বিদেশে বাংলাদেশী মিশনগুলোর সংষ্কার জরুরী

জসিম মল্লিক

রাতারাতি সবকিছু বদলে যাবে এমন আশা করা ঠিক না। যে কোনো পরিবর্তনের জন্য সময় দরকার। দীর্ঘদিনের অচলায়তন থেকে মুক্তি পেতে সংস্কার জরুরী। সেই পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোরও সংস্কার করতে হবে। জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিতে হবে। আমার বাইশ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি মিশনগুলোর কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশীদের সাথে সঠিক সংযোগ তৈরী করতে পারে না। সঠিক আচরণ করেন না। বিশেষকরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যারা রেমিট্যান্স যোদ্ধা তাঁদের সাথে প্রভু ভৃত্তের মতো আচরণ করেন। নানা ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। পাসপোর্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে ঘুষের অভিযোগ আছে। এয়ারপোর্টেও তাঁদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়।

সৌদী আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস। ছবি : দূতাবাসের ওয়েবসাইট

জাতীয় দিবসগুলোতে মুখচেনা এবং দলীয় বিবেচনায় দাওয়াত দিয়ে একধরনের পিকনিক করা হয়। সেখানে কমিউনিটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপেক্ষা করা হয়। লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সচেতনভাবে উপেক্ষা করা হয়। সেখানে একধরণের গোষ্ঠিপ্রীতি কাজ করে। এই প্রবণতা দূর করতে হবে। প্রবাসীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁদের যথাযথ সার্ভিস দিতে দল বিবেচনা করা অন্যায়। মিশনগুলোর কাছে সংশ্লিষ্ট দেশে কতজন বাঙ্গালি বাস করেন তার কোনো ডাটাবেজ নাই। বিদেশে নিজের দেশের মুখ উজ্জল করার কোনো উদ্যোগ নাই। যোগ্য লোকদের কোনো মূল্যায়ন নাই। বিদেশে অনেক প্রতিভাবানরা আছেন যারা দেশের জন্য অবদান রাখতে চান কিন্তু কোনো পরিবেশ পান না।  নতুন প্রজন্ম দারুণ ক্রিয়েটিভ তারা বিভিন্নভাবে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারেন। তাদের প্রতিভাকে কাজে লাগানোর এখনই সুযোগ। প্রবাসী তরুণদের সাথে বাংলাদেশের তরুণদের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম করতে পারেন। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে।

টরন্টো ২৫ আগষ্ট ২০২৪

ইয়েস, নো, ভেরিগুড জানলেই হবে

২০০০ সালের ৩ জানুয়ারি এক কাক ডাকা ভোরে আমি আমেরিকান এম্বাসিতে ভিসার জন্য ইন্টারভিউর জন্য দাঁড়ালাম। জীবনে প্রথমবার কোনো এম্বাসিতে যাওয়া আমার। এর আগে আমি বিদেশ বলতে একবার বাসে চড়ে কোলকাতা ছড়া আর কোথাও যাইনি। আমার সবসময় স্বপ ছিল আমি প্রথম প্লেনে চড়ে যে দেশটিতে যাব সেটা আমেরিকা হতে হবে। শংকরের এপার বাংলা ওপার বাংলা পড়ে আমেরিকা আমার মনের মধ্যে গেঁথে ছিল। কাউন্টারের ওপারে ঝকঝকে সাদা চেহারার এক আমেরিকার তরুণ। হাসি হাসি মুখ। দেখলে মনে হয় দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে নার্ভাস! টের পাচ্ছি আমার শিঁড়দাড়া বেয়ে ঘাম নেমে যাচ্ছে। ভিসা অফিসার আমাকে আমেরিকা কেনো যাব, কোথায় থাকব, খরচ কে দেবে, কতদিন থাকার প্লান ইত্যাদি প্রশ্ন করছে। আমি উত্তরে কি দিচ্ছি নিজেই জানি না। যা বলছি তা কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু অফিসার বুঝদারের মতো মাথা নাড়ছে। সে প্রশ্ন করল তুমি একলা কেনো যাবা, ওয়াইফ যাবে না কেনো! তাৎক্ষনিক আমার আমার মাথায় বুদ্ধি এসে গেলো, বললাম, বাচ্চারা ছোট তো তাই এখন যেতে পারবে না, পরে যাবে। তখন অফিসার আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ইনশাল্লাহ। বিকেলে আমি পাসপোর্ট কালেক্ট করতে গেলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমাকে ভিসা দেয়নি। দেওয়ার কারণও নাই। কিন্তু পাসপোর্ট দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দেখি এক বছরের মাল্টিপল ভিসা সীল লাগানো! সেবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘে মিলিনিয়াম২০০০ উপলক্ষ্যে কোনো একটা আর্ন্তজাতিক সেমিনারে গিয়েছিলাম। জাতিসংঘের মহাপরিচালক কফি আনান প্রধান অতিথি ছিলেন মনে আছে। ওখানে সদস্য সব দেশের নাম থাকে বাসার জায়গায়। আমিও বসলাম। সবার সামনে একটা স্পিকার থাকে এবং  যে যে ভাষায় বক্তৃতা করুক না কেনো যার যার নিজ দেশের ভাষায় অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। ইংরেজি না জানলেও সমস্যা হচ্ছে না। সেবার ওয়াশিংটন ডিসিতে একটা এনজিওর প্রোগ্রামেও একই ব্যবস্থা দেখেছি।

২০০৩ সালে আমি কানাডার ইমিগ্রেশনের জন্য লসএঞ্জেলেস গিয়েছিলাম। সাধারণতঃ কেউ আমেরিকায় গিয়ে ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা ভাবে না। তখন আইইএলটিএস ছিল না, ছিল ইংরেজি টেষ্ট। সেসময় বেশিরভাগ ইন্টারভিউ হতো দিল্লিতে। কিন্তু আমি গেলাম আমেরিকা। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০২৩। এলএর ডাউন টাউনে কানাডার ভিসা সেন্টারে আমার ইন্টারভিউ। ইন্টারভিউ শুরু হলো। গ্ল­াসের ওপারে এঞ্জেলিনা জুলির মতোই এক সুন্দরী অফিসার আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছে। তার পিছনেই দাঁড়ানো প্রায় সাত ফুট উচ্চতার একজন কুচকুচে কালো রঙের সুদর্শন এক লোক। মুখে এক ফোটা হাসি নাই। সে অবজার্ভ করছে। এবারও আমি ভয়ে ঘামছি। সবসময় আমি ইন্টারভিউতে নার্ভাস থাকি। আজকে আমার জীবন মরণ সমস্যা। এতোদূর এসেছি! ইন্টারভিউতে পাশ না করলে কানাডা আসার স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়ে যাবে। ইন্টারভিউতে বিচিত্র সব প্রশ্ন করছে আমাকে। গ্ল­াসের ওপার থেকে মনে হচ্ছে কোনো গায়েবি আওয়াজ হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। কোন প্রশ্নে কি উত্তর দিচ্ছি নিজেই জানিনা। আমার ইংরেজি কিছুই বুঝতে পারছে না আমি নিশ্চিত। সবশেষে যে প্রশ্নটি করেছে সেটা আমি বুঝেছি, প্রশ্নটি ছিল, তোমার কোনো প্রশ্ন আছে? এবারও আমি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলাম এবং নিজের বুদ্ধিতে নিজেই মুগ্ধ। আমি বললাম, আমি কি কোয়ালিফাই করেছি! এটা আমার জানার দরকার ছিল। পাশ না ফেল। ফেল হলে আমার আমেরিকা বেড়ানো মাটি। কারণ আমি প্রায় একমাস থাকার প্লান করে এসেছি। আর পাশ দিলে আমার ভ্রমণ আনন্দদায়ক হবে। মেয়েটি বলল, তুমি কোয়ালিফাই করেছো। তুমি চাইলে ৬ নম্বর কাউন্টারে গিয়ে ভিসা প্রসেসিং ফি দিয়ে যেতে পার। আমি যে জঘন্য ইংরেজিতে ইন্টারভিউ দিয়েছি তাতে কোনই সমস্যা হয়নি।

উত্তর আমেরিকায় এমন অনেকে আসেন যারা এক লাইন ইংরেজিও জানে না। প্লেনে উঠিয়ে দিলে অন্ধরাও দিব্যি চলে আসতে পারে। ভাল ইংরেজি না জেনেও সবাই কাজকর্ম করে খাচ্ছে। চাইনীজরা একদমই ইংরেজিতে কথা বলে না। কিন্তু তারা সবচেয়ে ভাল অবস্থায় আছে। ৪০ বছর ধরে থাকে আমার এক গুজরাটি প্রতিবেশি যিনি এক ফোটাও ইংরেজি জানেন না। এখনও এদশে অনেকের ইংরেজি উচ্চারণ বুঝি না কিন্তু কোনো সমস্যা হয় না। ইমিগ্রেশনে অনেক প্রশ্ন করা হয় আকস্মিক কিন্তু কাউকে আটকায় না। কাস্টমার সার্ভিসে ফোন করলে নানা কাহিনী বলে সব কথা বোঝা যায় না। কিন্তু কোনো সমস্যা হয়না। সবাইকে ইংরেজি জানতে হবে কেনো! নিজের ভাষাটা ঠিকমতো জানলেই হলো। আমার ছেলে মেয়ে আমাদের সাথে কখনও এক লাইন ইংরেজিও বলে না। অরিত্রি অনেক বাংলার মানে বোঝেনা তাও সবসময় চেষ্টা করে। যে সব বিদেশেরা বাংলাদেশে আসেন তাদের কিন্ত বাংলা ভাষার উপর দক্ষতা আছে। আমেরিকান ডিপ্লোম্যাটদের যে দেশে যায় সেখানকার ভাষা শেখানো হয়। কিছুদিন থেকে ইংরেজি নিয়ে খুব ট্রল হতে দেখছি। যারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে তারা ঠিকমতো ইংরেজিতো জানেইনা নিজের ভাষাটাও শুদ্ধভাবে রপ্ত করতে পারেনি। তাই বলি ইয়েস, নো, ভেরিগুড জানলেই চলবে।

টরন্টো ২৯ আগষ্ট ২০২৪

আসুন ঘুষ দেওয়া বন্ধ করি

বাংলাদেশে সরকারি অফিসে ঘুষ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অর্ন্তবর্তী সরকারের এটাও একটা এজেন্ডা হতে হবে। সংস্কারের অংশ হতে হবে। ঘুষ, দূর্নীতি, টেন্ডারবাজি এই সমাজটাকে পচিয়ে ফেলেছে। ঘুষ বন্ধ হলে সম্ভাব্য যা যা ঘটতে পারে..

১. দেশের বিশেষকরে ঢাকার যে সব রেষ্টুরেন্ট অযৌক্তিকভাবে মানুষের গলা কাটে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

২. তথাকথিত অভিজাত অর্ধেক শপিং মল বন্ধ হয়ে যাবে। লক্ষ টাকা দামের শাড়ি, পাঞ্জাবি বা ড্রেস বিক্রী বন্ধ হবে।

৩. সারাদেশে রিসোর্ট বলে কিছু থাকবে না।

৪. বড় বড় ক্লাবের বারগুলো এবং ওয়্যারহাউজ অর্ধে বন্ধ হয়ে যাবে।

৫. কক্সবাজার সহ অন্যান্য জায়গার অর্ধেক হোটেল বন্ধ হয়ে যাবে এবং রুম ট্যারিফ অর্ধেকে নেমে আসবে।

৬, সিনেপ্লেক্সে টিকিটের দাম কমে যাবে এবং কিছু কিছু বন্ধু হয়ে যাবে। যে সব প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেগুলো আবার চালু হবে।

৭. ঢাকার রাস্তায় অর্ধেকের বেশি প্রাইভেট কার চলবে না, এক ফ্যামিলিতে তিনটা চারটা গাড়িও থাকবে না। এতে যেমন জ্বালানী সাশ্রয় হবে তেমনি পরিবেশ রক্ষা পাবে।

৮. ডোমেস্টিক এয়ার লাইন্সগুলোর টিকেটের দাম কমবে। ছুটি ছাটা হলেই দলবেধে ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, কোলকাতা, সিঙ্গাপুর , কাঠমুন্ড যাওয়া কমে যাবে। দেশীয় ট্যুরিষ্ট স্পটগুলো চাঙ্গা হবে।

৯. ওমরাহ করার সংখ্যা কমে যাবে এবং মানুষের নৈতিকতা বৃদ্ধি পাবে।

১০, মাদকের সরবরাহ কমে যাবে।

১১. যারা কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বদলি বাণিজ্য করে সেটা বন্ধ হবে।

১২. নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য ও নির্বাচন করতে  শত শত কোটি টাকা খরচ বন্ধ হবে।

১৩, স্বল্প আয়ের লোকরা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই করতে পারে না। এমন কোনো সেক্টর নাই যেখানে ঘুষ নাই। ঘুষ দিতে দিতে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে।

১৪. এখন থেকে আসুন আমরা সবাই ঘুষ দেওয়া বন্ধ করি। সকিছুই জনগনের উপর দিয়ে যায়। জনগনকে স্বস্তি দিন।

স্বপ্নরা সারাক্ষন ওড়াওড়ি করে..

বিদেশে এসে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। বাইশ বছর বিদেশে থেকে যা অর্জিত হয়েছে তা সারা জীবন দেশে থেকেও অর্জন করতে পরিনি। আরো যতদিন থাকবো তত অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হবে। অভিজ্ঞতার ঝুলি উপচে পড়ছে। মাঝে মাঝে ভাবি এতো অভিজ্ঞতা কোথাও রাখবো। অভিজ্ঞতার ভারে নুজ্ব্য হয়ে গেছি। একটা কনসালটেন্সি খুলে বসলে ভালো করবো বলে আমার বিশ্বাস। অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো। মানুষতো আর নির্বিকার থাকতে পারে না। তাকে কোনো না কোনোভাবে কোনো না কোনো কিছুতে অংশ নিতেই হয়। এবং অর্জিত হয় নানা কিসিমের সব অভিজ্ঞতা। আমি কখনও জানতাম না যে একদিন আমি বিদেশ বিভুঁয়ে ঘাঁটি গাড়বো। বিদেশ প্রীতি বলতে যা বোঝায় তা আমার নেই। অন্যত্র বসতি স্থাপনের সবিশেষ কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমি আজ বিদেশে বসে অভিজ্ঞতা অর্জন করে চলেছি। কোনো অভিজ্ঞতাই বৃথা যায় না, সবকিছুই মূল্যবান..।

প্রথম প্রথম অনেকেই জানতে চাইত আমি কেনো বিদেশে আসলাম। কেনো আসলাম এর একটা ব্যাখ্যাও আছে। জানি এটা এখন আর কেউ জানতে চায়নি। এসব নিয়ে আজকাল কেউ মাথাও ঘামায় না। কত জন আসে কত জন য়ায় কে তার হিসাব রাখে। এটা ঠিক যে আমি দেশ বিদেশ ঘুরতে পছন্দ করি। লাসভেগাস থেকে লেছড়াগঞ্জ ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। কিন্তু কখনও ভাবিনি যে বিদেশ হবে আমার ঠিকানা। আমি কী আবার আমার ঠিকানা বদল করতে পারবো? আমি কী আবার ফিরে যেতে পারবো সেই ছায়া সুনিবিড় বরিশালের বাড়িতে যেখানে রয়েছে আমার মা আর বাবার কবর? পারবো কী ফিরতে? আবার কী প্রথম থেকে সব শুরু করা যায়?

আমি একদিন আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি যে প্রায় ছাব্বিশ বছর এই দেশে এসেছো, একবারও দেশে যাওনি। কেনো গেলানা! তোমারতো মা বাবা রয়েছে দেশে। তোমার কী দেখতে মন চায় না! সে নির্বিকার উত্তর দিয়েছিল, আমার মন টানেনা। আমি তাকে আর বলি নাই যে আমি গত বাইশ বছরে বিশবার দেশে গেছি। আমি বলি নাই যে মা বাবা চলে গেলে আর ফিরবে না। যে যায় সে আর ফেরে না। এই যে আমি বছর বছর দেশে গেছি মায়ের পাশে একটু বসে থাকার জন্য এখনও যখন রাত গভীর হয় আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ। মা ভাবে আমার যাদু চলে যাচ্ছে। আর কী দেখবে আমাকে! ভাবি মায়ের জন্য কত কী করার ছিল, কিছুইতো করলাম না। মায়ের পাশে আরো বেশী বেশী থাকতে পারতাম , থাকলাম নাতো! মা যখন চেতন ও অবচেতনের মাঝামাঝি তখন একদিন আমাকে বলেছিল, তুমি কেনো বিদেশ গেলা! নিজের দেশ ছেড়ে কেউ যায়!

মানুষ হিসাবে আমি কেমন! এই প্রশ্নের উত্তর খুউব কঠিন। আমি কষ্টে সৃষ্টে বেড়ে ওঠা মানুষ। এটা ঠিক যে আমার সাথে কারো কোনো আর্থিক লেন দেন নাই। আমি কখনও কাউকে ঠকাইনি। কারো কাছ থেকে টাকা ধার নিইনি। আমি যথাসময়ে সব বিল পরিশোধ করি। এগুলো হচ্ছে একটা অভ্যাসের ব্যাপার। অনেকেই করে। শুধু আমার যারা খুউব কাছের তাদের মাঝে মাঝে কষ্ট দেই, খেয়ালিপনা করি, রাগ দেখাই, নির্বিকার থাকি। জানি তারা এটা মেনে নেবে। জেনেশুনে কারো ক্ষতি করিনি। তবে ভুল করেছি অনেক জীবনে। ভুলগুলো বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভুগেছি, ভুল শুধরানোর চেষ্টা করেছি।

বিদেশে কেনো আসলাম এই ব্যাখ্যাটা খুউব কমন। সেকেলে। অনেকই এই ব্যাখা দেয়। বেশীরভাগ মানুষই বলে ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার জন্য বিদেশ এসেছি। এটা বললে আবার অনেকে ক্ষেপে যায়। হইছে আর ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দোহাই দিতে অইবে না। আইছে নিজের স্বার্থে এখন কয় ছেলে মেয়ের জন্য! আমার বিদেশ আসার কারণ একটু ভিন্ন। ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার ব্যপার যদি বলতে হয় তাহলে আমার দ্বায়িত্ব মোটামুটি শেষ। আমার ছেলে এবং মেয়ে দুজনই টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে পড়া শেষ করে চাকরি করছে। সংসার হয়েছে। যে যার মতো থাকছে। আমার পাশেও নেই তাঁরা। আবার একলা হয়ে গেছি। দুজনের সংসার শুরু হয়েছিল। আবার দুজন। ওদের লেখাপড়া নিয়ে আমি কখনও চিন্তিত ছিলাম না।

আমি কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে চাইনি। আমি একটু জেদি, একরোখা! আমার জেদ অনেক কিছুই আমাকে পেতে দেয়নি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আমি অনেক ভুগেছি। দেশে থাকতে আমি কয়েকবার চাকরি ছেড়েছি। চাকরি ব্যাপারটাকে আমি ঘৃণা করি। কিন্তু চাকরিই আমার ভরসা। এর বাইরে কিছু করার যোগ্যতা আমার নাই। কিছু মানুষ জন্মায় যারা আমার মতো। নিজেকে ঠিকঠাক মতো যারা গুছিয়ে উঠতে পারে না। স্বপ্ন দেখতেই দেখতেই যাদের সময় চলে যায়। আমি হচ্ছি স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন আছে বলে আমি বেঁচে থাকি। স্বপ্নরা সারাক্ষণ ওড়াওড়ি করে..।

পাখী হয়ে প্রাণ

মা আমাকে প্রায়ই বলতেন তুমি একটা পাখী। এই দেখি আবার দেখি নাই। এখন দেখছি আমার ছেলে মেয়েরাও আমার মতো পাখী। শুধু উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই ছুট। ঠিকমতো কাছেও পাওয়া যায় না। যেমন আমার মা আমাকে পেতেন না। অরিত্রি কালকে চলে গেলো আটলান্টা। ১৬ ঘন্টা ড্রাইভ! টরন্টো থেকে চার ঘন্টা ড্রাইভ করে উন্ডসর বর্ডার হয়ে ডেট্রয়েট। ওখানে লাঞ্চ সেরে আবার ছয় ঘন্টা ড্রাইভ করে কেনটাকিতে রাত যাপন। সকালে চেক আউট হয়ে আবার ছয় ঘন্টার ড্রাইভ করে ঘরে পৌঁছানো। যতক্ষণ না পৌঁছায় ততক্ষণই টেনশন। ঘরে বসে আমি শুধু অরিত্রির কন্ঠস্বর শুনতে পাই। অবশেষে বিকেল পাঁচটার দিকে অরিত্রির ম্যাসেজ, বাবা এরাইভড ইন আটলান্টা। এদিকে অর্করা গেছে ইউরোপ। দুদিন হয়ে গেছে কিন্তু কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। আজকে ম্যাসেজ দিলাম অর্ককে কেমন আছ! কোথায় এখন! অর্ক কয়েক ঘন্টা পর রিপ্লাই দিল। বাবা উই আর ইন লিসবন নাও। টুমরো গোয়িং টু এনাদার টাউন। অর্ক খুবই নেচার প্রিয়। পাহাড়, জঙ্গল আর সমুদ্র প্রিয়। লিসবন থেকে যাবে স্পেন। মাদ্রিদ এবং বার্সোলোনার কোন কোন গ্রামে ঘুরবে। বাবা মায়েদের টেনশন কিছুতেই যায় না।

আমেরিকা এমন একটি দেশ যে কেউ তার সমালোচনা করতে পারে, গালি দিতে পারে। পাগলেও পারে, জ্ঞানিরাও পারে। এমনকি ওভাল অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টকেও গালি দিতে পারে। তাতে কারো গুম খুন হওয়ার সম্ভবনা নাই বললেই চলে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। কিন্তু যে যতই সমালোচনা করুক তাতে আমেরিকার কিছুই যায় আসে না বা তারা দ্রুত রিএক্ট করে না। অনেক সত্য কোনোদিনও প্রকাশিত হয় না। শুধু তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলে সেটা তারা একশ বছর মনে রাখে। তাদের হাত অনেক লম্বা। সাধারণ মানুষের ধারণার চেয়েও লম্বা।

দেশে এখন মামলা ও গ্রেফতারের উৎসব চলছে। কেউ কেউ আবার একাধিকবার গ্রেফতার হচ্ছে। আমার মনে হয় কারো বিরুদ্ধে যদি মামলা দিতেই হয় সুনির্দিষ্ট অপরাধে দেওয়া উচিত। তা না হলে সেই মামলা টিকবে না, জজসাব শুরুতেই খারিজ করে দেবে। এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন থাকা উচিত। অপরাধীর বিচার হোক এটা সবাই চায়। এটাই পৃথিবীর স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। সভ্য দেশে কেউ অপরাধ করে পার পায় না। এটাই আইনের শাসন। এখন যেভাবে গণহারে মামলা দেওয়া হচ্ছে বিশেষকরে হত্যা মামলা এটা উদ্বেগজনক। এতে প্রকৃত অপরাধ হালকা হয়ে যাচ্ছে। অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার প্লট তৈরী হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে তাদেরই গ্রেফতার করা উচিত। শুধু রাজনৈতিক কারণেই নয় সব অপরাধেরই বিচার হওয়া উচিত। তাহলেই সমাজে শান্তি ফিরে আসবে।

ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে আমি সবসময় দূরে থাকতে স্বচ্ছন্দবোধ করি। এই ধরণের মানুষদের সাথে আমার কখনোই মাখামাখি সম্পর্ক হয়নি। ওদের সঙ্গ আমি ঠিক নিতে পারি না। ওদের ভাষা বোধগম্য হয় না। আমার মধ্যে  একধরণের ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তৈরী হয়। এমন না যে আমার ক্ষমতাবান বন্ধু নাই। অনেকই আছে। কিন্তু তাদের সাথে আমার যোজন যোজন দূরত্ব। এসব মানুষ যখন ক্ষমতাবান ছিল না তখন অনেক আঠা সম্পর্ক ছিল। শুধু ছিল না এমন সম্পর্ক যে এক বিছানায় ঘুমিয়েছি, এক প্লেটে খেয়েছি, একটা চা বা একটা কাপ সিগারেট ভাগাভাগি করেছি। যখনই সে ক্ষমতাবান হয়ে গেছে তখনই দূরে সরে গেছি। আবার আমাকেও অনেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আবার যখন ক্ষমতা হারিয়েছে তখন আবার কাছে টেনে নিয়েছি। ক্ষমতার উত্তাপে আমি ঝলসে যেতে চাই না। আমি চাকরিও করেছিলাম ক্ষমতাবানের সাথে। অতি ক্ষমতাবান। আমি নিজেও ক্ষমতাবান হয়ে উঠছিলাম সেটা টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই ক্ষমতার চর্চ্চা করতে না পারার ব্যর্থতায় দেশই ছেড়েছিলাম। সুতরাং ক্ষমতাবানের প্রতি আমার কোনো আলাদা আকর্ষণ নাই। কারণ আমি কারো কাছে কিছু চাইনা।

টরন্টো ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জসিম মল্লিক

লেখক ও সাংবাদিক

টরন্টো

jasim.mallik@gmail.com