হালচাল
নজরুল ইসলাম
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫২ বৎসর, শুনেছি কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধার বয়স ৫০ বা ৫১। এটা কি সত্যি ? কি করে সম্ভব?
দেশের কৃষক, মজদুর ও তাঁদের পরিবার ১৯৭১ সনে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে ভাত খাইয়ে পাক বাহিনীর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। দেশের আপামর জন সাধারণের সহযোগিতা ছাড়া দেশ স্বাধীন হতে পারতো না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের নিয়ে রক্ষিবাহিনী করা হয়েছিল এবং ওদের কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা দ্বারাই সেনাবাহিনীতে সমস্যা, বিশৃঙ্খলতা দেখা দেয়। বাংলাদেশ সরকার ৫২ বৎসরে মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছে। ওদের অবদান কেউ অস্বীকার করছে না, দেশের জনগণের স্বার্থকে দেখা প্রয়োজন ।
বাংলাদেশ সরকার কোটা সিস্টেমের মাধ্যমে চাকুরী নিয়োগ চালু করেছে সে ও অনেক দিন। কোটা সিস্টেমের মাধ্যমে যোগ্য ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে, এটা তাঁদের ন্যায্য দাবি। মুক্তিযোদ্ধরা মাসিক ভাতা পাচ্ছে, যদি তাদের ছেলেমেয়েরা ভালোভাবে পড়াশুনা করে, অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকুরী নেবে, এতে অসুবিধা কোথায়? কোটা সিস্টেম চালু থাকলে ওদের ছেলেমেয়েরা প্রতিযোগী হয়ে উঠবে না।
জুলাই ১৬, ২০২৪
যুদ্ধ শিশু
১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মহিলাদের উপর যে পাশবিক অত্যাচার করেছে, তার ফলে অনেক শিশুর জন্ম হয়েছে। এই শিশুদের কেউ কেউ পরবর্তীতে পশ্চিমা দেশগুলিতে পালক পিতা-মাতার কাছে বেড়ে উঠে। পালক পিতা-মাতা ওদের লালন-পালন করে, পড়াশুনা করিয়ে সমাজে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বড় হয়ে এরা অনেকেই একসময় তাদের মায়ের পরিচয় জানতে চায়। কিন্তু তাঁদের মাবাবার পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় নি, কারণ একদিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, অপরদিকে ধর্ষিতা বাংলাদেশী মহিলাগণ সামাজিক অবস্থার চাপে মা হিসাবে নিজেদের পরিচয় গোপন করে গেছেন। আমাদের সমাজে মহিলারা ধর্ষণের শিকার হলে লোকসমক্ষে তা প্রকাশ করার সাহস পায় না। সমাজে তাঁদের কেউ গ্রহণ করবে না বা করলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না এই ভেবে ওরা নিজের পরিচয় গোপন করে। এই অবৈধ শিশুদের কানাডা, নেদারল্যান্ড বা যে দেশেই নেয়া হয়েছে, সেখানে পালক পিতা-মাতাগণ যত্ন সহকারে স্নেহ এবং মায়া মমতা দিয়ে ও পড়াশুনার সুযোগ দিয়ে সুন্দরভাবে তাঁদেরকে দাঁড় করিয়েছে। সেই দিনের সেই শিশুরা এখন আর শিশু নেই ওরা ৫১-৫২ বৎসরের প্রৌঢ়,বাবা মা ও সংসারী।
অটোয়া প্রবাসী মুস্তফা চৌধুরীর লেখা ‘৭১ এর যুদ্ধও শিশু-অবিদিত ইতিহাস’ বই এবং বিভিন্ন মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী কানাডায় এবং অন্যান্য দেশে নেয়া এ সব লোকেরা সব সময় তাঁদের মায়ের পরিচয় অন্তত জানতে চান, যা হয়তো বাস্তবে সম্ভব হতে না ও পারে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ভাবে এই শিশুদের সংগ্রহ করেছে এবং কেউ এগিয়ে এসে শিশুদের মায়ের পরিচয় দিতে সাহস পায়ে নি।
তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার যদি এই শিশুদের দেশে রেখে দিতো, তারা কি হিসাবে বেঁচে থাকতো? এ সব শিশুরা হয়তো পিতৃ-মাতৃহীন অবস্থার মধ্যে পড়ে থাকতো, কেউ হয়তো কুড়িয়ে নিয়ে যেনতেন ভাবে মানুষ করতেন বা বস্তিতে বেড়ে উঠতো এবং অবহেলিত অবস্থায় সারা জীবন বেঁচে থাকতো। কিন্তু তৎকালীন সরকার বুদ্ধিমত্যার পরিচয় দিয়ে ওদের অনেককে বিদেশে পাঠানোর ফলে ওরা বিদেশের পরিবেশে বেড়ে উঠে শিক্ষা লাভ করে সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমাদের সমাজে দারিদ্র লোক ও শিশুদেরকে সর্বদাই অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। মা-বাবা দারিদ্র, সে জন্য ছেলে বা মেয়ে জন্মগত ভাবে দরিদ্র এবং সহায় সম্বল হীন। দরিদ্র পরিবার আর্থিক দুর্বলতার জন্য ছেলেমেয়েদের ভালো পড়াশুনা ও পরিবেশ দিতে পারে না। আমাদের সমাজ এ সব দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অপরদিকে ছেলে-মেয়ে ধনীর ঘরে জন্ম নিয়েছে, আলালের ঘরের দুলাল, এদের খাওয়া পড়ার কোনো অভাব থাকে না। মা-বাবা তাদের পড়াশুনা ও সমাজে বেড়ে উঠার ব্যাপারে সর্বদা খেয়াল রাখে। যদিও মেধার দিক থেকে উভয় শিশুরাই সমান, তবে সুযোগ ও যত্নের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে উঠে।
১ ) মানুষ যে পরিবেশে বড় হয়, সে পরিবেশ থেকে সৎ বা অসৎ হওয়া শিখে। শিশুরা মা-বাবা ও তার চারিদিকের পরিবেশ থেকে সর্বদাই শিখে। শিশুরা তাদের পরিবেশ থেকে ভালো বা মন্দ অন্বেষণ করে, অন্যদের তীক্ষ পর্যবেক্ষণ করে এবং সেভাবে অন্যের আচরণ অনুকরণ করে। শিশু এবং টডলাররা যখন সুরক্ষিত বোধ করে, তাদের চারপাশে যত্নশীল প্রাপ্তবয়স্করা থাকে তখন তারা সাফল্য লাভ করে। যদি তাদের চারপাশের প্রাপ্তবয়স্কদের পরিবেশ ভালো না থেকে, তারা ও সেভাবে কিছু শিখতে পারে না।
জুলাই ১৬, ২০২৪
এরা কি রাজাকারের বাচ্চা?
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০,৭৮৯ জন রাজাকার বাঙালিদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করেছিল (সূত্র ইন্টারনেট)। ১,৪৭,৫৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেশকে স্বাধীন করেছে। এ সময় ১৯১ জন বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছে (সূত্র ইন্টারনেট)।
যেভাবে সরকার ফলাও করে রাজাকার শব্দ ব্যবহার করে যাচ্ছে, তাতে মনে হয় যারা আওয়ামী লীগ সমর্থন করে না তারা সবাই রাজাকার। কিন্তু হিসাবে দেখা যায় মাত্র ১০,৭৮৯ জন রাজাকার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছে; তা হলে এত এত রাজাকারের বাচ্চা এল কোত্থেকে ?
নিম্নে আমাদের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের দেয়া বক্তব্য থেকে কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি :
ক) প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী ‘… রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকুরী পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না। অপরাধটা কি ?…’
খ) ডক্টর জাফর ইকবালের ভাষ্য ‘… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেতে চাই না, ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে রাজাকার ..’
গ) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কথায় কথায় বলেন ‘খেলা দেখাবো’।
বাংলাদেশ সরকারের কি হলো ?
দেশের ছাত্র-ছাত্রী তথা জনগণের দাবি মুক্তিযোদ্ধা কোটা উঠিয়ে দেয়া, এ নিয়ে সহজভাবে আলাপ আলোচনা না করে সরকার রাস্তায় পুলিশ, র্যাব এবং আর্মি নামিয়েছে ; গোলাগুলি করে নিরীহ ছেলেমেয়েদের হত্যা করা হচ্ছে।
দুনিয়ার কোনো সভ্য দেশে এ ভাবে গুলি করে ছাত্র হত্যা করে বলে কেউ শুনেছেন? বাংলাদেশ সরকার কি বিবেক হারিয়ে ফেলেছে ? এই সরকার তো আবার দেশকে উন্নত দেশ বানাতে চাচ্ছে, এটা কি কোনো উন্নত দেশের দৃষ্টান্ত হতে পারে ?
দেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত ছেলেমেয়ে বেকার; হাজার হাজার ছেলে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ খুঁজছে। এভাবে পাড়ি দিতে গিয়ে তাঁদের কেউ কেউ নৌকা ডুবিতে মারা যাচ্ছে। ইউরোপ এবং আফ্রিকার জঙ্গলে এদের কেউ কেউ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। ইউরোপ, কানাডা এবং আমেরিকার এখানে সেখানে এই ছেলেরা কাজের জন্য ঘুরছে, কাজ নেই, রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা নেই। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এ দেশে এসে না পারে দেশে যেতে, না পারে এখানে থাকতে, তাঁদের শৌচনীয় অবস্থা। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে মরুভূমিতে কিভাবে কষ্ট করে কাজ করে দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে প্রবাসীরা। অন্যদিকে দেশের দুর্নীতিবাজ লোকেরা বিদেশে অর্থ পাচার করছে। বাংলাদেশ সরকারের কি কোনো দায়িত্ব নেই এ সব দেখাশুনার? সরকার ছেলেমেয়েদের দাবিগুলি সহানুভূতির সঙ্গে না দেখে পুলিশ,প্যারামিলিটারি, মিলিটারি রাস্তায় নামিয়ে গুলি করে নিরীহ ছেলেমেয়েদের হত্যা, আহত ও নির্যাতন করেছে। এটা কি কোনো সভ্য দেশের দৃষ্টান্ত হতে পারে ?
জুলাই ১৯, ২২০২৪
হিন্দু মুসলমান এক সাথে
১৯৫৫- কি ১৯৬০ এর দিকে আমি স্কুলে পড়ি, সে সময় দেশে আমরা স্কুলে শ্রেণীকক্ষে হিন্দু মুসলমান এক সাথে পাশা পাশি বসে পড়াশুনা করতাম। আমাদের প্রতিবেশী হিন্দু তাঁদের জমিজমা, বাড়ি ঘর বিক্রি করে ভারতে চলে যেতে দেখেছি; অনেক সময় প্রশ্ন করেছি ‘কেন তোমরা এত সুন্দর বাড়িঘর,জমিজমা বিক্রি করে ভারতে যাচ্ছো? ‘আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু -মুসলমান কোনো সংঘর্ষ হতে দেখি নি। আমাদের প্রতিবেশী কাসিঠাকুর, ললিতকুমার, গোবিন্দ কবিরাজকে দেখেছি বাড়ি বাড়ি এসে রোগী দেখতো, সবাই তাঁদের সন্মান করতো।
গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছেলেমেয়েরা ছোট সময়ে ঘরে মায়ের কাছে বা মাদ্রাসার তালেব-আলেমের নিকট আরবি এবং নামাজ শিক্ষা করতাম। এ দেশের মুসলমান ধার্মিক হিসাবেই আমি দেখেছি; সে যুগে খুব কম সংখ্যক মুসলমান মেয়ে স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করতো, মূলতঃ মেয়েদের জন্য পড়াশুনার সুযোগ ছিল না।
বাংলাদেশে ৯৯% হিন্দু মুসলমান একত্রে বাস করে ; এ দেশে কেউ আওয়ামী লিগ, কেউ জমাতে ইসলাম বা অন্য দল করতে দেখেছি; কিন্তু এক দল আর এক দলকে শত্রু হিসাবে ভাবতে দেখি নি।
আমাদের রাজনীতিবিদদের মুখের ভাষা আদর্শগত, স্পষ্ট এবং জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। বিভিন্ন দলে নীতিগতভাবে মতবিরোধ থাকতে পারে, তাই বলে মুখের ভাষার মাধ্যমে কোনো ক্রমেই আক্রমণ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা উচিৎ নয়। সম্মানজনক ভাষা ব্যবহার, ইতিবাচক এবং গঠনমূলক কাজে উৎসাহিত করে।
জনগণ ও কোমলমতি ছাত্রজনতার মতামতকে সম্মান দেখানো না হলে যে কোনো দেশে বিভ্রান্তি হতেই পারে। সততা ও স্বচ্ছতা জনগণের প্রতি আস্থা তৈরি হতে সাহায্য করে। দেশে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে বেকার, মা-বাবা শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের নিয়ে সীমাহীন সমস্যায় রয়েছে।
লিবিয়ার গাদ্দাফি দেশের জন্য অনেক কিছু করেও শেষ পর্যন্ত জনগণের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে থাকতে পারে নি। কোনো কালে, কোনো দেশে, কোনো সরকার জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে বেশি দিন টিকে থাকতে পারে নি। তাকিয়ে দেখুন সিরিয়া এবং সুদানের অবস্থা, মিলিয়ন মিলিয়ন লোক হয় মারা গেছে, না হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। রাজনীতিবিদগণ দেশ এবং দেশের সম্পদকে নিজের মনে করে অপচয় করলে – শেষ পরিণতি ভালো হয় না। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা লাভ করা উচিৎ।
বাংলাদেশ কোন পথে এগুচ্ছে ?
১) বাংলাদেশ গণতন্ত্রের নামে স্বাধীন হলেও এই ৫৩ বৎসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে ; গণতন্ত্রের বিচারে এই দেশ নেহায়েত শিশু রাষ্ট্র।
২) সে দিন এক রাজনীতিবিদের মুখের ভাষা শুনলাম ‘আমি তোদের বাপ্, সাহস থাকলে আমার সামনে আয়’ বলে লোকদের সামনে চিৎকার করছিলেন। জনগণের সমর্থনের উপর নির্ভর করে একজন রাজনীতিবিদের পরিচয় বা জনপ্রিয়তা। আমি কানাডায় কোনো রাজনীতিবিদকে এভাবে জনগণকে অসম্মান করে কথা বলতে শুনিনি ।
৩) বাংলাদেশের জনগণের শতকরা এক ভাগও জামায়াতে ইসলামী দলকে কে সমর্থন দেয় না। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হলে ও ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত এই দল ক্ষমতায় আসা দূরের কথা ১০ বা ১৫ টি সিট এর বেশি কখনই পায় নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও কোনোদিন দুই বা তিনজনের বেশি এই দল থেকে সংসদে পাশ করতে দেখিনি। কাজেই এই দলকে নিয়ে এত এত হৈচৈ কেন?
৪) দেশ স্বাধীন কি শুধু আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযোদ্ধারা করেছে ? সারা দেশের ৯৯% লোকের সমর্থন না থাকলে দেশ কোনোদিনই স্বাধীন হতে পারতো না। পাকিস্তানী আর্মি গ্রামেগঞ্জে যেখানে গিয়েছে, সেখানেই মার খেয়েছে, তার মানে পাকিস্তানের প্রতি জনসমর্থন ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের ১৯৭১ সনে গ্রামে গঞ্জে যারা ভাত রান্না করে খাইয়েছে বা আশ্রয় দিয়েছে তাদের নাম কি কেউ মুখে উচ্চারণ করে ?
৫) বাংলাদেশের এই যে বর্তমান পরিস্থিতি, সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন ব্যবস্থাই কি দায়ী নয়? যে কোনো সরকারি শাসন ব্যবস্থায় যদি জবাদিহিতা না থাকে, এর চেয়ে ভালো কিছু কি আশা করা যায়?
৬) আমি কখনই রাজাকারের সমর্থন দিচ্ছি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন : একজন বাবা বা দাদা অপরাধ করলে তার ছেলে বা নাতি নাতনি কেন দায়ী হবে? এটা কোন বিচার ব্যবস্থায় আছে ? যে সংখ্যক রাজাকার ১৯৭১ সনে পাকিস্তানের পক্ষে অংশ গ্রহণ করেছিল, ওটা কোনো পার্সেন্টেজে আসে না, অতি নগন্য। কিন্তু এমনভাবে ঢাক ঢোল বাজানো হচ্ছে, মনে হয় যেন সারা দেশের মানুষ অর্থাৎ সবাই রাজাকার ছিল -এ ধরণের রাজনৈতিক হাতিয়ার অপর পক্ষকে জব্দ করার হীন প্রচেষ্টা ব্যতীত আর কি হতে পারে ?
রাজনীতি: ভিনদেশে
গত ১৫ বছরে, যুক্তরাজ্য পাঁচজন ভিন্ন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁদের সরকার দেখেছে, যাদের মধ্যে আছে :
গর্ডন ব্রাউন (লেবার), ডেভিড ক্যামেরন (কনজারভেটিভ), থেরেসা মে (কনজারভেটিভ), বরিস জনসন (কনজারভেটিভ), লিজ ট্রাস (কনজারভেটিভ), ঋষি সুনাক (কনজারভেটিভ) এবং সর্ব শেষ কিয়ার স্টারমার (লেবার)।
১
ঋষি সুনাক সমর্থন হারিয়ে ফেলার পর তর্কে জড়িয়ে না পরে সরাসরি রাষ্ট্র প্রধান রাজার কাছে পদত্যাগ পত্র দিয়ে সরে পড়ছেন। ঋষি সুনাক পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে একজন সাধারণ পাবলিক হিসাবে পরদিন দুই ব্যাগ গ্রোসারি নিয়ে ঘরে ফিরতেছে দেখলাম, মনেই হলনা যে সে কখনও যুক্তরাজ্যে প্রধান মন্ত্রী ছিল। এটাই তো রাজনীতির নিয়ম হওয়া উচিৎ। ব্রিটেনে গত ১৫ বৎসরে এ নিয়ে কোনো দাঙ্গা বা গণঅসন্তোষ বা রক্তক্ষয় হয় নি। দেশের প্রয়োজনে সরকার রদবদল হতেই পারে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে প্রায় সবসময়ই সরকার বদলের সময় বিশৃংখলা দেখা দেয়। কখনো কখানো রক্তপাতের ঘটনাও ঘটে।
২
আমেরিকা একটি শক্তিশালী ও সম্পদশালী দেশ, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ আমেরিকাকে সর্বদাই তোষামোদি করে চলে। পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে সম্পূর্ণ ওদের নখদর্পনে ; এ দেশের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন ‘আমি দেশ ও দেশের জনগণকে ভালোবাসি, দ্বিতীয়বার নির্বাচনে যাবো না।’ স্বাস্থগত কারণে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কামলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করার জন্য সমর্থন দিয়েছেন। জো বাইডেনকে মেয়াদ শেষ হলে গদি ছেড়ে দিতে হবে, এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এটাকেই বলে গণতন্ত্র এবং রাজনীতি।
৩
সিরিয়ার বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় তেরো বৎসর কেটে গেল। দেশটি এখন প্রায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এবং গভীরভাবে বিভক্ত, ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট, সীমিত রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং বিশ্বের বৃহত্তম বাস্তুচ্যুত সংকটের মুখোমুখি, যেখানে জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের এখন মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। এই দেশে গৃহযুদ্ধের ফলে ৫ থেকে ৬ লক্ষ লোক বা তারও বেশি এ যাবৎ মারা গেছে। ৬ থেকে ৭ মিলিয়ন লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য দেশের বিভিন্ন অংশে, ৫ মিলিয়ন বা তার ও অধিক প্রতিবেশী দেশে বা ইউরোপ,আমেরিকা কিংবা কানাডায় আশ্রয় নিয়েছে।
দেশটির ৭৫ % এলাকা প্রেসিডেন্ট বাসার আসাদ এবং বাকি ২৫% বিদ্রোহীদের অধীন। এ দিকে শক্তিশালী ইস্রায়েল ১৯৬৭ সনের যুদ্ধে গোলান হাইট দখল করে নিয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে ইস্রায়েল প্রায়ই আক্রমণ করে থাকে।
ভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই দেউলিয়া হয়ে যাবে
বাংলাদেশে বর্তমানে যা হচ্ছে তার কি কোনো তড়িৎ সমাধান হবে? ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ বলেই কি পার হওয়া যাবে? দেশে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে বেকার, কখনই সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার আসে নি। এ দেশে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা; অথচ একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ঘরে বসে ভাতা পায় বিশ হাজার টাকা। হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এ সুযোগ নিচ্ছে। কোনো দেশেই অরাজকতার সরকার বেশিদিন টিকে থাকে না, তবে কেউ হয়তো দেশকে এবং দেশের জনগণকে ভালোবেসে সহজেই ক্ষমতা ছেড়ে দেয়।
১৯৫২ সনে রফিক,শফিক, বরকত ও জব্বার ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছে, যাঁদের স্মরণে শহীদ মিনার করা হয়েছে এবং প্রতি বৎসর আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারী পালন করি। ১৯৭১ সনে ৩০ লক্ষ মা-বোন জীবন দিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করেছে, এত রক্ত দেয়ার মূল কারণ মাতৃভূমিকে স্বাধীন করা এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ; কিন্তু তা কি সম্ভব হয়েছে ? গত এক মাসে দেশের যে পরিমান সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, যে পরিমান নিরীহ ছেলেমেয়ে শহীদ হয়েছে, তা বর্ণনা করা কঠিন। এ ভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই দেউলিয়া হয়ে যাবে।
‘তুমি রিয়ালিটি মেনে নাও নিজের চিন্তাভাবনা না করে, নিজের মানুষকে বাঁচাও, কারণ আমি জানি বারোটা তোমার বেজে গেছে।’ আমি নিশ্চিত না এটা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য কিনা, তবে কথাটাতে রিয়ালিটি আছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এই বক্তব্যের মিল রয়েছে। বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার জন্য দায়ী কে ?
১) বাংলাদেশে কখনও জবাবদিহি সরকার ছিল না। স্বৈরতন্ত্র সরকার দিয়ে কোনো দেশ বেশিদিন ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে না। বর্তমান সরকার চতুর্থ মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছে, গত চারবারের নির্বাচনে জনগণকে ধোকা দিয়ে যা করেছে, এই পরিস্থিতি তারই ফল। রাতের অন্ধকারে বাক্স বোঝাই করে ভোট কারচুপি করে পাশ দেখিয়ে জনগণকে ধোকা দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতির জন্য ইনারাই দায়ী।
২) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন ‘এই দুই নেত্রী (বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা) কেউ কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। ‘ একজন মনে করে বাংলাদেশ তার বাবা স্বাধীন করেছে এবং আর একজন মনে করে তাঁর স্বামী স্বাধীন করেছে। এই দেশ স্বাধীন করেছে দেশের আপামর জনতা; ৩০ লক্ষ জনতা রক্ত দিয়েছে,পুরা দেশের জনগণ যে যেভাবে পেরেছে একতাবদ্ধ হয়ে দেশ স্বাধীন করার নিমিত্তে কাঁদে কাঁদ মিলিয়ে সংগ্রাম করে দেশকে স্বাধীন করেছে।
৩) রাজাকার, জামাত, শিবির এ সব কথাবার্তা হলো রাজনৈতিক চাল, এ সব কথার মাধ্যমে ধুঁয়া ছাড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ সব কথা বলে আসছে, যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জুলাই ৩১, ২০২৪
নজরুল ইসলাম
টরন্টো