৫ আগস্ট : বিপ্লব পরবর্তী জাতীয় আকাঙ্খা
মাহবুবুর রব চৌধুরী
৫ আগস্ট- বিপ্লব, সারা বিশ্বে আন্দোলন সংগ্রাম, ইতিহাসে এক নতুন সংযজন! ছাত্র, যুব, কিশোর, কিশোরী সহ নাগরিকদের সমন্বিত-ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী নয়া বাংলা বসন্ত। যা বাংলাদেশকে নতুন রূপে বিশ্বে তুলে ধরেছে। বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খা অপ্রত্যাশিত, ভিন্ন কিছু নয়। শত পরিবর্তনের মাঝেও অপরিবর্তনীয়, আমাদের নাগরিক আকাঙ্খা ও জাতীয় প্রত্যাশা। আর তা হল, সুখ,শান্তি সহ, নিরাপদ, মর্যাদাময়, স্বাচ্ছন্দের আধুনিক উন্নত জীবন। বিশ্বের অন্যান্য সভ্য দেশ ও জাতির নাগরিকের মত বাংলাদেশিরাও সেটিই চান। পেতে চান সত্যিকার মানবিক অধিকার ও নাগরিক মর্যাদা। প্রত্যাশা এত টুকুই।
উন্নত তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিশ্ব আজ সত্যিকার ভাবেই গ্লোবাল ভিলেজে রূপ পেয়েছে। যোগাযোগের মাধ্যমে সব দেশ ও জাতি একে অপরের জীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা এখন ঠিকই পেয়ে যাচ্ছেন। খবর তারা রাখেন। একই সাথে দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশীর মাধ্যমেও সরাসরি অনেক কিছুই দেশবাসি জানতে পারছেন। এ যুগে তথ্য লুকিয়ে রাখা আর সম্ভব নয়। সবই মানুষের নখ দর্পনে। হাতের মুঠোয়।
স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশী প্রত্যাশায় তার প্রভাবও পড়েছে। যে জাতি ১৯০ বছর ইংরেজ কলোনিয়াল শাসন শোষণ এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ১৪ই অগাস্ট ১৯৪৭ পেয়েছে। ২৪ বছর পাকিস্তানী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষে রক্ত ক্ষয়ী মুক্তি যুদ্ধে অর্জিত ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পেয়েছে। সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, আন্দোলন সংগ্রামের সে পথ ধরেই এনেছে নয়া বাংলা বসন্ত। মুক্ত স্বচ্ছ প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন বাজি রেখেই করেছে সংগ্রাম। অন্যায়, অত্যাচার, গুম, খুন উপেক্ষা করে- কোটা বিরোধী, বৈষম্য মুক্ত — সমাজ ও দেশ গঠন কল্পে আন্দলন সফল করে, চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেই ৫ই অগাস্ট ২০২৪ অর্জন করেছে। ঘটিয়েছে স্বৈরতন্ত্রের পতন। দ৪৭,দ৫২,দ৬৯,দ৭১,দ৯০,দ২৪ কোনটার গুরুত্বই কম নয়। এ সবই বাংলাদেশের ইতিহাসের একেকটা টার্নিং পয়েন্ট। কোনটাই কোনটার সাথে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটিই আগেরটির ধারাবাহিকতা এবং সময়ের প্রয়োজন। প্রতিটিরই আছে অসীম ঐতিহাসিক মূল্য এবং তাৎপর্য। তারা আলাদা হলেও স্ব স্ব মহিমায় মহিমান্বিত ও ইতিহাসের এ ধারাবাহিকতা স্বীকার করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে হবে।
একই সাথে জানতে হবে এবং পরিষ্কার ভাবে বুঝে নিতে হবে, কেন বার বার বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সংগ্রামী সাফল্য অভিষ্ঠ লক্ষ অর্জনে সফল হচ্ছে না। কেন বার বার এমনটি হচ্ছে – তীরে এসে কেন তরী ডুবছে? সমস্যা ও সমাধানের আলোচনাটি এ প্রেক্ষাপটেই। চিহ্নিত কিছু সমস্যার পাশে অমীমাংসিত অচিহ্নিত সমস্যার ক্ষেত্রগুলিও সঠিক ভাবে তুলে না ধরতে পারলে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি না করলে সমাধানের সূত্র পেলেও তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যা যেখানে সমাধানও সেখানে এই বক্তব্যের পাশে – সমস্যা যার সমাধান ও করতে হবে তার। এ দুটি সূত্রের মাঝে সমন্বয় করেই সমাধানের পথ বের করে আনতে হবে। একই সাথে দৃঢ় প্রত্যয়ে বার বার ঘু ঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, প্রতিরোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে যে বিষয় গুলি শক্ত ভাবে তুলে ধরতে হবে তা হল।
এক : জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এটি অর্জনে নাগরিক চিন্তায় এবং জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের মাঝে ন্যায়, নীতি, মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
দুই : গণতন্ত্র, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, ভোটাধিকার, কোন প্রকার হস্তক্ষেপ মুক্ত সুষ্ঠ, স্বাভাবিক ভাবে নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তিন : সুশাসন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনের সর্ব উচ্চ থেকে সর্ব নিম্ন পর্যন্ত সবাইকেই দুর্নীতি মুক্ত- স্বচ্ছ ও জবাবদিহি সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে দুর্নীতি মুক্ত – স্বচ্ছ ও জবাবদিহি সিস্টেম। এটি প্রাথমিক ভাবে বিশ্বের যে কোন উন্নত দেশের থেকে নিলেই হবে। জাপানও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষে এভাবেই আমেরিকার পদ্ধতি বিভিন্ন ভাবে গ্রহণ করেছে। সিস্টেম পরিবর্তন ছাড়া শুধু মাত্র সরকার পরিবর্তনে জনগনের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। অবশ্যই এটি মনে রাখতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও বিদ্বেষ দূরীকরণের জন্য সর্বাগ্রে আনতে হবে অর্থনৈতিক জীবনের নিরাপত্তা। সুষম অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্য মুক্ত ন্যায্য ব্যবস্থা।
চার : – সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার – এই ক্ষেত্রে দেশের সকল নাগরিক পাবে নিজ ইচ্ছায় স্বাধীন ভাবে নিজ ধর্ম কর্মের অধিকার। সর্ব প্রকার বিধি নিষেধ বেড়াজাল মুক্ত অধিকার। এটি নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিটি নাগরিককে এ বিষয়ে পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান এবং একই সাথে নিজ অধিকারের নামে কেউ যেন কোন ভাবে অন্যের অধিকারে অন্যায়, অন্যায্য হস্তক্ষেপের সুযোগ নিতে না পারে। কঠোর ভাবে সে ব্যবস্থায় নজর রাখা সাথে স্বাধীনতা ও অধিকারের আবরণে অশ্লীল – কুরুচি পূর্ণ,অস্বাস্থ্য কর কিছু যেন প্রোমট না হয়। সে দিকেও লক্ষ্য রাখা।
প্রতিটি নাগরিকের জন্য উন্নত সভ্য দেশের মত সম অধিকার প্রতিষ্ঠা। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জান, মাল, মান, সম্মানের অধিকার আইনের দ্বারা সংরক্ষিত করা। বাস্তব জীবনে এবং প্রয়োগ ক্ষেত্রে, সর্বত্র এ আইন প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলাদেশকে একটি সভ্য আধুনিক উন্নত দেশ রূপে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও দেশ গঠন।
পঞ্চম : কৃষ্টি, কালচার, সাংস্কৃতি : দেশের সকল নাগরিক নিজ ইচ্ছায় স্বাধীন ভাবে তার নিজস্ব কৃষ্টি, কালচার, সাংস্কৃতি চর্চায় হবে স্বাধীন। থাকবে সকল ধর্মের মানুষের মর্যাদা, সম মানবিক ও নাগরিক অধিকার। নিশ্চিত,নিরাপদ ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার। আমাদের কৃষ্টি, কালচারকে বাইরের আগ্রাসী অপ সাংস্কৃতির থাবা থেকে রক্ষায় প্রয়োজন একটি দইসলামিক কৃষ্টি, কালচার বিশ্ব বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা।
দেশের ৬৪ জেলারই আছে নিজস্ব সমৃদ্ধ কালচার এর সমন্বয়ে গড়ে তুলতে হবে বাংলাদেশী জাতীয় কালচার। সুস্থ্য সংস্কৃতি সুস্থ্য কৃষ্টি-কালচারই জাতির বিবেক জাতির হৃদয়। সামগ্রিক ভাবে এ বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের কেন্দ্র হবে ইসলামিক কৃষ্টি -কালচার বিশ্ববিদ্যালয়। এই ভার্সিটি থেকে শিক্ষিতরা বিশ্বের অন্যান্য মতবাদ ও ধর্ম অনুসারীদের মাঝে পারস্পরিক, নিজেদের মৌলিক পার্থক্যর দিক সম্পর্কে যেমন জানবে ও জানাবে তেমনি। বিশ্ব মানবতা, প্রকৃত ইসলামী উদারতা ও ভ্রাত্বিত্বের দিকটিও তুলে ধরতে সক্ষম হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সম্প্রদায়িকতা ও ক্ষুদ্রতা মুক্ত মেধাবান শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ই পারবে ইসলামোফোবিক চক্রকে সত্যিকার ভাবে বুদ্ধি ভিত্তিক মোকাবেলা করতে। সভ্য সমাজ থেকে দূরে লুকিয়ে থেকে নয়। শুধু মাত্র কথা বলেই দায়িত্ব শেষ করে নয়। নিজেদের সত্যিকার অবস্থান ঐতিহ্য কৃষ্টি কালচারের মহৎ ও সুন্দর দিক ণ্ডলি সৃষ্টিশীল পথে সত্যিকার মেধা ও মননের মাঝে সারা বিশ্বে তুলে ধরাতে।
পরিশেষে বিপ্লবকে সফল করতে প্রয়োজন -জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে – দেশের রাজনৈতিক দল সমূহের ঐক্য মতের ভিত্তিতে নুতন করে শাসনতন্ত্র রচনা।
অথবা বাস্তবতার নিরিখে প্রয়োজন শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় জরুরি সংশোধন। যেটি আমাদেরকে দেবে স্থায়ী গণতন্ত্র, বৈষম্য মুক্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক সম্প্রীতি ও আগ্রাসন মুক্ত স্বাধীন জাতীয় কৃষ্টি কালচার চর্চার পরিবেশ।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(লেখক পরিচিতি: ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)