নতুন দেশে খাপ খাইয়ে নেয়া

সুকাইনা জাফির

অভিবাসীরা তাদের বসবাসের জন্য বেছে নেয়া নতুন দেশে আসার পর কেমন বোধ করেন সেটা অনুভব করা খুবই কঠিন। সারা বছর গ্রীষ্মের পোশাক পরে কাটানোর পর হঠাৎ করে বরফের গুদামের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা চিন্তা করুন। খাবারের ঘ্রাণ থেকে শুরু করে আপনার প্রার্থনার আওয়াজ, শরীরে চাপানো কাপড়-চোপড় এমনকি কাজের ধরণ পর্যন্ত নতুন করে শুরু করতে হলে আপনি কেমন বোধ করবেন সেটা ভেবে দেখুন। আর নারীরা কীভাবে খাপ খাইয়ে নেন যখন তাদের ভাষাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

নতুন দেশে সফল হবার মত অবস্থানে আসতে পুরো অন্টারিও প্রদেশে নারীরা খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য কাজ করছেন।

২০১৬ সালে সিঙ্গাপুর থেকে অভিবাসী হিসাবে আসা হেদায়া আল দালিল-এর পরিবারের জন্য এখানকার আবহাওয়া ছিল রীতিমত পীড়াদায়ক। নিজের দেশের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়া থেকে আসার কারণে এখানে শীতের ওভারকোট চাপিয়ে রাখার ব্যাপারটা তাদের কাছে একেবারেই অচেনা। আল দালিল স্বীকার করেন, “(এখানে) আমাদের প্রথম শীতটা ছিলো কঠিন। বাচ্চারা তুষারপাত পছন্দ করেছে, কিন্তু তুষারের মধ্যে হাঁটতে বা গাড়ি চালাতে ভয় পেতো।”

মারিয়া সল পাজাদুরা ও তার পরিবার। ছবি : ইসাবের ইনক্ল্যান

এখানে এসে তারা যখন নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন সেই সময় আর্থিক সীমাবদ্ধতাও ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, “প্রথম কয়েক মাস ছিলো সবচেয়ে কঠিন। কারণ ওই সময়গুলো ছিলো অনিশ্চয়তায় ভরা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনওরকম স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। আমরা আল্লাহর আনুকূল্য পেয়েছি, কারণ এখানে আসার প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই আমার স্বামী একটি কাজ জুটিয়ে নিতে পেরেছিলেন, কিন্তু পেশাগত ‘অবনমন’এর ধারণা একটি অব্যাহত লড়াই জারি রাখবে।” 

প্রাথমিকভাবে আল দালিল একটি সেলুন ও স্পা সেন্টারে কিছুটা জায়গা ভাড়া নিয়ে সেখানে নিজের ম্যাসাজের কাজ শুরু করেন। তিনি ডর্ন-পদ্ধতিতে ম্যাসাজের মাধ্যমে মানুষের ঘাড়, কাঁধ ও পিঠের বেদনা দূর করার চিকিৎসা করেন। এই ম্যাসাজের ব্যাপারটা বেশ নিরাপদ ও বেদনাহীন হলেও কানাডায় এটি খুই বিরল এবং সেজন্যে এটি কোনও বীমার আওতায় পড়ে না। ফলে কয়েক মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাবার পর ব্যবসাটি

বন্ধ হয়ে যায়। আল দালিল স্মরণ করেন, “আমার পাশে কোনও নেটওয়ার্ক, সামাজিক পরিমণ্ডল বা সমর্থনকারী না থাকায় আমার পক্ষে খদ্দেরের বাজার তৈরি করাটা ছিলো কঠিনতর।”  তবে এতে হতোদ্যম না হয়ে আল দালিল বিভিন্ন কৌশলের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য পিল এলাকার নবাগতদের সেন্টারে একটি বৈশ্বিক ব্যবসায় বিষয়ক কোর্সে ভর্তি হন।

সেই কোর্স তার জন্য “অর্থনীতি, করনীতি, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিপনন এবং ব্যবসায়িক যোগাযোগ ইত্যাদি এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক পড়ে তোলার বিষয়গুলো বুঝতে সহায়ক হয়।” তিনজন উপদেষ্টার সঙ্গে কাজ করার ফলে তিনি নিজের আগ্রহের বিষয়গুলো খুঁজে পান। আল দালিল বলেন, “এটি ছিলো পড়ালেখার এক দারুণ অভিজ্ঞতা যা আমাকে নিজেকে গড়ে তোলার ভিত্তি সরবরাহ করেছে।” 

সাংস্কৃতিক বাধা

নবাগতদের জন্য বৈষম্য একটি বড় সাংস্কৃতিক বাধা বলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অনেকে উল্লেখ করেন। আমাদের এখানে বোনাস রাউন্ডসহ অবাধে ক্যাসিনো খেলার ব্যবস্থা আছে যেখানে কোনও রকম ডাউনলোড না করে, রেজিস্ট্রেশন না করে এবং সাইন আপ না করেও খেলা যায়। ইচ্ছা করলে আপনি এই মুহূর্তেই বিনা মূল্যে পোকি খেলতে পারেন। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের  সহযোগী অধ্যাপক  ড. সোমা চ্যাটার্জি ব্যাখ্যা করে বলেন, “কানাডীয়দের মূল ধারার চিন্তা-ভাবনা অবশিষ্ট বিশ্বের চেয়ে বেশি প্রগতিশীল। আমি অনেক অভিবাসী নারীকে চিনি যারা অগ্রসর মান অনুযায়ী মূল্যায়ন পেতে চাপের মধ্যে আছেন।”

তিনি উল্লেখ করেন যে, নবাগতরা বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে বৈষম্যের শিকার হতে পারেন। তারা যেসব জিনিস রান্না করেন সে সম্পর্কে আপত্তিকর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে তাদেরকে বাড়িভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। এসব কারণে অনেক অভিবাসীকে হয়তো তাদের সাংস্কৃতিক চেতনার গভীরে প্রোথিত কিছু মূল্যবোধ পাল্টাতে হয়।

এছাড়াও, এদেশে খাপখাইয়ে নেওয়ার সময় যদি ভাষাগত বাধা থাকে তাহলে সেই অভিবাসীর জন্য সময়টা সহজ হয় না। যেমনটা ঘটেছে এসরা আলীর ক্ষেত্রে। ইরাক থেকে এদেশে আসার পর তার জন্য সবচেয়ে বড় লড়াইটা ছিলো ইংরেজি শেখা নিয়ে। এটি এমন একটি বড় সমস্যা যা পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়। ৭০ শতাংশেরও বেশি অভিবাসীরই ইংরেজি বা ফরাসীর বাইরে অন্য একটি মাতৃভাষা আছে।

যেহেতু ইসরা আলী নিজের দেশে জীববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী সেজন্যে এখন তার খণ্ডকালীন চাকরির অংশ হিসাবে তাকে একটি স্কুলের ডাইনিং রুমের পর্যবেক্ষক এবং স্কুলটিতে শিক্ষক সরবরাহের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তিনি স্বল্প সময়ের কাজই পছন্দ করেন যাতে নিজের বাচ্চাদের পেছনে বেশি সময় দেওয়া যায়। মধ্যবয়সী মহিলা অভিবাসীদের ৩২ শতাংশই নিজের সন্তানদের যত্নে বেশি সময় দেওয়ার জন্য আলীর মত একই ধরণের সিদ্ধান্ত নেন।

খাপখাওয়ানো খুব কঠিন

২০১৬ সালের আগস্টে দুবাই থেকে অভিবাসী হিসাবে টরন্টোতে আসা পাকিস্তানী নাগরিক সাদাফ হুসেইনের জন্য এদেশে খাপ-খাইয়ে নেওয়ার ব্যপারটা ছিলো ভয়ানক কঠিন। তার স্বামী আমিরাতে চাকরিরত থাকার কারণে তিনি দুই বাচ্চাকে নিয়ে একাই এদেশে আসেন।

হুসেইন জানান, প্রিয়জনকে ফেলে আসাটাই ছিলো তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্যে প্রথম কয়েক মাস তাকে ভুগতে হয়েছে চরম একাকীত্ব বোধে। এই অনুভূতি তীব্রতর হয়েছে শীতকালে যখন দিনগুলো ছোট হয়ে এসেছে এবং বাইরে কাজ করার মত অবস্থাও ছিলো না।

মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য তাকে প্রায়ই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়ানোর সময় তিনি রীতিমত হতাশায় ভুগেছেন। তিনি বলেন, “প্রয়োজনীয় জিনিসটি কোথায় বিক্রি হয় সেটা খুঁজে বের করার জন্য আমাকে একের পর এক সুপারমার্কেটগুলোতে ঢু মারতে হয়েছে।” এর চেয়েও পীড়াদায়ক ছিলো স্থানীয় বাজারে কেনা জিনিসগুলোর দাম তার দেশের মুদ্রায় কত হয় সেই হিসাব কষা।

এমনকি সাধারণ কাজগুলো, যেমন বরফের ওপর দিয়ে গাড়ি চালানো অনেক সময় কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। কারণ তিনি কখনই বরফের দেশে বসবাস করেননি।

অন্য জায়গায় তিনি যে সামাজিক উষ্ণ পরিমণ্ডল পেয়েছেন সেটাও তার মনে পড়েছে। “দিনে পাঁচবার নামাজের জন্য আজান সম্প্রচারের বিষয়টি খুব মনে পড়েছে। আমার মনে পড়েছে রমজান মাস কেমন উৎসবমুখর ছিলো এবং কীভাবে আমিরাতের মানুষ একসঙ্গে রোজার ইফতার গ্রহণ করেছে (এক্ষেত্রে কামান দেগে বার্তা দেয়া হয়)।”

ধীরে ধীরে তিনি তার প্রাথমিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে শিখেছেন এবং এখন যেটিকে তার নিজের দেশ বলেন  সেখানে আরও বেশি সময় কাটার সঙোগ সঙ্গে নিজেকে খাপ-খাইয়ে নিতে পারছেন।

সামাজিকতার বোধ

অনেক অভিবাসীর কাছে তার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বেশ কয়েকটি দেশে বসবাসের কারণে আল দালিল কানাডায় যে বৈচিত্র্য রয়েছে সে বিষয়ে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি নিজের বাচ্চাদেরকে তাদের সাংস্কৃতিক শেকড় সম্পর্কে নিয়মিত শিক্ষা দেন। তিনি বলেন, “আমার সন্তানদের জন্য নতুন কানাডীয় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচিতি রক্ষা করা জরুরী।”

তাদের অনেক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পাল্টাতে বাধ্য হতে হলেও উভয় নারীই কানাডায় পাওয়া জীবনাচারের জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করেন।

আল দালিল আরও বলেন, “এখানে ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও পেশা পরিবর্তনের প্রভূত সুযোগ রয়েছে। আমি এটা শিখেছি যে, কানাডায় আপনি যে কাজ করবেন সেটি জানতে চাইবে না আপনি কে অথবা কেন আপনি কী হতে চান। যেমনটা অন্য অনেক জায়গায় করা হয়। এখানে আপনি বড় স্বপ্ন দেখতে পারেন…।”

(প্রতিবেদক সুকাইনা জাফির সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসাবে তিনি নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া, গার্ডিয়ান আনলিমিটেড এবং ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় লিখেছেন।)

– সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ