জীবনের বহু রং

সাইদুল হোসেন

আদিকালে ইউরোপের একটি ছাপাখানা। ছবি : World History Encyclopedia

(বাইশ)

 লেখালেখি

এপ্রিল ৫, ২০২৪

অতি কঠিন কাজ। পরিশ্রমের কাজ। সময়সাপেক্ষ কাজ। চাই মেধাও। সুদূর অতীতে মানুষ পাথরে খোদাই করে লিখতো। পরবর্তী প্রায় দু’হাজার বছর আগে চাইনীজরা সর্বপ্রথম কাগজ তৈরী করে, অতঃপর কাগজে লেখার প্রচলন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সব বইই হাতে লেখা হতো। ১৪৫০ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ইউরোপের জার্মেনীতে সর্বপ্রথম প্রিন্টিং মেশিনে বই মুদ্রণ বা ছাপানো শুরু হয়। Gutenberg নামক একজন পুস্তক প্রকাশক এই পদ্ধতিটির উদ্ভাবন করেন। বহু বই একই সংগে ছাপা এবং এর ফলে শিক্ষা বিস্তার দ্রুতগতি লাভ করলো। আবিষ্কৃত হলো Typewriter. হাতে লেখা সব বইপত্র type হতে লাগলো। সর্বশেষে এলো বিজ্ঞানের বিষ্ময় Computer. হাতে বইপত্র বা চিঠি লেখার যুগ শেষ। সবই এখন computer-এ। আজব দুনিয়া! অতীতে ধর্মগ্রন্থ Torah, Bible, Quran, বেদ, গীতা, ইত্যাদি লোকেরা হাতেই লিখতো।

লেখালেখি শিখাটা শৈশবকালে একটা অতি কঠিন কাজ ছিলো। শিখতেই হতো। আজো শিখতে হয় পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই। আমার নিজের কথা বলছি। আমি প্রাথমিকভাবে অ-আ-ক-খ, অ-ই-ঈ-উ লিখতে শিখেছি কলাপাতার উপর বাঁশের সরু কঞ্চিকাটা কলম দিয়ে।

বৃটিশ ইন্ডিয়ার বেংগল প্রোভিন্সের এক পাড়া গাঁয়ে আমার জন্ম আজ থেকে ৯১ বছর আগে- ১৯৩৩ সনে।

হাতে লেখার যুগে এবং তৎপরবর্তী Typewriter-এর যুগে, অবিশ্বাস্য হলেও, লেখকেরা শতশত বই লিখে পাবলিশ করে গেছেন। দু’জনের কথা এখানে বলছি।

(এক)

English novelist John Creasey (1908-1973).

তিনি স্বনামে এবং ছদ্মনামে মোট ৫৬৪টি বই লিখে প্রকাশ করে গিয়েছেন। কথিত আছে যে তিনি নানা ধরনের বই লিখতে গিয়ে ২৮টি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। John Creasey প্রধানতঃ crime and detection ধরনের বই লিখতেন। কোন কোন সূত্র তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬০০’রও অধিক বলে উল্লে­খ করে থাকে।

(দুই)

Russian-born American science fiction writer Isaac Asimov (1920-1992).

তিনি ৩৫৭টি original এবং ১৪৭টি edited book পাবলিশ করে গিয়েছেন। তাঁর লেখা ৯০,০০০ letters and post cards-এরও সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ইংরেজী ভাষায় ROBOTICS শব্দটির সৃষ্টিকর্তা।

অন্যদিকে ROBOT শব্দটির সৃষ্টিকর্তা (১৯২০/১৯২১) ছিলেন Czech science fiction writer (playwright) Karel Capek and his brother Josef Capek. Robot means a fictional humanoid which could carryout tasks unpleasant for people (humans). Nowadays, Robots are no more fictional. Science has made them real, they are made and put to work in almost any field of work done by the humans. প্রসংগত উল্লে­খ করা যেতে পারে যে বিখ্যাত বাংলাদেশী লেখক ও নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদের লিখিত ও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২০০-এর অধিক। (Google search)

(তেইশ)

নবী হজরত মুসার কাহিনী

(Egyptian Version)

এপ্রিল ৬, ২০২৪

নবী হজরত মুসা ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্যু আনুমানিক ১৩ঃয পবহঃঁৎু ইঈঊ-তে ফেরাউনের নীল নদে সৈন্যদলসহ ডুবে মরার কয়েক বছর পর।

তিনি মিশরে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শিশু অবস্থায় তাঁকে তাঁর মা দ্বারা ছোট একটা বাক্সতে (ধ নড়ী, ধ পযবংঃ) ভরে নীল নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, সেই বাক্সটা ফেরাউনের কন্যা কর্তৃক নদী থেকে উদ্ধার করা, এবং সেই শিশুকে রাজপ্রাসাদে তাঁর যৌবনকাল পর্যন্ত রাজকীয় আদরে লালনপালন করার কাহিনীটা সারা পৃথিবীর  মানুষের কাছেই পরিচিত ইরনষব (ঙষফ ঞবংঃধসবহঃ- ঞঙজঅঐ, ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ), ইরনষব (ঘবি ঞবংঃধসবহঃ- খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ) এবং ছঁৎ’ধহ (মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ) পাঠের মাধ্যমে।

ওহফরধহ ঠবৎংরড়হ-১ (কর্ণ)

কিন্তু আমি বিষ্মিত হলাম জেনে যে এই কাহিনীটা হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ মহাভারতেও বর্ণিত আছে। স্থান প্রাচীন ভারত (ওহফরধ), চরিত্রগুলোও ভারতীয়। সময়কাল আনুমানিক ১৩০০ খৃষ্টপূর্ব (ইঈঊ) যা নবী মুসার জন্মকালের সংগে হুবহু মিলে যায়, এবং মিলে যায় কাহিনীর অন্যান্য বর্ণনাও।

মহাভারতে বর্ণিত কাহিনীটা এরকম (সূত্র ঃ সুবলচন্দ্র মিত্র সংকলিত সরল বাঙ্গাঁলা অভিধান, কলকাতা (ইন্ডিয়া) থেকে নিউ বেঙ্গঁল প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯০৬ সন ১লা সেপ্টেম্বর। তৃতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারী ১৯১২) পৃষ্টা ১১৫৬ ঃ হেডিং ঃ “রাধা”।

“অধিরথ নামক সূত্রধর জাতীয় সারথির ভার্যা এবং কর্ণের পালিকা মাতা রাধা একদা পতিসহ নদীতে স্নান করিবার সময় দেখিতে পান যে, একটি মঞ্জুষা ভাসিয়া যাইতেছে। ইহার অনুরোধে অধিরথ তাহা ধরিয়া আনিলে ইনি তন্মধ্যে একটি সদ্যঃপ্রসূত শিশু দেখিতে পান। অতঃপর রাধা শিশুটিকে লইয়া যাইয়া অতি যত্নে লালনপালন করেন। এই শিশুটি উত্তরকালে মহাবীর কর্ণ নামে প্রসিদ্ধ হন।”

টীকা ঃ              ১) মঞ্জুষা অর্থ পেটিকা, সিন্দুক, পযবংঃ, নধংশবঃ. কুরআনের ভাষায় “তাবুত”।

২)          মহাবীর কর্ণ হিন্দুদের বিখ্যাত মহাভারত মহাকাব্যের নানা অস্ত্রে পারদর্শী প্রসিদ্ধ সেনাপতি ছিলেন যিনি কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কর্ণ ছিলেন পান্ডুপত্নী ও পান্ডবজননী কুন্তীর কুমারী অবস্থায় সূর্যের ঔরসে জাত অবৈধ সন্তান। লোকলজ্জার ভয়ে কুন্তী তার সেই শিশুপুত্রকে একটি সিন্দুকে ভরে দাসীর সাহায্যে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন যাকে অধিরথ সূত্রধর উদ্ধার করেছিলো। [অভিধানের পৃষ্ঠা ৩৪৪-৩৪৫ দ্রষ্টব্য।]

অবাক হওয়ার কারণটা হলো যে আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তিন হাজার মাইল ব্যবধানের দু’টি দেশে, ভারত ও ঈজিপ্টে, একই ঘটনার হুবহু পুনরাবৃত্তি কেমন করে সম্ভব হলো?

সেই বাংলা অভিধানটার ৪৪৩ পৃষ্ঠা থেকে অনুরূপ আরো একটি কাহিনী শোনাচ্ছি যা শোনার পর পাঠকও হতবাক না হয়ে পারবেন না। কাহিনীটা এরকম-

ওহফরধহ ঠবৎংরড়হ-২ (মিহির)

খনা। এক প্রাচীন হিন্দু বিদুষী রমণী।

এই মহিলা (খনা) বাংলাদেশের এবং পশ্চিম বংগের (ইন্ডিয়া) সর্বত্র সুপরিচিত তাঁর “খনার বচন”- এর মাধ্যমে বহু শত বছর ধরেই।

প্রবাদ এইরূপ যে, “খনা সিংহল দ্বীপে (বর্তমান শ্রীলংকা) জন্মগ্রহণ করেন। তথায় মিহিরের সহিত ইহার বিবাহ হয়। মিহিরের পিতা বরাহ ভারতবাসী এবং জ্যোতিঃশাস্ত্রীয় গণনায় সুপন্ডিত ছিলেন। মিহিরের জন্ম হইলে তিনি গণনা করিয়া দেখিলেন যে মিহিরের এক বৎসর মাত্র পরমায়ুঃ। পুত্রের অকালমৃত্যু দর্শন পরিহার করিবার অভিপ্রায়ে বরাহ তাঁর শিশু পুত্র মিহিরকে একটি পাত্রের মধ্যে রাখিয়া সমুদ্রের জলে ভাসাইয়া দিলেন। দৈবক্রমে পাত্রটি সিংহলের তীরে উপস্থিত হইল। অতঃপর সেই শিশু সিংহল রাজ সমীপে নীত হইল। রাজা শিশুটিকে পরমসুন্দর ও সুলক্ষণাক্রান্ত দেখিয়া পুত্রের ন্যায় প্রতিপালন করিতে লাগিলেন।”

“কিছুদিন পরে সিংহল রাজের এক কন্যা হয়। শুভক্ষণে ঐ কন্যার জন্ম হয় বলিয়া রাজা উহার নাম ক্ষণা বা খনা রাখেন। রাজার যত্নে খনা ও মিহির উভয়েই নানা শাস্ত্রে বিশেষতঃ জ্যোতির্বিদ্যায় অসাধারণ জ্ঞান লাভ করেন। অতঃপর খনার সহিত মিহিরের বিবাহ হয়।”

টীকা ঃ ১) কাহিনীটা আরো দীর্ঘ। আমি শুধু মিহিরের জন্ম, তাকে একটা পাত্রে রেখে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া ও তার পুনরুদ্ধারের অংশটুকুর বর্ণনা দিলাম সুদূর মিশরের নবী মুসার জন্ম ও সংশ্লি­ষ্ট কাহিনীটার সংগে হুবহু মিলের তুলনাটা তুলে ধরতে।

২)          প্রাচীন ভারতের এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন বিক্রমাদিত্য। তাঁর রাজসভায় নানা গুণে গুণান্বিত ও বহু বিদ্যায় পারদর্শী নয়জন পন্ডিত ছিলেন। সেজন্য তাঁদেরকে “নবরত্ন” উপাধি দেয়া হয়েছিল। সেই নবরত্নের এক রত্ন ছিলেন বরাহ। মিহির ছিলেন তাঁর পুত্র। এই মিহিরেরই স্ত্রী ছিলেন খনা।

৩)          নবরত্নের আর একজন ছিলেন কবি কালিদাস যাঁর রচিত মেঘদূত কাব্য (সংস্কৃত) অতি বিখ্যাত সাহিত্যকীর্তি।

৪)          সেই নবরত্নের নামগুলো ছিলো ঃ ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, অমরসিংহ, শংকু, বেতালভট্ট, ঘটকর্পর, কালিদাস, বরাহমিহির ও বররুচি।

(চব্বিশ)

বাংগালী মুসলিম

নারীপরুষের নামবিভ্রাট

এপ্রিল ৮, ২০২৪

(এক)

সেকেন্দার

আলেকজান্ডার একটা জগদ্বিখ্যাত নাম। জন্ম ৩৫৬ খৃষ্টপূর্ব। তিনি ছিলেন প্রাচীন গ্রীসের অন্তর্গত মেসিডনিয়া (গধপবফড়হরধ) রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর ২০ বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন (৩৩৬ খৃষ্টপূর্ব)। দু’বছর পর মাত্র ২২ বছর বয়সে ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি সমগ্র এশিয়া বিজয়ের মানসে অভিযানে বের হন। পথে বহু রাজ্য জয় করার পর তিনি বিরাট এবং শক্তিশালী রাজ্য পারস্য (চবৎংরধ) আক্রমণ করেন। পারস্যরাজ উধৎরঁং ওওও ঘোরতর যুদ্ধের পর পরাজিত হন (৩৩৩ খৃষ্টপূর্ব)। আলেকজান্ডারের মৃত্যুসন (৩২৩ খৃষ্টপূর্ব)।

পারস্য বিজয়ের পর আলেকজান্ডারকে পারসী ভাষায় নাম দেয়া হয় সেকেন্দার, বাদশাহ সেকেন্দার। অপর নাম ইস্কান্দার।

আলেকজান্ডার ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিম ছিলেন না, তথাপি মুসলিম সমাজে সেকেন্দার নামটা দেশেবিদেশে খুব পরিচিত এবং প্রিয় বহু শতাব্দী ধরেই।

অষবীধহফবৎ-এর ওঃধষরধহ াবৎংরড়হ হলো অষবংংধহফৎড়, এবং ঝঢ়ধহরংয াবৎংরড়হ হলো অষবলধহফৎড় (আলেহান্দ্রো)।

(দুই)

সোহরাব ও রুস্তম

৬৩৭ খৃষ্টাব্দে আরব মুসলিম বাহিনী কর্তৃক পরাজিত হওয়া পর্যন্ত পারসী (চবৎংরধহ) জনগণ ছিলো অগ্নিউপাসক (ঋরৎব ড়িৎংযরঢ়ঢ়বৎং), মুসলিম নয়। তা সত্বেও দু’টি পারসী নাম মুসলিম সমাজে বেশ জনপ্রিয়- সোহরাব এবং রুস্তম যারা ছিলো আগুনের পূজারী। এরা ছিলো পিতা (রুস্তম) ও পুত্র (সোহরাব), দুই বিখ্যাত বীরযোদ্ধা।

(তিন)

কায়সার

“কায়সার” নামটাও মুসলিম সমাজে বেশ জনপ্রিয় অথচ নামটা ইসলামভিত্তিক নয়। কথাটা আসলে “সীজার” যা মূলতঃ রোমান জেনারেল ঔঁষরঁং ঈধবংধৎ-এর নাম। ঈধবংধৎ-এর কায়সার উচ্চারণ এসেছে জার্মান ভাষার কধরংবৎ (কাইজার) থেকে। কধরংবৎ সবধহং ধহ ঊসঢ়বৎড়ৎ.

জঁংংরধহ ঊসঢ়বৎড়ৎ ঈুধৎ/ঞংধৎ কথাটারও মূল ঈধবংধৎ (জড়সধহ এবহবৎধষ ঔঁষরঁং ঈধবংধৎ-এর নাম থেকে। খধঃরহ ভাষা)।

 (চার)

অন্যান্য

ক)         রাবেয়া (শুদ্ধ উচ্চারণ রাবি’আ)। আরবী শব্দ রাবি’আ, অর্থ হলো চতুর্থ অথবা মাবাবার চতুর্থ কন্যাসন্তানটি। একটি মেয়ের নাম হওয়ার উপযুক্ত অর্থ বহন করে না রাবেয়া।

খ)          জিন্নত/জিন্নাত (আরবী) ঃ যাকে জীনে আসর করে বুদ্ধি লোপ করে দিয়েছে। নামটা হওয়া উচিৎ জীনাত (তববহধঃ) ঃ অলংকার, সৌন্দর্য।

গ)          সখিনা (ভুল)। হওয়া উচিৎ সাকীনাহ (আরবী)। ঝধশরহধয. অর্থ শান্তি, প্রশান্তি।

ঘ)          মজ্নু (ভুল)। মাজনু (আরবী মাজনূন)। অর্থ যাকে জীনে আসর করে পাগল করে দিয়েছে।

ঙ)          বিন্তে ফাতেমা- ফাতেমার কন্যা। এটা কোন নাম নয়।

চ)          কানিজ ফাতেমা- ফাতেমার দাসী/চাকরানী। এটা কোন নাম নয়।

ছ)          খুরশীদা/খুরশিদা- মূল কথাটা হলো খুরশীদ (ফার্সী ভাষা) যার অর্থ হলো সূর্য। নামের শেষে আকার যোগ করাটা অর্থহীন কারণ সূর্যের কোন স্ত্রীলিংগ নেই।

জ)         আম্বিয়া (আরবী শব্দ, যার অর্থ নবীগণ)। মানুষের নাম হওয়ার উপযুক্ত শব্দ নয়।

ঝ)         আরবাব (আরবী শব্দ, যার অর্থ রবগণ (বহু আল্ল­াহ)। কোন মানুষের নাম হওয়ার যোগ্য নয়।

ঞ) তোরাব আলী/তুরাব আলী- আরবী- “তুরাব” অর্থ হচ্ছে মাটি (ফঁংঃ). মাটি আলী? ঘড় ধিু!

(পঁচিশ)

ছাত্রজীবনে আমার অংকভীতি

এপ্রিল ১০, ২০২৪

(এক)

গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে

আমাদের স্কুলটা ছিলো আমাদেরই গ্রামে। আমাদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে। ক্লাস শুরুর ঘন্টাটা স্কুলের দফ্তরী টংটং করে বাজালেই মোটা সূতা দিয়ে বাঁধা বইগুলো হাতে নিয়ে স্কুলে রওয়ানা দিতাম। ১৯৩৯-১৯৪৫ সনের কথা- সেযুগে পরবর্তী যুগের মত স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার প্রচলন ছিলো না। আমার জন্ম ১৯৩৩ সনে। তাছাড়া সেটা ছিলো গ্রামদেশ।

স্কুলের ছাত্রদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম থেকে আসা ছাত্রদের সংখ্যাধিক্য ছিলো চোখে পড়ার মতো কারণ আমাদেরটা ছাড়া ঐ এলাকায় অন্য কোন প্রাইমারী স্কুল (ক্লাস সিক্স পর্যন্ত) ছিলো না।

অংকে আমি বরাবরই কাঁচা। খুব দুর্বল। অংকের বইটা ছিলো একটা অতিশয় ভীতিজনক বস্তু। ক্লাসে টিচার কোন অংক কষতে দিলেই ঘাবড়ে যেতাম, কান ভোঁভোঁ করতে থাকতো। অংক না পারার কারণে কত যে বেতের বাড়ি খেয়েছি টিচারের হাতে বছরের পর বছর ক্লাস সিক্স পর্যন্ত গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে তার কোন হিসাব নেই। দেহের ব্যথার সংগে মনের ব্যথাটাও যোগ দিতে হবে কারণ প্রতিদিন সেই বেতগুলো স্কুলের বাইরের জংগল থেকে আমাকেই গাছের ডাল কেটে/ভেংগে বানিয়ে আনতে হতো। তবে আমি একা নই। ক্লাসের টিচারদের দৈনিক ছাত্র পিটানোর জন্য বেতের সাপ্ল­াই দেয়াটা স্কুলজুড়ে ছাত্রদের একটা অলিখিত দায়িত্ব-কর্তব্য ছিলো সেই যুগে।

অংক না পারার কারণে বাড়িতে বাবার হাতেও চড়-থাপ্পড় খেয়েছি প্রচুর।

আজো স্পষ্ট মনে পড়ে যে বহিরাগত ছাত্রদের মাঝে (ক্লাস সিক্স, ১৯৪৫ সন) দু’জন সহপাঠি ছিলো দিনেশ এবং মনমোহন। অংকে অতি তুখোড়, কোন অংকই ওদের কাছে কঠিন ছিলো না- যাকে বলে “জলবৎ তরলং” অর্থাৎ পানির মত তরল (সহজ)। কোন কঠিন অংক ওদের কাছে বুঝতে চাইলে বেশ আগ্রহসহকারে সেটা বুঝিয়ে দিতো এবং শেষে জিজ্ঞাসা করতো, “বোধ ফাইসোনি বা?” অর্থাৎ বুঝতে পেরেছো কি? ওরা সিলেটি ভাষায় কথা বলতো।

(দুই)

শহরের হাই স্কুলে

গ্রামের স্কুলে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা সমাপ্ত করে নিকটবর্তী সাবডিভিশাল টাউন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে সেখানে মুসলিম ছাত্র সংখ্যাধিক্যের কলেজিয়েট হাই স্কুলের ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম (১৯৪৬-এর জানুয়ারী) তখন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ ১৯৩৯-১৯৪৫ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। বৃটিশ রাজ বিজয়ী হয়েছেন কিন্তু ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বৃটিশবিরোধী আন্দোলন প্রচন্ডবেগে এগিয়ে চলেছে। যার ফলে ১৯৪৭-এর ১৪ই আগষ্ট ইন্ডিয়াকে বিভক্ত করে ওহফরধ ধহফ চধশরংঃধহ এই দুই ধর্মভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বৃটিশ ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে গেল। ইন্ডিয়া হিন্দুদের জন্য এবং পাকিস্তান মুসলিমদের জন্য- এই নীতি গ্রহণ করেই ১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তিকরণটা (চধৎঃরঃরড়হ ড়ভ ওহফরধ) ঘটেছিলো।

এখানে এসে অতীতের একটি স্মৃতিকে পুনর্জাগরিত করতে চাই।

তৎকালীন বৃটিশ ইন্ডিয়ার আসাম ও বেংগল প্রোভিন্সের চা বাগানগুলোতে প্রচুর পরিমাণ উন্নতমানের চা উৎপাদিত হতো কিন্তু দেশবাসীরা চা খেতে অভ্যস্থ ছিলো না। তাই চায়ের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করতে বিলাতি চা উৎপাদনকারী কোম্পেনীগুলো, যেমন ঔধসবং ঋরহষধু, খরঢ়ঃড়হ, ইৎড়ড়শব ইড়হফ ইত্যাদি দেশের সর্বত্র শহরে-বন্দরে-গ্রামে চায়ের গুণকীর্তন করে বড়বড় সব সাইনবোর্ড রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুঁতে দিয়েছিলো। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া শহরেও ওগুলো ছিলো। একটার কথা আজো স্পষ্ট মনে পড়ে যেটাতে লেখা ছিল-

“চায়েতে নাহিক কোন মাদকতা দোষ,

কিন্তু তা পানে করে চিত্ত পরিতোষ।”

হাই স্কুলে তো ভর্তি হলাম কিন্তু অংকভীতি আমাকে আরো বেশী করে জড়িয়ে ধরলো কারণ আগে ছিলো শুধুই অংক (অৎরঃযসবঃরপ) কিন্তু এখন তার সংগে যোগ হলো  এবড়সবঃৎু ধহফ অষমবনৎধ! অষমবনৎধটা যেমন তেমন কিন্তু এবড়সবঃৎুটা কিছুতেই মাথায় ঢুকে না। পড়লাম অথৈ সাগরে অথবা বলা যায় অথৈ মহাসাগরে!

১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯, এই চারটি বছর ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেন-এর চৎবঃবংঃ পর্যন্ত কোন পরীক্ষাতেই আমি সরহরসঁস ৩০ সধৎশং পেয়ে গধঃযং ংঁনলবপঃটা পাস করতে সক্ষম হইনি। প্রতি বছর উপরের ক্লাসে প্রমোশন পেয়েছি ংবপড়হফ পড়হংরফবৎধঃরড়হএ (ভধরষবফ রহ ড়হব ংঁনলবপঃ), ভরৎংঃ পড়হংরফবৎধঃড়হএ কখনো নয়। ঊহমষরংয, ঐরংঃড়ৎু, এবড়মৎধঢ়যু, ঝপরবহপব, ৎবষরমরড়ঁং ংঃঁফরবং (অৎধনরপ), ইবহমধষর- সবগুলোতে ঋরৎংঃ উরারংরড়হ সধৎশং- ধষধিুং- নঁঃ ভধরষবফ রহ গধঃযং. ঝড় ঁহভড়ৎঃঁহধঃব!

তবে সুখবর হলো এই যে গধঃৎরপঁষধঃরড়হ ভরহধষ বীধস-এর আগে কয়েক মাস একজন গধঃযং ঃবধপযবৎ-এর কাছে প্রাইভেট পড়ে এবং নিজেও আপ্রাণ চেষ্টা করে গধঃৎরপ পাস করি ঝবপড়হফ উরারংরড়হ-এ (১৯৫০) গধঃযং-এ ৪০ সধৎশং পেয়ে। গরৎধপষব রহফববফ!

তবে আব্বা-আম্মা বলতেন যে পরীক্ষার আগে তাঁদের পীর বাবা আমার বুকে ফুঁ দেয়ার বরকতেই গধঃযং-এ ফেইল মারিনি। হতেও পারে। সত্যটা যে কি তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

তবে এখানে এসে আবারও উল্লে­খ করা প্রয়োজন যে হাইস্কুলেও বিভিন্ন সাবজেক্টের টিচারদের হাতে প্রচুর বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয়েছে প্রাইমারী স্কুলের মতোই। এবং সেই বেত-ও আমরা ছাত্ররাই টিচারদের সাপ্ল­াই দিতাম।

একটা কথা এখানে এসে যোগ করতে চাই ছাত্রদের বেত দিয়ে পিটানোর নধপশমৎড়ঁহফ হিসাবে।

ওহফরধতে আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন করেছিলো তদানিন্তন শাসকগোষ্ঠী বৃটিশ সরকার। সেই যুগে ইৎরঃরংয বফঁপধঃরড়হ ংুংঃবস-এ ছাত্রদের বেত দিয়ে পিটানোটা ষবমধষ ছিলো। নীতিটা ছিলো এই ঃ “ঝঢ়ধৎব ঃযব ৎড়ফ, ংঢ়ড়রষ ঃযব পযরষফ.” অর্থাৎ বেত দিয়ে না পিটালে ছাত্ররা নষ্ট হয়ে যাবে।

অতএব কারণে-অকারণে ছাত্রদের বেত দিয়ে পিটানোর ষরপবহপব বা অনুমতি ছিলো টিচারদের। আমরা ছাত্ররা ছিলাম সেই অনুমতির ভুক্তভোগী।  (চলবে)

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *