সুফিবাদ ও বাংলাদেশ

প্রথম অধ্যায়
বাংলাদেশে সুফিবাদ ও এনায়েতপুরী তরিকা

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার পর ইসলামি মতাদর্শ আরব উপদ্বীপের বাইরে প্রচারে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁরা হলেন আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত, রাসূলুল্লাহর প্রেমাপ্লুত, অধ্যাত্মসাধনায় সিদ্ধ এবং আধ্যাত্মিকজ্ঞানে সমৃদ্ধ সাধু-পুরুষ। সর্ব সাধারণের নিকট তাঁরা পীর, দরবেশ, সুফিসাধক বা অলী-আউলিয়া নামে পরিচিত। তাঁদের মানবিক অবদান অতুলনীয়, সামাজিক সংস্কার অসামান্য এবং পৃথিবীর দিকবিদিকে বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে ইসলামি বিধান প্রচার, প্রসার এবং চর্চায় এঁদের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়। কুরআন-হাদিসে প্রদর্শিত এবং নির্দেশিত এবং তাঁদের প্রচারিত পথই ইসলামি মরমীবাদ বা সুফিবাদ নামে পরিচিত।

‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি
‘সুফিবাদ’ শব্দটার উৎপত্তি আলোচনা করার পূর্বে ‘সুফি’ শব্দটার অর্থ ও তাৎপর্য আলোচনা করা প্রয়োজন। ‘সুফি’ শব্দটা মূল আরবী ধাতু ‘সাফা’ (পবিত্রতা), ‘সুফ’ (পশম), ‘সাফ’ (সারি) এবং ‘সুফ্ফা’ (মসজিদে নব্বীর ভিতর উঁচু মেঝে) প্রভৃতি থেকে উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। আবার, ইবনে আল-জাওযি মনে করেন যে, প্রাক-ইসলামি যুগে ‘সুফাহ’ নামে একদল লোক সর্বদা কাবা শরীফের খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন।

খাজা এনায়েতপুরীর জীবনদর্শনের আলোকে
তাঁর মতে, এই ‘সুফাহ’ থেকে ‘সুফি’ শব্দটা এসেছে। একাদশ শতকের প্রখ্যাত সুফি দার্শনিক আল-কুশায়রী (৯৮৬ – ১০৭৪) [al-Qushayri] বাচনিক বা শাব্দিক সাদৃশের ভিত্তিতে ‘সুফি’ কথাটার উৎপত্তি যুক্তিসঙ্গত নয় বলে মনে করেন, কেননা ভাষাগত দূর্বোধ্যতা এর সবচেয়ে বড় বাধা।
অন্যদিকে, অধিকাংশ গবেষক মনে করেন যে, উপরে বর্ণিত কোন না কোন শব্দ থেকে ‘সুফি’ শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে। যেমন, আল-সোহরাওয়ার্দী (১১৪৪ – ১২৩৪) [al-Suhrawardi] মনে করেন যে, ‘সুফ’ (পশম) শব্দ থেকেই ‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে এবং তিনি এ বিষয়ে হযরত আনাস থেকে বর্ণিত একটি হাদিসের উল্লে­খ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার এক কৃতদাসের নিকট থেকে দাওয়াত পান এবং তা তিনি কবুল করেন। তার ঘরে যাবার জন্য সেদিন তিনি উটের পরিবর্তে গাধাকে বাহন হিসেবে নিয়েছিলেন এবং ‘সুফ’ (পশম)-এর কাপড় পরিধান করেছিলেন। তাঁর সাথে যে-সকল সাহাবা কেরাম ছিলেন তাঁরাও সবাই ‘সুফের’ কাপড় পরিধান করেছিলেন। যেমন, হযরত উমর (রা.) এবং হযরত সালমান ফারসী (রা.) ‘সুফের’ (পশমী) কাপড় পরিধান করেছিলেন। ইবনে খালদুন (১৩৩২ – ১৪০৬) এই মতকে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। কারণ, ব্যুৎপত্তিগত অর্থে এবং সুফিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ‘সুফ’ থেকে ‘সুফির’ উৎপত্তি অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। অন্যদিকে, আলী হুযউরী (৯৯০ – ১০৭২) [Ali Hujwiri], যিনি ‘দাতা গঞ্জ বখশ’ নামে পরিচিত, মনে করেন যে, শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কোন কিছুর নামকরণ করা ঠিক নয়। তাঁর মতে ‘সাফা’ (পবিত্রতা) কথাটা থেকে ‘সুফি’ কথাটার উৎপত্তি একটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য মত, কেননা যাঁরা পবিত্র জীবনযাপন করেন ও আধ্যাত্মিক সূক্ষজ্ঞানে বলীয়ান তাঁদেরকেই ‘সুফি’ বলে অভিহিত করা হয়।

সুফি পেইন্টিং । এঁকেছেন মুাহাম্মদ সুলেমান রেহমান (সাচ্চি আর্ট)

নবম ও দশম শতকের দিকে, অর্থাৎ সুফিবাদের বিকাশের গোড়ার দিকে, সুফিদের নৈতিক, আধ্যাত্মিক তথা অতি উচ্চমানের ধর্মীয় জীবনযাপনের ওপর গুরুত্বসহকারে সুফি গ্রন্থাদি রচিত হত। দশম ও একাদশ শতকে আরবীতে সুফিবাদের ওপর নিবন্ধে ‘সুফি অভিধান’ সংযোজিত হয়েছিল। যেমন, আবু নসর আল-সারাজ (মৃ. ৯৮৮) তাঁর কিতাব আল-লুমা ফিত-তাসাউফ গ্রন্থে ১৫৫টি সুফি শব্দের পরিভাষা সংযোজন করেন। কুরআনে ব্যবহৃত শব্দাবলী নিয়েই যে সুফিরা সে-সময় সুফি-নিবন্ধ রচনা করতেন সে-বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। এ সময় সঙ্গত কারণেই সুফি গবেষক ও লেখকদের সুফি-রচনায় একটা প্রচেষ্টা ছিল সুফিদের সঙ্গে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্বন্ধ অনুসন্ধান করা। এদিক থেকে ‘সুফি’ শব্দটা ঐতিহাসিকভাবে আরবী ‘সুফ্ফা’ শব্দের সঙ্গে সংযুক্ত বলে মনে করা হয়। আরবী ‘সুফ্ফা’ শব্দের অর্থ ‘বেঞ্চ’ বা ‘উঁচু মেঝে’। মদিনা মনোয়ারায় মসজিদে নববীর ভিতরে যে উঁচু স্থান থেকে নামাযের ইমামতি করা হয় তাকে ‘সুফ্ফা’ বলে। আরবী ‘সুফ্ফা’ কথাটা থেকে ইংরেজি ‘সোফা’ (sofa) কথাটা এসেছে। ‘সুফ্ফা’ কথাটার ঐতিহাসিক ভিত্তি হিসেবে অভিমত আছে যে, রাসূলুল্লাহার একদল সাহাবা (বেঞ্চের সাহাবা) ছিলেন, যারা গৃহহীন এবং সহায় সম্বলহীন। এ-সকল গৃহহীন সাহাবাগণ যা খাবার পেতেন তা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে খেতেন এবং নিদ্রার সময় হলে বেঞ্চের উপর শয়ন করতেন। একইভাবে, আর একটি ঐতিহাসিক মত হলো, ‘আসহাব আস-সুফ্ফা’ থেকে ‘সুফি’ শব্দটার উৎপত্তি। রাসূলুল্লাহার মসজিদে নব্বীর বারান্দায় একদল সাহাবা নামাযে, ওজিফাতে এবং কুরআনের নাযিলকৃত বাণী স্মৃতিতে ধরে রাখতে অধিকাংশ সময় কাটাতেন। এঁরা ‘আসহাব আস-সুফ্ফা’ (বারান্দার সাহাবা) নামে অভিহিত ছিলেন।
যারা সুফিবাদকে গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করেন তাঁদের মতে গ্রিক শব্দ ‘সফস’ (sofos) বা ‘জ্ঞান’ থেকে ‘সুফি’ কথাটা এসেছে। যেহেতু ‘সুফি’ শব্দটা ‘জ্ঞানের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত আর গ্রিক দর্শনের ‘সোফিস্টরা’ (Sophists) জ্ঞানী বলে পরিচিত, তাই এরুপ ধারণা করা হয়। এটি একটি অমূলক চিন্তা। নিছক শব্দের উচ্চারণগত কিংবা শাব্দিক সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে কোন বিষয়ের নামকরণ অযৌক্তিক। সুফিদের তথা মুসলমানের নামায, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত, যিকর, মুরাকাবা কি গ্রিক দর্শনে পাওয়া যায়? সুফিরা শরিয়তের বিরোধী নয়। খাজা এনায়েতপুরীর সুফিবাদ পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, সুফিবাদ গ্রিক দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত কোন মরমীদর্শন নয়, বরং এটি যে ইসলামের অন্তর্নিহিত মরমী ভাবধারা তাতে সন্দেহ নেই।

সুফি কে?

কুশায়রীর মতে, ‘সুফি’ পদটি আরবী শব্দ ‘সাফ্ওয়া’, অর্থাৎ ‘মনোনিত’-এর সঙ্গে জড়িত। সুফিদের তিনি ‘আল্ল­াহর মনোনিত’ ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করে বলেন যে, “আল্লাহ তাঁর বন্ধুদের মধ্য থেকে এদেরকে মনোনিত করেন এবং তাঁর রাসূল ও নবীদের পরে অন্যান্য ইবাদতকারীর উপরে তাঁদেরকে সম্মানিত করেন এবং তিনি তাঁদের সব ধরণের প্রতিকুলতা থেকে মুক্ত করেন।” সুফিবাদ সুফিদের ক্বলবের বিশুদ্ধতার কথা বলে, আর এজন্য একজন সুফিকে কঠোর নৈতিক জীবনযাপন করতে হয়, ত্যাগের মহিমায় মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হয়, আর যিকর এবং মুরাকাবায় দেলকে (ক্বল্ব) তাজা করে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করতে হয়। একবাক্যে একজন সুফির মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। মাশুকের সঙ্গে আশিকের মিলন। এ মিলনের ব্যাকুলতা আমরা বাউলদের মধ্যেও খুঁজে পাই। তাইতো লালন গেয়েছেন ‘মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষের সনে’। বস্তুত: বাঙলায় সুফিবাদের প্রভাব বাউলদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
সুফিবাদ হলো নফসের মধ্যে মরে যাওয়া এবং আল্লাহতে বেঁচে ওঠা। এটা দৈহিক মৃত্যু নয়। আমাদের চেতনার নিম্নস্তরের (নফসের), যা কামনা-বাসনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তার বিলুপ্তিসাধন। এজন্য একজন সুফির কৃচ্ছতাসাধনের, আত্মসংযমের, আত্মসংবরণের ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের প্রয়োজন পড়ে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে একজন প্রকৃত সুফি হলেন তিনি যার ধন আছে কিন্তু তিনি দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করেন, তাঁর সম্মুখে খাদ্য আছে কিন্তু তিনি ক্ষুধার্ত থাকেন, তাঁর ক্ষমতা আছে কিন্তু তিনি বিনয়ী হন এবং তাঁর খ্যাতি আছে অথচ তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন।

সুফিবাদের প্রবক্তা কে? সকল সিলসিলার উৎস রাসূলুল্লাহ (সা.)। সকল সুফির আধ্যাত্মিক মুর্শিদ রাসূলুল্লাহ (সা.)। কিন্তু আমাদের জানা মতে, ‘সুফি’ উপাধিটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয় সিরিয়ার অধিবাসী আবু হাশিম আল-সুফি (মৃ. ৭৬৭)-এর ক্ষেত্রে। তবে তাঁর আগে বা সময়ে সুফিবাদ অনুসরণকারী ছিলেন, কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রেই সর্বপ্রথম ‘সুফি’ উপাধিটি ব্যবহার করা হয়।

সুফিবাদ: উৎস, আকরগ্রন্থ ও ভিন-সংস্কৃতি

সুফিবাদের উৎপত্তি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এ সম্পর্কে মূলত: দু’টি মত আছে। প্রথমটি হলো: সুফিবাদ ভিন-সংস্কৃতির (অইসলামি) উপাদান দ্বারা প্রভাবিত একটি ইসলামি উপধারা। আর দ্বিতীয়টি হলো: সুফিবাদ ইসলামের মরমীবাদী চিন্তার ফসল, কুরআন এবং সুন্নাহ হলো যার উপকরণ। কিছু অমুসলিম শিক্ষাবিদ-গবেষক এবং কিছু মুসলিম পন্ডিত, যারা ইসলামের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেন (যেমন, মৌলবাদী ও ওহাবীপন্থী), তারা প্রথম মতটির ধারক। ইউরোপীয় ‘ওরিয়েন্টালিস্টরা’ সুফিবাদকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখেছেন। অমুসলিমরা ইসলামের ওপর গবেষণায় ইসলামের ভক্তিমূলক এবং আধ্যাত্মিক দিকের পরিবর্তে সর্বদা এর ব্যবহারিক, আইনগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মানুষের নৃতাত্তিক ও ধর্মের সমাজতাত্তিক গবেষণায় এখন দেখানো হয় যে, মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাবাহিকতায় তার ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক আকাঙ্খার জন্ম হয়। পাশ্চাত্যে ইসলামকে এখন রাজনৈতিক-ইসলাম (political Islam) হিসেবে দেখা হয়। ইসলামের আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও ভক্তিবাদী দিকের চেয়ে পাশ্চাত্যের নৃতাত্তিক গবেষকরা এবং প্রচার-মাধ্যম ইসলামকে ‘সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়’ (socio-political phenomenon) হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহকে ইসলামের নবী বা বার্তাবাহক হিসেবে জানার চেষ্টা করেন না, বরং তাঁকে একজন রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা হিসেবে দেখেন, আর সুফিবাদকে ইসলাম-বহির্ভূত অইসলামি ভাবধারার সংমিশ্রিত বিষয় বলে ধারণা করেন।

ইসলামি ধর্মীয় চিন্তার ওপর ভিন-সংস্কৃতির প্রভাব হিসেবে সুফিবাদের বিকাশ সাধিত হয়েছে বলে যারা মনে করেন তাঁরা মূলত: পাশ্চাত্যের হেলেনস্টিক ও নব্য-প্লেটোবাদী ধারণা এবং প্রাচ্যের তথা ভারতের বৈদিক ও বৌদ্ধিক দর্শনের প্রভাবের কথা বলেন। তাঁরা সাধারণত কিছু সুফিচিন্তা ও আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে অন্যান্য মরমীবাদী দর্শনের সাদৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সুফিবাদ ইসলাম-বহির্ভূত অন্যান্য মরমী দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত। এটিকে যুক্তিবিদ্যার ভাষায় ‘হেত্বাভাস’ (fallacy) বলে, কেননা দুই বা ততোধিক বিষয়ের সাদৃশ্য যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করে না যে, এদের একটি অন্যটি থেকে প্রভাবিত বা নিঃসৃত হয়েছে। এ বিষয়ে বিখ্যাত ফরাসী সুফি দার্শনিক লুই ম্যসিনন (Louis Massignon) বলেন যে, ‘মৌলিকতার দিক থেকে সুফিবাদের বিচার করলে বলা যায় যে, সুফিবাদ হলো কুরআনে নাযিলকৃত সত্যের গভীর অনুধ্যানের ফল এবং পবিত্র গ্রন্থে (কুরআন) ব্যবহৃত কতকগুলি অভিব্যক্তির মর্মার্থ’। তিনি মনে করেন যে কুরআনের বিশেষ কতকগুলি আয়াত আছে যা সুফিদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে-সকল সুফি গবেষক সুফিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশে কুরআনকে আকর গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করেন তাঁরা শরিয়তের মৌলিক বিশ্বাস ও নিয়ম-নীতির আদলে সুফিবাদের মূলনীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লে­ষণ করেন। কুরআনের তাৎপর্যপূর্ণ আয়াতসমূহে আল্লাহর একত্ব, ঐশি প্রেম, আল্লাহর প্রতি মানুষের আনুগত্য, মানুষের সঙ্গে মহাবিশ্বের এবং পাক আল্লাহর সম্পর্ক, রাসূলুল্লাহর প্রতি মহব্বত, জগতের সৃষ্টিরহস্য ইত্যাদি বিষয় সুফিদের মনে চিন্তার উদ্রেক সৃষ্টি করে এবং এ-সকল বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য তাঁরা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার আশ্রয় গ্রহণ করেন।

কুরআনের পর সুফিদের দ্বিতীয় আকর গ্রন্থ হলো হাদিস এবং এর সাথে য্ক্তু হয় রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ, যা সুফিবাদের তৃতীয় উৎস। হাদিস দু’প্রকার- হাদিস-ই-নববী এবং হাদিস-ই-কুদসি। প্রথম প্রকার হাদিস হলো রাসূলুল্লাহর নিজস্ব পাক জবানের বাণী আর দ্বিতীয় প্রকার হাদিস হলো সেই পাক বাণী যা রাসূলুল্লাহ স্বয়ং আল্লাহর বাণী বলে দাবি করে তাঁর সাহাবাদের (যেমন হুরায়রা) কাছে বর্ণনা করেছেন। সুন্নাহ হলো রাসূলুল্লাহর আচার-আচরণ, কথাবার্তা, কর্মপদ্ধতি, পোশাক-আশাক, এককথায় তাঁর জীবনপ্রণালী। উভয় প্রকার হাদিসের বেশ কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ বাণী আছে যার ভিত্তিতে সুফিরা তাঁদের দর্শনের বিকাশ সাধন করেন, যদিও সুফিবাদের বিরোধিতাকারীরা এগুলোকে দূর্বল হাদিস বলে দাবি করেন। তবে একথা সত্য যে, রাসূলুল্লাহর স্ব-নির্বাচিত দারিদ্র, বিনয় ও সদাচার, সম্পদ ও বিলাসিতার প্রতি বিরূপ মনোভাব, নফল ইবাদত, ওজিফা ইত্যাদি সুন্নাহ হলো সুফিদের নিকট বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সুফিরা সকল সুফি সিলসিলা (তরিকা) রাসূলুল্লাহর আদর্শ থেকে উদ্ভুত এবং রাসূলুল্লাহকে সুফিবাদের জনক বা প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করেন। রাসূলুল্লাহর ওপর কুরআন নাযিল হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই তিনি দূর্গম হিরা গুহার নির্জনস্থানে মুরাকাবা করতেন। এই হিরা গুহায় তিনি প্রথম ওহীপ্রাপ্ত হন। সুফিরা এর ভিত্তিতে মুরাকাবা ও যিকর (আল্লাহর স্মরণ) অন্যতম ওজিফা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পবিত্র রমযান মাসে (শেষ ১০ দিনে) মসজিদে যে ‘ইতিকাফ’ করা হয় তা এই মুরাকাবারই অনুসরণ। সুতরাং সুফিদের মুরাকাবা হিন্দু সাধুদের ধ্যানের অনুকরণ নয়।
প্রতিটি মুসলমানদের নিকট রাসূলুল্লাহর জীবনপ্রণালী, তাঁর নৈতিক গুণাবলী, তাঁর কর্ম ও বাণী, আচার-আচরণ প্রভৃতি ‘মডেল’ বা আদর্শ হিসেবে বিবেচিত। রাসূলুল্লাহর সাহাবা কেরামগণ রাসূলুল্লাহর সুন্নাহকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করেছেন। সাহাবা কেরামদের যারা অনুসরণ করেছেন তাঁরা হলেন ‘তাবেঈন’ আর যারা তাবেঈনদের অনুসরণ করেছেন তাঁরা হলেন ‘তাবে-তাবেঈন’। এরই পরম্পরায় এসেছেন অলী-আউলিয়া বা সুফি, যাঁরা পারস্যে এবং উপমহাদেশে ‘পীর’ হিসেবে পরিচিত। সুফিদের জীবনধারায় তাই রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ প্রতিফলিত হয়েছে, যে সদগুণের ভিত্তিতে সুফি নীতিবিদ্যার জন্ম হয়েছে। খোলাফা-ই-রাশিদিনের জীবনধারা থেকে জানা যায় যে, তাঁরা এমনকি নিষ্কলুষ সুখকে বর্জন করতেন এবং শ্রমের মর্যাদা আর সহজ-সরল জীবনকে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন। আমাদের রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতের জন্য দূর্গম হিরা পর্বতের গহীন গুহায় দিন-রাত কেঁদেছেন, সমগ্র মুসলিম জাহানের অধিপতি হয়েও দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে ক্ষুধা নিবারণের জন্য পেটে পাথর বেঁধেছেন, আর জীবনের-আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাস পরিহার করে সরল সাদাসিধে জীবনযাপন করেছেন। তাঁকে অনুসরণ করে খোলাফা-ই-রাশিদিনরা জীবনের সাধারণ আরাম-আয়েশকেও পরিহার করেছেন। হযরত আবুবকর (রা.) একখন্ড কাপড়কে পিন দিয়ে আঁটকে পরতেন, যেজন্য তাঁকে ‘দুই-পিনের মানুষ’ বলা হত। হযরত উমর (রা.) ডজনখানেক তালিদেয়া কাপড় পরতেন। কতকগুলি তালি আবার কাপড়ের অভাবে চামড়া দিয়ে করা হতো। হযরত উসমান (রা.)-এর পোশাক এত মলীন ও ছিন্ন থাকত যে, তাঁকে দেখে অনেকে কৃতদাস ভাবত। হযরত আলী (রা.)-এর দারিদ্র আর বিনয় ইসলামের ইতিহাসে প্রবাদ হিসেবে গণ্য হয়েছে। রাসূলুল্লাহর পূর্ববর্তি নবী যেমন হযরত দাউদ (আ.), হযরত মুসা (আ.) এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর জীবনেও দারিদ্রতার কষাঘাত লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সুফি তরিকার অনুসারীদের মধ্যে সাধারণ মোটা কাপড়ের ব্যবহার, কৃচ্ছতা, দারিদ্রতা, সরলতা, বিনয়, নম্রতা ইত্যাদির অনুসরণ ইসলামের অতীত ইতিহাস থেকেই এসেছে। সুফিদর্শন বা তরিকত সম্পর্কে অনেক ভুল বুঝাবুঝি থাকলেও আজ এটি পরিষ্কার যে, কুরআন ও হাদিস হলো এর আকরগ্রন্থ, কেননা, সুফিবাদ কোন নতুন ধর্ম নয়, এ হলো ইসলামের অন্তর্নিহিত সার।

কুরআন মজিদে বর্ণিত হয়েছে: “ওয়া মান কানা ফি হাযিহি আহমাঅ ফাহুয়া ফিল আখিরাতি,” অর্থাৎ ‘যে এ দুনিয়াতে অন্ধ (ক্বল্ব বন্ধ) সে আখেরাতেও অন্ধ’ [সূরা বনি ইসরাঈল (১৭):৭২]। দুনিয়ায় মানুষের লক্ষ্য হলো বন্ধ ক্বলবকে তাজা করা। এজন্য সত্য তরিকার অনুসরণ করা আবশ্যক। রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, “আমি জগতে তোমাদের জন্য দু’টি জিনিষ রেখে গেলাম। যদি তোমরা এ দু’টিকে শক্ত করে ধরো তবে মুক্তি পাবে। একটি হলো আল্লাহর কুরআন এবং অপরটি হলো আমার সুন্নাহ।” অহীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু বেলায়েত চালু থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। সুতরাং, ইলহামের দরজা খোলা থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে প্রয়োজন কুরআনকে আঁকড়ে ধরা আর রাসূলুল্লাহকে অনুসরণ করা। এই অনুসরণ থেকেই সুফিসাধক বা পীর-মাশায়েখের উদ্ভব।
সুফিবাদের মূলনীতি কুরআনের মধ্যেই নিহিত। কুরআনের শুরুতেই যে আয়াতসমূহ আছে তা সুফিদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সূরা বাক্বারার ২ থেকে ৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন:
এ সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেজগারদের জন্য। যারা অদৃশ্য বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযি দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সে-সব বিষয়ের ওপর যা-কিছু তোমার (রাসূলুল্লাহ) প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সে-সব বিষয়ের ওপর যা তোমার (রাসূলুল্লাহ) পূর্ববর্তিদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর আখেরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে [সূরা বাক্বারাহ (২):২-৪]।

উপর্যুক্ত আয়াতসমূহে ইসলামের তথা সমগ্র মুসলিমজাহানের মৌলিকনীতি নিহিত। তাত্ত্বিকভাবে, একজন মুসলমান হিসেবে তার কর্তব্য হলো তিনটি প্রধান বিষয়ে বিশ্বাস, যথা – (ক) অদৃশ্য বিষয়ের (আল্লাহ) ওপর বিশ্বাস করা, (খ) কুরআন এবং কুরআনের পূর্ববর্তি কিতাবসমূহে বিশ্বাস করা, এবং (গ) পরকালে বিশ্বাস করা। আর একইভাবে ব্যবহারিক দিক থেকে, একজন মুসলমানের উক্ত বিষয়সমূহে বিশ্বাসের মাধ্যমে প্রধান দুটি করণীয় কর্তব্য হলো (ক) নামায পড়া, এবং (খ) দান করা। আর এই ৫টি বিষয় ‘পথ-প্রদর্শনকারী পরহেজগারদের’ জন্য প্রযোজ্য। এখানেই জ্ঞানীব্যক্তি, বা দার্শনিক, বা অলী-আউলিয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। এই ৫টি বিষয়ের সূক্ষ্ম বিশ্লে­ষণের মধ্যেই পরোক্ষভাবে সুফিবাদের বীজ পাওয়া যায়। সুফিরা যে আল্লাহতে ইবাদত করেন তা মুসলমানদের একচেটিয়া খোদা নন, তিনি সকল ধর্মের আল্লাহ (God), তিনি ‘রাব্বুল আলামিন’ অর্থাৎ ‘সকল সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা’। তিনি সকল যুগে, সকল জাতির জন্য বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। ইসলামের এই সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশী প্রতিফলিত হয়েছে উদার ও উন্মুক্ত মানসিকতার সুফিবাদে, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ উপমহাদেশের সুফিবাদচর্চায় পরিলক্ষিত হয়। (চলবে)

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর
টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *