্ত্রণা পেয়েছি। কিন্তু সেসব আমি মনে রাখিনি। সবাইতো আর এক রকম হবে না। আগে বেশি এসব নিয়ে আদিখ্যেতা করতাম। মাথা ঘামাতাম। এখন করি না। এটাই জীবন। এসব নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। পৃথিবীতে নিরবচ্ছিন্ন সুখ যেমন নাই দুঃখও নাই।

যেমন মা চলে গেলেন। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। অথচ দেখতে দেখতে চৌদ্দটি বছর পার হয়ে গেলো। ২০১০ এর এইদিনে মা চলে গেলেন। জীবন থেকে এভাবেই সময় চলে যায়। মা চলে গেলেও তিনি আছেন হৃদয়ে, স্মরণে, মননে, স্মৃতির আয়নায়। অনেক অসাধারণ সব স্মৃতি আছে আমাদের যা সবসময় জ্বলজ্বল করে। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো সবসময় মুক্তোর মতো ঔজ্জ্বল্য ছড়ায় প্রতিনিয়ত। একটা ঘটনা মনে আছে, তখন আমার বয়স দশ বারো বছর হবে। মামা বাড়িতে গেছি। অজ গ্রাম। এক-একদিন সন্ধেবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন এক-একটা বিকেল বেলা আছে যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়তো উঠোনে। আকাশের রং যেত পালটে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ’আমি’ আছে। সেই সব বিষণ্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হত। প্রায়ই পশ্চিমের ঘরে মাকে খুঁজতে গিয়ে পেতাম না।

সারা বাড়ি খুঁজে মাকে হয়ত পেতাম বড় ঘরের পাটাতনের সিঁড়ির তলায় গামলায় চাল মেপে তুলছে। আমি অবোধ দুর্জ্ঞেও এক বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যে মার কাছে গেছি তা মা বুঝত না। তবু একটুক্ষণের জন্য হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিত। একটুক্ষণের জন্য মাথাটা চেপে রাখত বুকে। আমি তখন মায়ের গা থেকে মা মা গন্ধটা পেতাম। মা ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করতো দুপুরে পেট ভরেছিল? আমি বুক ভরে মায়ের গায়ের সুঘ্রাণ নিতাম। আজ মা নেই। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই আনন্দ।

সেদিনের আকাশেও সপ্তর্ষি ছিল, ছায়াপথ ছিল না। মা বসে থাকেন পাশে। পিঠে হাত বোলান। কথা বলেন না। নীরবে মাতা-পুত্রের সময় পার হয়ে যায়। ধুলারাশির মতো আকীর্ণ নক্ষত্রপুঞ্জ বিপুল একটি অনির্দিষ্ট পথের মতো পড়ে থাকে, ওখানে রোজ ঝড় ওঠে, ঝড়ো হাওয়ায় নক্ষত্রের গুঁড়ো উড়ে সমস্ত আকাশে ছড়ায়। সপ্তর্ষির চেহারা শান্ত। প্রশ্নচিহ্নের মতো। ব্যক্ত ও অব্যক্ত জগতের সীমায় বসে আছেন সাতজন শান্ত-সমাহিত ঋষি। মৃত্যুর পর থাকে কি কোনো চেতনা? অথবা আর একবার কি জন্ম নেয়া যায়? মৃত্যু, মহান একটি ঘুম, তার বেশি কিছু না। ছেলেবেলায় ফাঁকা মাঠে শুয়ে আকাশ দেখা হতো। দেখতে দেখতে কোনো শূন্যতায় পৌঁছে যেতো মন। পার্থিব কোনোকিছুই আর মনে থাকতো না। তখন আকাশে থাকতেন দেবতারা, মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতেন। আজ তারা কেউ নেই- না মনে, না আকাশে। তবু আজও সপ্তর্ষির অদৃশ্য আলো শরীর আর মনে অনুভব করা যায়।

আবার যদি দেখা হয় মায়ের সঙ্গে। আবার যদি! আমার মাথায় একটু হাত রাখো তো মা, একটু হাত রাখো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, কেন রে? সব ভুলিয়ে দাও তো মা, ভুলিয়ে দাও তো। বুদ্ধি, স্মৃতি, অবস্থা ভুলিয়ে দাও। আবার ছোট হয়ে কোলে ফিরে যাই..।

সম্পর্ক নিয়ে কত কথা

প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যেই একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। ভারসাম্য ব্যাপারটা কি এটা বুঝতে হবে। কোন সম্পর্কটা টেকসই হবে, কোন সম্পর্ক কোনো ঝড় ঝঞ্ঝায় ভেঙ্গে পড়বে না, মচকাবে না, অটুট থাকবে সেটা অনুধাবন করতে হবে। তাহলেই সম্পর্ক আনন্দময় হবে, তাহলেই সম্পর্ককে হালকা মনে হবে। এমন সম্পর্ক করা উচিত না যা পাথরের মতো ভারি, এমন সম্পর্ক করা উচিত না যা নিয়ে সারাক্ষণ উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি থাকলে সম্পর্ক কখনও মজবুত হবে না। সম্পর্কে নির্ভরতা, রেসপেক্ট, প্যাশন থাকতে হবে। একতরফা সম্পর্ক করা উচিত না। সম্পর্ক হতে হবে খোলা বইয়ের মতো। সম্পর্ক হতে হবে ফুলেল সৌরভ মাখা, যেখানে কোনো কালো আঁচর থাকবে না, দাগ থাকবে না। তাহলেই সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হবে।

আমি মানুষের মনোজগৎ নিয়ে অনেক চিন্তা করি, রিলেশন ইস্যুজগুলো আমার চর্চার একটা বিষয়। সবসময়ই আমি এসব ভাবতাম। আমি স্পর্শকাতর মানুষ, আবেগি। আপাতঃ শান্ত মনে হলেও আমার ভিতরে একটা জেদি মন আছে। আমি একলা বড় হয়ে ওঠা মানুষ। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছি সবসময়। শৈশবকাল থেকেই আমি এমন। প্রথাবিরোধী এক বালক ছিলাম আমি। আমার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে আমি একদম মেনে নিতে পারি না। আমার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। এসব কারণে আমি জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি। এসব কারণে আমি অনেক একলা।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামজিক অবস্থান একটি বড় ফ্যাক্টর। ধনীর সাথে গরীবের কখনও বন্ধুত্ব হবে না। যদি হয়ও সেটা বন্ধুত্ব না, সেটা এক ধরনের দয়া, করুণার সম্পর্ক। গরীবরা সবসময় হীনমন্যতায় ভোগে আর ধনীরা সেটা উপভোগ করে। ধনীরা সবসময় গরীবকে চমকে দিতে চায়, মুগ্ধ করতে চায়, প্রশংসা শুনতে চায়। তারপর একসময় আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করে না। গরীবের তখন নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সারা পৃথিবী জুড়ে ধনীদের জয়জয়কার। এই পৃথিবী তাদের। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। এমপ্লয়ারের সঙ্গে কর্মচারির কখনও বন্ধুত্ব হবে না। পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা থাকতে পারে কিন্তু সেটা কখনও বন্ধুত্ব না। কর্মচারী কোনো ভুল করলে এমপ্লয়ার কখনও ক্ষমা করবে না। মনে রাখতে হবে সবাই ধনী হবে না, কেউ কেউ হবে। ভাগ্যের বরপুত্র সবাই হতে পারবে না।

ক্ষমতবানদের সাথে দুর্বলের কখনও বন্ধুত্ব হবে না। দুর্বল মানুষরা ক্ষমতাবানদের সান্নিধ্যে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে, পুলক অনুভব করে বটে কিন্তু সেটা প্রকৃতপক্ষে করুণা মাখা। করুণা নিয়ে কে বাঁচতে চায়! সম্পর্ক রচনা নিয়ে আমি অনেক সতর্ক। সবসময় তাই ছিলাম। তারপরও কি আমার ভুল হয় না! অনেকই হয়! আমি কি ভুল সম্পর্ক করি না! করি। আমি অনেক সাধারণ, আমার কোনো ক্ষমতাও নাই। তা সত্ত্বেও আমি অনেক ক্ষমতাবানদের সান্নিধ্যে এসেছি, অনেক ধনাঢ্য মানুষ আমার বন্ধু তালিকায় আছে, সেটা কি বাস্তব জীবনে কি সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেক সেলিব্রেটি যেমন আছে তেমনি আমার মতো সাধারণ মানুষও আছে। সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে আমি ইকুলিব্রিয়াম রক্ষা করে চলতে চাই। ক্ষমতাবান বা ধনীদের নিয়ে আমার আলাদা কোনো আবেগ হয় না। একজন সেলসম্যান, একজন উবার ড্রাইভার, একজন পিজা ডেলিভারিম্যান আমার কাছে যেমন তেমনি একজন সেলিব্রেটি বা মিলিয়ন ডলার বাড়িতে থাকে সেও তেমনি। করাইল বস্তিতে যে থাকে সেও যেমন গুলশান বা বারিধারায় যে থাকে সেও তেমন।

এসব কারণে সম্পর্ক নিয়ে আমার মধ্যে কোনো টানাপোড়েন হয় না, কোনো উচাটন নাই। রাতের ঘুম নষ্ট হয় না। কারণ আমি কারো কাছে কিছু পেতে চাই না। ক্ষমতার কাছে মাথা নত করি না। টাকা দিয়ে আমাকে কেনা যায় না। যখন আমি ঠিকমতো খেতে পেতাম না তখনও আমি এমনই ছিলাম। যে কোনো সম্পর্ককে আমি পেঁজা তুলোর মতো হালকা রাখতে চাই। অনেক ভার আমি নিতে পারি না। ধনী বা ক্ষমতাবানদের সাথে আমি উঠা বাসা করে দেখেছি কিন্তু ঠিক স্বস্তি যাকে বলে আমি পাই না। আমার তেমন কথা থাকে না তাদের সাথে। এটা কোনো হীনমন্যতা না বা অবহেলা প্রদর্শনও না, আমি ওই লেভেলের না বলে কোনো ঈর্ষাও কাজ করে না। আবার অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবানদের সাথেও আমি উঠা বাসা করেছি। তারাও অনেকে আমাকে বুঝতে পারে না। তাদের মধ্যেও এক ধরনের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করে।

যতই মনোজগত নিয়ে চর্চা করি না কেনো মানুষের মনের রহস্য কিছুতেই ভেদ করা যায় না। কোনো মানুষই প্রকৃতপক্ষে পুরোপুরি মানবিক হয়ে উঠতে পারে না। আমিও পারি না। আমার মধ্যেও অনেক দ্বিধা আছে, হীনমন্যতা আছে, ঈর্ষা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। অবচেতনেই এসব কাজ করে। নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গণ্য করতে পারি না নিজেকে। সম্পর্কের এইসব জটিল সমীকরণ কিছুতেই মেলানো যায় না। জীবনে কিছুই অনিবার্য না এই থিউরিতে বিশ্বাস করি, তাই সম্পর্ক রচনা নিয়ে আমি নির্ভার থাকতে পারি।

জসিম মল্লিক

লেখক ও সাংবাদিক

টরন্টো

লধংরস.সধষষরশ@মসধরষ.পড়স

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *