বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য
এডেবি ডির্যাঙ্গো -এডেম
সংস্কৃতিকে সাধারণভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় একটি নির্দিষ্ট সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও জীবনাচরণের প্রকাশভঙ্গি হিসাবে। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম অভিবাসী জনসংখ্যা এবং বহু সংস্কৃতির দেশ কানাডায় সংস্কৃতির ধারণাটি অনেক বেশি জটিল হয়ে পড়েছে। তবে অভিবাসী বাবা-মা ও তাদের কানাডায় বেড়ে ওঠা শিশুর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিষয়টি যতটা জটিল আকার ধারণ করেছে এমনটা আর কোথাও হয়নি।
অনেক অভিবাসী বাবা-মা যুক্তি দেখান যে, একটি নতুন দেশের সমাজে মিলিত হবার ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের সমৃদ্ধ ও অর্থবহ সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার কোন প্রয়োজন নেই। তারা যুক্তি দেন যে, তারা তাদের মূল্যবোধ তাদের সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করে যাবেন এবং এ নিয়ে কোন আলোচনা হতে পারে না। তারপরও অভিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণকারী অনেক সন্তান স্বীকার করে যে, কানাডায় সাংস্কৃতিক পরিচিতি একটি বহুমাত্রিক বিষয় এবং বিশ্বকে দেখার একটিরও বেশি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।
আমাকে জানতে হবে। আমি ইতালীয় ও ইথিওপীয় বাবা-মায়ের সন্তান; আমার বাবা-মা উভয়েই সামাজিক কাজে জড়িত ছিলেন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কমিউনিটিতে তারা কাজ করেছেন। মিশ্রবর্ণের সন্তান হিসাবে আমার জীবন সবসময়ই ছিলো সেতুবন্ধন গড়ে তোলার: বর্ণগত, সম্প্রদায়গত এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত দিক থেকে সেতুবন্ধন গড়ে তোলার কাজ। আমার বাবা-মা উভয়েই গ্রাজুয়েট স্কুলে লেখাপড়া করেছেন এবং ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হিসাবে পরস্পরকে বিয়ে করেছেন, এটি ছিলো তাদের উভয়ের সংস্কৃতির জন্য একই সঙ্গে দুটি বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ।
এর ফলে উভয়েরই সংস্কৃতির কিছু কিছু মূল্যবোধ আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে, সেইসঙ্গে এই বোধ জন্ম নিয়েছে যে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে আরও ভালো কোন ঐতিহ্যের জন্য। আর অভিবাসনের ক্ষেত্রে নতুন দেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার স্বার্থে এই বিবর্তন প্রায়শ প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। অনেকের কাছে এটি হলো একটি নতুন ভাষা শেখার মত ব্যাপার।
ইথিওপীয় বংশোদ্ভূত একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী কালকিদান কুইবেকে এসেছিলো নেহায়েত বালিকা বয়সে। সে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জানায়, ‘‘নিজের ঘরে আমি সবসময়ই ইথিওপিয়ান ছিলাম যদিও স্কুলে অন্য সবার মত আমিও ছিলাম একজন কুইবেকি। আমার বাবা-মা আমার সঙ্গে শুধুই ইথিওপিয়ান ভাষায় কথা বলতেন… কয়েক বছর পর যখন ফরাসী ভাষাই আমার প্রথম ভাষা হয়ে দাঁড়ালো তখনই আমাদেরকে টরন্টোতে চলে আসতে হলো। তাই আমাকে একেবারে শুরু থেকে ইংরেজি শিখতে হলো।’’
এদিকে মিশ্রবর্ণের কানাডীয় ড্যানিয়েল বলেন যে, সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হওয়া উচিৎ এক ধরণের দেয়া-নেয়ার বিষয়, এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে শিশুরা তাদের উত্তরাধিকার বহন করবে। ড্যানিয়েল স্বীকার করে যে, কানাডায় সফল হতে হলে সমাজের মূল ধারায় নিজেকে স্থাপন করার বিষয়টিকে একটি অস্তিত্ব রক্ষার কৌশল হিসাবে নিতে হয়। অন্য কথায় নতুন দেশে অভিবাসনের অর্থ হলো সাংস্কৃতিক সীমারেখা নতুন করে আঁকা।
বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে সাবধান
কিন্তু সম্প্রতি চীন থেকে আসা অভিবাসী পলের মতে, এক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। তার ভাষায়, ‘‘কানাডায় এমন একটি সমাজ রয়েছে যেখানে সবকিছু অঙ্গীভূত করে নিতে হয়, এখানে এসে এবং কানাডিয়ান হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের পুরনো বিশ্বের সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে হয়। আর এটি নিশ্চিত করতে হয় যে, আমাদের সন্তানেরাও পরিপূর্ণভাবে কানাডীয় হবে। কিন্তু আমাদের অনেকের ক্ষেত্রেই এটির পরিসমাপ্তি ঘটে বিচ্ছিন্নতা বোধের মধ্য দিয়ে।’’ সংহতির এই ধারণা যা বিচ্ছিন্নতাবোধের দিকে ঠেলে দেয় এটি কানাডায় বহুসংস্কৃতিবাদের প্রবক্তাদের কাছে প্রত্যাশিত নয়। তা সত্বেও কানাডার অভিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এবং বেড়ে ওঠা অনেক তরুণেরই মনের মধ্যে এ ধরণের বিচ্ছিন্নতাবোধ রয়ে গেছে।
একজন ভারতীয় তরুণী রিটা যেমনটা বলেন, ‘‘আমি নিজেকে ভারতীয় কিংবা কানাডীয় কোনওটাই মনে করি না। কানাডীয় সমাজে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে আমার বাবা-মার চেয়ে আমি অনেক বেশি নিরাপত্তা বোধ করি কারণ আমি স্থানান্তরিত হওয়া মানুষ নই। কিন্তু কানাডায় জন্মগ্রহণ করলেও আমি যেখানেই যাই সেখানেই আমার সঙ্গে ভিন্নভাবে আচরণ করা হয়। তাছাড়া কানাডার মূল সমাজের সংস্কৃতি এবং আমার বাবা-মায়ের মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের মধ্যে কোনটা বেছে নেবো সে বিষয়ে জটিলতা থেকেই যায়।’’ উদাহরণ স্বরূপ, ডেটিং করা, বিয়ে, শিক্ষা ও কর্মজীবন বেছে নেয়ার বিষয়গুলিতে সিদ্ধান্ত নেয়াটা কানাডায় ব্যক্তির নিজের বিষয়, কিন্তু বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা মানুষের কাছে জীবনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই নেয়া হয় পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে।
১৯৮০-র দশকে আর্জেন্টিনা থেকে কানাডায় আসা সোলেদাদ বলেন, ‘‘আমি চাই আমার সন্তানের মধ্যে পারিবারিক মূল্যবোধ থাকবে। আমি এটাও চাই যে, শেকড়ের সঙ্গে আমার সন্তানদের কোনও ধরণের বন্ধন অটুট থাকবে।’’
সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব
ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে অবস্থান করার অর্থ হলো অভিবাসী শিশুদের জীবনে সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব একটি নিত্য দিনের বাস্তবতা। তারা এমন অনুভব করতে শুরু করতে পারে যে, কোনও সংস্কৃতিই তাদের নিজের সংস্কৃতি নয়। এদিকে, বাবা-মায়েরা তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আশু চাহিদা পূরণে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে তাদের পক্ষে সন্তানের মানসিক অনুভূতির বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয়া প্রায়শই সম্ভব হয় না। দুর্ভাগ্যক্রমে এধরণের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব নিরসনে সহায়তা দেয়ার মত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে খুবই সামান্য।
কানাডায় নবাগতদের সহায়তাদানের জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক এবং বিশেষ সংস্কৃতিভিত্তিক অনেক সংস্থা ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে ঠিকই তবে তাদের মূল লক্ষ্য থাকে নবাগতদেরকে ভাষা শিক্ষা দেয়া এবং জীবন-জীবিকার উপায় খুঁজে দেয়ার দিকেই। অনেক ভাষাভিত্তিক সমাজে ব্যক্তি, পরিবার ও যুবসমাজের জন্য কাউন্সেলিংয়ের মত সেবাদানের সুযোগ একেবারেই সীমিত। কিন্তু অভিবাসী পরিবারগুলোকে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসে সহায়তা দেয়ার জন্যই কাউন্সেলিংয়ের মত সেবা দেয়া জরুরী।
ভারসাম্য খুঁজে বের করা
আমাদের স্বাধীনতা ও অধিকারের সনদে বহু সংস্কৃতিবাদের কথা বলা হলেও সংস্কৃতির একটি নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সম্ভবত কানাডায় ‘সংস্কৃতি’ আক্ষরিক অর্থেই একটি রূপকে পরিণত হয়েছে। এটি এই অর্থে যে, সংস্কৃতি বলতে এখন একটির বেশি জিনিস বোঝায়, আর আলংকারিক অর্থেও, কারণ, এর অর্থ হলো অসমানুপাতিক ধারণা নতুন ও পুরনোর মধ্যে সেতু রচনা করা অথবা ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস।
১৯৮৬ সালে কানাডায় আসা মিসরীয় বাবা ও ব্রিটিশ মায়ের সন্তান পিএইচডি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দোনিয়া বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে এভাবে, ‘‘আমার মনে হয়, সংস্কৃতিকে যাতে পশ্চাৎমুখি হিসাবে নাকচ করে দেয়া বা প্রত্যাখ্যান করা না হয় বরং এর লালন ও মূল্যায়ন করা হয় এমন ইতিবাচকভাবে সংস্কৃতির সঞ্চালনের মূল চাবিকাঠি হলো ‘‘ভারসাম্য’’। সর্বোপরি বহু সংস্কৃতির দেশ কানাডার প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতি কোন একক অভিব্যক্তি হতে পারে না। এটি হলো বিভিন্ন অভিব্যক্তির যেমন, লাইফস্টাইল, আদর্শ, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সামাজিক মডেলগুলোর একটি সংমিশ্রন। আমরা এমন একটি জাতি যেখানে বৈচিত্র্য ও সংহতি হাত ধরাধরি করে চলতে পারে। এটি হলো পুরোপুরি ভারসাম্য খুঁজে পাওয়ার বিষয়।
– সূত্র : কানাডিয়ানইমিগ্র্যান্ট.সিএ