অভিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে চায় কানাডা
উদ্দেশ্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসা ও আবাসন সংকট কমিয়ে আনা
প্রবাসী কণ্ঠ নিউজ ডেস্ক, অক্টোবর ২৫, ২০২৪ : কানাডার ফেডারেল সরকার অভিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে কমাতে চায়। আর এই কারণে নতুন অভিবাসন পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে সরকার। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছর পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট গ্রহণ করা হবে ৩৯৫,০০০ জন। ২০২৬ সালে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৮০,০০০ জনে এবং ২০২৭ সালে ৩৬৫,০০০ জনে। গত ২৪ অক্টোবর নতুন এই ঘোষণা দেয়া হয়।
উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ঘোষণা করা হয়েছিল ২০২৫ এবং ২০২৬ এই উভয় বছরেই পাঁচ লাখ করে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট গ্রহণ করা হবে কানাডায়। সেই সময়ের অভিবাসন মন্ত্রী সিন ফ্রেসার নতুন লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশ করে বলেছিলেন, কানাডার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য এই পদক্ষেপ জরুরি।
দি কানাডিয়ান প্রেস এর খবরে তখন বলা হয়েছিল, কানাডার শিল্পখাত গুরুতর শ্রমিক সঙ্কটে রয়েছে। সারা দেশে প্রায় ১০ লাখ চাকরির পদ শূন্য। মন্ত্রীর নতুন পরিকল্পনায় এমন অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছিল যারা তাদের কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরবর্তী তিন বছরে এদেশে আসবেন।
এই খবর প্রকাশ পেয়েছিল এমন একটা সময়ে যখন আদম শুমারির রিপোর্টে বলা হয়েছিল অভিবাসী ও পারমানেন্ট রেসিডেন্টের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ – যা সর্বকালের সর্বোচ্চ।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা জানিয়েছিল, ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আসা অভিবাসীরা গড় বয়সে কানাডার জনসংখ্যার চেয়ে তরুণতর এবং কানাডার শ্রমবাজারে অনেক চাকরির পদ পূরণের জন্য তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কানাডার বিজনেস কাউন্সিল (বিসিসি) কেন্দ্রীয় সরকারের ঐ ঘোষণাকে তখন স্বাগত জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, কানাডাজুড়ে চাকরিদাতারা শূন্যপদ পূরণের জন্য লড়াই করছে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিসিসি বলেছিল, তারা চায়, অর্থনৈতিক ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীর সংখ্যা যেন মোট অভিবাসীর অর্ধেকের চেয়ে কিছু বেশি থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় আবাসন সংকট এবং চিকিৎসা সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় লোক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয় ফেডারেল সরকার। আর সে কারণেই কানাডায় অভিবাসীদের সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বিবিসি নিউজ তাদের এক রিপোর্টে জানায়, সাম্প্রতিক মাসগুলোয়, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন যে তিনি কানাডায় অনুমোদন দেয়া অভিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে কমাতে চান। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ,অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক সেবা ঠিকমত পাওয়া যাচ্ছে না, জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছে এবং আবাসন বা থাকার জায়গার খরচ আকাশ ছুঁয়েছে।
সমালোচনার মুখে এবং জনপ্রিয়তায় তার অনুমোদনের রেটিং কমে যাওয়ায়, প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন যে তার সরকার ভুল করেছে এবং কানাডার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার “স্থিতিশীল” করতে হবে যাতে সরকারি অবকাঠামো স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে।
এছাড়া কানাডায় অস্থায়ী বসবাসের প্রোগ্রামগুলোয় কাটছাঁটের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অস্থায়ী বিদেশি কর্মী এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরাও এই কাটছাঁটের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
বিবিসি নিউজ জানায়, সরকারের নীতিতে এই পরিবর্তনকে “জনসংখ্যা বৃদ্ধি থামানোর” প্রয়াসে হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। যার আওতায় দেশটিতে অভিবাসনের অনুমোদনের হার অনেকটাই কমিয়ে আনা হবে। এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি থামানো যাবে।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, বিভিন্ন প্রভিন্সে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি এবং আবাসন শক্তিশালী করার জন্য এই সময়টা প্রয়োজন। তবে কানাডার অভিবাসন নীতিতে এমন পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে, জাস্টিন ট্রুডো একটি কথাই বলছেন। তা হল: “কানাডিয়ানরা তাদের অভিবাসন ব্যবস্থা নিয়ে গর্বিত”। তিনি আরো বলেন,“কানাডার অভিবাসন আমাদের অর্থনীতিকে বিশ্বের দরবারে ঈর্ষান্বিত স্থানে নিয়ে গিয়েছে। এভাবে আমরা শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পেরেছি।”
তবে ট্রুডো স্বীকার করেছেন যে তার সরকার, কোভিড-১৯ মহামারির পরে শ্রমের যে ঘাটতি দেখা গিয়েছিল তা মেটাতে রেকর্ড সংখ্যক অস্থায়ী বাসিন্দাদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। এ কারণে অভিবাসনে “ভারসাম্য রক্ষা করা যায়নি”। এ কারণে এখন কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থাকে “স্থিতিশীল” করা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি কানাডায় অভিবাসনকে ঘিরে জনসমর্থন কমে আসার পরপরই ট্রুডোর এই ঘোষণা আসে।
উল্লেখ্য যে, জাস্টিন ট্রুডোর সরকার যখন নতুন অভিবাসন লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতে
যাচ্ছিল, ঠিক তার দিনকয়েক আগে প্রকাশিত এক জাতীয় জরিপে দেখা গেছে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো কানাডায় নতুন অভিবাসীদের সংখ্যার প্রতি জনসমর্থন কমেছে।
ঐ জরিপে দেখা গেছে ১০ জনের মধ্যে প্রায় ছয়জন নাগরিক বিশ্বাস করেন যে কানাডা অনেক বেশি অভিবাসী গ্রহণ করছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রায় ২,০০০ লোকের উপর জরিপটি চালানো হয়। জরিপে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে দেখা যায়, এরকম বিশ্বাসীদের হার ২০২৩ তুলনায় ১৪ শতাংশ এবং ২০২২ সালের তুলনায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে।
দাতব্য সংস্থা সেঞ্চুরি ইনিশিয়েটিভের সহায়তায় গবেষণা গ্রুপ এনভাইরোনিক্স ইনস্টিটিউট এবং টরন্টো মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ডাইভারসিটি ইনস্টিটিউট কর্তৃক গত ১৭ অক্টোবর প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, “গত পঁচিশ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো স্পষ্টতই সংখ্যাগরিষ্ঠ কানাডিয়ান বলেছেন যে খুব বেশি অভিবাসী রয়েছে দেশটিতে।”
উল্লেখ্য যে, গত বছর ডিসেম্বরে প্রকাশিত এনভায়রনিক্স এর এক সমীক্ষায়ও দেখা গিয়েছিল, ৪৪ শতাংশ কানাডীয় মনে করেন, দেশে খুব বেশি অভিবাসন হচ্ছে। এটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উদ্বেগের প্রতিফলন। সিটিভি’র নিউজে ঐ সময় বলা হয়, আগের বছর অভিবাসনের প্রতি জনসমর্থনের যে প্রবণতা ছিল বর্তমান সমীক্ষার এই তথ্য তার বিপরীত মতের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি তুলে ধরে। অবশ্য, ৭৪% কানাডীয় এখনও মনে করেন অভিবাসন কানাডা ও তার অর্থনীতির জন্য ভালো। সমীক্ষায় এটাও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে যে, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় ছিল প্রধান উদ্বেগের বিষয়।
অর্থনৈতিক উদ্বেগ বেড়ে যাবার প্রতিফলন ঘটিয়ে আরও বেশি সংখ্যক, ৪৪% কানাডীয় এখন ভাবছেন যে, দেশে খুব বেশি অভিবাসীর আগমন ঘটছে কিনা।
সমীক্ষায় তখন বলা হয়, “প্রতি ১০ জনের মধ্যে চার জনেরও বেশি কানাডীয় এখন এই বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেন যে, ‘কানাডায় খুব বেশি অভিবাসন হচ্ছে।” এই বক্তব্যে জোরালো সমর্থন জানান ২৩% এবং অনেকটাই সমর্থন জানান ২১% কানাডীয়। এই সংখ্যাটা এক বছর আগের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি এবং তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক বছরের মধ্যে জনমতের বৃহত্তম পরিবর্তন।
এদের সংখ্যা এখনও অভিবাসনের পরিমাণ নিয়ে সন্তুষ্ট কানাডীয়দের চেয়ে কম। সন্তুষ্টদের সংখ্যা ৫১%। তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, “দেশে খুব বেশি অভিবাসন হচ্ছে কানাডীয়দের এমন কথা বলার সম্ভাবনা এক বছর আগের চেয়ে এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এতে নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে কয়েক দশকের পুরানো প্রবণতা। অভিবাসী হিসাবে কারা আসছে এবং তারা কোত্থেকে আসছে এমন প্রশ্নের চেয়ে এই প্রথমবারের মত অনেক বেশি সংখ্যক কানাডীয় প্রশ্ন তুলেছেন যে, দেশে কত অভিবাসী আসছে?”
“ফোকাস কানাডার সবশেষ গবেষণায় দেখা যায়, দেশে খুব বেশি সংখ্যক অভিবাসী গ্রহণ করা হচ্ছে এমন ধারণা পোষণকারী কানাডীয়র পরিমাণ যথেষ্ট বেড়েছে। এতে এক বছর আগের জনমতের নাটকীয় বৈপরীত্য ধরা পড়ে। তখন অভিবাসনের পক্ষে জনমত ছিল সব সময়ের চেয়ে বেশি এবং তা ছিল গত তিন দশকের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার স্বাক্ষর।”
গত বছর সেপ্টেম্বরে ন্যানোস-এর এক সমীক্ষায় প্রকাশ পায় যে, ৫৩% কানাডীয় চায় অভিবাসীর সংখ্যা কমানো হোক।
উল্লেখ্য যে, কানাডার জনসংখ্যা সম্প্রতি চার কোটিরও বেশি হয়ে গেছে। ২০২২ সালে দেশটি ১০ লাখের বেশি নতুন বাসিন্দাকে স্বাগত জানিয়েছে, এই বৃদ্ধির ৯৮% ভাগই ঘটে অভিবাসনের মাধ্যমে। ঐ সময় বলা হয়েছিল অভিবাসনের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন আগামী কয়েক বছরে অভিবাসনের পরিমাণ নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এবার তারই প্রতিফলন দেখা গেল নতুন অভিবাসন নীতিতে। গত ২৪ অক্টোবর কানাডার ইমিগ্রেশন মন্ত্রী মার্ক মিলার অভিবাসন কমানোর এই ঘোষণা দেন।
কানাডায় অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে রিফিউজির সংখ্যা বৃদ্ধিও একটি কারণ হিসাবে কাজ করছে। গ্লোবাল নিউজের এক খবরে বলা হয়, চলতি বছর পহেলা জানুয়ারি থেকে শুরু করে ৩১ আগস্টের মধ্যে কানাডায় মোট ১ লাখ ৮ হাজার ৩৫ জন ব্যক্তি রিফিউজি ক্লেইম করেছেন। এর মধ্যে ১২ হাজার ৯ শ ১৫ জন ক্লেমেন্ট ছিলেন স্টাডি পারমিটে এবং ১ হাজার ৩ শ ১০ জন স্টাডি পারমিট এক্সটেনশনে।
খবরে বলা হয় ২০১৮ সালে কানাডায় ১ হাজার ৫ শ ১৫ জন শিক্ষার্থী রিফিউজি ক্লেইম করেছিলেন। তার সাথে তুলনা করলে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের রিফিউজি ক্লেইমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০০ শতাংশ।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য কানাডার একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে আমাদেরকে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে এই সিস্টেমের কোন অপব্যবহার যাতে না হয়। সম্প্রতি জাতি সংঘের সদর দফতরে সফর কালে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
জাস্টিন ট্রুডো আরো বলেন, আমাদেরকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হবে কাদের সবচেয়ে বেশী সাহায্যের প্রয়োজন, কে একজন সত্যিকারের আশ্রয়প্রার্থী। সিস্টেম অ্যাবিউজ করে কেউ শর্টকাটে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি বা সিটিজেনশীপ পাওয়ার জন্য রিফিউজি ক্লেইম করলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।
উল্লেখ্য যে, কানাডার ইমিগ্রেশন মন্ত্রী মার্ক মিলার কদিন আগে গ্লোবাল নিউজের সাংবাদিক মার্সিডিস স্টিফেনসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডায় প্রবেশের পর এ দেশে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আশ্রয় দাবি করছে। এই প্রবণতাকে মন্ত্রী ‘উৎকণ্ঠাজন’ বলে অভিহিত করেছেন। মন্ত্রী আরো বলেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ স্টুডেন্ট ভিসার প্রোগ্রামটিকে ‘কানাডায় ব্যাকডোর এন্ট্রি’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। প্রায়শই এটি করা হচ্ছে তাদের টিউশন ফি কমানোর জন্য। এই পরিস্থিতিতে কানাডার বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজগুলোকে অবশ্যই তাদের স্ক্রিনিং এবং মনিটরিং প্র্যাকটিসকে উন্নত করতে হবে যাতে কেউ এই সিস্টেমের অপব্যবহার না করতে পারে।
তিনি জানান তার মন্ত্রণালয় এই সমস্যাটি নিয়ে স্টাডি করছে এবং স্টুডেন্ট ভিসা প্রোগ্রামটিতে আরো সংস্কারের বিষয়টি অন্বেষণ করা হচ্ছে।
ইমিগ্রেশন মন্ত্রী মার্ক মিলার আরো বলেন, রিফিউজি ক্লেইম করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা খুবই উদ্বেগজনক। তাত্ত্বিকভাবে, এই শিক্ষার্থীরা কানাডায় আসেন আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে যাতে তারা তাদের টিউশন ফি ও থাকা খাওয়ার খরচ চালাতে পারেন। তাদের টিউশন ফি কানাডিয়ান শিক্ষার্থীদের তুলনায় চারগুণ বেশি। আর দেখা গেছে আন্তর্জাতিক এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা রিফিউজি ক্লেইম করেন তারা তাদের প্রথম শিক্ষা বর্ষেই এই কাজটি করেন। এবং প্রায়শই এমন সব কারণ দেখিয়ে রিফিউজি ক্লেইম করেন যার তেমন কোন বৈধতা থাকে না। ক্লেইম করার অন্যতম একটা কারণ, তাদের টিউশন ফি কমিয়ে কানাডিয়ান শিক্ষার্থীদের সমমানের করা।
ইমিগ্রেশন, রিফিউজি এ্যান্ড সিটিজেনশীপ কানাডা’র একজন মুখপাত্র গ্লোবাল নিউজকে বলেন, কানাডার আইন অনুসারে কেউ এখানে রিফিউজি ক্লেইম করলে তার কেইস হিয়ারিং এর সুযোগ রয়েছে। এটি তার অধিকার। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কেউ ক্লেইম করলেই কানাডায় থাকার গ্যারান্টি পেয়ে যাবেন।
এদিকে অধিক অভিবাসনের কারণে কানাডায় আবাসন আরও ব্যয়বহুল হচ্ছে এমন কথাও প্রচারিত হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই। গত মার্চে দি কানাডিয়ান প্রেস এর এক খবরে বলা হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের আমলারা দুই বছর আগেই সরকারকে সতর্ক করেছিলেন যে, বড় ধরনের অভিবাসন সাধ্যের মধ্যে আবাসন ও অন্যান্য পরিষেবায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারের অভ্যন্তরীণ নথিপত্র থেকে এটি জানা গেছে।
সম্প্রতি কানাডিয়ান প্রেসের হাতে আসা ঐ নথিতে দেখা যায়, কানাডার অভিবাসন, উদ্বাস্তু ও নাগরিকত্ব দপ্তর তার ২০২৩-২০২৫ সময়কালের অভিবাসন লক্ষ্য নির্ধারণের আগে দেশের অর্থনীতি, আবাসন ও পরিষেবার ওপর অভিবাসনের কী প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে মূল্যায়ন করে।
তথ্য অধিকারের আওতায় অনুরোধ জানিয়ে পাওয়া নথি অনুযায়ী, দপ্তরটি অন্যান্যের মধ্যে ডেপুটি মিনিস্টারকে ২০২২ সালে সতর্ক করে যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গৃহায়ন সুবিধা নির্মাণ করা যাচ্ছে না।
একটি নথিতে লেখা হয়, “কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ সুলভ বাসযোগ্য বাড়ির সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।”
আবাসনের প্রাপ্যতা এখন লিবারেল সরকারের জন্য রাজনৈতিক বোঝায় পরিণত হয়েছে। এই বিষয়টিকে প্রচারণার ইস্যু বানিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি গত বছর বেশ গতি অর্জন করেছে, যদিও তারা নির্দিষ্ট করে অভিবাসনের বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এই চাপের ফলে লিবারেল সরকারকে তার গৃহায়ন নীতির বিষয়ে নতুন করে নজর দিতে হয় এবং তারা নতুন বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যমান সংকট নিরসনে উদ্যোগী হয়।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অস্থায়ী রেসিডেন্টগ্রহণ করার কারণেও কানাডার জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি অব্যাহতভাবে রেকর্ড করে চলেছে। অস্থায়ী রেসিডেন্ট আনা হচ্ছে বহুলাংশে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং অস্থায়ী ফরেন ওয়ার্কার কর্মসূচির মাধ্যমে।
ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ
ব্যাংক অব কানাডাও একই রকমের বিশ্লেষণ করেছে। ডেপুটি গভর্নর টনি গ্রাভেল ডিসেম্বরে এক বক্তৃতায় সতর্ক করেন যে, জনসংখ্যার জোরালো বৃদ্ধি বাড়ির দাম ও বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জনমত জরিপেও দেখা যাচ্ছে, অভিবাসনের কারণে পরিষেবা, আবাসন ও অবকাঠামোর ওপর যে চাপ পড়ছে তাতে কানাডীয়রা ক্রমবর্ধমান হারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে এবং তাতে উচ্চহারে অভিবাসনের প্রতি জনসমর্থন কমে যাচ্ছে।
ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক মিকাল স্কাটারুড, যিনি অভিবাসন নীতির ওপর জোর দেন, বলেছেন, মনে হয়, কেন্দ্রীয় সরকার অস্থায়ী অভিবাসী প্রবাহের ওপর “নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।”
এদিকে জনসংখ্যার ‘বিপুল বৃদ্ধি’ অন্টারিওর জরুরি বিভাগগুলোতেও বাড়তি চাপ ফেলছে।
গত মার্চে অন্টারিওর হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশন (ওএইচএ) সতর্ক করেছে যে, জনসংখ্যার “বিপুল বৃদ্ধি” প্রদেশের জরুরি বিভাগগুলির ওপর “স্থায়ী চাপ” আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্লোবাল নিউজের এক খবরে এ কথা জানানো হয়।
ওএইচএ বলেছে, “অন্টারিওর অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তনশীল জনসংখ্যার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অপেক্ষার সময় এবং হাসপাতালে অধিক সংখ্যক রোগীর অবস্থান সরাসরি সংশ্লিষ্ট। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধি এবং জরুরি বিভাগে উপস্থিত রোগীদের অস্থিরতার স্তর বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নানা ধরণের স্বাস্থ্যগত জটিলতাসম্পন্ন বয়স্ক জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান সংখ্যা স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বড়িয়েছে।
কর্মচারী স্বল্পতা, অতিরিক্ত রোগীর ভিড় এবং ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবসহ নানা কারণে সারা দেশের জরুরি বিভাগগুলিতে সেবা পাবার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে থাকা রোগী উপচে পড়ছে।
এখন অপেক্ষার পালা এটি দেখার জন্য যে, নতুন ইমিগ্রেশন পলিসি আবাসন সংকট এবং স্বাস্থ্যসেবা সংকটসহ অন্যান্য সেবামূলক কার্যক্রম পরিস্থিতি উন্নয়নে কতটা কাজে আসে। সরকারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ইমিগ্রেশন পলিসি গ্রহণ করার ফলে আগামী দুই বছরে জনসংখ্যা ০.২ শতাংশ হ্রাস পাবে। এ কারণে আগামী কয়েক বছরে “আবাসন সরবরাহের ব্যবধান প্রায় ৬৭০,০০০ ইউনিট হ্রাস করবে”। “এর অর্থ অতিরিক্ত ৬৭০,০০০ আবাসন ইউনিট তৈরি করতে হবে না”।
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছর নতুন স্থায়ী বাসিন্দাদের ৪০ শতাংশের বেশি কানাডায় বসবাসরত অস্থায়ী বাসিন্দাদের পুল থেকে নেওয়া হবে। ইমিগ্রেশন মন্ত্রী মিলার বলেন, “এই মানুষগুলো তরুণ এবং দক্ষ। এবং এরা অলরেডি কানাডায় বাস করছে অস্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে। এদের কারণে আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক পরিষেবাগুলিতে অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি করবে না। পরিকল্পনায় আরও দক্ষ কর্মী আনার উপরও জোর দেওয়া হয়েছে।” অভিবাসন বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বৃদ্ধি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, মিলার বলেন, সামাজিক চ্যালেঞ্জের জন্য অভিবাসনকে দায়ী করা সহজ কিন্তু “এর কোন মানে হয় না।” তিনি আরো বলেন, “সবকিছুর জন্য অভিবাসীদের দোষ দেওয়া সহজ। তবে এটাও অনস্বীকার্য যে অভিবাসনের পরিমাণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু সেখানে কিছু সূক্ষ্ম তারতম্য আছে। আর আপনি বলতে পারেন না যে সমাজের সমস্ত ক্ষতিকর বা দুর্ভাগ্যজনক বিষয়গুলো ইমিগ্রেশনের কারণে হয়। এরও কোন মানে হয় না।”