জীবনের বহু রং

সাইদুল হোসেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

(আঠারো)

বহু-মাত্রিক কিছু গল্প

মার্চ ২৭, ২০২৪

(এক)

মিথ্যা কথা বলা ক্ষতিকর

আমেরিকার Oklahoma City. সেখানে এক জায়গাতে miniature golf খেলা চলছে। টিকেট কিনে ফিল্ডের ভেতরে ঢুকে খেলা দেখতে হয়।

এক বাবা তার ছোটছোট দুই ছেলেকে সংগে নিয়ে সেই খেলা দেখাতে ওখানে গিয়ে টিকেট কাউন্টারে বসা যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলো, “প্রবেশমূল্য কত?”

যুবকটি বললো, “তোমার জন্য ৩ ডলার, ৬ বছর এবং তার কম বয়সের বাচ্চারা ফ্রি।”

লোকটি তখন কাউন্টারে ৬টি ডলার রেখে দু’টি এন্ট্রি টিকেট দিতে বললো।

যুবকটি তার সামনে দাঁড়ানো ছেলে দু’টির দিকে তাকিয়ে লোকটাকে বললো, “তুমি তো আমাকে ৩ ডলার দিলেই পারতে যদি বলতে যে তোমার বড় ছেলেটির বয়স ৬ বছর? I wouldn’t know the difference

বাবা জবাবে বললো, “হ্যাঁ, ৩টা ডলার বাঁচাতে পারতাম বটে কিন্তু আমার সাড়ে ছয় বছর বয়সের ছেলেটা তৎক্ষণাৎ জেনে যেতো যে তার বাবা একজন মিথ্যাবাদী, নগণ্য তিনটা ডলার save করার জন্য মিথ্যা বললো, কারণ সে তার বয়সটা জানে। সেটা আমার জন্য কত বড় একটা ক্ষতির কারণ হতো একবার ভেবে দেখ তো? That would have made the difference”

(দুই)

মাত্র একটি হলেও প্রাণ বাঁচাও

এক টুরিস্ট মেক্সিকোর জনশূন্য একটা Sea beach-এ সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলো যে সাগরের পানির কাছে দাঁড়িয়ে একটা গ্রাম্য বৃদ্ধ নীচু হয়ে কিছু একটা কুড়িয়ে নিয়ে সাগরের পানিতে নিক্ষেপ করছে। কৌতুহলী হয়ে সে সেই লোকটার কাছে গিয়ে দেখলো যে সে জ্যান্ত Star fish শুকনো বালি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সেটাকে সাগরের পানিতে ছুড়ে মারছে। আরো কাছে গিয়ে লোকটাকে সে বললো, “তুমি যা করছো তা একটা বৃথা চেষ্টা, কারণ জোয়ারের স্রোতে হাজার হাজার Star fish ভেসে আসে প্রতিদিন। জোয়ার নেমে গেলে সেই মাছগুলো ডাংগায় পড়ে থাকে। মরে। ক’টাকে তুমি বাঁচাবে? অসম্ভব কাজ একটা। It makes no difference!”

তার কথা শুনতে শুনতে নীচু হয়ে আরো একটি জ্যান্ত Star fish উঠিয়ে এনে সাগরে নিক্ষেপ করতে করতে লোকটি বললো, ”At least, this fish will not die. Yes, this makes a difference for him!”

(তিন)

সাহস

তিন বছর বয়সের মেয়েটি প্রাণঘাতী একটা রোগে ভুগছে। তার বাঁচার একমাত্র চিকিৎসা হলো কারো দেহ থেকে a special type of blood মেয়েটির দেহে transfusion করা। অনুসন্ধান করে ডাক্তাররা আনন্দিত হলেন জেনে যে মেয়েটির পাঁচ বছর বয়সী বড় ভাইয়ের দেহেই সেই bloodটা বইছে। মা-বাবার সংগে আলোচনা করে ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিলেন যে সেই transfusionটা স্থানীয় হসপিটালেই করা হবে তবে তার আগে ছেলেটিকে সবকিছু জানিয়ে ওকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে।

ওকে ডাক্তাররা সব বুঝিয়ে বলার পর জানতে চাইলেন, “তোমার প্রিয় ছোটবোনের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তোমার দেহ থেকে তোমার বোনকে রক্ত দিতে রাজী আছ?”

একটু ইতস্ততঃ করার পর ছেলেটি বললো, “এতে যদি লিজার প্রাণ বাঁচে, আমি রক্ত দিতে রাজী আছি।”

সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করার পর হসপিটালে নিয়ে দুই ভাইবোনকে পাশাপাশি দু’টি বেডে শুইয়ে blood transfusion দেয়া শুরু হলো এবং কয়েক মিনিটের মাঝেই মেয়েটির মুখের ও দেহের চামড়ার রং বদলাতে শুরু করলো। আশার লক্ষণ। ডাক্তাররা এবং মাবাবা মহাখুশী!

ওদিকে এতক্ষণ ধরে হাসিমুখে থাকা ছেলেটির চেহারা ক্রমে মলিন হতে লাগলো। পাশে বসা ডাক্তারকে সে প্রশ্ন করলো, “Doctor, am I going to die now”

ডাক্তারদের কথাবার্তা সব সে বুঝে উঠতে পারেনি। তাই ওর মনে ভয়টা ঢুকলো যে ওর দেহের সব রক্ত তো বোনটাকে দিয়ে দেয়া হয়েছে, এখন তো সে নিশ্চয়ই মরে যাবে!

ডাক্তাররা তাকে আদর করে অভয় দিয়ে আশ্বস্থ করলেন যে ওর ভয়টা অমূলক, অল্প পরিমাণ রক্তই ওর বোনকে দেয়া হয়েছে। ওরা দু’জনই সুন্দর স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকবে।

কথাগুলো শুনে ছেলেটির মুখে আবার হাসি ফোটে উঠলো।

(চার)

হতদরিদ্র কিন্তু লোভকে করেছে জয়

নিউ ইয়র্ক সিটি।

আকাশচুম্বী অট্টালিকাতে ধনীরা যেমন বাস করেন, তেমনি হতদরিদ্র আশ্রয়হীন ভিক্ষুকদেরও বাসস্থান সেই নগরী।

এক মহিলা অফিসকর্মী রোজ তার গাড়ি ড্রাইভ করে কোন এক রাস্তার পাশের সেই সব ভাসমান জনগণের বস্তির পাশ দিয়ে যাতায়াত করেন এবং লক্ষ্য করেন ওদের জীবনসংগ্রাম। সহানুভূতি, করুণা জাগে তার মনে। এমন হতাভাগা জীবনও কেউ কাটাতে পারে? ভাবেন তিনি মনেমনে।

একদিন তাঁর অফিসে Thanksgiving Day উপলক্ষ্যে আনীত প্রচুর খাবার বেঁেচ গেলো। হঠাৎ সেই মহিলার মনে পড়লো সেই গরীবদের রাস্তার পাশের বস্তির সেই বৃদ্ধার কথা যাকে তিনি ঘনঘনই দেখেন জীবনযুদ্ধে পরাস্ত, স্বাস্থ্যহীন, অর্ধভূক্ত, নোংরা-ছেঁড়া জামাকাপড় পরে নানা কাজে ব্যস্ত। ভাবলেন, কিছু খাবার ওকে দেয়া যাক, নিশ্চয়ই খুশী হবে উত্তম খাবার দেখে।

অতঃপর একটা বড় প্যাকেটে নানা ধরনের খাবার সাজিয়ে মহিলা বহু খুঁজে সেই বৃদ্ধাকে সেই বস্তির একধারে খুঁজে পেলেন। গাড়িটা ওর কাছে নিয়ে জানালাটা নামিয়ে সেই প্যাকেটটা বৃদ্ধার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, “এটাতে কিছু খাবার আছে, তোমার জন্য এনেছি। টার্কি রোস্ট আছে, স্টাফিং আছে, এপল পাই আছে।”

প্যাকেটটার দিকে হাত না বাড়িয়ে বৃদ্ধা বললো, “খাবারটা আনার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমার প্রয়োজন নেই, আজ রাতের খাবারটা আমি খেয়ে নিয়েছি একটু আগেই।” তারপর বস্তিটার দিকে আংগুল তুলে বললো, “ওখানে যাও। ওদের কারো প্রয়োজন হতে পারে, খাবারটা বরং তুমি ওদেরকেই দাও।”

কথা শেষ করে সে ওর বিছানাতে ছেঁড়া একটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। খাবার প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মহিলা তো হতভম্ব! এতো নির্লোভ মানুষ হতে পারে যার কিছুই নেই!

জীবনের চলার পথে বিরাট একটা lesson নিয়ে তিনি ঘরে ফিরে এলেন। এবং পরদিন অফিসে গিয়ে ঘটনাটা তার সহকর্মীদের সবিস্তার বর্ণনা করে শোনালেন।

(পাঁচ)

Puppies (কুকুরছানা) বিক্রি হবে

একটা স্টোরের দরজায় একটা সাইনবোর্ড Puppies For Sale সেটা দেখে স্টোরে ঢুকে একটা বাচ্চা ছেলে জানতে চাইলো ঃ “মূল্য কত?”

স্টোরের মালিক বললো ঃ “৩০ ডলার থেকে ৬০ ডলার।”

কানাডায় বাড়িতে কুকুর পালা একটি কমন হবি মানুষের। ছবি : এনিমেলকিংডমএজেড.কম

সেটা শুনে ছোট ছেলেটা তার প্যান্টের পকেট থেকে কিছু খুচরা coins বের করে সেগুলো গুনে পেলো ২ ডলার ৩৭ সেন্ট ($2.37)। তারপর সে কুকুরছানাগুলোকে দেখতে চাইলো।

মালিক শিস্ দিতেই খোঁয়াড়ের ভেতর থেকে মা-কুকুরটা তার পেছনে ছোটছোট পাঁচটা বাচ্চা নিয়ে বের হয়ে এলো। ওদের মাঝে একটা বাচ্চা অন্যগুলোর বেশ পেছনে একটা পা টানতে টানতে এগিয়ে আসতে লাগলো। ওটার দিকে আংগুল তুলে ছেলেটা জানতে চাইলো, “ওর সমস্যাটা কি?”

মালিক বললো ঃ “পশুডাক্তার বলেছেন যে ঐ বাচ্চাটার hip-এ একটা socket ছাড়াই সে জন্মগ্রহণ করেছে। সে সারা জীবনই সে কারণে ওর পাটা টেনেটেনে (limping করে) হাঁটবে।”

সেকথা শুনে ছোট ছেলেটা বললো, “আমি ঐ লেংড়া কুকুরছানাটাই কিনতে চাই।”

মালিক বললো ঃ “না, ওটা তোমাকে কিনতে হবে না। তোমাকে ওটা আমি ফ্রি দিয়ে দেবো।”

শুনে ছেলেটার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেই লেংড়াটার দিকে হাতের আংগুল দিয়ে ইশারা করে বললো, “না, ওটাকে আমি ফ্রি চাই না। অন্যগুলোর মত ওটারও একটা মূল্য আছে। একটা price আমাকে বল, আমি full price দিয়ে puppyটাকে কিনতে চাই। Down payment হিসাবে তোমাকে আমি এখন $2.37 দিচ্ছি, তারপর থেকে প্রতিমাসে ৫০ সেন্ট করে দিতে থাকবো full price না দেয়া পর্যন্ত।”

মালিক তখন বললো ঃ “কেন কিনবে ওটাকে? সে তো তোমার সংগে সংগে দৌড়াতে পারবে না, লাফঝাঁপ দিতে পারবে না, খেলতে পারবে না।”

মালিকের কথা শেষ হলে বাচ্চা ছেলেটা নীচু হয়ে ওর বাম পায়ের প্যান্টটা টেনে উপরে উঠালো। দেখা গেল, ওর সেই পা-টা ভাংগা, থেঁতলানো, একটা metal brace দিয়ে fix করা।

তারপর সে স্টোরের মালিকের চোখে চোখ রেখে বললো, “দেখলে তো? আমি নিজেও দৌড়াতে পারি না। এই ছোট্ট puppyটার সংগী এমন একজন হওয়া দরকার যে তার কষ্টটা/অপারগতাটা বোঝে।”

(ছয়)

ধর্ম ও মানবতা

দু’জন বৌদ্ধ সাধু (Buddhist monks) তাদের কোন এক তীর্থক্ষেত্র দর্শন করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। চলতে চলতে একখানে গিয়ে দেখলো যে তাদের সামনে ছোট একটা অগভীর নদী বয়ে চলেছে। এবং আরো লক্ষ্য করলো যে সেখানে নদীটার পানির কাছে সুসজ্জিতা একটি যুবতী বসে রয়েছে। মলিন মুখ তার।

এক সাধু জানতে চাইলো যুবতী ওখানে বসে আছে কেন?

জবাবে সে জানালো যে নদীর ওপাড়ের এক গ্রামে ওকে যেতে হবে জরুরী কাজে কিন্তু এসে দেখলো যে নদীতে কোন খেয়া নেই অথবা পুলও নেই। নদী পার হওয়া যাচ্ছে না। তাই অসহায় হয়ে বসে আছে অথচ বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। ভেবে পাচ্ছে না সে কি করবে এখন?

বিবরণ শুনে সাধু একবার নদীর পানির গভীরতার দিকে তাকালো, তারপর যুবতীর অসহায় মুখের দিকে তাকালো। তারপর তাকে বললো, “তুমি আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে উঠো। আমি তোমাকে নদীটা পার করে দিচ্ছি।” যুবতী তাই করলো। সাধু তাকে ওপাড়ে তার পিঠ থেকে নামিয়ে দিলো। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যুবতী তার গন্তব্যস্থলের দিকে হাঁটা দিলো।

দুই সাধু একই সংগে নদী পার হলো এবং তাদের গন্তব্যের দিকে আবার যাত্রা করলো। বহুক্ষণ পর দ্বিতীয় সাধু প্রথম সাধুকে বললো, “আজ তুমি আমাদের ধর্মীয় শিক্ষাবিরোধী একটা কাজ করলে। আমাদের শিক্ষা হলো পরনারীকে স্পর্শ না করা, অথচ তুমি সেই নারীকে তোমার কাঁধে চড়িয়ে নদীটা পার করে দিলে! তুমি একটা পাপ করলে।”

শুনে প্রথম সাধু বললো, “কোন অসহায়কে সাহায্য করতে আমাদের ধর্ম নিষেধ করে না। আমি যা করেছি সেটা করেছি আমার মানবতাবোধ থেকে।”

একটু থেমে আবার যোগ করলো, “আমার বোঝা তো আমি বহু আগেই নামিয়ে দিয়েছি কিন্তু সেই মেয়েটির বোঝাটা তুমি এখনো কেন বয়ে বেড়াচ্ছো?”

(ঊনিশ)

ভালোবাসার অসীম শক্তি

(I love you, son.)

মার্চ ২৮, ২০২৪

Tom. টম একজন চিত্রকর। সে একজন কাদামাটি (clay) দিয়ে হাড়ি-থালাবাটি এবং পুতুল তৈরীকারকও বটে। An artist and a potter. স্ত্রী এবং ছোটছোট দু’টি ছেলে নিয়ে তার সংসার। একদিন রাতের বেলাতে বড় ছেলেটা পেটের ব্যথায় চিৎকার করে বিছানায় গড়াগড়ি যেতে লাগলো। ব্যথাটা কিছুতেই কমে না। টম অথবা ওর স্ত্রী বিষয়টাকে তেমন কোন গুরুত্ব দিলো না; ভাবলো, এটা একটা সাধারণ ব্যথা, কিছুক্ষণ পর এমনিতেই সেরে যাবে। কিন্তু ব্যথাটা ক্রমে বেড়ে গিয়ে সেই রাতেই ছেলেটা মারা গেলো। পরদিন ডাক্তারী পরীক্ষায় প্রকাশ পেলো যে সেটা কোন সাধারণ ব্যথা ছিলো না, ছেলেটা মারা গেছে acute appendicitis-এর ব্যথায়।

সময়মত চেষ্টা করলে হয়তো ছেলেটাকে বাঁচানো যেতো, তার অবহেলার কারণেই ছেলেটা মারা গেছে, এই অপরাধবোধটা টমের জীবনে দারুণ এক মানসিক বিপর্যয়ের/অস্থিরতার জন্ম দিলো। ওর emotional health ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে লাগলো।

ঠিক এমনি দুর্দিনে ওর স্ত্রী আকষ্মিকভাবে ওকে ছেড়ে ছ’বছর বয়সের ছোট ছেলেটাকে রেখে অন্য একজনের সংগে চলে গেল।

আঘাতের উপর আঘাত! মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! টম আঘাতে আঘাতে দিশাহারা! চারিদিকে অন্ধকার। অসহায়। তাই বাঁচার অবলম্বন হিসাবে সে আকঁড়ে ধরলো মদকে, হয়ে পড়লো সে একজন alcoholic. সর্বদা নেশাগ্রস্ত।

আয়-রোজগার বন্ধ। বাঁচার তাগিদে সে বিক্রি করতে শুরু করলো তার সব সম্পদ। একেএকে বিক্রি করে দিতে হলো সবই। সর্বশেষে বাড়িটাও। সব ছেড়ে উঠতে হলো গিয়ে শহরের একটা motel-এ। এবং সেখানেই সে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। সম্পূর্ণ একা!

টমের এমন করুণ মৃত্যুতে ঘটনাটার বর্ণনাকারী (যিনি টমের পরিবারকে শুরু থেকেই চিনতেন/জানতেন) ভাবলেন, “আহা রে, টমের জীবনটা সম্পূর্ণ বৃথা গেল! What a complete failure!”

কিন্তু একটু খোঁজখবর নিয়ে তিনি টমের ছোট ছেলে Harryকে বের করলেন এবং তার পরিবারের সংগে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুললেন। এবং লক্ষ্য করতে লাগলেন ওদের জীবনযাত্রার ধরণ। ক্রমে তিনি দেখতে পেলেন কি অসীম মায়া-মমতা-ভালোবাসা না বিরাজ করছে সেই পরিবারে মাবাবা ও তাদের সন্তানদের মাঝে!

তিনি ভেবে পেলেন না এত ভালোবাসা সেই হতভাগা, বঞ্চিত ছেলেটার পরিবারে আসলো কোথা থেকে? তার কৌতুহল মিটানোর উদ্দেশ্যে তিনি একদিন Harryকে বললেন,

“আমি তো জানি ঘরে তোমার মা ছিলো না। তোমার অতি দুর্দশাগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত বাবাই কোন রকমে তোমাকে লালনপালন করেছিলো। স্নেহ-ভালোবাসা ছিলো তোমাদের ঘরে অনুপস্থিত। নিতান্ত  অবহেলিত জীবন নিয়ে তুমি বড় হয়েছো। অথচ তোমার পরিবারে দেখতে পাচ্ছি স্নেহ-মায়া-মমতার ছড়াছড়ি। আমি বিষ্মিত। বলতো, এটা  কি করে তুমি অর্জন করলে? তোমার বাবার মাঝে এমন কি একটা বিশেষ গুণ ছিলো যার প্রভাবে তোমার পরিবারে এমন অভাবনীয় শুভ পরিবর্তন তুমি আনতে পারলে?”

প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে Harry জবাব দিলো,

“১৮ বছর বয়সে বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বাধীন জীবন যাপন করা শুরুকরার পূর্বের রাত পর্যন্ত, আমার যতটুকু মনে পড়ে, বাবা প্রতিটি রাতে শুতে যাবার আগে আমার রুমে আসতো, আমাকে জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু খেতেখেতে বলতো, “I love you, son.”

জবাবটা শুনে আমার চোখে পানি এসে গেলো। অনুভব করলাম যে Tom-এর জীবনটা একটা total failure নয়, ওর জীবনটা সম্পূর্ণ বৃথাও যায়নি। সে কোন ধনসম্পদ রেখে যেতে পারেনি বটে, কিন্তু তার ছেলের মাঝে অতি উত্তম চরিত্রের স্নেহ-ভালোবাসায় পূর্ণ একটা মানুষ রেখে যেতে পেরেছে।

(কুড়ি)

একজন উত্তম শিক্ষক

মার্চ ৩১, ২০২৪

আমার জীবনের কথা। ১৯৯৯ সন। বহু বছর আগের কথা। টরন্টো সিটির রেক্স্ডেইলে উডবাইন সেন্টার মলে একটা জুতার দোকানে তখন ছোটখাটো একটা  job করতাম। বাসা থেকে বের হয়ে পরপর তিনটা বাস ধরে সেখানে পৌঁছতে হতো। সময় লাগতো দেড় ঘন্টা। ফেরার সময়ও সেই একই রুটিন। Boss ছিলেন একজন বয়ষ্ক ইটালিয়ান। হাসিখুশী মেজাজের মানুষ। গল্প করতে ভালোবাসতেন। আর ভালোবাসতেন খেতে। নানা ধরনের খাবার কন্টেইনারে ভর্তি করে বাসা থেকে নিয়ে আসতেন এবং কিছুক্ষণ পরপরই একটু একটু করে কিছু না কিছু খেতেন, আর টেবিলে আংগুলে টোকা দিয়ে গুণগুণ করে ইটালিয়ান গান গাইতেন।

মাঝারি ধরনের বড় একটা জুতার দোকানের ম্যানেজার, কিন্তু তাঁর এসিসটেন্ট বা হেল্পার বলতে ছিলাম আমরা দু’জন। অপর ছেলেটি ছিল ইটালিয়ান। কাস্টমার সার্ভিস প্রধানতঃ তিনিই দিতেন, আমরা শুধু তাঁর নির্দেশমত শেলফ থেকে জুতার বাক্সোগুলো এনে তাঁর সামনে দিতাম এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাজ করতাম। জুতা বিক্রির কাজ যখন করতাম তখন তিনি আমাকে সাহায্য করতেন।

হাসিমুখে কাস্টমারকে “Hi” and “Bye” বলাটার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বসহকারে আমাকে শিখিয়েছিলেন। কাস্টমারদের অধিকাংশই ছিল ইটালিয়ান।

তাঁর নাম ছিল Domenic. ডোমেনিকের কিছু বৈশিষ্ঠ্য বা special qualities ছিল যা আমাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতো। সেগুলোর মাঝে কয়েকটার উল্লে­খ করছি। তিনি বলতেন ঃ

১)           বিজনেস করতে এসেছ, ভালো কথা। তবে কাস্টমারকে মিথ্যা বলে, ঠকিয়ে নয়। তোমার merchandise সম্পর্কে সদা সত্য কথা বলবে। মিথ্যা বললে কাস্টমার একদিন না একদিন বুঝে ফেলবে, সে আর কোনদিন তোমার দোকানে আসবে না। তোমার বিজনেস বন্ধ হয়ে যাবে। Big loss.

২)          কাস্টমারের সংগে সদা হাসিমুখে কথা বলবে, কখনো মুখ কালো করে অথবা রুক্ষ কণ্ঠে কথা বলবে না। Customer is the boss. He is happy, you have business. You survive. No customer, no business. Capisci (কাপিশি)? অর্থাৎ বুঝেছ?

৩)          সে জুতা কিনুক বা না কিনুক, বিদায়কালে কখনো কাস্টমারকে হাসিমুখে Thank you, please come again বলতে ভুলবে না। This is an investment for your business.

৪)          Hypocrisy জীবনের সর্বক্ষেত্রে বর্জন করবে। Tell the truth, you will never regret. জেনেশুনে defective shoes কখনো বিক্রি করবে না।

৫)          যত ছোট কাজই হোক, সেটা তোমার জন্য অন্য কেউ করলে তাকে Thank you বলতে ভুলবে না। একটা taxi hire করে কোথাও গেলে সেখানে গাড়ি থেকে নেমে হাসিমুখে ড্রাইভারকে tips তো দেবেই, সংগে Thank you for the nice ride বলতে ভুলবে না। This will create a happy feeling in his heart. সে তোমার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ করবে। ওর দিনটা ভালো যাবে। Try to make others happy at no cost.

এবার প্রসংগান্তরে যাই।

কোম্পেনীর হেড অফিস থেকে নিয়োগ পত্র হাতে নিয়ে প্রথম দিন স্টোরে গিয়ে ডোমেনিকের সংগে দেখা করলাম। বললাম, “Good morning, sir. আমার নাম সাইদ। আপনাদের হেড অফিস থেকে এপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে এসেছি আপনার কাছে জয়েনিং রিপোর্ট দিতে।”

তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার আসার খবর জেনারেল ম্যানেজার আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন। Welcome. I am Domenic. I am the manager. We will work together. But never say “Sir” to me again in future. I am not your “master”, nor you are my “slave”. Whenever needed, address me by my name- Domenic. And you are Sayed. OK?”

এই ছিল আমাদের দু’জনের মাঝে প্রথম সাক্ষাৎকালীন dialogue.

Domenic-এর আরো একটি ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করতো। তিনি ঘনঘনই কিছু না কিছু খেতেন সেকথা আগেই উল্লে­খ করেছি। এব্যাপারে একদিনের কথা বলি।

তাঁর খাবারের কন্টেইনার খুলে মুখে একটা কিছু দিতে দিতে তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, “খাওয়ার সময় তোমাকে কিছু অফার করি না সেটা নিশ্চয়ই তুমি লক্ষ্য করেছ। কেন করি না জান? প্রথমতঃ লিমিটেড কোয়ানটিটি ফুড আনি। দ্বিতীয়তঃ আমরা ইটালিয়ানরা Pork (শূকরের মাংস) খেতে খুব ভালোবাসি, আমাদের বহু খাবারেই পোর্ক থাকে।

অন্যদিকে তুমি হলে একজন মুসলিম, পোর্ক খাওয়া তোমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ। তুমি তা খাবে না।

তাই জেনেশুনে তোমাকে আমার খাবার অফার করাটাকে আমি একটা hypocrisy বলে গণ্য করি। Hypocrisy no good. তাই তোমাকে অফার করি না।”

আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি যে Domenic-এর মত একজন উত্তম চরিত্রের মানুষের সাহচর্য আমি কিছুদিনের জন্য পেয়েছিলাম। আল্ল­াহ তাঁর মংগল করুন। (চলবে)

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *