বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং পর্যবেক্ষণ

রেজাউল করিম তালুকদার

বৃটিশ-ভারতের তদানিন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ৭ জুলাই ১৯০৫ বাংলাকে ভেঙ্গে পূর্ববঙ্গ এবং আসাম নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ গঠনের ঘোষণা দেন। প্রশাসনিক সুবিধার জন্যই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা থেকে বাংলাকে ভেঙ্গে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে পূর্ববঙ্গ এবং আসাম নামে নতুন প্রদেশের জন্ম। রাজধানী হয় ঢাকা। শুরুতে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করলেও পরে তা বিভক্ত হয়ে যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে অটুট রাখতে রাখিবন্ধন উৎসবের আয়োজন করেন এবং মুসলমানদের হাতে রাখিও বেঁধে দেন। বাঙ্গালির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তিনি এই মহোৎসবের সূচনা করেছিলেন। ইংরেজ প্রশাসন পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়কে বুঝিয়েছিল যে বঙ্গভঙ্গ হলে এই অঞ্চলের মানুষেরা সর্বেেত্র এগিয়ে যাবে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সমাজপতিদের অনেকেই ইংরেজ প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানান। তাঁদের মধ্যে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লার নাম চলে আসে সর্বাগ্রে।

বঙ্গভঙ্গের বিষয়টিকে কবিগুরু কেবল আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, রচনা করেছিলেন বেশকিছু কালজয়ী গান। স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলোর মধ্যে “আমার সোনার বাংলা, আমি তেমায় ভালবাসি” অথবা “ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা” উল্লেখযোগ্য। বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালে রচিত গান “আমার সোনার বাংলা” স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে গেল কোন যুক্তিতে! ১৯০৫ থেকে ১৯৭১ ইতিহাসের দীর্ঘ পথ, নানা চড়াই-উৎরাই। ১৯০৬ সাল উপমহাদেশীয় রাজনীতির এক কালো অধ্যায়, জন্ম হয় মুসলীম লীগ এবং হিন্দু মহাসভার।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেল, বাংলা পুনরায় জোড়া লাগলো। কিন্তু দাগটা থেকে গেল। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে পাশ হলো ঐতিহাসিক প্রস্তাব, এবং যে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। প্রস্তাবে বৃটিশ-ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা গুলোতে আলাদা রাষ্ট্র গড়ে ওঠার বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় মাত্র দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হলো। আমরা পেলাম পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান। মাঝে হাজার মাইলের ব্যবধান।

ঢাকায় একটি স্কুলে সকালে ক্লাশ শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে শিশুরা। ছবি: bcsl.portal.gov.bd

১৯৪৭ থেকেই শুরু হলো দু:শাসনের আরেক কালো অধ্যায়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বললেন, “উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। প্রতিবাদের ঝড় উঠলো পূর্ববাংলায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং আত্মত্যাগের পথ দিয়ে জাতি এগিয়ে চললো সামনের দিকে। এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য তরুন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন পূর্ববাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। কারাগার হয়ে উঠলো স্থায়ী ঠিকানা। ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের জোয়ারে ভেসে গেল তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো সব মিথ্যা মামলা। ১৯৭০ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তাঁকে ক্ষমতা দেয়া হলো না, বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপরে চালানো হলো অবর্ণনীয় হত্যাযজ্ঞ। রক্তে ভিজে গেল বাংলাদেশ। শুরু হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে আমরা অর্জন করলাম স্বাধীনতা। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালিন সময়েই “আমার সোনার বাংলা” গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করা হয়। হতবাক হতে হয় যখন ভাবি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রচিত গীতি কবিতাটিকে কোন যুক্তিতে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত করা হলো। কবিগুরুতো বঙ্গভঙ্গকেই মানতেন না, আর সেই চেতনা থেকেই তাঁর রচনা “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি”। পূর্ববাংলাইতো আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। কবিগুরু নেই বলে কি তাঁর চেতনাকে আঘাত করে এবং জোর খাটিয়ে তাঁর গীতি কবিতাকে আমরা জাতীয় সঙ্গীত বানিয়ে ফেলবো!! আর তাছাড়া এই গানের সুরকারতো তিনি নন। এই গানের সুরটি তিনি নিয়েছেন বাউল কবি এবং শিল্পী গগনচন্দ্র দাম বা গগন হরকরার রচনা এবং সুর থেকে “আমি কোথায় পাব তারে , আমার মনের মানুষ যেরে” গানের উপর সম্পূর্ন ভিত্তি করে (ুড়ঁঃঁনব এ গেলেই দেখা ও শোনা যাবে অসর শড়ঃযধু ঢ়ধনড় ঃধৎব)। এই গানটি কোনভাবেই রবীন্দ্র সংগীত নয়। কারণ সুরটিই তাঁর নয়। গগন হরকরা ছিলেন শিলাইদহ পোষ্ট অফিসের ডাক পিয়ন। সে কারণেই তিনি গগন হরকরা নামে বেশী পরিচিত। কবিগুরু প্রায়ই তাঁর কণ্ঠে গান শুনতেন। তাছাড়া কবিগুরুর সব চিঠিপত্র গগন হরকরাই বহন করে কুঠিবাডিতে পৌঁছে দিতেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কবিগুরুর সংগে লালন ফকিরের পরিচয়টাও করিয়ে দেন গগন হরকরা।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এমন মিথ্যা আজকের যুগে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। গগন হরকরা ডাক পিয়নের কাজ করতেন বলে সুরকার হিসেবে বা সংগীতকার হিসেবে তাঁর নাম কোথাও লেখা থাকবে না এ কেমন কথা!! তাছাডা স্বাধীনতাপূর্ব কালের কোন গানকে যদি জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করতে হয় তাহলে ডি. এল. রায় এর “ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা” গানটি অতুলনীয়। যদি সেটি না হয় তবে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নসহ স্বদেশ প্রেমের কোন গানকে জাতীয় সঙ্গীত করা যেতে পারে। জাতীয় সঙ্গীত কোন অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশের জাতীয় জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন- জার্মানী, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, দণি আফ্রিকা, আফগানিস্তান, নেপাল ইত্যাদি। এমনকি ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে কানাডার জাতীয় সঙ্গীতের শব্দেও পরির্বতন আনা হয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের বিষয়ে অনেকের দ্বিমত থাকতেই পারে। তবে আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে নয় বরং বাস্তবতা এবং যুক্তির মাপকাঠিতে বিষয়টি বিবেচনা করলে জাতি উপকৃত হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেতনার প্রতিও শ্রদ্ধা জানানো হবে।

রেজাউল করিম তালুকদার

লেখক এবং সিনিয়র সাংবাদিক

টরন্টো