কানাডায় উচ্চ শিক্ষা ও পেশাজীবনে সফল অভিবাসী পরিবারের সন্তানেরা
খুরশিদ আলম
কানাডায় গত কয়েক দশকের মধ্যে আসা অভিবাসী পরিবারের সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষা ও পেশাজীবনে উল্লেখযোগ্য হারে সাফল্য লাভ করছে। এমনকি কানাডায় জন্ম নেওয়া একই বয়সের মূলধারার ছেলে-মেয়েদের তুলনায়ও তাদের সাফল্য বেশি। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার গবেষণায় সম্প্রতি এই তথ্য আবারও উঠে এসেছে।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই মিলিয়ন অভিবাসী শিশু তাদের মা-বাবার সঙ্গে কানাডায় প্রবেশ করেছে। কানাডায় প্রবেশের সময় এই শিশুদের বয়স ছিল ১৪ বছর বা তারও নিচে। উপরে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে আসা মোট অভিবাসীদের মধ্যে এদের সংখ্যা প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন।
দেখা গেছে অভিবাসী এই সন্তানেরা লেখাপড়া শেষ করে যখন চাকরি জীবনে প্রবেশ করছে তখন তাদের আয় দাঁড়াচ্ছে অন্য বয়সী অভিবাসীদের তুলনায় বেশী। এমনকি কানাডায় জন্ম নেওয়া তাদের বয়সী মূলধারার অনেক ছেলেমেয়েদের তুলনায়ও বেশী।
আরো দেখা গেছে অভিবাসী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে যারা কম বয়সে এদেশে এসে লেখাপড়া শুরু করেছে তাদের মধ্যে মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষার প্রতি ঝোঁক বা সম্ভাবনা বেশী। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার তথ্য অনুসারে দেখা যায় – অভিবাসী তরুণেরা, যাদের বয়স বিশ এবং যারা কানাডায় এসেছে চার বছর বয়সে বা তারও কম বয়সে, তাদের মধ্যে শতকরা ৭৭.৩ ভাগই পোস্টসেকেন্ডারি বা মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষা গ্রহণ করেছে। আর যারা কানাডায় এসেছে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সে তাদের মধ্যে শতকরা ৬৯.৯ ভাগই মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষা গ্রহণ করেছে। কাছাকাছি চিত্র দেখা যায় যারা দশ থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে কানাডায় এসেছে তাদের ক্ষেত্রেও। তাদের মধ্যে ৬১.৩% মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষা গ্রহণ করেছে।
আমরা দেখেছি যে, কানাডায় আসার পর প্রথম প্রজন্মের অধিকাংশ অভিবাসীদেরকে অর্থনৈতিক চাপসহ আরো নানারকমের চাপের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই অভিবাসীরা শিক্ষার কদর ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বুঝিয়ে দেন তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে। আর এই কারণেই হয়ত তাদের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত হয় এবং কর্মক্ষেত্রেও তারা সাফল্য লাভ করে।”
স্ট্যাটিসটিসক কানাডার তথ্য অনুসারে আরো দেখা যায়, শিশু বয়সে যে সকল অভিবাসী ছেলে-মেয়ে কানাডায় এসেছে এবং শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষা গ্রহণ করেছে – তারা আয়ের ক্ষেত্রেও সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২১ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে ঐ সময় যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৪ এর মধ্যে ছিল এবং এদের মধ্যে যারা শিশু বয়সে কানাডায় এসেছে তাদের আয় সামগ্রিকভাবে অন্যান্য কানাডিয়ানদের তুলনায় নিম্ন মধ্যম পর্যায়ের ছিল। তবে বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে পৌঁছানোর পর তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়ে সামগ্রিকভাবে অন্যান্য কানাডিয়ানদের সমপর্যায়ে চলে এসেছে বা তারও বেশী পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বয়স ৩০ এ পৌঁছানোর পর এই অভিবাসীদের বাৎসরিক আয় মধ্যম পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যায়, যার পরিমাণ গড়ে ৫৪,৯০০ ডলার। এটি এই বয়সী অন্যান্য কানাডিয়ানদের গড় আয়ের (৪৬,৬৯০ ডলার) তুলনায় ১৭.৬% বেশী।
উপরে উল্লিখিত আয়টি গড় হিসাব। দেখা গেছে অনেক অভিবাসী পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বাৎসরিক আয় উপরে উল্লিখিত গড় হিসাব থেকে অনেক বেশী। দ্বিগুণ বা তিন গুণ আয়ও করে থাকেন তাদের মধ্যে অনেকে। এদের মধ্যে আবার যারা আমেরিকায় পাড়ি জমান তাদের আয় প্রায় চারগুণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যারা ইঞ্জিনিয়ারিং বা কম্পিউটার ফিল্ডে কাজ করেন তাদের বেলায় এরকমটি দেখা যায়।
টেকনোলজি ফিল্ডে এই অভিবাসী তরুণদের ডিমান্ড এত বেশী যে অনেক ক্ষেত্রে চাকরি তাদেরকে খুঁজতে হয় না, চাকরিই তাদেরকে খুঁজে নেয়। আর এমনও দেখা গেছে যে, কানাডার এই অভিবাসী ছেলে-মেয়েদের কাউকে কাউকে চাকরিতে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য বিমান ভাড়া ও হোটেল খরচ দিয়ে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয় কোম্পানির খরচে।
কানাডায় অভিবাসী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যারা চিকিৎসা পেশায় বা আইন পেশায় আছেন তাদের আয়ও সাধারণ পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক বেশী। সরকারি চাকরিতে যারা ঢুকেন তাদের আয়ও বেসরকারি সাধারণ পেশাজীবীদের তুলনায় বেশী।
আমরা জানি উচ্চশিক্ষা স্বাভাবিক ভাবেই আয়ের উপর প্রভাব রাখে। আর কানাডায় অভিবাসী এই তরুণ-তরুণীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পিছনে প্রাথমিকভাবে তাদের মা-বাবার একটা প্রভাব রয়েছে। তারা সেই শৈশব থেকেই দেখে আসছে তাদের মা-বাবা উচ্চ শিক্ষিত। সন্তানেরা প্রথমত মা-বাবাকেই অনুসরণ করে। অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষিত মা-বাবাও চান তাদের সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষা লাভ করুক। আর কানাডায় সেই সুযোগও রয়েছে ষোলআনা। অধিকাংশ অভিবাসী মা-বাবা নতুন দেশে এসে তেমন আয় উন্নতি না করতে পারলেও তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের ঋণের সুবিধা। যেমন অন্টারিওতে আছে Ontario Student Assistance Program (OSAP). এছাড়াও কানাডায় রয়েছে Registered Education Savings Plan (RESP) নামের একটি বিশেষ প্রকল্প। সব কানাডিয়ান পরিবারের সন্তানদের জন্যই রয়েছে এই সুবিধা। কিন্তু দেখা গেছে এই সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বা ঋণের প্রয়োজন না থাকলেও কানাডার মূলধারার পরিবারের সন্তানদের অনেকেই অভিবাসী পরিবারের সন্তানদের তুলনায় পিছিয়ে আছে উচ্চ শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার প্রকাশিত ইতিপূর্বের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, কানাডায় জন্মগ্রহণকারী মা-বাবার সন্তানের তুলনায় কানাডায় অভিবাসী হয়ে আসা মা-বাবার সন্তানের সংখ্যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় দ্বিগুণ হবে। ভবিষ্যতবাণীটা ছিল এরকম – শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এমন পরিবারের সন্তান যারা পরিবারের সঙ্গে কানাডায় অভিবাসী হয়ে এসেছে। আর মা-বাবার মধ্যে একজন অভিবাসী এমন পরিবারের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে ৩১ শতাংশ আর মা-বাবা উভয়েই কানাডীয় এমন পরিবারের সন্তান ভর্তি হবে ২৫ শতাংশ।
সার্বিকভাবে, কানাডীয়দের তুলনায় এশিয়া থেকে আসা অভিবাসী পরিবারের সন্তানদের কলেজ পর্যন্ত ওঠার সম্ভাবনা কানাডীয়দের তুলনায় চারগুণ বেশি, যদিও মাধ্যমিক স্কুলে তাদের পারফরমেন্স নগণ্য।
২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার এক রিপোর্টেও বলা হয়েছিল, এশীয় অভিবাসীদের সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সম্ভাবনা অনেক বেশি। প্রবাসে এই তরুণদের সাফল্যগাঁথার কথা উঠে এসেছিল অন্য একটি গবেষণা পত্রেও যেটি কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ জার্নালে। ঐ সময়ে টরন্টো ইউনিভারসিটির অধ্যাপক জেফরী জি. রিটজ্, অধ্যাপক নাওকো হকিংস এবং মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল ইউনিভারসিটির অধ্যাপক হিদার জ্যাং তাদের ঐ গবেষণা পত্রে উল্লেখ করেছিলেন, কানাডায় মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৯ তাদের বাৎসরিক আয় ৫০ হাজার ডলার। অন্যদিকে চীনা বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুণদের বাৎসরিক আয় ৬৩ হাজার ডলার।
কানাডায় দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য এথনিক গ্রুপের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সাফল্যও কমবেশি একইরকম। অধ্যাপক তিনজন তাদের গবেষণা পত্রে আরো উল্লেখ করেছিলেন যে, চীন এবং দক্ষিণ এশীয় তরুণ ছেলে মেয়েদের মধ্যে গ্রাজুয়েশন লাভ করার হারও মেইনস্ট্রিম ছেলে মেয়েদের তুলনায় বেশী।
চীন ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের ছেলে-মেয়েরা কেন সাফল্যের দৌড়ে মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের তুলনায় এগিয়ে আছে সেই রহস্য লুকিয়ে আছে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ, নেপাল, ও ভূটান। টরন্টো ইউনিভারসিটির অধ্যাপক জেফরী জি. রিটজ বলেন, “চীন ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে গত দুই বা তিন দশকের মধ্যে আগত অভিবাসীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত।”
যদি বাংলাদেশের কথাই বলা হয় তবে দেখা যাবে যে, কানাডায় গত দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশে থেকে কানাডায় এসেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা প্রফেশনাল ক্যাটাগরিতে অথবা বিজনেস ক্যাটাগরিতে, তাদের মধ্যে সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। এদের মধ্যে আছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিজ্ঞানীসহ আরো কয়েকটি প্রফেশনের ব্যক্তিবর্গ। আছেন ধনী ব্যবসায়ীরাও। আবার এদের স্ত্রী বা স্বামীও উচ্চ শিক্ষিত। সবাই কলেজ বা বিশ^বিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। আবার যারা ইতিপূর্বে কানাডায় এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন তারাও কিন্তু কমবেশি উচ্চ শিক্ষিত। অবশ্য গত এক-দেড় বছরের মধ্যে যারা কানাডায় এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে কোন তথ্য এই মুহূর্তে আমাদের জানা নেই। তবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের হিসাবে যারা কানাডায় এসেছেন কিন্তু পরবর্তীতে এদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন তারা সবাই শিক্ষিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের মধ্যে যেমন উচ্চ শিক্ষিত আছেন তেমনই মধ্যম পর্যায়ের শিক্ষিতও আছেন। তবে এদের মধ্যে কতজন শেষ পর্যন্ত কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি পাবেন তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। ইমিগ্রেশন, রিফিউজি অ্যান্ড সিটিজেনশীপ কানাডার বরাত দিয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে গ্লোবাল নিউজ জানায় গত আট মাসে প্রায় ১৩ হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী কানাডায় রিফিউজি ক্লেইম করেছেন। চলতি বছর পহেলা জানুয়ারি থেকে শুরু করে ৩১ আগস্টের মধ্যে কানাডায় মোট ১ লাখ ৮ হাজার ৩৫ জন ব্যক্তি রিফিউজি ক্লেইম করেছেন। এর মধ্যে ১২ হাজার ৯ শ ১৫ জন আছেন স্টাডি পারমিটে এবং ১ হাজার ৩ শ ১০ জন স্টাডি পারমিট এক্সটেনশনে। ইমিগ্রেশন মন্ত্রীর মতে রিফিউজি ক্লেইম করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা খুবই উদ্বেগজনক। গ্লোবাল নিউজের খবরে বলা হয় ২০১৮ সালে কানাডায় ১ হাজার ৫ শ ১৫ জন শিক্ষার্থী রিফিউজি ক্লেইম করেছিলেন। তার সাথে তুলনা করলে বর্তমানে রিফিউজি ক্লেইমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০০ শতাংশ।
ইমিগ্রেশন, রিফিউজি অ্যান্ড সিটিজেনশীপ কানাডা’র একজন মুখপাত্র গ্লোবাল নিউজকে বলেন, কানাডার আইন অনুসারে কেউ এখানে রিফিউজি ক্লেইম করলে আদালতে তার হিয়ারিং এর সুযোগ রয়েছে। এটি তার অধিকার। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কেউ ক্লেইম করলেই কানাডায় থাকার গ্যারান্টি পেয়ে যাবেন।
এখন এই রিফিউজি ক্লেইম করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ যদি কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি পেয়ে যান তাহলে তাদের সন্তানেরাও নিশ্চিতভাবেই লেখাপড়ায় এবং পরবর্তী পেশা জীবনে সাফল্য অর্জন করবে এমনটা আশা করা যায়।
ইতিপূর্বে টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, সাধারণত অভিবাসী পরিবারের তরুণদের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক দূরত্ব সত্ত্বেও বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে এসব তরুণ। শিক্ষাগত দিক থেকে তারা স্থানীয়দের পেছনে ফেলছে। ব্যবস্থাপনা বিষয়ক চাকরিগুলোতেও ভালো করছে তারা, বিশেষত চীন ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূতরা।
গবেষণাটির নেতৃত্ব দেয়া টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের জেফরি জি রিটজ বলেন, “কানাডীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে এসব তথ্য আশাব্যঞ্জক। মূলধারার কানাডীয়দের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের বাৎসরিক আয় ৫০ হাজার ডলার আর চীনা বংশোদ্ভূতদের আয় ৬৩ হাজার ডলার।” কেন এমনটা হয়? রিটজের মতে, এর উত্তর হয়ত পাওয়া যাবে অভিবাসীদের বাবা-মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে তাকালে। তিনি বলেন, “আর্থিক দুরবস্থা থাকলেও শিক্ষার গুরুত্ব তাদের সন্তানকে বোঝাতে ভুল করে না তারা, যার বিনিময়ে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় তাদের সন্তানরা”। (তথ্যসূত্র : এমিলি রোজ/ কানাডিয়ানইমিগ্রেন্ট.সিএ)
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অভিবাসী পরিবারের সন্তানেরা বাবা-মায়ের খুব নজরদারিতে থাকে। কারণ বাবা-মা নতুন একটি দেশে এসে নতুন একটি সংস্কৃতির মধ্যে ছেলে-মেয়েদেরকে সহসাই স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেন না। ফলে অভিবাসী ছেলে-মেয়েদের শৈশব কাটে মোটামুটি নজরদারির মধ্যে। এ কারণে তারা একটি শৃঙ্খলার মধ্যে থাকে এবং পরিবারের চাপের কারণে লেখাপড়ার প্রতি বেশী মনোযোগী হয়।
তাছাড়া নতুন একটি দেশে এসে অভিবাসীদের ছেলে-মেয়েরা দেখে তাদের বাবা-মায়েরা কীরকম অক্লান্ত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এবং এই পরিশ্রম যে তাদেরই জন্য তাদের বাবা-মা করে যাচ্ছেন এই বিষয়টিও তারা উপলব্ধি করে। অনেক অভিবাসী পরিবারের শিশুরা আবার দেখে তাদের বাবা-মা অক্লান্ত পরিশ্রম করেও স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পায় না। এসব কিছু মিলিয়ে এই অভিবাসী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের জেদ বা অঙ্গীকার জন্ম নেয়। সেটি আর কিছুই নয়, জীবনে উন্নতি করতে হবে। বাবা মায়ের কষ্ট লাঘব করতে হবে।
এই চিত্রটি কেবল কানাডার ক্ষেত্রেই যে সত্যি তা নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়াতেও দেখা গেছে এই একই চিত্র। ঐ দুটি দেশেও প্রচুর সংখ্যক প্রথম প্রজন্মের চীনা ও দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী বাস করেন। তাদের ছেলে-মেয়েরাও কানাডার অভিবাসী ছেলে-মেয়েদের মত লেখাপড়া ও চাকরির ক্ষেত্রে মেইনস্ট্রিমের অনেক ছেলে-মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে আছে। টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি জি রিটজ এর নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় এই তথ্যই উঠে এসেছে। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, উল্লিখিত তিনটি দেশেই এশিয়ান ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা ক্ষেত্রে মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে আছে। অর্থনৈতিক সাফল্যের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ঐ তিনটি দেশে এশিয়ান ছেলে-মেয়েরা মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে আছে।
তাদের গবেষণায় আরো দেখা যায় চাইনিজ ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠীর তুলনায় চাইনিজ ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার হার ১৫% বেশি। কানাডায় এই হার ২০% এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১৭%।
কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াতে মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠীর তুলনায় অন্যান্য এথনিক গ্রুপের ছেলে-মেয়েরা বেশী মাত্রায় ম্যানেজারিয়াল ও প্রফেশনাল জব দখল করে আছে। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে চাইনিজ ও দক্ষিণ এশীয় ছেলে-মেয়েরা বেশী এগিয়ে থাকায় তাদের পেশাগত সাফল্যও বেশি। আবার ঐ তিনটি দেশে যে সকল চাইনিজ ও দক্ষিণ এশীয় ছেলে-মেয়েরা ম্যানেজারিয়াল ও প্রফেশনাল জব করছে তাদের সংখ্যা সমবয়সি মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশী।
পরিশেষে বলা যায়, অভিবাসী ছেলে-মেয়েরা কানাডায় সাফল্যের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও সত্যি যে তারা শুরু থেকেই পুষ্প বিছানো পথে হাঁটেনি। চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া, ঘরে ও বাইরে দুই সংস্কৃতির মোকাবেলা করাসহ আরো কিছু বাধা তাদেরকে অতিক্রম করতে হয়েছে। আর এই সব বাধা অতিক্রম করে তারা আজ সফল প্রজন্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্বপ্ন পূরণ করছে বাবা-মায়ের। পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ