আকাশের ঠিকানায়
পত্রোপন্যাস
ফারহানা পল্লব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৪-সৌম্যর চিঠি- মার্চ ২৮, ২২
সেই যে তুমি চলে গেলে। আর তো কোথাও মন বসে না। সারাদিন ফোনের আশেপাশে ঘুরি। যদি তোমার ফোন আসে আর অন্য কেউ ধরে ফেলে, তুমি তো আমাকে চাইতে পারবেনা। পাছে তোমার বহু প্রতীক্ষার ফোনকল মিস করে ফেলি। তারপর একদিন ক্রিং ক্রিং কলে তোমার হালকা কণ্ঠস্বর ভেসে এল- ‘হ্যালো’। যেন স্বর্গ থেকে এক অপ্সরী আমাকে কোথায় ভাসিয়ে নিল। আমিও থতমত, কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বললাম- কেমন আছো? চট্টগ্রাম যাবার পথে অসুবিধে হয়নি তো?
তুমি আবার আস্তে করে বললে -ভাল আছি, না অসুবিধে হয়নি। তারপর আবার কথা শেষ।
একটু হালকা অনুযোগের সুরে বললাম ‘এতদিন লাগলো ফোন করতে?’
তুমি বললে- ‘হুম। সুযোগ পাইনি, এসেই কলেজে ভর্তির দৌড়াদৌড়ি। তারপর মা বাবার ঘরে ফোন তো, খালি পাওয়া মুশকিল।’
তারপর একটু সহজে কিছু নিত্যদিনের কথা বার্তা। আমাকেই কথা চালাতে হল, তুমি ছিলে চুপচাপ শুধুই হু আর হা-তে। মনে হচ্ছিলো হালকা হাওয়ায় শ্বেত শুভ্র কিছু পালক উড়ে যাচ্ছে। আমার মনটা হালকা হয়ে উড়ে যাচ্ছিলো সে পালকের সাথে।
তারপর আমি কল করতাম দু একদিন পরপর। তুমি বলেছিলে তোমাদের বাসার সবাই যখন মন দিয়ে ভিসিআর দেখে, তুমি পড়াশুনা কর তোমার ঘরে। সে সময়ে আমি কল করি, তুমি পড়ায় ফাঁকি দিয়ে বাবা মায়ের অন্ধকার ঘরে বসে কথা বল। তখন তো শুধু বাসার ল্যান্ড ফোন তাতে আবার তালা লাগানো থাকতো বেশির ভাগ সময়ে। আমি তালা খুলে সময়মতো সন্ধ্যায় কল করতাম। আর তুমি একটু আগেই তোমাদের ফোনের রিঙার অফ করে রাখতে। সুতরাং আমার ফোনের ক্রিং ক্রিং তোমাদের বাসার কেউ শুনতে পেত না। সে সব মাসে আমাদের বাসার ফোন বিল আসতো আকাশচুম্বী। আমার আম্মা সব সামলাতেন।
এত গোপন লুকোচুরি করে যে কল করতাম, বেশির ভাগ সময় তোমার নি:শ্বাস ই শুনতাম। কথা বলতে ফিশফিশ করে। সেই সামান্য কথা বা ফিশফিশে আমার বুকের মাঝে কেমন লাগতো আজও মনে পরে। সারা পৃথিবী ভুলে গিয়েছিলাম। পড়াশুনায় মন নেই। খাওয়া দাওয়া, বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা কিছুতেই মন বসেনা। সারাদিন অপেক্ষা করি সন্ধ্যার জন্য একটা ফোন কল, একটু নি:শ্বাসের শব্দ, একটু বুকের দুরুদুরু, কি যে ভালোলাগায় মন ভরে থাকে। আবার কীরকম এক শূন্যতা। অপূর্ণতা, অপেক্ষা, আরেকবার দেখার। সামনে বসে কথা বলার। অন্ধকারে নিষ্পলক চেয়ে থাকার। এই সেই ভালবাসা যা অনেক খুঁজেও পায় না। আমার জীবনে এভাবে এসেছো তুমি যে আমি স্রষ্টার কাছে হাজার শুকরিয়া করি, তুমি যেভাবে আমার জীবনে এসেছো যেন সেভাবেই জীবনভর থাকো। আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম তোমাকে দেখার জন্য।
এর মাঝে তোমার ভাইয়ার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আমার সমবয়সি তোমার ভাই খুব ভাল মনের ছেলে আর আমাদের গল্প আর খেলাধুলার পছন্দ একরকম হওয়াতে বন্ধুত্ব হয়ে যায় জলদি। আমি কোন এক উপায় খুঁজছিলাম তোমার কাছে যাবার জন্য। ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে চট্টগ্রাম চলে আসি একদিন।
তুমি আমার সাহস দেখে হতবাক। আমি তোমাকে তোমাদের বাসায় এত কাছে থেকে দেখে আরো মুগ্ধ। তোমাদের পরিবারের সকলের সাথে পরিচয় হয়ে আরো ভাল লাগলো। তুমি শুধু ভয়ে অস্থির। কেউ বুঝতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি আমার সাথে কথা বলা দূরে থাক তাকাও না সবার সামনে। আমি তো মহাআনন্দে তোমার পরিবারে মিলে গিয়ে টিভি দেখি, একসাথে ডিনার করি। তোমার ভাইয়ের সাথে বাইরে ব্যাডমিন্টন বা টেবিল টেনিস খেলি। আর রাতে অপেক্ষা করি যদি কথা বলার সুযোগ পাই।
রাতে নয় তবে দিনের বেলা কোন এক সুযোগে তুমি কলেজে বের হওয়ার সময় আমাকে জানিয়ে গেলে বাইরে যেতে। তুমি তো সকাল সকাল কলেজে চলে গেলে। আমি তড়ি ঘড়ি বের হয়ে তোমার নাগাল পেলাম না। কতক্ষণ পর কলেজে গিয়ে হাজির হই। সেখানে তোমাকে পেয়ে গেলাম। তুমি ক্লাস শেষ করলে আমরা দুজনা রিক্সা করে বের হলাম। আমি যেহেতু চট্টগ্রাম শহর তেমন চিনি না। তুমি তোমার পছন্দের জায়গাগুলোতে নিয়ে গেলে আমায় দেখাতে। ওয়ার সেমিট্রি, কফি হাউজের ক্লাব সযান্ডউইচ খেয়ে নিয়ে গেলে প্রবর্তক সংঘ পাহাড়ে। সেখানের সামনেই লা সানির বার্গার খেয়ে বিকেলে দুজনে আলাদা বাসায় ফিরলাম।
কত কথা দুজনে, তখন তুমি তোতা পাখির মত সহজে নিজের, বান্ধবীদের কত মজার মজার গল্প বলে চললে। আমি তোমার মুখের পানে চেয়ে রইলাম অপলক। ঢাকায় পরিচয় হওয়া কিশোর উত্তীর্ণ মেয়েটা কেমন নব যৌবনের উল্লাসে অপরূপ হেসে খেলে বেড়ে উঠছে। যত দেখি মুগ্ধতায় ছেয়ে যাই। তোমার পরিবারের আদর শাসনের মধ্যেও কেমন আত্ম সচেতন এক মেয়ে নিজের আনন্দে কখনো গান গেয়ে, ছবি এঁকে, বন্ধু বান্ধবের আড্ডায় বা কলেজের ক্লাসে সকলের মন জয় করে বেড়ে উঠার উৎসবে মেতে উঠেছে। দেখে দেখে আমার আর মন ভরেনা।
অনু, একটা কথা সবসময় বলেছি- তোমাকে কেন্দ্র করে আমার জীবনটা ঘুরেছে। সবসময়, তুমি যখন ছিলে, তখন স্বপ্নের ঘোরে।
তোমাকে যখন হারিয়েছিলাম তখনো মনোজগতে এই তুমিই আমার কেন্দ্র ছিলে।
যেদিন আবার খুঁজে পেয়েছি আমার জীবন আবার স্বপ্নময় শুধুই তুমিময়।
৫- অনুরাধার চিঠি
এপ্রিল ৪,২০২২
প্রিয়,
এমন পাগলামি কখনো দেখিনি আগে। আসলে যদি জানতাম এভাবে ডাকাত হয়ে ফিরবে আমার ঘুম কেড়ে নিতে তাহলে হয়তো ৩২ বছর ভরেই চিঠিগুলো লিখে রাখতাম। দেখা হলে দিয়ে দিতাম তোমায়। তুমি পড়তে পড়তে ভাসতে ভাসতে আরো কত বছর পেরিয়ে যাবে।
শুধু ঘুম বলছি কেন, সারাদিন রাত কোন কাজই করা হয় না। তোমার নিজেরওতো কাজে মন নেই, ঘর সংসার, কাজ কর্ম সব শিকেয় উঠলো।
চল তবে সেদিনে-
তুমি ফোনে কথা বলতে বলতে অস্থির হয়ে উঠছিলে দেখা করার জন্য। আমি তো ভেবেই পাইনা সেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম কি করে দেখা হবে? তখন ভাইয়া থাকতো ঢাকায়। তুমি বুদ্ধি করে ভাইয়ার সাথে বন্ধুত্ব জমিয়ে নিয়েছিলে। একদিন সত্যি তার সাথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে হাজির। কি কাণ্ড বলতো, আমি তো এখনো ভেবে পাই না এত সাহস তোমার! তুমি দিব্যি হাসতে হাসতে আমাদের বাসার সবার সাথে মিশে গেলে। শুধু সুযোগ পেলেই গ্রিল বারান্দায় যেখানে মায়ের সাজানো বাগানে আমাকে একা পেলেই কথা বলতে চাও। আমি সবার সামনে সহজ থাকলেও একা কথা বলতে ভয়ে হিম হয়ে যাই। সবাই বাসায়। ডাইনিং স্পেসে আসা যাওয়া, কীভাবে কথা বলি? ভেবে বের করলাম তোমাকে আমার শহরটা দেখাই। একদিন জানিয়ে রাখলাম কলেজে আসতে। তুমিও ক্লাস শেষে হাজির। আমরা দুজন একটু অপরিচিত অলি গলি দিয়ে হেঁটে একটা রিক্সা নিয়ে নিলাম। সে আরেক ভয়, ছোট শহর, সবাই ভাইয়াকে চেনে, কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হবে।
আমার সব প্রিয় আড্ডা আর সুন্দর জায়গাগুলো ঘুরে ফিরে গিয়েছিলাম প্রবর্তক সংঘের পাহাড়ে। যে বটবৃক্ষের পাটাতনে দিনের পর দিন একা কাটিয়েছি, যে মন্দিরের বারান্দায় মন খারাপের দিন কাটিয়েছি, যে সিঁড়িগুলো স্বর্গে উঠে গিয়েছিল সেগুলো আমরা একসাথে পেরুলাম। এত সুন্দর পছন্দের জায়গাটা সেদিন স্বর্গীয় আনন্দে ছেয়ে গিয়েছিল। আমি প্রজাপতির মত ওড়না উড়িয়ে ছুটে বেড়িয়েছিলাম বটতলা থেকে মন্দির আর মন্দির থেকে স্বর্গ সিঁড়ি। আমরা দৌড়াদৌড়ি করে পরে সিঁড়িতে বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম। কি সেই মজার মজার গল্প। আমার সব কল্প কাহিনী। তুমি শুনছিলে আর মিটিমিটি হাসছিলে। আমার সেদিনের স্বাচ্ছন্দ্য আর চঞ্চলতায় তুমি অবাক হয়ে নতুন এক রাধাকে আবিষ্কার করলে। প্রকৃতি পাহাড়, গাছপালা জঙ্গল ঝোপঝাড় আর আকাশ সেদিন মুখরিত হয়েছিল আমার মুক্তিতে। আমার সকল ভাল লাগা সেদিন ফল্গুধারায় উৎসরিত হল। এতদিনের দ্বিধান্বিত, মাথানত, আর নিশ্চুপ আমার বোধগুলো হঠাৎ বাঁধন ছেঁড়া উচ্ছলতায় তোমাকে আমাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিছুই না বলেও, শুধু আঙুল ছুঁয়ে আমি তোমার ভালোবাসায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম।
তুমি মুগ্ধ। তাকিয়ে শুধু। ঠোঁটের কোনে জয়ের হাসি। বিশ্বজয়ের আনন্দ তোমার চোখে। আমি লজ্জায় তাকাতে পারি না। তারপর থেকে কথা আমাদের আর ফুরাতো না। লুকিয়ে ল্যান্ড ফোনের সেই বিশেষ সোনালী তালা খোলা শিখে প্রতিদিন রাত কথা হত। তখন আমাদের সময় কাটতো দুজনার বাসার ফোনের আশেপাশে। কথা না হলেই মন খারাপ। কথা হলেই বৃষ্টি নামে। সব হিন্দি সিনেমা যেন আমাদের প্রেম কাহিনী। দুজনার পড়াশুনায় বারোটা বেজেছে সেদিকে কারো খেয়াল নেই। তারপরেও পরিবারের চাপে এইচ এস সি পরীক্ষায় খুব ভাল নম্বর সহ মানবিক বিভাগ থেকেই ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হয়ে গেলাম। আর ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিনের সফর দারুণ মজায় চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
তুমিও পড়াশুনায় ভাল ছিলে তাই ফাঁকি দিয়ে দিয়েও ভালোমতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাপগুলো পার করেছিলে।
তারপর বেশ কয়েকবার চট্টগ্রাম এসেছিলে। আমরা পাহাড়ে পাহাড়ে কখনো বন্ধুবান্ধব বা আমার চাচাতো ভাইদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। এক বিকেলে তোমার বন্ধু গেয়ে শুনালো- ঐ ঝিনুক ফোঁটা সাগর বেলায়।
আরেকদিন অনেক ভোরবেলা আমার চাচাতো ভাইকে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কর্ণফুলি নদীর মোহনা আর সাগরের শুরু যেখানে। অনেক বড় বড়ঢেউতে আমরা সমুদ্র স্নান করেছিলাম। পরে ভিজা কাপড় গায়ে শুঁকিয়েছে। কি যে বোকার মত সব কাণ্ড করতাম। যা মনে আসতো তাই করে ফেলতাম। আমার তোমার সব ছেলেমানুষি।
তারপর যখন ঢাকায় ফিরছিলে, সে যে কি কষ্ট। আমি ভোরবেলা শুয়ে শুয়ে গোপনে চোখের জলে একাকার। একটু পর দেখি তুমি ফিরে এসেছো। কারণ ট্রেন মিস করেছো। তারপর আবার বাসের টিকিট করলে, আবার মন খারাপ হতে না হতেই বান্দা হাজির। বাসও মিস করেছো। তারপর আবার বাসে করে রওনা করেছো ঢাকাতে। তখন তেমার পাগলামি দেখে আমি সব দুঃখ কষ্ট ভুলে হাসতে থাকলাম।
৬-সৌম্যের চিঠি।
রাধা,
ক’দিন ঠিকমতো কথা হয়নি। তুমি ব্যস্ত, না হয় আমি। আমরা দুজনেই প্রায় অবসরের মত জীবন যাপন করছি। কিন্তু তবুও সমাজ সংসার সামলে নিয়ে সবসময় কথা বলার সুযোগ হয়তো হয়না। তবে মনটা বেশী পাগল। অভিমানে ভরে উঠে। আমি রাগ করে থাকি। তোমার বাসায় কত রাত পর্যন্ত মেহমান। ওদের বলে দাও বাসায় যেতে, আমরা এখন প্রেম করবো। তুমি শুধু হাসো। আমার ব্যাকুলতায় তুমি গান শুনাও।
কিন্তু যখনি চেহারাটা দেখি। সব রাগ উড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এত মায়া আর প্রশান্তি যদি এক চেহারায় থাকে তাহলে অপলক চেয়ে থেকেই তো জীবন কাটানো যায়। বলো আর কখনো যাবে না আমাকে ফেলে? কেন যে আর খুঁজলাম না। কেন এত অভিমান নিয়ে সরে গিয়েছিলাম? ‘দিবসে যে ধন হারিয়েছি আমি পেয়েছি আঁধার রাতে।’
তোমাকে যেদিন হারিয়েছিলাম সে বিভীষিকাময় রাতটা এখনো আমাকে দু:স্বপ্নে তাড়া করে ফিরে। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর ছিল রবিবার। সেদিন অযোধ্যায় জড়ো হওয়া কয়েক লক্ষ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাড়ে চারশো বছরের বেশি সময় আগে স্থাপিত বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে। তাঁদের ঠেকাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহত হন কয়েক শ হিন্দুত্ববাদী কর্মী। ঘটনার প্রতিক্রিয়ার দেশটির কয়েকটি রাজ্যে তাৎক্ষণিকভাবে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশে ঐ ঘটনার প্রভাব তৈরি হয় পরদিন ৭ই ডিসেম্বর। এর পরের কয়েকটি দিন বেশ ঘটনা বহুল ছিল বাংলাদেশের জন্য।
৭ই ডিসেম্বর, ১৯৯২।
সেদিন ছিল সোমবার। আগের দিনই ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছে সেখানকার হিন্দুত্ববাদীরা। ঢাকার থেকে প্রকাশ হওয়া বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিকগুলোর সব কটির প্রধান শিরোনাম ছিল এ বিষয়টি নিয়েই। সেদিন বাংলাদেশের সব কয়টি রাজনৈতিক দল এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছিল। মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকেও বিষয়টির নিন্দা করা হয়।
কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুরে পৌঁছানোর আগেই ঢাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। বিভিন্ন জেলায়ও একই ধরনের বিক্ষোভ মিছিল হয় বিক্ষুব্ধ ইসলামী জনতার ব্যানারে।
দুপুরের মধ্যে সেই বিক্ষোভ পরিণত হয় সহিংসতায়। লাঠিসোঁটা নিয়ে হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর এমনকি মন্দিরে হামলা ও লুটপাট চালানো হয় এসব মিছিল থেকে।
ভারতীয় তথ্যকেন্দ্রের লাইব্রেরিতে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার বই রাস্তায় ফেলে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভকারীরা।
সেই সঙ্গে পল্টনে কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসে হামলা করে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বিকেলে হামলা হয় হিন্দু অধ্যুষিত শাখারীবাজর এলাকায়।
ক্রমে ঢাকার বাইরে থেকেও সংঘর্ষ ও হামলার খবর পাওয়া যায়। পরিস্থিতি এমন হয়, সরকার ঢাকার কিছু অংশে এবং চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলার কারফিউ ঘোষণা করে। টাঙ্গাইল ও জামালপুরসহ কয়েকটি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
সেদিন ঢাকাসহ দেশের অন্তত ২১ টি জেলায় বিক্ষুব্ধ ইসলামী জনতার ব্যানারে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মন্দিরে হামলা চালানো হয়।
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলেছিল সেই অবস্থা।
আমরা দুজন দুজনার মধ্যে এভাবে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে আমরা দুজনা দুই ধর্মের যে বিষয়টা কখনো মাথায় আসেনি এই ঘটনার আগ পর্যন্ত। তুমি অনুরাধা ভট্টাচার্য্য আর আমি সৌম্য চৌধুরী, দুজনে একসাথে ঈদ করেছি। তুমি রোজা রেখেছো আমার সাথে। আমি উপবাস করেছি তোমার সাথে। পূজা মণ্ডপে গিয়েছি, ঢাকের ছন্দে নাচ গান কি না করেছি। একটিবারও মনে আসেনি আমাদের ভিন্নধর্মের বিষয়টা আমাদের এক হবার পথে বাধা হতে পারে। অনেক উদার মন মানসিকতার আমাদের দুই পরিবারকে আমরা হয়তো বুঝাতে পারবো সময় এলে। এ বিশ্বাস আমাদের ছিল।
কিন্তু এ কি হল মাঝ পথে। বাবরী মসজিদ নিয়ে এসব আন্দোলন কারফিউ আর ধর্মীয় / রাজনৈতিক উত্তেজনায় হঠাৎ তোমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল। আমি আঁচ করতে পারছিলাম তোমরা খুব চাপের মধ্যে আছ। যদিও তুমি খুব বেশী কিছু খুলে বলতে না। কিন্তু তেমার বাবা মা, কাকা আর পরিবারের চাকরি, ব্যাবসা বাণিজ্য সর্বোপরি বাড়ন্ত বয়সের পুত্র কন্যাদের নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান আর নিরাপদ মনে করছিলেন না। এরকম আলাপ-আলোচনার মধ্যেই একদিন তোমাকে আর ফোনে পেলাম না। হন্যে হয়ে তোমার ঢাকার চাচাতো ভাইদের কাছে গেলাম, তারাও চিন্তিত ছিল। বললো অনেক গন্ডগোল চলছিল তোমাদের এলাকায়। মন্দিরে আর বাসা বাড়ি ব্যবসায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমি সব হরতাল আর কারফিউ উপেক্ষা করে গিয়েছিলাম তোমার খোঁজে। গিয়ে দেখি শুধু ছাই ভস্ম। অনেক লোকজন মারা গিয়েছে। তোমরা বেঁচে আছ কিনা বা কোথায় আছ কেউ বলতে পারলো না।
আমি পোড়া মনটাকে নিয়ে একা প্রবর্তক সংঘের পাহাড়ে গিয়ে বসে রইলাম। মনে হচ্ছিল আর বাঁচার কোন অর্থ হয়না। সেই দুর্গম শহর থেকে ছাই ভস্ম মনটা নিয়ে মৃত আমি যেন ফিরছিলাম ঢাকায় রাতের বাসে। পথে রোড এক্সিডেন্টে আমাদের বাস উল্টে গেল। আমি শেষ জ্ঞান হারানোর মুহূর্তটা ভাবলাম- অনু আমি আসছি, তুমি মন খারাপ করো না। খুব শগিগরি আমাদের দেখা হবে।
৭-অনুরাধার চিঠি- এপ্রিল ১২,২০২২
সৌম্য,
মন খারাপের পাহাড় জমছে
আচ্ছা আমি কি দিনে দিনে দু:ক্ষ কষ্টের অনুভূতিগুলো হারিয়ে ফেলছি?
কেন আমার কষ্ট লাগেনা?
ঘঁসন হয়ে গেছি মনে হয়।
তোমার জন্য খারাপ লাগে।
তোমাকে ফোনে না পেলে মন খারাপ হয়।
অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে থাকি।
একটাবার ভাবি না, যে তুমি তো আমার নও।
আমার বলে সবাই যাকে মনে করে সেও তো আমার নয়। আমার যারা ছিল তারাও তো আমার নেই। তাহলে হিসেবটা কি হল বলো? আমি সবসময়ই একা।
যেদিন আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। মনে হয় পূর্বজন্মে কোন সময়ে। বাবরী মসজিদ নিয়ে কি সব দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। এরকম সময়গুলোতে নিজেদের খুব অসহায় লাগতো। ধর্মীয় দাঙ্গাগুলোর সময়ে আমাদের পরিবার পরিজন কেমন মন খারাপ আর ভীতি নিয়ে দিন কাটাতেন। আজন্ম যে দেশ কে নিজের জেনেছি। যে মাটিতে পূর্ব পুরুষের সব ইতিহাস। যে দেশ মুক্ত করতে কাকা-রা যুদ্ধ করেছেন খালাত ভাইয়ের তাজা রক্তে যে মাটি অর্জন হল, হঠাৎ করে সে দেশ আর আমার রইলে না। কোথাকার কোন বাবরী মসজিদ ভাঙার দায়ে আমরা সপরিবারে দেশছাড়া হলাম।
কি যে কষ্টের সে সময়গুলো। আমাদের ভাই বোনদেরকে বুকে আগলে মা বাবা লুকিয়ে রাখতেন। চারদিকে দাউ দাউ আগুন। আমাদের তিনতলা বাসার পাশে কিছু কাঁচা বাড়ি ছিল। সেখানে দাউ দাউ আগুন দেখে আমরা যখন ভিত সন্ত্রস্ত। আগুন নিমেষে ছড়িয়ে পড়েছে পেছনের বিরাট গাড়ি সারানোর গ্যারেজে। সেখানে একেকটা ভাঙা গাড়ির বডি শপে আগুন দশগুণ বেড়ে গাড়িগুলো বিরাট আওয়াজে বিস্ফোরণ হতে থাকলে পেছনের বাড়িগুলেতেও আগুন ছড়িয়ে পরে। সে ছিল আবার বৃষ্টির রাত। ঝড় বাতাসে আগুন ছড়াচ্ছিল আরো দ্রুত। আমরা ফোন, কারেন্ট পানি সব বিচ্ছিন্ন হয়ে সেখান থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টায় ছিলাম।
তোমাকে অন্য প্রতিবেশীর বাসা থেকে কল করেছিলাম। ফোন ব্যস্ত ছিল একদিন। আরেকদিন অন্য কেউ ফোন ধরেছিল তাই আর যোগাযোগ করতে পারিনি। আব্বা আমাদের পাসপোর্ট কাহজপত্র সব দু একদিনের মধ্যেই ঠিক করে বেনাপোল দিয়ে বাই রোডে কয়েকদিন দীর্ঘ যাত্রা করে আমরা পশ্চিমবঙ্গে নানির বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিলাম। সে বিভীষিকার দিনগুলো আর ভাবতেও পারি না। আমাদের ঘর বাড়ি, ব্যাবসা, সহায় সম্পত্তি বন্ধু আত্মীয় সব ফেলে শূন্য হাতে নতুন জীবন শুরু করেছিলাম কোলকাতায়। তবে আজো বাংলাদেশকেই নিজের মনে করি। চট্টগ্রামের অলি গলি, ঘর বাড়ি সবই স্বপ্নে আসে।
কয়েক মাসের মানসিক, আর্থিক, সামাজিক বিপন্ন অবস্থা কাটিয়ে উঠে যখন একটু স্থির হয়েছি, তোমার খোঁজ করেছি, পাইনি। আমার চাচারা তখনো ঢাকায় থাকতেন কথা হত মাঝে মধ্যে। সবাই চিন্তায় ছিলেন আমাদের নিয়ে। প্রায় অনেকবার তোমার বাসায় কল করেছি, তুমি আর ফোন ধরতে না। পরে একদিন আমার অন্য চাচাতো ভাইকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম খুব খারাপ একটা বাস এক্সিডেন্ট করেছিলে। কোথায় কবে কীভাবে কিছুই সে বলতে পারেনি। তুমি বেঁচে আছো কিনা সেটাও বলতে পারেনি। সেদিন আমার মনে হয়েছিল সত্যি সব হারালাম। আমার কি যে শূন্যতা বুকের মধ্যে। তবু ঈশ্বরের কাছে সকল প্রার্থনায় চাইতাম তুমি বেঁচে থাকো। নিজেকে মনে হত তোমার জন্য অভিশাপ ছিলাম হয়তো। ভাবলাম আমার নয় নাইবা হলে, অন্য কোথাও বেঁচে থাকো, ভাল থাকো। মন কখনোই মানতে পারেনি তুমি নেই। (চলবে)
লেখক পরিচিতি
কানাডা প্রবাসী ফারহানা পল্লব একজন লেখক, সঙ্গীত শিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং গ্রাফিকস্ শিল্পী। বর্তমানে তিনি অন্টারিও বাঙ্গালী কালচারাল সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক।