জরিপ বলছে এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে জাস্টিন ট্রুডোর ভরাডুবি নিশ্চিত!

অন্যদিকে বিপুুল ভোটে জয়ী হবেন কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পোইলিয়েভ

প্রবাসী কণ্ঠ ॥ সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪ : গত ২৫ সেপ্টেম্বর কানাডার ফেডারেল পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে উত্থাপন করা হয়েছিল এক অনাস্থা প্রস্তাব। কিন্তু এই যাত্রায় বেচে যান তিনি। কারণ অপর দুই বিরোধী দল এনডিপি ও Bloc Québécois এই অনাস্থা প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানায়নি। ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে প্রকাশিত চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেছে অনাস্থা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ২১১ জন এমপি। পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১২০ জন এমপি। দুই জন স্বতন্ত্র এমপি এবং দুই জন গ্রীন পার্টির এমপি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। অপর দুই জন স্বতন্ত্র এমপি ভোট দিয়েছেন প্রস্তাবের পক্ষে।   

কিন্তু বিভিন্ন জরিপ বলছে, এই সময়ে যদি কানাডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তবে লিবারেল পার্টির প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভরাডুবি ঘটবে। আর বিপুল ভোটে জয়ী হবেন প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান ও বিরোধী দলীয় নেতা পিয়েরে পোইলিয়েভ। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারবেন তিনি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন জরিপ ফলাফলের গড় রিপোর্টে এমন ভবিষ্যতবাণীই করা হচ্ছে। রিপোর্ট সিবিসি নিউজ এর।

জাস্টিন ট্রুডোর এই সঙ্কটাপন্ন দশা আসলে গত প্রায় এক বছরের বেশী সময় ধরেই চলছে। তার জনপ্রিয়তা ক্রমেই অধোগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। টলটলায়মান অবস্থায় বিরাজ করছে তার মসনদ। প্রধান বিরোধী দল তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করলে এবং দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকা কোন বিরোধী দল যদি ট্রুডোর প্রতি সমর্থন না দেয় তবে নির্ঘাত তিনি ক্ষমতা হারাবেন এমনই অবস্থা বিরাজ করছে অনেকদিন ধরেই। এনডিপি’র জাগমিত সিং অবশ্য তাকে এতদিন আনুষ্ঠানিক সাপোর্ট দিয়ে আসছিলেন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে। দুই দলের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছিল এই বিষয়ে। কিন্তু সম্প্রতি সেই চুক্তি থেকে বের হয়ে এসেছেন এনডিপি নেতা জাগমিত সিং।

(বাঁ থেকে) Yves-François Blanchet, জাস্টিন ট্রুডো, পিয়েরে পোইলিয়েভ ও জাগমিত সিং। ছবি : সংগৃহীত

আর এই সুযোগে প্রধান বিরোধী দলের নেতা পিয়েরে পোইলিয়েভ বিপুল উৎসাহ নিয়ে মাঠে নেমেছেন জাস্টিন ট্রুডোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। দিন কয়েক আগে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি সংসদে জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবেন। তার হিসাবটা ছিল – জাগমিত যেহেতু সাপোর্ট দিচ্ছেন না সেহেতু অনাস্থা প্রস্তাব নির্ঘাত কাজে দিবে। কিন্তু পোইলিয়েভ এর সেই স্বপ্নে বাধ সাধেন আরেক বিরোধী দলের নেতা Yves-François Blanchet. তিনি Bloc Québécois এর নেতা। পোইলিয়েভ জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনলে তিনি সমর্থন দিবেন না বলে জানিয়েছিলেন দিনকয়েক আগে। অন্যদিকে এনডিপি’র নেতা জাগমিত সিং লিবারেল পার্টির সাথে করা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসলেও অনাস্থা প্রস্তাবে সায় দিবেন না বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও প্রস্তাব পাস হবে না জেনেও কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান পোইলিয়েভ পার্লামেন্টে ট্রুডোর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। অর্থাৎ এই যাত্রায় বেচে যান জাস্টিন ট্রুডো।

তবে প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পোইলিয়েভ জাস্টিন ট্রুডোকে আগাম নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এখন উঠে পড়ে লেগেছেন।

কনজার্ভেটিভ পার্টি ছাড়া অন্য সবকটি বিরোধী দল ও দুই জন স্বতন্ত্র এমপি অনাস্থা প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন না দিলেও পোইলিয়েভ এখানেই থামছেন না। ২৫ সেপ্টেম্বর তার অনাস্থা প্রস্তাব পাস না হলেও পরের দিনই অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর আবার আরেকটি অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন পার্লামেন্টে। পরের সপ্তাহে এটি নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা ও ভোটাভুটি হওয়ার কথা।

তবে এই অনাস্থা প্রস্তাবও পাস হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ এনডিপি ও Bloc Québécois ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে তারা এবারও লিবারেল এর পক্ষেই থাকবে। 

কিন্তু Bloc Québécois এর নেতা Yves-François Blanchet প্রথম অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না দিলেও এবং দ্বিতীয় অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে থাকবেন না এ কথা জানিয়ে দেওয়ার পরও এবার তিনি নিজেই জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে অনাস্থা

প্রস্তাব আনার পরিকল্পনা করছেন শীঘ্রই। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ট্রুডো যদি তার দাবী না মানেন তবে তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। প্রয়োজনে তিনি এনডিপি এবং কনজার্ভেটিভ পার্টির সাথেও এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে জনিয়েছেন। তার দাবী হলো, কানাডায় যাদের বয়স ৬৫ থেকে ৭৪ এর মধ্য তাদের জন্য Old Age Security (OAS) বেনিফিট ১০% বৃদ্ধি করতে হবে। আর এটি করতে হবে আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে। উল্লেখ্য যে, লিবারেল সরকার গত ২০২২ সালে Old Age Security (OAS) বেনিফিট বৃদ্ধি করেছিল শুধুমাত্র যাদের বয়স ৭৫ বা তারও বেশী তাদের জন্য।   

এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী অনাস্থা প্রস্তাবগুলোতে জাস্টিন ট্রুডোর কি পরিনতি হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু রাজনীতির মাঠ যে গরম হয়ে উঠেছে তা স্পষ্টতই টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে রাজনীতির মাঠ যত গরমই হোক, জাস্টিন ট্রুডোও সহজে ক্ষমতা ছাড়ার পাত্র নন। কারণ তিনি মনে করছেন দেশটিকে তিনি সঠিক পথেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তার দলের ভিতরই কেউ কেউ বলছেন এখন সময় এসেছে তার সরে দাঁড়ানোর। এদের মধ্যে কয়েকজন দলীয় এমপিও আছেন। কিন্তু ট্রুডোর সাফ কথা, তিনি নিজে নিজে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রুডো ও তাঁর সরকারের প্রতি জনগণের ব্যাপক অসন্তোষের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে আছে বাড়ির মূল্য ও ভাড়া আকাশচুম্বী হওয়া, দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য সেবা যথাযথভাবে না পাওয়া ইত্যাদি।

জরিপ প্রতিষ্ঠান ইপসোস এর সিইও ডেরিল ব্রিকার ইতিপূর্বে বলেন, “জরিপ থেকে এটা স্পষ্ট, আজ যদি নির্বাচন হয় তাহলে কনজারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে।” জীবনযাত্রার ব্যয়, আবাসনের প্রাপ্যতা ও মূল্যস্ফীতির উল্লেখ করে ব্রিকার বলেন, “এই মুহূর্তে কানাডিয়ানরা যেভাবে ভাবছেন সে বিষয়ে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, তাঁদের মধ্যে দেশ যেদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে সত্যিকারের অসন্তোষ আছে। নির্দিষ্ট করে বললে, সেইসব গুরুতর বিষয়ে যেগুলি তাঁদের ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত।”

কানাডা এখন অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা ও গৃহায়ন সম্পর্কিত যেসব প্রধান সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে সে বিষয়ে জরিপে দেখা যায়, তিনটি ক্ষেত্রেই পয়লিভরে’রই সেরা পরিকল্পনা আছে বলে বহু কানাডিয়ান মনে করেন।

আঞ্চলিক ক্ষেত্রে, কুইবেক ছাড়া প্রতিটি প্রদেশ ও অঞ্চলেই পয়লিভরে’র পক্ষে আনুকূল্য তালিকার শীর্ষে রয়েছে। টেরিটোরিগুলি এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

গত ২৩ ডিসেম্বর গ্লোবাল নিউজে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, “আমি জানি যে লোকেরা আমার প্রতি হতাশ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা যারা ২০১৫ সালের নির্বাচনে লিবারেল পার্টিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনে সহায়তা করেছিল। আট বছর পর আমরা এখন যে বৈশি^ক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেটার কারণে সেদিনের সেই তরুণ প্রজন্ম আজ বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে, নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে এখন তারা চিন্তিত।

কিন্তু তারপরও জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, জনমত যাই হোক, আমি এই পরিস্থিতিতে সরে দাঁড়াচ্ছি না। এটা হাতপা গুটিয়ে নেওয়ার সময় না। বরং আমি দেশবাসীর স্বার্থে আরো জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব।

ট্রুডো আরো বলেছিলেন, আমাদের সরকারে একটা দুর্দান্ত টিম রয়েছে যারা কানাডিয়ানদের বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে আবাসন, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি, জলবায়ুসহ আরো কিছু সমস্যা।

তবে ট্রুডো ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যপারে যতই চেষ্টা করুক, বাস্তবতা এখন তার পক্ষে নয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, কভিড মাহামারীর সময় তার জনপ্রিয়তা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঐ সময়ে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপে দেখা গিয়েছিল তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রয়েছে। ফলে এই সময় নির্বাচন দিলে তিনি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারেন। আর এতে করে বিরোধী দলের চোখ রাঙ্গানি বা অনাস্থা প্রস্তাবের তোয়াক্কা না করেই সরকার পরিচালনা করতে পারবেন নির্বিঘ্নে। আর সেই আশায়ই তিনি মাহামারীর সময় মেয়াদ পূর্ণ হবার প্রায় দুই বছর আগেই জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন।

বিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে ঐ সময় বলা হয়েছিল, জাস্টিন ট্রুডো যখন নির্বাচনের ডাক দেন তখন পরিস্থিতি তাঁর অনুকুলেই ছিল। কানাডিয়ানরাও বেশ খুশি ছিল দেশ যে ভাবে চলছিল এবং মহামারী মোকাবেলায় সরকার যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছিল সে ব্যাপারে। বিভিন্ন জরিপে সেরকম তথ্যই দেখা যাচ্ছিল। প্রথম দিকে অবশ্য ভ্যাকসিন সংকটের কারণে কিছুটা হোচট খেয়েছিল সরকার। কিন্তু পরবর্তীতে বেশ দ্রুতই দেশের ব্যাপক সংখ্যক অধিবাসী ভ্যাকসিনের আওতায় চলে আসেন। বিভিন্ন প্রভিন্সে লকডাউন শিথিল করা হয়। লোকজন সামারও উপভোগ করেন অনেকটা নির্ভয়ে। কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রাক্তন ক্যাম্পেইং ম্যানেজার জেনি বায়ার্ন বিবিসি-কে তখন বলেন, ‘সপ্তাহ তিনেক আগেও আমি যখন লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি তখন তাঁরা এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে নির্বাচনে লিবারেল পার্টির জয় খুব সজহ হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে এসে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। লিবারেলের অবস্থান তখন পাল্টে যেতে থাকে।’

মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এ্যালেক্স মারল্যান্ড তখন বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘কানাডার জনগণ অনেকটা বিস্মিত হয়েছেন এই ভেবে যে, ট্রুডো কেন মেয়াদ পূর্তির দুই বছর আগেই নির্বাচনের ডাক দিলেন। তিনি এ বিষয়ে সন্তোষজনক কোন উত্তর দেননি যে কারণে ভোটারদের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক হয়েছে এবং তাঁরা হতাশ এ ব্যাপারে।’

তখন যেটা লক্ষ্য করা গিয়েছিল তা হলো, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে কানাডার রাজনৈতিক মঞ্চের দৃশ্যপট। তারিখ ঘোষণার মাত্র কয়েক মাস আগেও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির অবস্থা তখন হয়ে উঠে টালমাটাল। প্রতিদিনই কমতে থাকে দলটির জনপ্রিয়তা। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো দূরের কথা তখন কোনরকমে জিততে পারে কি না সেই নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে পায়ের তলায় মাটি ছিল না এমন প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছিল। শুধু তাই নয়, এই দলটি নির্বাচনে জিতে যাবে এমন তথ্যই মিলছিল বিভিন্ন জরিপ থেকে।

তবে সেই যাত্রায় ট্রুডোর দল নির্বাচনে জিতে গিয়েছিল। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। অর্থাৎ লিবারেল পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য সেই সময়ের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্র–ডো নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেটা অধরাই থেকে গিয়েছিল। বিশ্লেষকরা তখন বলেছিলেন, ঐ জাতীয় নির্বাচনে আসলে কেউ জেতেনি। ফলাফল দুই বছর আগের (২০১৯ সালের) জাতীয় নির্বাচনের অনুরূপই হয়েছে। ফলে গতবারের মতো সংখ্যালঘু সরকার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ট্র–ডোকে।

এটা ছিল কানাডার ৪৪তম জাতীয় নির্বাচন। ফলাফলে দেখা গিয়েছিল ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি ১৫৮টি আসন পেয়েছিল। ২০১৯ সালের চেয়ে যা একটি আসন বেশি মাত্র।

সেই থেকে জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা আর বৃদ্ধি পায়নি। বরং ক্রমেই তা হ্রাস পেতে থাকে। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নেমেছে যে নির্ধারিত সময়ের (অক্টোবর ২০, ২০২৫) নির্বাচনে অথবা এই মুহুর্তেও যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তবে তিনি হারবেন। এই পরিস্থিতি অবশ্য গত প্রায় এক বছর ধরেই বিরাজ করছে।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পুল ট্রাকারের প্রতিবেদনেও তাই বলা হচ্ছে। পুল ট্রাকার কর্তৃক প্রকাশিত ফলাফল কোন একক জরিপ প্রতিষ্ঠানের নয়। সবগুলো জরিপ প্রতিষ্ঠানে প্রকাশিত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে একটি গড় হিসাব তুলে ধরে সিবিসি নিউজের পুল ট্রাকার। ফলে এর ওপর অনেকটাই বিশ্বাস স্থাপন করা যেতে পারে। 

অন্যদিকে জরিপ ফলাফল ছাড়াও দেখা গেছে গত কয়েকটি উপনির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টির প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। উপনির্বাচনের এই ফলাফলও ইঙ্গিত দিচ্ছে তার ও তার দলের জনপ্রিয়তা এখন তলানীতে।

গত বছর অক্টোবরে প্রকাশিত এক জরিপেও দেখা গেছে, কানাডিয়ানরা মনে করছেন, ট্রুডো হলেন গত ৫৫ বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে কম পছন্দের প্রধানমন্ত্রী। রিসার্চ কো. নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জনমত জরিপে এমনটাই জানা গেছে। জরিপের এই রিপোর্টটি ঐ সময় প্রকাশ করেছিল নাউ.কম পত্রিকা।

সেই পরিস্থিতির কোন উন্নতি আর লক্ষ্য করা যায়নি গত এক বছরে। জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা এখনো সেই তলানিতেই রয়ে গেছে।

সিবিসি নিউজের পুল ট্রাকার এর তথ্য অনুয়ায়ী আরো দেখা যাচ্ছে যে এই সময়ে কানাডায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে কনজার্ভেটিভ পার্টি দুই শতাধিক আসনে জয়ী হবে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত আসন সংখ্যা এটি। কানাডার আইন অনুযায়ী সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে ১৭০ টি আসনে জয়ী হতে হবে। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশী আসন। কানাডার জাতীয় সংসদে মোট আসনের সংখ্যা ৩৩৮টি। 

পুল ট্রাকার এর তথ্য অনুযায়ী আরো দেখা যাচ্ছে যে, এই সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে Bloc Québécois এর আসন সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এনডিপি তার কিছু আসন হারাতে পারে। কানাডায় স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য ফ্রি ডেন্টাল কেয়ার এর ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে চাপ দিয়েছিল এই দলটি। উদ্দেশ্য ছিল ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়ানো। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, কেন্দ্রীয় সরকার গত বছর ডিসেম্বর মাসে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত কানাডিয়ান ডেন্টাল কেয়ার প্ল্যানের বিস্তারিত প্রকাশ করে। এর ফলে ব্যক্তিগত বীমা নেই এমন নিম্ন ও মাঝারি আয়ের নাগরিকরা সুবিধা পাবেন। গ্লোবাল নিউজ তখন এই তথ্য জানায়।

সিডিসিপি নামে পরিচিত এই পরিকল্পনার জন্ম হয় ২০২২ সালে এনডিপি দলের সঙ্গে লিবারেল দলের supply-and-confidence deal চুক্তি তথা সরকার গঠনে সমর্থনের বিনিময় হিসাবে। এই পরিকল্পনায় ৯০,০০০ ডলারের নিচে উপার্জনকারী যেসব পরিবার বীমার আওতার বাইরে রয়েছে তাদেরকে সরাসরি দাঁতের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য যে, স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য ইতিপূর্বে ফ্রি ডেন্টাল কেয়ার এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অন্টারিও’র নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি-ও। তবে তাদের শর্ত ছিল নির্বাচনে তাদেরকে জয়ী করতে হবে। অর্থাৎ ভোট দিলে দাঁতের উপকার হবে আর ভোট না দিলে হবে না! এই শর্ত দেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনের আগে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সে বছর ড্যাগ ফোর্ডের কনজার্ভেটিভ পার্টি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিল। অন্যদিকে সে সময়ে ক্ষমতাসীন দল অন্টারিও লিবারেল পার্টির পরাজয় ঘটেছিল অত্যন্ত করুণভাবে। মাত্র সাতটি আসন পেয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় দলটি। ঐ সময় বিরোধী দলের স্ট্যাটাসও হারায় তারা। তারপর থেকে দলটি এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

তবে জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে ফেডারেল লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় এসে প্রথম টার্মে বেশ ভাল অবস্থানেই ছিল। প্রথমবারের সেই উত্তেজনাপূর্ণ বিজয় তাকে এনে দিয়েছিল আরো কিছু খ্যাতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিভিন্ন নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও ডিরেক্টরদের কাছে তিনি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। এ কথা বলেন কানাডিয়ান প্রেস এর প্রধান সম্পাদক স্টিফেন মুরিস।

নির্বাচনের জয় পরাজয় সবসময়ই বড় মাপের সংবাদ  হয়ে থাকে। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডোর জয় ছিল ঐতিহাসিক এবং এই বিজয় তাকে অনেক নিউজ মিডিয়া কর্মীদের কাছে আলাদা চরিত্র হিসাবে দাঁড় করিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক মহলেও তার উচ্চ প্রশংসাধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। নির্বাচনে জীয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহনের পরপরই জাস্টিন ট্রুডো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং ঐ সম্মেলনগুলোতে তিনি ছিলেন সকলের মধ্যমনি। সিরিয়ার রিফিউজিদের গ্রহণ করেও তিনি আন্তর্জাতিক মহলে প্রচুর সম্মান লাভ করেন। এ সমস্ত কিছু মিলিয়ে তিনি ২০১৫ সালে নিউজমেকার অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন কানাডায়।

শুধু রাজনৈতিকভাবেই যে জাস্টিন ট্রুডো কানাডা ও অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমের নজর কেড়েছেন তা নয়। তার ব্যক্তি ইমেজ ও সুদর্শন অবয়বও নজর কেড়েছে অনেকের। আমেরিকার খ্যতিমান ও জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ভোগ এর কভার ম্যান হিসাবেও এসেছেন তিনি। ভোগ ম্যাগাজিনের কভারে সাধারণত মুভি স্টার বা ফ্যাশন স্টারদেরকে আনা হয়। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডোর বেলায় সেই রীতি ভঙ্গ করা হয়েছে। ভোগ ম্যাগাজিনে জাস্টিন ট্রুডোকে তারুন্যে ভরপুর ও আশাবাদী এক নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।

কিন্তু দিনে দিনে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এর মধ্যে অবশ্য গোটা পৃথিবী অভাবনীয় এক ঘটনার সাক্ষী হয়। সেটি হলো কভিড-১৯ বা করোনা মহামারী। গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি এক বড় রকমের ধাক্কা খায় সেই মাহামারীর কারণে। অর্থনীতিতে দেখা দেয় মহামন্দা। সেই মহামন্দার ধাক্কা খায় কানাডাও। তবে জাস্টিন ট্রুডো সেই যাত্রায় দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যান। সে কারণে কানাডিয়ানরা তাকে সেরা নেতা হিসাবে বিবেচনা করছিলেন তখন। দি কানাডিয়ান প্রেস-এ তখন এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল। জরিপে অংশ নেওয়া ভোটাররা তখন ট্রুডোকে বেশ বড় ব্যবধানে অন্যতম দৃঢ়সংকল্প, বুদ্ধিদীপ্ত ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা এবং সবচেয়ে সেরা যোগাযোগকারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে বর্ণনা করেন। তাকে তখন দেখা হয় অন্যতম যত্নশীল এবং দরদী মানুষ হিসাবেও।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বাস্তবতা হলো সেই দৃঢ়সংকল্প, বুদ্ধিদীপ্ত, ক্যারিশম্যাটিক ও দরদী মানুষটা এখন আর বেশীর ভাগ কানাডিয়ানের পছন্দের তালিকায় নেই। আগামী বছর নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হোক বা অনাস্থার কারণে আগামী এক দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন হোক, বিভিন্ন জরিপ প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতবাণী বলছে জাস্টিন ট্রুডোর পরাজয় এখন অবশ্যম্ভাবী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *