আকাশের ঠিকানায়

পত্রোপন্যাস

ফারহানা পল্লব

অনেক ছোটবেলার কথা, অনুরাধার মনে পরেনা সে সৌম্যকে কখনো চিঠি লিখেছিল কিনা। এত বছর পরে তার আব্দার চিঠি লেখার। অণু জিজ্ঞেস করে কোন ঠিকানায় পাঠাবো সে চিঠি? সে বলে আমার বাসার ঠিকানায় পাঠিও, শুধু পাঠিয়ে জানিয়ে রাখবে। আমি প্রতিদিন সকালে পোস্টম্যানের কাছ থেকে নিজে সব চিঠি নিয়ে রাখবো। অন্য কারো হাতে যেন সে চিঠি না পরে।

অণুরাধা হেসে বলে, আমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি পাঠাবো, যদি পারো পড়ে নিও। না হলে আকাশেই মিশে যাবে।

সেই থেকে গল্পের শুরু।

চিঠির শুরু।

আকাশের ঠিকানায় লেখা এ চিঠি অণুরাধার মনের না বলা কত কথা আর সৌম্যর না জানা কত প্রশ্ন তার হৃদয়ে নাড়া দেবে তার জানা নেই। তবে একদিন সে আকাশ তারা দুজনা পেড়িয়ে যাবে। তাদের অনুভূতি ৩২ বছরেও এতটুকু হালকা হয়নি। শত জনমেও শেষ হবে না।

অনুরাধার চিঠি

১.          

বলেছিলে নিজ হাতে চিঠি লিখতে। অভিযোগ তোমার- আমি নাকি চিঠি লিখতে সবসময়ই কার্পণ্য করেছি। সত্যি কি তাই? অন্য অনেক ঘটনার মতই আমার এটাও মনে নেই।

তারপর বল্লাম- আসলে আমার হাতের লেখা খারাপ তাই লিখিনা।

ঘটনা কিন্তু সত্য নয়। অনেক ছোটবেলা থেকেই আমার কলম বন্ধু ছিল। তাঁদের মতে তখনো আমি বেশ ভালই লিখতাম। তবে তোমাকে লিখতে যে কৃপণতা তা মনে হয় সংকোচ থেকে। প্রেম পত্র লিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করিনি হয়তো সেটাই কারণ।

তবে ৩২ বছর অপেক্ষা করে যাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, তারপর পেয়েছি। এখন আর কোন সংকোচ না করাই শ্রেয়। তাহলে শুরু থেকে শুরু হোক ঠিক আছে?

১-জীবনের যে বয়সটায় তোমার সাথে পরিচয়, তখন ছেলেদের সম্পর্কে খুব বেশী ধারনা ছিল না। যদিও ভাইদের মাঝেই বড় হওয়া ডানপিটে সেই দস্যি মেয়েটাই আমি। তাই ছেলেদেরকে মেয়ের চোখে দেখা হয় নি। প্রথম তোমাকে দেখলাম। অবাক চোখে। বই মেলায় হাজার চোখের ভিড়ে ঐ চোখ জোড়ায় কেন আমার চোখ আটকে যাচ্ছিল বার বার? তুমি হালকা নীল রঙের হাফ শার্ট পরেছিলে। আজো মনে আছে। বইয়ের স্টলের সামনে আমি। অপর পাশে তুমি, আমার দিকে তাকিয়ে। কি কান্ড! ঐভাবে কেউ দেখে? কি অস্বস্তি হচ্ছিল আমার! তবু ঘুড়ে ফিরে চোখ তোমাকেই খুঁজছিল। বাসার পাশে থেকেও এভাবে দেখা হয়নি। বইমেলায় যেন প্রথম দেখা। লাভ এট ফার্স্ট সাইট কি একেই বলে? না সেটা মনে হয় না, কারণ তোমাকে দেখেছি তারও আগে। তবে এক জানালা থেকে অন্য জানালায়। আমাদের বাসায় চলতো কিশোর কুমারের ‘মন জানলা খুলে দেনা বাতাস লাগুক গায়ে।’ সে বাতাস লাগছিল দুজন তরুণ তরুণীর গায়ে। আমার প্রথম ভাল লাগা। কি রকম সে অনুভূতি ভাষায় পুরোপুরি বোঝানো কঠিন। তবু চেষ্টা করি আজ। যা কখনোই বলা হয়নি কারণ বলা যায় না। কিন্তু আজ যদি না বলি আর কখনে হয়তো সুযোগ হবে না বলার। নিয়তি আরেকবার সুযোগ দিয়েছে আমাদের। সব কথা বলার আর শুনার- আজো যদি না বলি বা না লিখি, আমাদের গল্পটা অজানাই রয়ে যাবে।

এস. এস. সি পরীক্ষার পর ঢাকায় কাকার বাসায় বেড়াতে এসেছি চট্টগ্রামে থেকে। পাশের বাসার তরুণ তুমি। তোমার মনে হয়তো পরিবর্তনগুলো আগেই এসেছে। বয়সের পরিবর্তন, মেয়েদেরকে নারীরূপে, পুরুষের চোখে দেখার মন মানসিকতা কখন ঘটে গেছে তুমিও হয়তো জানতে না বা জেনে গেছো। আমি কৈশোরের দুরন্তপনার গন্ডি পেড়িয়ে সালোয়ার কামিজ পরতে শুরু করেছি। শরীরের পরিবর্তন তখন মেনে নিয়ে মনের পরিবর্তনের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রেমের সিনেমা দেখতে ভাল লাগতো। হিন্দি সিনেমা হিরো দেখে জ্যাকি শ্রফের জন্য চোখ ভাসিয়েছি। প্রেমের গান শুনলে গুনগুনিয়ে গাইতে থাকি। হাসিটা ছিল বরাবরই আমার সঙ্গী, যে কোন সামান্য কারণে হেসে গড়িয়ে পরতাম, আজো তাই করি। তোমাকে প্রথম কবে থেকে দেখছিলাম ঠিক মনে পরেনা। প্রথমে আড় চোখে জানালায় দেখতাম। আশ্চর্যজনক ভাবে টের পেতাম আরেক জোড়া চোখ আমাকে অনুসরণ করছে। মুরুব্বিদের জেনে যাবার ভয়, প্রেমে পরে যাবার আশঙ্কা আর তোমাকে দেখে ফেলার তীব্র আকর্ষণ সব একসাথে চুম্বকের মত টানতো ঐ ঘরটাতে, যেখানে জানালার ঐ পাড়ে আরেক জোড়া চোখ আমাকে খোঁজে। আমার সকল কাজের মাঝে চিন্তা ভাবনা, পরিবারের আড্ডার মাঝে সেই জানালা আমার ঝুলে থাকতো। ঐ ঘরে ঢুকলেই বুকের হাতুরীপেটা চলতো তীব্র। সারাক্ষণ নিশ্চই তুমি থাকতে না ওখানে। কিন্তু আমার বোকা মনটা ভাবতো সারাক্ষণই তুমি আছো, চেয়ে আছ অবাক চোখে। আমি যেমন চোখ ফেরাতে পারিনি বইমেলায় তোমাকে দেখে। মনে হচ্ছিল আমার মানুষ আমার সাথেই আছে।

কখনো এভাবে কোন ছেলেকে দেখিনি, ভালো লাগার যে কি আনন্দ, তোমাকে দেবদূতের মত লাগতো। যেদিন তোমার চিরকুট পেলাম জানালা দিয়ে বিছানার উপরে। সেদিন তো সেই বুকের হাতুড়িপেটা শতগুণ হয়ে বাজছিল, পাছে না আবার অন্য কারো হাতে পরে ঐ চিরকুট!

এক লাইনের সেই চিরকুটে কি যাদু ছিল, না তুমি জানো না আমি। ‘এই মেয়ে তোমার নাম কি’?

একেবারে যেন বোমা বর্ষণ হল আমার মনে। সে কথার কোন উত্তর দিয়েছিলাম কিনা আমার আর মনে নেই। যেদিন সারারাত বারান্দায় বসে কথা বলেছিলাম সেদিন মনে হল সব পেয়েছি।

সৌম্যের চিঠি

২-

প্রিয় রাধা,

অনেক বছর পরে তোমাকে লিখছি – বল্লে ভুল বলা হবে। তোমাকে আসলে লেখা কখনোই বন্ধ হয়নি, শুধু কাগজে কলমে তা বর্ণিত হয়নি, বা বলা যায় তোমাকে পাঠানো হয়নি অনেক দিন।

তুমি কি জানো, সিনেমার মত আমি শুধু বছরই নয়, মাস , দিন ক্ষণ পর্যন্ত গুনে রাখতাম যতদিন তোমাকে খুঁজে পাইনি। তবে আমার বিশ্বাস ছিল সৃষ্টিকর্তার উপর, যে তিনি আমার সহায় হবেন। হিন্দি সিনেমার মত বলতে হয় মানুষ যখন মন থেকে কিছু চায় সারা কায়ানাথ এক সাথে তা পূরণ করতে উদ্যত হয়। আমার জীবনে আজ আর চাইবার কিছুই বাকী নেই।

যা চেয়েছিলাম সব পেয়ে গেছি।

তুমি অনেক ঘটনা ভুলে গিয়েছো কিন্তু আমি সেসময়ের সব ঘটনা আয়নার মত পরিষ্কার মনে করতে পারি আজো।

প্রথম তোমার কন্ঠস্বর শুনেছিলাম। তখনো তোমাকে দেখিনি। পাশের বাসায় সবসময় মেহমান থাকে জানি। তাছাড়া এ পাশের প্রতিবেশী নিজেরাই বেশ জোড়ে কথা বার্তা বলে। হৈ চৈ পরিবার, টু ইন ওয়ানে গান শুনে জোড়ে। ইদানিং সেই গানে কন্ঠ মিলায় কে যেন।

কার সুরেলা কন্ঠ যেন হাতছানি দেয়। আমি উঁকি ঝুকি দেই দেখতে পারি না। তারপর শুরু হল আড্ডা গল্পের মাঝে মাঝে সেই সুরেলা হাসির রোল। সবার গল্পের কথা শুনা যায় আর মাঝে মাঝে গানের মতই সেই হাসি। হাসি আমার ঘুম কেড়ে নিল। কি কান্ড তবু তার দেখা পাইনা। এত মধুর যে হাসি আর গান সে না জানি কত সুন্দরী। আমার চোখ মন অন্তর পরে থাকে জানালার ওপাড়ে। কখনো আমার ঘরের জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করি, আবার সে হেঁটে চলে যায় পাশের ঘরে, তখন আবার রান্নাঘরের জানালায় যেতে হয়। আমার মায়ের চোখে ধরা পরি সবার আগেই। আমার পড়াশুনায় মন নেই। এত ”ঞ্চল মানুষ কি করে হয়? এখনি এই ঘরে আবার চোখের নিমেষে অন্য ঘরে। মনের মাঝে হাসন রাজার গান চলে- “বাড়ির কাছে আরশী নগর সেথা পড়শী বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”।

অবশেষে এই প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটলো। একদিন সকালে দেখি সে অপরূপা বাসন্তী রঙের সালোয়ার কামিজ পরে তার মায়ের সাথে রিক্সা করে বাইরে যাচ্ছে। সকালের আলোতে মনে হচ্ছিলো একটা তাজা গাঁদার ফুল হাসতে হাসতে ফিরে তাকালে। বুকের মাঝে সে কি উথাল পাথাল। চোখ ফেরাতে পারিনা। তুমিও সহজ হাসিতে তাকিয়ে রয়েছো – আমাদের প্রথম চোখাচোখি। তুমি তো জানোনা কতদিন অপেক্ষার পর এ পাওয়া কি মধুর। নিমেষেই রিক্সা তোমাকে নিয়ে উধাও। তারপর সারাদিন কান পেতে রইলাম কখন আবার কন্ঠস্বর শুনতে পাবো। দুপুরের পর শুনেছিলাম তোমরা ফিরেছো।

তারপর টের পেলাম যেন তুমিও এ জানালায় তাকাও, কি যে ভাল লাগা- এই ভাল লাগা নিয়ে তোমার চাচার বাসার রেকর্ডারের গান আমিও শুনি। আরো বুঝি তুমি জানালার ব্যাপারে সচেতন থাকো। আগের মত জোড়ে গাইছো না। সোজাসুজি তাকাও না। বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় ইচ্ছা করে ব্যস্ত থাকো, যদি পাছে আবার আমার চোখে ধরা পরে যাও।

তোমার যত উপেক্ষা আমার তত আকাংখা শতগুনে বাড়তে থাকে। আমি তোমাকে দেখার জন্য জানালা থেকে সরি না। বই খুলে বসে থাকি। আরেকদিন রান্না ঘরের পাশের জানালাটায় তুমি থাকো বুঝতে পেরে রান্নাঘরে হাতের কাছে কাঁচা মরিচ পেয়ে জানালায় ছুঁড়ে দিলাম। তুমি বিছানায় সেটা দেখে হাতে নিয়ে সে ঘর থেকে তড়িঘড়ি বের হয়ে গেলে। দেখার বা কথা বলার নেশা যেন চেপে বসলো আমার মাথায়। এরপর সেই একলাইনের চিরকুটটা লিখে ছুঁড়ে দিলাম আবারো তোমাদের বিছানায় পরে রইলো। তুমি সে ঘরে ঢুকে হাতে তুলে সেটায় চোখ বুলিয়ে হতবিহ্বল অবস্থায় এক নিমেষে হাতের মুঠোয় নিয়ে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে।

একটিবার জানালার দিকে চাইলে না। বুঝতেও পারলাম না কি হল তোমার প্রতিক্রিয়া, রাগ করে গিয়ে বড়দের কাউকে বলে দিলে কি না সেটাও একটা আশংকা ছিল মনের ভেতর। আমার মনের সে কিরকম ভগ্নদশা। মনে হচ্ছিলো গুরুতর এক অপরাধ করে ফেলেছি। আমাকে তুমি কি ভাবছো। আর ভয়ে থাকতাম কখন জানি তোমার চাচা বা চাচী নালিশ নিয়ে আসে আমাদের বাসায়। সকল আশায় ক্ষান্ত দিয়ে রীতিমত ভয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম।

এর মাঝে একদিন দেখি তোমার ছোট আন্টি, জানালা দিয়ে কথা বল্লেন আমায় ডেকে। সেদিন তোমাদের বাসায় কেউ ছিল না তাই জানালা দিয়ে ডেকে কথা শুরু করলেন আর তোমাকেও ডেকে দিলেন। তুমি কিছুই বলনি। চোখ নামিয়ে শুধু আমাদের কথা শুনছিলে। তারপর আন্টি বল্লেন পরের দিন তোমরা সবাই বই মেলায় যাবে। যেন ইশারায় আমাকেও যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে দিলেন। আমি তো মহা খুশি। এরকম সামনা সামনি বাসার বাইরে দেখা করার একটা সুযোগই তো মনে মনে খুঁজছিলাম আমিও। আমার সময় আর কাটেনা- কাল আসতে যেন অনেকদিন লাগলো। জানালাটা আরও প্রিয় হয়ে গেল। আন্টির সাথে তুমি জানালার পাশে বসে আড্ডা দাও, আমিও মনে মনে এ পাশের জানালা থেকে যেন সে আড্ডায় যোগ দেই।

পরের দিন খুব পরিপাটি হয়ে মেলায় গেলাম। তখনকার বইমেলা হত শুধু বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণেই। ভিড় ছিল সহনীয়। তখন তো হাতে হাতে সেলফোনও ছিল না বেশী ভিড় হলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হত। সুতরাং একটু ঘুরাঘুরি করেই তোমাকে পেয়ে গেলাম। কিন্তু তোমার সাথে চোখা চোখি হতেই তুমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশের মেয়েটা যে তোমার সাথে গিয়েছিলো, তার সাথে কথা বলা শুরু করলে। তারপর একে একে চোখে পরলো তোমার পুরো ভাই ও তার বন্ধু বান্ধবের গ্যাঙের দিকে। আমি আর কাছে এগোলাম না। তোমার সাথে একা দেখা করার সখ মিটে গেছে। শুধু দূর থেকে অনুসরণ করলাম। তোমাদের দলের সবাই সারাক্ষণ হাসি মজা দুষ্টুমীতে মেতে ছিলে। তোমার আনন্দে আমিও উদ্বেলিত হলাম। সেদিন তুমি হালকা ছাই রঙা পোষাক পরেছিলে সামনে ছোট ছোট ফুলের প্রিন্ট করা ডিজাইন দেয়া।

তারপর জেনেছিলাম তুমি চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছিলে পরীক্ষার পরে চাচার বাসায়। ঢাকায় কত মেয়েদের দেখি কিন্তু তোমার পোষাক আশাক চাল চলন সবকিছু অন্যরকম লাগছিলো। বাতাসে তোমার চুল উড়িয়ে রিক্সা করে চলে যাওয়া বুকের মধ্যে কি উত্তাল ঢেউ তুলে যেত। আমি বারান্দায় অপেক্ষা করে থাকতাম ফিরবে কখন। এরপর কয়েকদিন বাসার ফোনে কথা হয়েছে। তোমার চট্টগ্রাম ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছিল। আমার মন খারাপের দিনগুলো। মনের মধ্যে এক হাহাকার, যদি হারিয়ে যাও। যদি ফিরে গিয়ে আর কথা না বলো। এসব ভেবেই বিরহ বেদনায় কাতর হয়েছিলাম। এখনো সেই কষ্ট অনুভব করতে পারি।

অনুরাধার চিঠি

৩-

চিঠিটা শুরু করেও লেখা হয়নি। কারণ সৌম্যর ফোন এসেছিল। এখন অনুরাধার জীবনে এই একটি ফোনকলই সবচাইতে মূল্যবান। যা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ যেন তার পূনর্জনন্ম।

মার্চ ২০, ২০২২

অনুরাধা লিখে যায় তারপরের ঘটনা-

তারপর একদিন বলেছিলে রাতে কথা বলবে। আমি ভেবেছিলাম জরুরী কিছু। ফিরে যাবার সময় কাছে তাই হয়তো কিছু জরুরী বার্তা বাকী।

আমি সারাদিন বসেছিলাম কখন সন্ধ্যা নামবে। সেদিনটাও  ছিল খুব দীর্ঘ, বা এমনি হয়তো লাগে অপেক্ষার প্রহরগুলো। যখন রাত নামলো ড্রইংরুমে মহা আড্ডা চলছিলো, আমি বারান্দায় যাবার সুযোগই পাচ্ছিলামনা। ছোট আন্টিকে বলার পর তিনি আমাকে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে অনেক্ষণ বেতের চেয়ারে বসে গল্প করলেন। তারপর তুমি এলে। তোমার সাথেও হাল্কা গল্প করে একটু পরে চলে গেলেন ঘুমাতে। আমাদেরকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে।

সে দৃশ্য আজো চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পাই। আমি বেতের চেয়ারটা একটু টেনে গ্রীলের কাছে বসলাম। আর তুমি গ্রীলের ঐপাশে সিঁড়ির দরজার কলাপ্সেবল গেটের গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলে। কি কান্ড, সারাটা রাত ঐভাবে দাঁড়িয়ে রইলে। কতবার বসতে বল্লাম কোনো একটা ব্যবস্থা করে (যদিও সখানে চেয়ার বা মোড়া কিছুই পাওয়া সম্ভব ছিল না)। সারাক্ষণ মশার কামড়, তারপর রাত বাড়াতে হাল্কা ঠান্ডাও পরছিলো। আমি তো আমার ম্যাক্সির মধ্যে হাত পা গুটিয়ে গোল হয়ে চেয়ারে পা তুলে বসে রইলাম।

আর কি যেন সেই জরুরী কথাটা ছিল? সেটা আর জিজ্ঞেসই করা হয়নি। সারারাত কত কথা! কত কথা! আমি তো প্রথমে লজ্জায় কথাই বলতে পারিনি। তারপর অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আড় চোখে না, উঁকি ঝুকি বা লুকিয়েও না, সেই প্রথম সরাসরি তাকিয়েছিলাম। অপলক দৃষ্টিতে, ভেবেছি অন্ধকারে তুমি হয়তো আমায় দেখছো না। তবে তুমি অনেক কথা বলছিলে। খুব সাধারণ সব কথা বার্তা। বাবা মায়ের কথা, পরিবারের কথা, পড়াশুনার কথাও। তুমি কিন্তু সরাসরি দেখছিলে না আমাকে। হয়তো বুঝতে পারছিলে যে আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম। কি যে বোকা আমি, ভাবছিলাম অন্ধকারে তুমি দেখতে পাবেনা। তারপর তোমার কথায় আমার লজ্জা ভাঙলো আমিও স্বাভাবিক কথোপকথন চালিয়ে গেলাম। কত রাত পর্যন্ত! কি কথা বলেছিলাম একটুও মনে নেই। তবে কোন প্রেমের কথা যে হয় নি সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। কারণ তাহলে মনে থাকতো। কিন্তু কি যে সে ভাল লাগা! একটুও ভয় ছিল না, ঘরের থেকে কেউ বের হয়ে এলে কি জবাব দিতাম আজো জানিনা। তেমন কোন জরুরী কথাও না তবু যে ভালো লাগায় দুজনে দুলছিলাম, আমার জীবনে এরকম স্মৃতি আর আসেনি। অনেকে স্বপ্ন দেখে যে নিজের বাসর রাত জেগে কাটাবে। আমার আর সেরকম স্বপ্নের কোন প্রয়োজনই ছিল না। কারণ না চাইতেই আমি পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মুহূর্তগুলো পেয়ে গিয়েছি। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার জীবনে আর কিছুই চাইবার নেই।

আমার থেকে হয়তো একহাত দূরে তুমি দাঁড়িয়েছিলে ঘন্টার পর ঘন্টা। শুধু কথা আর গল্প, কত শত কথার ঝাঁপী সেদিন উজাড় করেছিলে, কখন সারা রাত পার করে দিয়েছি আমাদের হুঁশ নেই। এর মাঝে রাতের পাহাড়াদার রাস্তায় বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে চিৎকার করে গেছে কতবার- সাবধান! আমাদের কোন সাবধানতা নেই। এ জগৎ সংসারে কে দেখলো কে কি বল্ল কিছুতেই যেন আমাদের পরোয়া নেই। আমরা একে অপরে বিভোর। কঠিন লোহার গ্রীলে ঘেরা সে বারান্দা যেন খোলা আকাশ হয়ে গিয়েছিল। তুমি ঐ ওপারে দাঁড়িয়ে যেন আমাকে তারা দেখাচ্ছিলে, আমরা দুজন খোলা আকাশের নীচে নিষ্পাপ বালক বালিকা সেই সৃষ্টির শুরুর মত একজন আরেকজনকে আবিস্কার করছি তারার মেলায়। আমি ভাসছিলাম মাটি থেকে উপরে, আমার চেয়ারটা পাখা মেলে নিয়ে চল্ল তারার দেশে, তুমি আমাকে দোলনায় দোল দেয়ার মত করে আকাশ পরিদর্শনে নিয়ে বেড়িয়েছো। একসময় চেয়ার উধাও, তুমি আর আমি হাত ধরে ভাসছিলাম তারা ভরা আকাশে। তুমি আমায় তারা চেনালে। গভীর সবুজ ঘাসে শুয়ে আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে আমরা তারা চিনলাম- স্বাতী, শুকতারা, চিত্রলেখা বা অনিরূদ্ধ। তোমার কথাতেই ফিরে এলাম বাস্তবে, আমি বসে সেই বেতের চেয়ারেই, তুমি দাঁড়িয়ে গ্রীলের ঐ পাড়ে। আলো ফুটলে দু একজন নামাজির আনাগোনা শুনা হল রাস্তায়। বুঝলাম আমাদের রাত পোহালো। সারারাত আমরা কাটিয়ে দিলাম কি এক ঘোড়ের মধ্যে। কি সে উপলব্ধি। আমি যেন একরাতের আকাশ ভ্রমণে অনেকটা বড় হয়ে গেলাম। অস্থিরতা, মনের যত সংশয়, ভয় ডর সব উধাও। চট্টগ্রাম ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত কিন্তু অনেক পাওয়া সাথে করে নিয়ে ফিরছিলাম। একেই হয়তো বলে জীবনের পরিপূর্ণতা। একটু মন খারাপ হচ্ছিল কবে আর দেখা হবে তোমার সাথে, সে কথা ভেবে। কিন্তু তোমাকে হারিয়ে ফেলার কোন সংশয় বিন্দুমাত্র ছিল না।

‘’Juliet is saying good night to Romeo. Their sorrowful parting is also `sweet’ because it makes them think about the next time they will see each other” (Shakespeare)

ফারহানা পল্লব

লেখক পরিচিতি

কানাডা প্রবাসী ফারহানা পল্লব একজন লেখক, সঙ্গীত শিল্পী, সাংস্কৃতিক

সংগঠক এবং গ্রাফিকস্ শিল্পী। বর্তমানে তিনি অন্টারিও বাঙ্গালী কালচারাল সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *