নিভৃতে

ভূমিকা

‘নিভৃতে’ রীনা গুলশানের প্রথম উপন্যাস। প্রবাসের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই প্রবাসের। এবং তারা সবাই অবাঙ্গালী। সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যে এটি একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন সন্দেহ নেই। এই জাতীয় উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে সচরাচর চোখে পড়ে না।

শুরুতে কেউ কেউ মনে করতে পারেন ‘নিভৃতে’ সম্ভবত একটি অনুবাদ উপন্যাস। কারণ এর চরিত্রগুলোই যে শুধু অবাঙ্গালী তা নয়, উপন্যাসে বর্ণিত স্থান কাল ও পাত্রের নিখূঁত বর্ণনা যে ভাবে উঠে এসেছে তাতে এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এটি একটি মৌলিক উপন্যাস।

প্রবাসে প্রচন্ড ব্যস্ততার জীবন আমাদের। দম ফেলানোর ফুসরত মেলা ভার চরম শীতপ্রধান এই কানাডায়। তারই মাঝে সময় করে একটি উপন্যাস লিখে ফেলা এক অভাবনীয় কাজ সন্দেহ নেই। আর এ রকম একটি অভাবনীয় কাজ করেছেন কবি, লেখক ও কলামিস্ট রীনা গুলশান।

রীনা গুলশান অনেক বছর ধরেই বাস করছেন কানাডায়। তাঁর কর্মস্থল ছিল টরন্টোর ডাউন টাউনের সুবিশাল ইটন সেন্টারে। নানা বর্ণের আর নানা চরিত্রের মানুষের আনাগোনা এখানে সারাক্ষণ। আসেন অনেক পর্যটকও। কর্মসূত্রে এই মাল্টি কালচার আর মাল্টি ফেইথের মানুষগুলোকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। তিনি নিজেও ভ্রমণ করেছেন কয়েকটি দেশ। এভাবে পৃথিবীর নানান জাতের মানুষ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার ভান্ডার আগে থেকেই ছিল সমৃদ্ধ। আর এই অভিজ্ঞতার ছোঁয়াই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে উপন্যাসটি জুড়ে। চরিত্র নির্মানে এবং স্থান ও কাল বর্ণনায় তাকে কোন কিছু ধার করতে হয়নি। নিজের অভিজ্ঞতায়ই তিনি রচনা করেছেন অনবদ্য এই উপন্যাসটি।

রীনা গুলশান তার সব লেখাতেই সহজ কথাটি সহজে বলার চেষ্টা করেন। অযথা ভাষায় দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি তার লেখায় দৃষ্টিগোচর হয়না। ফলে পাঠক খুব সহজেই তার রচনা আস্বাদন করতে পারেন। এই উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 

এই উপন্যাসের নায়কের জন্ম ইটালীতে। কিন্তু শিশুকাল থেকেই সে ছিল পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত। মায়ের প্রতি ছিল তার যুগপৎ অভিমান ও ভালবাসা। এভাবেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে সে এবং যৌবনের ঊষালগ্নে ইটালী থেকে কানাডায় এসে স্থায়ী বসত গড়ে। নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও সে স্বপ্ন দেখে একদিন অনেক বড় সঙ্গীত শিল্পী হবে। আর তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিঃস্বার্থ সমর্থন ও উৎসাহ যুগিয়ে চলে তারই এক নিরব প্রেমিকা। বঞ্চনা, অভিমান, ভালবাসা আর নিঃস্বার্থ প্রেমের এক অনুপম উপাখ্যান এই ‘নিভৃতে’ নামের উপন্যাসটি।  

তবে উপন্যাসের চরিত্রগুলো অবাঙ্গালী হলেও তাতে বাঙ্গালীয়ানার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় কিছু কিছু অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে। জগতের সব প্রান্তের মানুষের প্রেম ও ভালবাসার অনুভূতি ও তার বহিঃপ্রকাশ এক ও অভিন্ন বলেই সম্ভবত এরকমটা মনে হয়ে থাকতে পারে। সে কারণে উপন্যাসটির কাহিনী আস্বাদন করতে গিয়ে পাঠকের মনে একটা একাত্মতাবোধ জাগ্রত হতে পারে চরিত্রগুলোর প্রতি।

আমাদের বিশ্বাস, প্রবাসের পাঠকের পাশাপাশি বাংলাদেশী পাঠকের কাছেও উপন্যাসটি সমানভাবে সমাদৃত হবে।

– সম্পাদক

আজ এত বড় ভুল ও কি করে করলো তা নিজেই বুঝতে পারছে না। আবহাওয়া চ্যানেল না দেখে কখনো ও বের হয় না। উহ! আজ কি করলো? বাইরে রীতিমত বরফের ঝড় হচ্ছে। আর সে কিনা একটি লেদারের জ্যাকেট পরে বেরিয়ে এসেছে। আর এই লেদারের জ্যাকেটে কোন হুডিও নাই। পিঠে ওর বেশ ভারী আর মাঝারী সাইজের গিটার সহ বক্স। তার আজন্মের লালিত এই একটি জিনিষই তার সাথে সাথে ঘুরছে। এটার অবশ্য খুব ভাল কভার দেওয়া। আসবার সময় ভাল করে খেয়েও আসেনি। খাবে কি? কিছু থাকলে তো খাবে? এই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ওর কপাল কুচঁকে যায়! ওহ! স্ট্রীট কারটাও আসবার নাম নাই। আজ সিওর দেরী হয়ে যাবে। বুড়োর ঝাড়ি তো আছেই। আরো কি আছে কপালে কে জানে? আজ আবার পে ডে।

এতক্ষণে হেলে দুলে আসছে ৫০৪ স্ট্রিট কার। ইস! দেখলে গা জ্বলে যায়। এর থেকে হেটে গেলে অনেক জলদি যাওয়া যায়। কিন্তু এই ভরপুর স্নোর মধ্যে হাটাও যায় না। মাঝে মধ্যেতো ও দিব্যি হেটেই চলে যায়। সেই জন্যই তো এখানে বাসা নিয়েছিল। কিং এ্যন্ড ক্লোজ এভিনিউতে ওর বাসা। বিশাল হাইরাইজ বিল্ডিং এ ও থাকে। উনিশ তলাতে। ভাড়া একটু বেশী। কিন্তু, যখনই ব্যালকোনিতে যেয়ে ফাবিয়ান দাড়ায়, তখন সে তার বেশী ভাড়ার দুঃখ ভুলে যায়। একটি বেডরুম, ১৬০০ ডলার ভাড়া। তবুও যখন ব্যালকোনি দিয়ে দিগন্ত জোড়া অন্টারিও লেক দেখে, ও সব ভুলে যায়। মনের ভেতরে তখন ক্যাবলই হু হু করতে থাকে! কত চাপা দেওয়া  কষ্ট, বেদনা তখন কান্না হয়ে ওর বুক ভাসায়। আর ওর বেশীর ভাগ গানের কথা এবং সুর এই ব্যালকোনিতে বসেই ও করে ফেলে। তবে শীতের সময়টাতে ওর লিভিং রুমে বসে সব সুরের কাজ করে। তবু পর্দাটা সরিয়ে দেয়। লিভিং রুমে বসেও সবই দেখতে পায়। কারণ লিভিং রুমের, লেকের সাইডের দেওয়ালটা অর্ধেকেরও বেশী কাঁচের।

যাক বাবা এতক্ষনে পৌঁছালো। কি যে আছে কপালে আজ। ফাবিয়ান দৌড়ায়! স্ট্রিট কার থেকে নেমে ওকে আর এক ব্লকের মত হাটতে হয়। তবেই তার ‘হীচ-হাইকার’ নাইট ক্লাব। সামনেই জনি রোজকার মত মুখ গোমড়া করে দাড়িঁয়ে আছে।

নাইট ক্লাবের সিকিউরিটি গার্ড। আজপর্যন্ত ওকে ফাবিয়ান হাসতে দেখেনি। তবু ওকে জনি খুব পছন্দ করে। সেটা ফাবি বুঝতে পারে। রোজ মজা করে একটা স্যালুট মারে।

: হে ম্যান … কেমন আছ আজ?

: আর থাকা… যত্তসব মাতাল বদমাশদের নিয়ে আমার কারবার।

: কাম অন… ওরা কিন্তু খুব খারাপ নয়!

: হু, তা তো বলবেই…তোমাকে তো আর ঝামেলা সামলাতে হয় না! মাঝে মধ্যে ঘুষি লাথি আমাকেই খেতে হয়!

: হা…হা…হা – তা যা বলেছো! বুড়োটা কোনদিকে?

: হু! আজ বসের মেজাজ খুব খারাপ।

: নতুন কিছু বল!

: না হে… এই সন্ধ্যাতেই একজন মাতাল হয়ে বমিটমি করে একাকার করেছে। সেই জন্য বসের মেজাজ সপ্তমে!

: বলকি? নতুন মাল বোধ হয়। যাই হোক জনি… ভাল যাক তোমার সময়।

ফাবিয়ান কোনা দিয়ে সোজা পেছনের দিকে চলে যায়। অবশ্য যাবার আগে নাওমীকে একটা ইশারা করে যেতে ভুল করে না! হ্যা, ফাবিয়ানের এই অভ্যাসটা আছে। স্টেজে যাবার আগে গলাটা ভিজিয়ে নেয়। প্রতিদিন এটা নাওমী-ই তাকে এনে দ্যায়। নাওমী সুলেভান। তার একমাত্র সুহৃদ বন্ধু। যাকে ও সব সঅব কিছু নির্দ্ধিধায় বলতে পারে। ওর সমস্ত দুঃখ বেদনা সুখ একমাত্র নাওমীকেই ও বলে। কোন কিছু কখনো গোপন করেনি। আর নাওমীর মত এরকম শ্রোতাও সারা পৃথিবীতে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। কখনও চোখ বড় করে, কখনও চোখ কুচকে নিরবে ওর কথা শুনে যায়। আর ফাবিয়ানের মনে হয় আজ পর্যন্ত নাওমীর মত ওকে আর কেউ বুঝতেও পারেনি। অনেক সময় এমন হয়েছে-কিছু বলবার আগেই নাওমী তা বুঝে ফেলে।

: কি হলো – আজ আবার দেরী কেন? বস কিন্তু রেগে আগুন হয়ে আছে… ওমা মাথাটা ভিজে…কি করেছো? দাড়াও আমি টাওয়েল নিয়ে আসছি। আগে তাড়াতাড়ি এটা খেয়ে নাও।

গ্লাসটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নওমী দৌড়ায় টাওয়েল আনতে। ওহ! আজ মারটিনি বেজ বানিয়ে দিয়েছে। এতক্ষনে ফাবিয়ানের মনটা বেশ চাঙ্গা হয়ে যায়। গ্ল­াসের সাথে একটা চিপসের প্যাকেটও দিয়ে গেছে।

: দেখিতো ঠিক হয়ে বসো। মাথাটা ভাল করে মুছে দেই। না হলে আবার ঠান্ডা লেগে যাবে।

: নওমী… তুমি কি বলতো? এ্যাঞ্জেল?

: ঠিক আছে আর ঢং করতে হবে না। আজো না খেয়ে আসা হয়েছে তো? ঠিক আছে… আমি তোমার জন্য গরুর কিমা আর সব্জি দিয়ে পাস্তা বানিয়ে এনেছি। ব্রেকটাইমে দিয়ে যাবো।

হঠাৎ ফাবিয়ানের চোখ ভিজে আসে কান্নায়। কি করে নাওমী বুঝতে পারে? যখনি ও না খেয়ে আসে নাওমী ওর চোখের দিকে তাকিয়ে তা বুঝে ফেলে! আর একমাত্র নানীই এরকম ওকে বুঝতে পারতো। নাহ… এখন স্টেজে যেতে হবে।

: কি হলো… শেষ পর্যন্ত সাহেবের আসবার সময় হলো? সাহেবের না আসলেও আমার কিছু বলার ছিল না। সব লাট সাহেরবের বাচ্চা! আমার এখানে জড়ো হয়েছে। এন্থনীর হেড়ে গলা শোনা গেল।

: যাই বস। ফাবিয়ান আমতা আমতা করে দেরী করে আসার ব্যাখ্যা দিতে যায়… কিন্তু এ্যান্থনী আবার বিকট চিৎকার।

: আচ্ছা… আচ্ছা… ঠিক আছে। এখন এগুলি গিলে নিজের কলিজাটা আর না জ্বালিয়ে যাও দর্শকের হৃদয়ে আগুন জ্বালাও।

অতপরঃ ফাবিয়ান হেলতে দুলতে রোজকার মত স্টেজে ওঠে। সাথে সাথে দর্শকের সারির ভেতর থেকে চিৎকার ধ্বনি ভেসে আসে… ফাবিয়ান… ফাবিয়ান… উই লাভ ইউ ফাবিয়ান। ফাবিয়ান স্টেজে উঠে প্রথমে তার প্রিয় গিটারের তারে টুং টাং করে… মুড আনে। তারপর তার ঘাড় পর্যন্ত কোকড়ানো চুল দুলিয়ে গাইতে শুরু করে –

Here I am losing thought,
I am losing your shadow
I scream and can you hear me?
I love you a lot
and I need to know
why can’t you stand by me…

ফাবিয়ান গিটারের তারে ঝড় তুলে যাচ্ছে আর কণ্ঠে বেদনার ঢেউ খেলে যাচ্ছে…

Pleasure for someone else, sadness is mine
I’m blistering, and she keep asking
why… and I say…
I loved you a lot…

গাইতে গাইতে ফাবিয়ান গানের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে যায়। হারিয়ে যায় কোথায় জানি, ও নিজেই জানে না। জীবনে এই প্রথম ওর চোখ ভিজে যায়, প্রচন্ড আবেগে ওর কণ্ঠ রোধ হয়ে যায়। আর জীবনে এই প্রথম ও আশ্চর্য হয়ে দেখলো ওর গিটারের তার ছিড়ে গেছে। প্রচন্ড বিস্ময়ে ও নিজেই ওর গিটারের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর আশ্চর্য ভাবে তখনি তার মনে পড়ে যায় একটা মুখÑএকটা গোটা অবয়ব যা তাকে প্রায় এই পাঁচটি বছর শয়নে স্বপনে জাগরণে যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছে। প্রতিটি মুহুর্তে তাকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছে। আজ এই ছেঁড়া তারের দিকে তাকিয়ে অন্য একটা স্মৃতির কাছে ফিরে যায়, সেই প্রায় ছেলেবেলায়…

: একি করেছো? তুমি আমার গিটারের তার ছিড়ে দিলে? হায় হায়… এখন কি হবে Ñ তুমি জাননা আগামী কাল স্কুলের বার্ষিক উৎসবে আমাকে গাইতে হবে?

: সরি সরি ফাবিয়ান। আমি খুবই দুঃখিত। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। হঠাৎ আমি হাত দিতেই তারটা ছিড়ে গেল।

: আমি না তোকে বলেছি তুই আমার গিটারে কখনো হাত দিবি না…

: ঠিক আছে ফাবি, আর কখনো হাত দিব না। বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে ডোরিন।

: ঠিক আছে… ঠিক আছে। আমার তাড় ছিড়ে আবার ন্যাকামি করে কাঁদছে!!

: কি বললি, আমি ন্যাকামি করছি?

: করছিস তো, তুই তো কান্নার ওস্তাদ!

: আচ্ছা ঠিক আছে Ñ যা তোর কাছে যদি জীবনেও আর আসি Ñ তোর মুখও দেখবো না। 

ফাবিয়ান হেসে ফেললো Ñ হঠাৎ দর্শকদের লাগামহীন করতালিতে ও আবার স্টেজে ফিরে আসে। এতক্ষণ ওর কি ব্রেক টাইম হলো? ফাবিয়ান খুউব ক্লান্ত ভাবে গ্রীনরুমে ফিরে আসে। ও আসা মাত্রই ছুটে নওমী এসে একটা প্লাস্টিকের হট বক্স দিয়ে যায়, সাথে এক ক্যান চিল্ড বিয়ার। ফাবিয়ান মোটামুটি ঝাপিয়ে পড়ে খাবারের উপর। ওহ! ওর এত ক্ষুধা পেয়েছিলÑমুটামুটি গোগ্রাসে খেতে থাকে। আর পাশে এক সমুদ্র অপার ভালবাসা নিয়ে চেয়ে থাকে নাওমী। মনে হচ্ছে ফাবিয়ান খাচ্ছে না, নাওমী নিজেই খাচ্ছে। হঠাৎ ফাবিয়ানের খেয়াল হয় Ñ

: নাওমি -এটাতো তোমার ডিনার ছিল – তাইনা?

: আরে না, আমিতো সেই কখন খেয়ে নিয়েছি।

: আচ্ছা, ঠিক আছে – ফাবিয়ান হাত বাড়িয়ে দ্যায়Ñ

: বল, হাত ছুঁয়ে বল – তুমি খেয়েছ?

: নাহ – এটা খুব বাড়াবাড়ি তোমার! কসম কেন খেতে হবে শুনি?

হঠাৎ ফাবিয়ান নাওমীর কোমর জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলে আর বলতে থাকেÑ

: নাওমী – তুমি কে – তুমি কি আমার এ্যাঞ্জেল? তুমি কি আমার নন্না? কই আমার মাও তো আমার কথা এরকম করে ভাবেনি?

: নাওমী ওর চুলে হাত বুলিয়ে দ্যায়। ওর কপালে চুম্বন করে – খুউব নরম স্বরে বলেÑ

: ছি! ওরকম বলতে নেই মায়ের নামে। মা-তো মা-ই।

: নাওমী তুমি – তুমি সব জানো না।

নাওমী ফিস ফিস করে বলে-

: আমি সবই জানি। তুমি সবই আমায় বলেছো। আজ তোমার কি হয়েছে বলতো? সিসিলিয়ার সাথে আবার কিছু হয়েছে নাকি?

: সিসিলিয়া! উহ! ওর নামও আমার সামনে করোনা।

: বারে – তোমার গার্লফ্রেন্ড বলে কথা! তাইতে আবার অপরূপা সুন্দরী।

ওর কণ্ঠস্বরে হঠাৎ একটা জ্বলুনি টের পায় ফাবিয়ান। একটা ব্যাথাও।

ফাবিয়ার হঠাৎ চকিত হয়ে কিছু বলতেই দেখে নাওমী ধীরে ধীরে চলে গেল।

ওহ! আজ যে কি হয়েছে! সারাটা দিন – রাতের ভূ-ভাগ – কার মুখ দেখে উঠেছিল?

: ফাবিয়ান – নাওমী –  তোমরা কোথায় গেলে? আমি কি সারারাত এটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকবো? সব ইডিয়টের দল-পে চেকের কথাও মনে থাকে না?

: হ্যা বস আসছি-

ফাবিয়ান তারাতাড়ি তার গিটার বক্সে ঢুকিয়ে পিঠে ফেলে ছুটে এন্থনীর সামনে যায়-

: সরি বস। দেরী হয়ে গেল।

: হু – ঠিক আছে। এখানে সইটা করো। তবে যাই বল, আজ তোমার গান খুব দারুন হয়েছিল- কি, ব্যাপার কি? মনটা খারাপ? তোমার নন্নার শরীর ঠিক আছে তো? এ্যান্থনী জিজ্ঞাসা করলোÑ

: হ্যা হ্যা, ঠিক আছে সব।

ফাবিয়ান ক্লিষ্ট হেসে বাসার দিকে রওনা হয়।

: ফাবি আমি তোমাকে ড্রপ করতে পারি? নাওমীর তড়িৎ প্রশ্ন।

: কিন্তু তোমার তো তাহলে অনেক ঘুরতে হবে!

: নাহ্! তেমন আর কইÑআমি তো এমনিতেই গার্ডেনার ধরে যাব। আর তোমার বাসাতো ঐ দিকেই।

: ওকে। ধন্যবাদ নাওমী। আমার আজ অবশ্য সত্যিই খুব ক্লান্ত লাগছিল।

: হু! দেখতেই পাচ্ছি। নাওমী গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো।

: কি ব্যাপার। গাড়িটা নতুন কিনলে নাকি?

: হ্যা। আগের গাড়িটা মোটামুটি লক্করমার্কা হয়ে গিয়েছিল। তাইতে আবার ভাল একজন খরিদ্দারও পেয়ে গেলাম- দুই হাজার ডলারে বিক্রি করেছি।

: বলকি! কোন বোকার হদ্দ নিল? এটাতো দারুন কিনেছো!  রঙটাও খুব সুন্দর। ওহ্! মনে পড়েছে, তাইতো গত মঙ্গলবারে আমাকে তিনটে রঙ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলে কোন রঙটা ভাল? সত্যিই আমি এবোনি ব্লাক খুবই পছন্দ করি। আর ভক্সওয়াগন বিটল এর এই মডেলটাও খুব সুন্দর।

: ধন্যবাদ। ডাউন পেমেন্ট প্রায় দশ হাজার দিয়েছি। বাকিটা লোন। তবে সুদের হার ভাল পেয়েছি।

: আচ্ছা। দারুন করেছো। চলো তাহলে এবার সামারে একটা লং ড্রাইভে যাই।

: ওকেÑ খুউব ভাল আইডিয়া করেছো। তাহলে সিসিলিয়াকেও বলে রেখো। আচ্ছা এসে পড়েছি। আমি আর তোমার ড্রাইভওয়েতে ঢুকলাম না। ওকে বাই। শুভরাত্রী।

দুই

রাত প্রায় সাড়ে চারটে। ফাবিয়ান এ সময়ে যখন ঘরে ঢুকে তখন খুব আস্তে দরজা খোলে। যদিও ওদের দরজাতে একটা ক্যাক ক্যাক শব্দ হয়। অনেকবার এপার্টমেন্টের ম্যানেজার ফিলিপকে বলা সত্বেও এখনও ঠিক করেনি।

: ব্যাটা মাঙ্কি। মনে মনে গালি দ্যায় ফাবিয়ান। এবারে অবশ্যই লিখিত দিতে হবে ম্যানেজমেন্টের কাছে দরজার ব্যাপারে।

দরজা খুলে খুব আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে। ক্লোজেটে জ্যাকেট রাখে। জুতা একদম ভিজে গেছে।

কি করার আছে ওর? কাঁধ ঝাঁকালো। সেই তুষারের ঝড় তাও গেল! তাড়াতাড়ি আগে বাথরুেেম গিয়ে একটা হট শাওয়ার নিতে হবে। তারপর একটা বেশ জোশ করে নাস্তা করবে। বেশি করে বানাবে, তাহলে সিসিলিয়াও খেয়ে অফিসে যেতে পারবে। টোনা মাছের সাথে স্প্যাগেটি দিয়ে একটা রান্না করে ফাবিয়ান। সিসি খুব পছন্দ করে। খুব আয়েশ করে খেতে খেতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেÑ

: যাই বল ফাবি, পাস্তার রান্নাটা তোমাদের ইটালিয়ানদের হাতে যেমন আসে আমাদের তা যতই চেষ্টা করি না কেন ঠিক তেমনটি হয় না।

ফাবিয়ান নিজের মনে হাসে। প্রথমে স্প্যাগেটি সেদ্ধ চড়িয়ে দ্যায়। এতে লাগবে গ্রীন অনিয়ন প্রচুর, রেড পেপার চিলি ক্রাশ, কিছু ক্যারেটের পিস আর দুই কৌটা টোনা। সাদা টোনাটা বেশি ভাল হবে। টমেটো পেস্ট ৪ টেবিল স্পুন আর টমেটো কেচাপ ১ কাপ। সব শেষে বেজিলের গুড়ো এক টেবিল স্পুন। আহ, জিভে পানি এসে গেছে। দারুণ মজা। স্প্যাগেটি সেদ্ধ করে, ফাবিয়ান হট শাওয়ার নিতে গেল। হট শাওয়ার নিয়ে বেশ ঝরঝরে লাগছে। এবারে সেদ্ধ স্প্যাগেটি রান্না করে ফেললো। আয়েশ করে খেল। তারপর বড় এক মগ টু পারসেন্ট দুধের মধ্যে কফি খেল। এবারে বিছানা।

বিছানা খুব টানছে। টানছে সিসিলিয়ার টগবগে গরম শরীর। এ সময়টা অবশ্য সিসি বেশ অনীহা প্রকাশ করে। কারণ, তার শরীরে তখন ঘুম থাকে। যেমন-তেমন করে একবার জাগিয়ে দিতে পারলে সিসি একেবারে হট চকলেট। পাঁচ ফুট ৭ ইঞ্চি শরীরের প্রতিটি ভাজ তখন কথা বলে। সিসির শারীরিক ভাষা এত প্রবল যে তার চরিত্রের অন্য সব মাইনাস দিকগুলো মাঝে মধ্যে ওভারলুক করা যায়।

যাই হোক, পা টিপে টিপে বেডরুমের দরজা খুলে ফাবিয়ান দেখে বিছানায় সিসি নাই। বাথরুমে আবার দেখলো, নাহ কোথাও নাই। ফাবিয়ান কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেল। এর আগেও ৩/৪ দিন সিসি রাতে আসেনি। তখন সে কৈফিয়ত দিয়েছিল যে কলিগের জন্মদিনের লেট নাইট পার্টি ছিলো। তাহলে আজ? ফাবিয়ান তাড়াতাড়ি সিসির সেলে কল করে। নাহ্। সুইসড অফ্। ব্যাপারটি কি? ফাবিয়ানের মাথা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। কোন কাজ করছে না। এখন প্রায় ৭টা বাজে। এত ভোরে কাকে ফোন করবে? সেদিন যার জন্মদিন ছিল তাকে করবে? নাকি সিসির ম্যানেজারকে করবে? ফাবিয়ান আসলে কিছুই ভাবতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত  অনেক দোনোমোনো করে ওর ম্যানেজারকেই ফোন করবে বলে ভাবলো। টেলিফোনের ডায়রিটা ঘাটতেই ‘ফার্স্ট চয়েস স্পা’র ম্যানেজারের নম্বরটা পেয়ে গেল! দুটো রিং হতেই একটা ঘুম জড়ানো হাস্কী কণ্ঠÑ

: হ্যালো

: আমি কি ‘ফ্যালানিয়া ন্যাসুয়ার’ সাথে কথা বলতে পারি?

: হ্যাঁ বলছি, কে বলছেন?

: আমি খুবই দুঃখিত এত সকালে আপনাকে ডিসটার্ব করার জন্য।

: ঠিক আছে, ব্যাপারটি কি?

: নাহ্ মানে, আমার গার্লফ্রেন্ড সিসিলিয়া ক্যালাডাইন রাতে বাসায় আসেনি। খুব চিন্তায় পড়ে গেছি। তাই আপনাকে একটু ডিসটার্ব করলাম।

: ওহ্! ওতো কাজ শেষে প্রায়ই দেখি এ্যাডাম ওরাইলি’র সাথে বেরিয়ে যায়!

: এ্যাডাম? কে এই এ্যাডাম?

: ও, সে তো আমাদের স্পার অনেক পুরনো এমপ্ল­য়ী। হেয়ার স্টাইলিস্ট। তা তুমি কি সিসিকে ফোনে ট্রাই করেছো?

: হ্যাঁ, সুইসড অফ। অনেক বার চেষ্টা করলাম।

: আচ্ছা, এ্যাডামকে একবার ট্রাই করে দেখতে পারো?

: কিন্তু, ওর নম্বরটা…

ফ্যালানিয়া এ্যাডামের নম্বরটা বললো। এবং ওকে বাই বলার সময় কণ্ঠস্বরটা একটু অন্যরকম হয়ে গেল! সহানুভূতিতে ভরা।

শেষ চেষ্টা হিসাবে ফাবিয়ান এ্যাডামের ফোনে কল করল। মজার ব্যাপার ৩/৪টা রিং হবার পর সিসিলিয়াই ফোনটা ধরলোÑ

: হ্যালো সিসিলিয়া! তুমি কোথায়? আরে আমি সেই কখন থেকে তোমাকে খুঁজে মরছি।

: কিন্তু, কেন আমাকে খুঁজছো?

: মানে কি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না সিসি।

: মানে বোঝ না, ইউ ফাকিং এ্যাসহোল, কেন আমাকে ডিসটার্ব করছো?

: সিসি!

ফাবিয়ানের কানে ঠাস করে টেলিফোন রাখার শব্দ আসে। ফাবিয়ান কেমন যেন স্থবির হয়ে বসে থাকে। ওর কোন ভাষা নাই। দুঃখ, বেদনায়, অপমানে ও কেমন যেন অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে থাকে। (চলবে)

তিন

কতক্ষণ বসেছিল ফাবিয়ান নিজেই জানে না। ওর মাথা কেমন যেন কাজ করছে না। সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এমনিতেই বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ওর ঠিক মত ঘুম হয় না। সারারাত কাজ করে এসেও ঘুম হয় না। যার জন্য ওর শরীরটা খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর যদিও বা ঘুম হয়, তখন ঘুমের মধ্যে অজস্র দুঃস্বপ্ন দেখে চলে। যে সব স্বপ্ন ও আদৌ দেখতে চায় না। হ্যাঁ, ঘুম এলেই স্বপ্ন আসে। স্বপ্ন এলেই ডোরিন চলে আসে। আর স্বপ্নই হোক আর বাস্তবেই হোক ডোরিনের কথা মনে এলেই ওর মধ্যে অসম্ভব একটা কষ্ট বোধ তাড়না করে। তাই ওর কথা সে মনে করতে চায় না।

এখনও ভাবতে পারছেনা, ফাবিয়ান, একটু আগে সিসিলিয়া ওকে যা বললো তা আদৌ সত্যি কিনা। ওর সমস্ত ব্যাপারটাই দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। এরপর অবশ্যই সিসিলিয়ার সাথে থাকবার কোন প্রশ্নই আসে না। যদিও এপার্টমেন্টটি ফাবিয়ানের, তবুও অন্তত এই ব্যাপারে অবশ্যই সিসির সাথে ওর আলোচনা করতে হবে। সে যদি এখানে থাকতে চায়, তবে তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। আর যদি সিসি এখান থেকে চলে যেতে চায় তাহলে তার কাপড়-চোপড় তাকে দিয়ে দিতে হবে। সে যাই হোক, ফাবিয়ানের শরীরটা ভেঙে আসছে ঘুমে। সম্ভবত আজ ওর খুউব ভালো ঘুম হবে। বেশ কিছু দিন ধরে ওর যে সিসির সাথে সম্পর্কটা খুবই শীতল চলছিল এই কথাটা অবশ্য নাওমীও জানে। যদিও সব জানে না। বিশেষ করে যখন থেকে সিসি এই স্পাতে জয়েন করেছে। ওর এ্যাটিচ্যুট পুরো বদলে গেছে। ‘মুই কি হনুরে’ টাইপ। প্রায়ই ওকে বলতো-

: ফাবিয়ান, তুমিতো এখন অন্য কোন জব করতে পারো! তাছাড়া তোমার এ্যালবামের তো কোন খবরই নাই। আরো কি সব ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা এতকাল ধরে বলেছো, তারওতো কোনই খবর নাই।

: তুমিতো জানো আমি চেষ্টা করছি। বিভিন্ন জায়গাতে আমার অডিও এবং ভিডিও সিডি জমা দিয়েছি। এমনকি চলচ্চিত্র এন্ড টিভিতে চান্স পাবার ব্যাপারে একজন এজেন্টকেও নিয়োগ করেছি। সে আমার হয়ে কাজ করছে এবং তার জন্য ভালো টাকাও দিতে হচ্ছে এজেন্টকে। কিন্তু তুমি জানো এসব ব্যাপারে এত সহজ নয়। এসব ব্যাপারে ভাগ্যেরও একটা স্পার্ক লাগে।

: আর লেগেছে! সিসিলিয়া ঠোট মটকায়।

কিন্তু ফাবিয়ান ভাগ্যে বিশ্বাসী। বার বার সে ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়েছে। আবার ডুবতে ডুবতে ওর ভাগ্য ওকে টেনে তুলেছে। নাহলে এত দুঃখের মধ্যেও ওর হাসি পেয়ে যায়। নাহলে নাওমীর সাথে ওর পরিচয়ই বা হবে কেন?

নাওমীর জন্যই তো ওর এই ক্লাবের চাকরিটা পাওয়া। এমনকি সিসিলিয়ার সাথে ওর পরিচয়, তাও সেই নাওমী। সিসিলিয়া এ নাওমীর খুব ভালো একজন বন্ধু ছিলো। নাওমী সব সময়ই ফাবিয়ানকে একজন খুউব ভালো বন্ধু মনে করেছে। নাওমী একদমই একটা অন্য রকম চরিত্রের মেয়ে। খুব ভদ্র, শান্ত এবং খুবই রিজার্ভ ধরনের মেয়ে। ফাবিয়ানের সাথে যখন নাওমীর আলাপ বন্ধুত্বে গড়িয়েছে, তখন একদিন ফাবিয়ান বলেছিলো-

: নাওমী, তোমার চরিত্রের সাথে তোমার চাকরি একদম বেমানান!

নাওমী হেসেছে। গভীর দুঃখের হাসি। নাওমীর হাসিটাও চমৎকার। এত সুন্দর ওর হাসি, মাঝে মাঝে ফাবিয়ান অবাক হয়ে ভাবে, কোন মানুষ এত সুন্দর করে কিভাবে হাসতে পারে! নাওমী সেই সুন্দর হাসিটা দিয়ে ওকে বলেছে-

: মানুষ যা ভাবে তাই কি সে করতে পারে? আমারও সেই রকম কিছু মনে করো…

: তবুও, তুমি এত শান্ত , এত ভদ্র, তোমার চরিত্রের কোনোখানে এত উগ্রতা নাই, অথচ তুমি কিনা ‘বারটেন্ডারের’ চাকরিটা করছো, এটা কি করে সম্ভব?

: এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব ফাবিয়ান, না হলে দেখো কোথায় কোন ইটালির একটা ছোট শহরে তুমি বড় হয়েছো, তুমি কি কখনো ভেবেছো কখনও কানাডাতে আসবে! এই রকম করে নাইট ক্লাবে গান গাইবে?

: নাহ! ভাবিনি, ঠিকই বলেছো- কখনো ভাবিনি। তবুও আজ আমি জানতে চাই তুমি কেন এই বারটেন্ডারের কাজ করছো?

: আমার কোন উপায় ছিল না ফাবি।

: কেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি তো রিয়াল ক্যানাডিয়ান। ক্যানাডারই মেয়ে তুমি।

: তা ঠিক, আসলে হয়েছে কি, আমি মা-বাবার সাথে অনেক ফাইট করে এই টরেন্টোতে এসেছিলাম।

তখন নাওমী একটু একটু করে তার জীবনের সব সুখ-দুঃখের কথা বলে। নাওমী সুলেভান। ও কানাডার নিউ ব্রান্সউইকের মেয়ে। ওরা ব্রিটিশ ক্যানাডিয়ান। ওর বাবা আইটি ইঞ্জিনিয়ার। আর মা লাইব্রেরিয়ান। ওরা চার ভাই-বোন। নাওমীই সবার বড়। প্রচণ্ড ভালো ছাত্রী। গ্রেড টুয়েল্ভে খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল। তখন অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাপ্লাই করবার সময়ে ও গোপনে রায়ারশন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও দিয়েছিল। ও নার্স হতে চেয়েছিল। এখানেই বিপত্তি হলো। ওর বাবা-মা চেয়েছিল ওখানকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই তাদের মেয়ে পড়ুক। অথবা নোভাস্কোশীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাক। কিন্তু অন্টারিওর টরেন্টোতে নয়। অনেক দূর। ওদের পরিবারের কেউ কখনো অত দূরে যায়নি। কিন্তু সবার মানা সত্বেও নাওমী জিদ করে টরেন্টোতে এলো। রায়ারশানের ডর্ম এ ছিল। নার্সিংয়ের প্রথম সেমিস্টারে খুউব ভালই করেছিল। দ্বিতীয় সেমিস্টারে ফাইনালের পরীক্ষার সময় নাওমীর কি যেন হলো, ঘুম হয় না। খেতে ইচ্ছা করে না। কেমন যেন ডিপ্রেশন-এর মত হলো। আসলে কখনো বাবা-মা, ভাই-বোনকে রেখে থাকেনিতো? পড়তে ইচ্ছা করতো না। চুপি চুপি শুধু কাঁদতো। ব্যাস, যা হবার তাই হলো। ফেল করলো। ফেল করবার পর ওর বাবা-মা বললো-

: অনেক হয়েছে টরেন্টোতে থাকা, এবার দয়া করে চলে আসো।

কিন্তু নাওমী অসম্ভব জিদ্দি। ও খুব জলদি বারটেন্ডারের একটা কোর্স করলো এবং এখানে জয়েন করলো। টাকা-পয়সা এখানে ভালোই পায়। শুধু টিপসের টাকা দিয়ে ওর খরচা চলে যায়। আর চেকের টাকা প্রথম এক বছর টানা জমিয়েছে। এখন সেনটেনিয়াল কলেজে ভর্তি হয়েছে নার্সিংয়ে। এখানে দু’বছর পড়া। অলরেডি ৪ সেমিস্টার হয়ে গেছে। এবার ভার্সিটিতে যাবে। সেখান থেকে নার্সিং পাশ করবে। এখন ওর একা থাকা এ্যাডজাস্ট হয়ে গেছে এবং ওছাপ’ও (পড়ার জন্য সরকারি ঋণ) একদম নিচ্ছে না। তবে খুউব কষ্ট করতে হচ্ছে। একটা বেজমেন্টে ৩ জন মেয়ে এক সাথে রুম শেয়ার করে থাকে। ওর রুমেমেটই ছিল সিসিলিয়া ক্যালাডাইন। আর মজার ব্যাপার, স্বভাবে দুজন ঠিক দুই গ্রহের বাসিন্দা। তবুও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। যদিও রাতে দুজনই বারটেন্ডারের কাজ করে, ওটুকুতেই মিল ছিল। বাকি চরিত্রগত কোন মিলই ছিল না। পরে যখন সিসিলিয়া ফাবিয়ানের সাথে লিভিং টুগেদার করবার জন্য ওর ঘর ছাড়লো নাওমী হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। কারণ, খুব অগোছালো এবং হল্লাবাজ। নাওমীর খুবই রাগ হতো। কিছু বলতেও পারতো না, সইতেও পারতো না। তার পড়ার খুব ডিসটার্ব হতো। এখন অবশ্য নাওমী একটা ১ বেডরুেেমর এ্যাপার্টমেন্টে থাকে এগলিংটন এন্ড কেনেডিতে। এটা একটা ব্যাচেলর এ্যাপার্টমেন্ট। মাত্র ৭৫০ ডলার ভাড়া, হাইড্রো ইনক্লুডেট।

হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে ফাবিয়ান যেন গভীর সমুদ্র থেকে ভেসে উঠলো-

: হ্যালো।

: নন্না, কেমন আছো? ফাবিয়ান আর কথা বলতে পারে না। গভীর কষ্টে তার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।

: আমি তো ভালোই আছি। তোর কি হয়েছে সোনা, প্রায় ২/৩ সপ্তাহ তোর ফোন আসে না, আমি তো খুবই চিন্ত ার মধ্যে আছি।

: আমি, আমি ভালো আছি। হয়তো খুব শিগগিরই তোমার কাছে আসবো।

: তাই? আয় সোনা, তোকে রেখে আর থাকতে পারি না। এখন এই বয়সে একা থাকা খুব কষ্টের। তোকে রেখে… ফাবিয়ানের নানী কান্নায় ভেঙে পড়ে-

: তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বলতো?

: নন্না তুমি কেঁদো না, প্লিজ। আমি শিঘ্রি আবার ফোন করবো, আমার আর একটা ফোন এসেছে।

ফাবিয়ান কলার আইডিতে নাওমীর নাম দেখে ফোন রিসিভ করে-

: হ্যালো, কি ব্যাপার তুমি এখনও ঘুমাওনি? আজ স্কুল নাই?

: স্কুল, স্টুপিড! আজ রবিবার ভুলে গেছো। তবে ঘুম পড়ার চেষ্টা করছি, এখন এই দুপুরে একটু না ঘুমালে রাতে কাজ করতে পারবো না। নাওমী কথা বলতে বলতে হাই তোলে।

: তোমার সমানে হাই আসছে! ঘুমিয়ে পড়ো।

: হু! ঘুমাচ্ছি, তুমি ঠিক আছো তো? তোমাকে আজ খুব ডিসটার্ব লাগছিল। সিসি ভালো আছে তো?

: ওহ! ইয়া, খুব খুউব ভালো আছে। নাওমী আমি রাখছি, আমার খুবই ঘুম পাচ্ছে।

নাওমী কিছুটা হতভম্ভ হয়ে ফোন রেখে দিল। ফাবিয়ান জীবনে কখনো এভাবে ফোন রাখে না। তার খুবই দুশ্চিন্ত া হচ্ছে, কেন যেন তার সিক্সথ সেন্স বলছে ফাবিয়ান ভালো নেই। নাওমী ঘুমাতে গেল! এমন সময় এ্যান্থনির ফোন এলো-

: হ্যালো নাওমী।

: হাই এ্যান্থনি, কি ব্যাপার? এ সময়ে…

: নাহ্! রিসিপশন থেকে ফোন আসলো যে, ফাবিয়ান নাকি সিক কল দিয়েছে, আজ রাতে আসবে না। কি ব্যাপার বলতো? তুমি তো আবার ওর খুব ভালো বন্ধু! গতকাল রাতে স্টেজেও গান গাইতে গাইতে ওর চোখ দিযে কান্না ঝরছিল। আমি কিছু বুঝতে পারছি না! আজ এত বছরের মধ্যে ওতো কখনো সিক কল দেয়নি। তাও আবার রবিবারে।

: আমিও বুঝতে পারছি না বস্। আমি ফোন করেছিলাম তো বেশি কথা বললো না। খুব দ্রুত ফোন রেখে দিল।

: হু! আমার মনে হয় ঐ পাজী মেয়েটার সাথে কিছু হয়েছে। ফাবিয়ান যখনই ওর সাথে মুভঅন করেছিল, আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু আমার কি করার ছিল বল? তবে কিনা আমি ওকে আমার ছেলের মত ভালোবাসি!

: জানি বস। আমি এখনি দেখছি! আপনি চিন্তা করবেন না।

: ওকে! বাই হানি, টেক কেয়ার।

নাওমী গভীর চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল। ঠিক কি করা উচিত ও বুঝতে পারছে না। গভীর দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে। আবার ফোন করা বা ওর বাসায় যাওয়া, সেটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? ফাবিয়ান মনে করতে পারে নাওমী তার জীবনে খুব বেশি ইন্টারফেয়ার করছে! আর সব থেকে বিশ্রি ব্যাপাটার হলো সিসিলিয়াও এক সময় তার রুমেমেট ছিল, বন্ধুও বটে। বন্ধু! বুলসিট, সিসিলিয়াতো তার জীবনটাই…! (চলবে)

রীনা গুলশান

লেখক রীনা গুলশান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স  ও মাস্টার্স শেষ করেছেন। স্বামী অধ্যাপক ড. কে এ কাজিমের সাথে কুয়েট ক্যাম্পাসে দীর্ঘ দিন বাস করেছেন, ভারতে পাঁচ বছর এবং পরবর্তীতে কানাডাতে স্থায়ী আসন গেড়েছেন স্বামী এবং দুই পুত্রকে  নিয়ে। সত্তরের এর মাঝামাঝি সময় থেকেই তাঁর লেখার প্রকাশনা শুরু। খুলনার সব জনপ্রিয় পত্রিকা এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট সব দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার লেখার প্রকাশনা হয়েছে। পরবর্তীতে কানাডায় প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকাগুলোতে লিখে যাচ্ছেন কলাম, ছোট গল্প এবং কবিতা। এছাড়া টরন্টোর একমাত্র ম্যাগাজিন ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ এর উনি একজন নিয়মিত কলামিস্ট। রীনা গুলশান একইসাথে কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা এবং কলাম লিখে থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *