সমান মজুরি : পুরুষ সহকর্মীর সমান আয় করতে পারছেন না? আপনার কী করণীয়?
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ব্রায়ান কেইল জানতেই পারতেন না যে, তার পুরুষ সহকর্মীরা তার চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করে।
টরন্টোতে বসবাসকারী কেইল একটি অনলাইন প্রকাশনা সংস্থায় কনটেন্ট রাইটার হিসাবে কাজ করেন। কয়েক মাস ধরে কাজ করার পর এক সময় তিনি আবিষ্কার করেন যে, কোম্পানি তাকে পুরুষ সহকর্মীদের সমান মজুরি দিচ্ছে না।
গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, “আমি আসলে মোবাইল ফোনের অ্যাপ দিয়ে ব্যাংকিং সম্পর্কিত কিছু কাজ করছিলাম এবং আমার একজন পুরুষ সহকর্মী সে কাজে আমাকে সাহায্য করছিলেন। সেই পুরুষ সহকর্মী নিশ্চিত ছিলেন যে, তার তুলনায় আমাকে যেরকম স্বল্প মজুরি দেওয়া হচ্ছে তাতে নিশ্চয়ই আমাকে ভুলভাবে মজুরি দেওয়া হচ্ছিলো।”
কেইল বলেন, তারা যখন নিশ্চিত হলেন যে, তাকে স্বল্প মজুরি ভুল করে দেওয়া হয়নি তখন তার পুরুষ সহকর্মী তাকে নিয়ে কোম্পানির মানব সম্পদ বিভাগে যেতে সম্মত হন। তিনি বলেন, “আমার পুরুষ সহকর্মী কোনওভাবেই মনে করেননি যে এটা আদৌ যথার্থ।”
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “কোম্পানিতে আমাদের উভয়ের ভূমিকা ছিলো একই। কিন্তু তার কনটেন্ট রাইটার হিসাবে কোনও অভিজ্ঞতা ছিলো না আর আমার চেয়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে সে এই কোম্পানিতে কাজ শুরু করে। অন্যদিকে আমি কনটেন্ট রাইটার হিসাবে শিক্ষা অর্জন করেছি এবং আগে থেকেই কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার ছিলো।”
কেইল মজুরি বৈষম্যের বিষয়টি তার ম্যানেজারকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতে তার অভিজ্ঞতা ইতিবাচক হয়নি।
কেইল বলেন, “আমাকে বলা হয় যে, আমার বেতন নিয়ে অন্য কারো সঙ্গে আলোচনা করা উচিৎ হয়নি। আর আমার পূর্ব অভিজ্ঞতার বিষয়টি হিসেবে ধরা হয়নি। আমাকে বলা হয় যে, আরও তিনমাস পর আমার চাকরির মেয়াদ ছয় মাস হলে বেতন বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হতে পারে। কিন্তু এক বছর পর আরও দুজন ম্যানেজারের সঙ্গে আলোচনা করেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।”
নারী পুরুষে বেতন বৈষম্যের বাস্তবতা
কেইলের অভিজ্ঞতা কানাডার অনেক বাস্তবতা তুলে ধরেছে, যেমন নারী পুরুষের মধ্যকার বেতন বৈষম্য।
কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বেতন নির্ধারণে যে বৈষম্য করা হয় সেটি হলো উভয়ের ক্ষেত্রে মজুরির ব্যবধান। এই বৈষম্যের অর্থ হলো নারীরা পুরুষের চেয়ে কম অর্থ আয় করেন।
কানাডার নারী ফাউন্ডেশন বলেছে, নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য স্বল্প আয়ের নারী, জাতিগত পরিচয়ে চিহ্ণিত নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী এবং নবাগত নারীদের ওপর সামঞ্জস্যহীন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
কর্ম অনুসন্ধান সম্পর্কিত কানাডার একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গ্লাসডোরের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পুরুষদের এক ডলার আয়ের বিপরীতে কানাডার নারীরা মাত্র ৮৪ সেন্ট আয় করেন। সরকারিভাবে যে
পরিসংখ্যান দেওয়া হয়, আয়ের এই ব্যবধান তার সমান। ২০১৭ সাল স্ট্যাটসক্যান জানায়, কানাডায় পুুরুষের এক ডলার আয়ের বিপরীতে নারীরা ৮৭ সেন্ট উপার্র্জন করে থাকে।
কর্মসংস্থান বিষয়ক আইনজীবী এবং টরন্টোর আরই-ল এলএলপি’র অংশীদার আরন রোজেনবার্গ বলেন, “নারী-পুরুষে বেতনের ব্যবধান হলো কানাডার কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের অন্যতম ও সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয়। যদিও আইনে প্রতিটি কর্মীর অনুরূপ কাজের জন্য সমান গুরুত্ব ও সমান মজুরির নিশ্চয়তা এবং সমঅধিকার দেওয়ার কথা বলা আছে। তারপরও নারী ও পুরুষের আয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অসমতা রয়ে গেছে।”
কর্মীদের ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে মজুরি দেওয়া কি বৈধ?
টরন্টোর কর্মসংস্থান বিষয়ক আইনী প্রতিষ্ঠান ম্যাকডোনাল্ড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস-এর আইনজীবী ক্যাথরিন মার্শাল বলেন, নারী ও পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে মজুরি দেওয়া নিয়োগদাতার জন্য অবৈধ। গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, “অন্টারিওর এমপ্লয়মেন্ট স্টান্ডার্ড অ্যাক্ট অনুযায়ী কোনও নিয়োগদাতা একই ধরণের দায়িত্ব পালনকারী কোনও কর্মীকে শুধু লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে কম মজুরি দিতে পারেন না।”
তার মানে হলো, একই রকম দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার ভিত্তিতে একইরকম কাজ যদি আপনি একই রকম কর্মপরিবেশে থেকে সম্পাদন করেন তাহলে আপনার সমপরিমাণ মজুরি পাওনা হবে।
প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব আইন থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকারের আইনে বলা আছে, একই ধরণের কাজের জন্য কর্মীদের সমপরিমাণ মজুরি পাওয়ার অধিকার আছে। কানাডার মানবাধিকার আইন এবং শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মীদের লৈঙ্গিক ভিন্নতার ভিত্তিতে মজুরি কমবেশি দেওয়া বৈষম্যমূলক।
আইনের কিছু ব্যতিক্রমও আছে অর্থাৎ এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে যে নিয়োগদাতা কর্মীদের বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে মজুরি দিতে পারেন। মার্শাল বলছেন, যেমন অন্টারিওতে একই কাজের জন্য সমমজুরির শর্ত প্রযোজ্য হবে না যখন সিনিয়রিটি বা মেধার প্রশ্ন আসবে। অর্থাৎ লৈঙ্গিক বিবেচনা ছাড়াও কাজের মান, পরিমাণ কিংবা অন্য কোনও বিষয়ের ভিত্তিতে আপনার আয়ের মূল্যায়ন করা হতে পারে।
মার্শাল আরও বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের মজুরি সমতা আইনে (পে ইকুইটি অ্যাক্ট) আরও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। তিনি বলেন, “নিয়োগদাতারা কর্মীদের কাজের রেকর্ড রাখবেন এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের গুরু দায়িত্ব পালন করবেন কেন্দ্রীয় আইনে এমনটাই আশা করা হয়েছে।”
যদি মনে করেন আপনাকে মজুরির ক্ষেত্রে অন্যায় করা হচ্ছে তাহলে কী করবেন?
মার্শাল বলেন, আপনি যদি মনে করেন, নারী হিসাবে আপনাকে কম মজুরি দেওয়া হচ্ছে তাহলে সবচেয়ে ভালো হবে আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা মানবসম্পদ বিভাগের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা কেন আপনাকে কম মজুরি দেওয়া হচ্ছে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “ক্ষতিপূরণ অবশ্যই সাধারণত বিভিন্ন মানদণ্ড ও উপকরণের সামগ্রিকতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তবে একজন কর্মীকে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে অন্য কোনও কর্মীকে বেশি বেতন দেওয়ার কোন আইনসম্মত কারণ আছে কিনা।”
মার্শাল বলেন, কর্তৃপক্ষের কাছে বেতনের পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে আপনি তাদেরকে প্রথমেই লৈঙ্গিক বিভাজন বা বৈষম্যের দায়ে অভিযুক্ত না করে বরং নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ করে দিলেন।
মার্শাল বলেন, “আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন আলোচনাটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করতে। সুতরাং আপনি প্রশ্ন করুন, যেমন, অমুক লোকটি আমার চেয়ে বেশি বেতন পায় কেন? আমরা তো একই কাজ করি।” তিনি বলেন, “বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দিকে ঠেলে দিন এবং তাদেরকে ব্যাখ্যা করতে দিন কেন এমনটা ঘটছে।”
আপনার নিয়োগদাতা কী বলেন তার ভিত্তিতে বেতন বৈষম্যের বিষয়টি নিরসনের চেষ্টা করুন। নিয়োগদাতারা কখনই লৈঙ্গিক বৈষম্য বা বেতন বৈষম্যের দায়ে অভিযুক্ত হতে চান না। তাই তারা আপনার বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে চাইবেন। মার্শাল বলেন, “আলোচনার ভিত্তিতে নিজের বেতন বাড়িয়ে নেওয়া যায় কি না সেই চেষ্টা করুন।”
রোজেনবার্গও এই উপায়ে এগুনোর কথাই বলেন। তিনি বলেন, অনেক সময় আলোচনা করাটাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আপনি চান।
রোজেনবার্গ বলেন, “কোনও কোনও পরিস্থিতিতে বিষয়টি সরাসরি নিয়োগদাতার কাছে বা মানব সম্পদ বিভাগের কাছে উত্থাপন করাই হয়তো সমাধান পাবার জন্য যথেষ্ট।”
আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার উপায়
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যদি সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে আপনি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। আপনি লৈঙ্গিক বৈষম্যের ইস্যুতে নিয়োগদাতাকে আদালতের কাঠগড়ায় তুলতে পারেন।
যদি মনে করেন যে, আপনার নিয়োগদাতা সম মজুরির আইন লংঘন করছেন তাহলে এ বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
সৌজন্যে : লরা হেনস্লে/গ্লোবাল নিউজ