‘একজন আন্তর্জাতিক ছাত্র হিসাবে আমি ভালো, মন্দ ও কুৎসিত সবই দেখেছি’
উইসেম আবদ্ আল হামিদ মোহাম্মেদ ॥
আন্তর্জাতিক ছাত্রদের অধিকারের পক্ষে আমি যখন কথা বলি তখন প্রায়শই এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করি। সেটি হলো, “কেন আন্তর্জাতিক ছাত্রদের ব্যাপারে কানাডার মনোযোগী হওয়া উচিৎ?”
আমি ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একজন আন্তর্জাতিক ছাত্র। এ ছাড়াও আমি কানাডীয় ছাত্র ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক ছাত্র বিষয়ক প্রতিনিধি। কানাডায় আসার আগে আমার ধারণা ছিলো, এখানে ছাত্র-জীবনের যথাযথ অভিজ্ঞতা পাবো। কিন্তু এখানে আসার পর সাহায্য-সহযোগিতা এবং এ সম্পর্কিত অবকাঠামোর অভাবে আমার সংগ্রামী জীবন শুরু হতে খুব বেশি দেরি হয়নি। নানা পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করার কারণে একজন আন্তর্জাতিক ছাত্রের জীবনে ঘটতে পারে এমন সব ভালো, মন্দ এবং কুৎসিত বিষয়ই আমি দেখেছি।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা সংগ্রাম করেই টিকে থাকে
আমি যখন আমার কানাডীয় বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করি, “তুমি কি কখনও ভাবো, তোমার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ কি না?” তাদের উত্তর সব সময়ই একটিই, “নাÑ আমার যখন দরকার তখনই ডাক্তারের কাছে যাই।”
কিন্তু একজন আন্তর্জাতিক ছাত্র হিসাবে আমাকে ডাক্তারের কাছে যাবার আগে দুবার ভাবতে হয়। আমাকে নিজের সাধ্য বিবেচনা করে কোন চিকিৎসা গ্রহণ করবো সেটি নির্ধারণ করতে হয়। কারণ আমাদের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীকেই আগে চিকিৎসকের ফি পরিশোধ করতে হয়, পরে সেই অর্থ পাবার আশা করে থাকতে হয়। যে দেশে সর্বজনীন চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা আছে সেই দেশে কাউকে তার সাধ্যের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পাওয়ার মত পরিস্থিতিতে ফেলা অনৈতিক।
এ দেশে সব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকেই এদেশের একজন বাসিন্দার মতই বিবেচনা করা হয় এবং ট্যাক্স আদায় করা হয়। কিন্তু ১০টি প্রদেশের মধ্যে মাত্র পাঁচটি প্রদেশে তাদেরকে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। কোনও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী প্রাদেশিক সরকারের স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনার আওতাভুক্ত না হলে তার জন্য অবশ্যই স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা দেওয়া হয়। আমাদের কল্যাণ ও স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে কানাডীয়দের গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। আমরা কানাডার জন্য নিছক আয়ের উৎস নই, আমরা মানুষও।
কানাডার মাধ্যমিক-উত্তর ইন্সটিটিউটগুলো এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সমস্যাটি বড় আকার ধারণ করেছে। দেশটির অভিবাসন, শরণার্থী
ও সিটিজেনশিপ বিভাগের (ওজঈঈ) তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে কানাডায় লেখাপড়ার অনুমতি পেয়েছে পাঁচ লাখ ৭২ হাজার ৪১৫ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী যা ২০১৭ সালের চেয়ে ১৬.২৫ শতাংশ বেশি। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা অসমানুপাতিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মচারীর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অভিবাসন, আবাসন, চাকরির বাজার এবং ম্বাস্থ্য সেবা পাবার ক্ষেত্রে সহায়তা করার মত আরও বেশি কর্মচারী দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ন্ত্রিতভাবে টিউশন ফি বাড়ানোও আরেকটি ধকল যা আমাদের মোকাবেলা করতে হয়। টিউশন ফি নির্ধারণের ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতেই ন্যস্ত। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যমতে, মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর টিউশন ফি গড়ে ১৭,৭৪৪ ডলার যা কানাডীয় শিক্ষার্থীদের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপিউটার সায়েন্সে পড়ার জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর টিউশন ফি বিপুল পরিমাণে অর্থাৎ ৬২% ভাগ বাড়ানো হয়েছে। যে ফি ছিল বার্ষিক ১৫,৮২৩ ডলার সেটি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫,৬৫৩ ডলারে।
এ তো শুধু মাথা গণা নয়, এ হচ্ছে জীবন
কানাডীয়দের মত অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীও নিজ দেশের শিক্ষা ঋণ গ্রহণ করি বা পরিবারের অর্থনৈতিক সহায়তার ওপর নির্ভর করি। টিউশন ফি বেশি বাড়ানো হলে তা আমাদের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে এবং আমাদের টিউশন ফি দিতে হিমশিম খাওয়া পরিবারের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।
গত ফেব্রুয়ারিতে কানাডীয় ছাত্র ফেডারেশনের লবিং সপ্তাহে আমি জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করি। আমরা “আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যায্যতার নীতি” গ্রহণের দাবি জানাই। এতে টিউশন ফি সুনির্দিষ্ট করা, এদেশে লেখাপড়ার বৈধ অনুমতি পাওয়া শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা এবং মাধ্যমিক-উত্তর ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি কানাডীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বেশিরভাগ কানাডীয় আইনপ্রণেতা সুপারিশগুলো সমর্থন করেননি।
কানাডা সরকারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের সফরকারী সদস্যরা ২০১৮ সালে কানাডার অর্থনীতিতে ২,১৬০ কোটি ডলারের অবদান রেখেছে। আমাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মত আচরণ করা উচিৎ না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ট গর্ব করে কিন্তু আমাদেরকে নিছক পরিসংখ্যান হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা, টিউশন ফি, আবাসনের ভাড়া, স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বাড়ানোর মত বিষয়গুলি আমাদের জীবনযাত্রাকে সরাসরি প্রভাবিত করে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয় সেগুলোর ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কানাডীয়রা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করবেন না। আমি উদ্বিগ্ন যে, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও সহায়তা ছাড়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা এমনভাবে বাড়তে থাকবে যেন উপচে পড়া গ্লাসে অবিরত পানি ঢালা হচ্ছে। আমাদেরকে মেঝেতে ফেলে দেয়া হচ্ছে।
(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.কম এ ২০২০ সালে। মিশর থেকে আসা উইসাম আবদ্ আল হামিদ মোহাম্মদ তখন ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল বিজ্ঞানে ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টস সোসাইটির ভাইস-প্রেসিডেন্টও ছিলেন তিনি তখন। )