বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
জসিম মল্লিক
যখন দেখি কেউ অনেক ভাল আছে তখন তার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখি। ইচ্ছে করে যে দূরত্ব করি তা না, আমার অবচেতন মন আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। ভাবি এই ধরণের মানুষের অনেক বন্ধু, অনেক আপনজন, অনেক গুনগ্রাহী, অনেক চাটুকার থাকে, আমাকে আর দরকার নাই। যখন দরকার ছিল, যখন সে ভাল ছিলনা, কষ্টে ছিল, দুঃখ ছিল তখন আমি তার পাশে ছিলাম। আবার যদি কখনও কষ্ট আসে, দুঃখ আসে তখন আমি তার পাশে দাঁড়াব। জীবন খুউব অনিশ্চিত। আমি ধনী মানুষদের সাথে বাড়াবাড়ি সখ্য করিনা, যেনো সে মনে না করে তার কাছে আমার কিছু চাওয়ার আছে। এমনকি বন্ধুত্বও হতে হয় সমান সমান। তাহলে একটা একুলিব্রিয়াম থাকে। যারা নিজেকে সুপিরিয়র ভাবে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে অসুবিধা হয় আমার।
আমি নিজে কষ্টের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি বলে কষ্টের মানুষেরা আমাকে তাদের একজন মনে করে। আমিও তাদের প্রতি নৈকট্য অনুভব করি। কেউ কেউ আছে নিজেকে রাতারাতি বদলে ফেলতে পারে। আমার এক বন্ধু একদিন লিখেছে, ‘যিবহবাবৎ ঁ পড়সব ঃড় ইধহমষধফবংয, ফড়হ’ঃ ভড়ৎমবঃ ঃড় পষ সব, আমি এখন বসুন্ধরায় নতুন বাড়ি বানাইছি। সুইমংপুলওয়ালা বাড়ি। নতুন বউ, নতুন বাড়ি। ঊাবৎুঃযরহম’ং পযধহমবফ.’ এই বন্ধু দীর্ঘদিন আমেরিকা, কানাডা ছিল। তার স্ত্রী অনেক কষ্ট করেছে ছেলে মেয়ে সংসার নিয়ে। সেই বন্ধু একদিন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে। স্ত্রীর অপরাধ হচ্ছে সে স্মার্ট না, দেখতে সুন্দর না।
আমি উত্তরে তাকে লিখলাম, ‘ঢাকার কত মানুষ পানির অভাবে গোসল করতে পারে না, রান্না করতে পারে না। তুমি সুইমিংপুল দিয়া কি করো! সেখানে কি পানি আছে? তোমার আগের স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে কত কষ্টে আছে তা কি জান! সে এখন অসুস্থ্য। তোমার নতুন বউ হইছে, তার তো নতুন স্বামী হয় নাই! নিজের সন্তান, এতোদিনের সঙ্গীর প্রতি এতোটা নির্মম হইয়ো না।’ যারা কষ্টে আছে, অসুবিধায় আছে বা সামান্য একটু সহযোগিতা পেলে যাদের অনেক বড় উপকার হয় এই ধরনের মানুষের পাশে থাকার পক্ষে আমি। এজন্য নিজের সামান্য ক্ষতি স্বীকার বা কারো পা ধরতেও আমি কুন্ঠিত হব না..।
টরন্টো ২১ জুন ২০২৪
আমি, রহমান এবং খাবারের কষ্ট
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার একজন দুর্দান্ত বন্ধু হয়েছিল। দুজনে দুই ডিপার্টমেন্টের হলেও বন্ধুত্ব হতে আটকায়নি। আমরা মহসিন হলের ছয় তলায় থাকতাম। রহমান তার নাম। রহমানের সাথে আমার সখ্যতা হয় ডাইনিং হলে খেতে গিয়ে। প্রায়ই আমরা পাশাপাশি বসে খেতাম। হলের ডাইনিংয়ের বিস্বাদ খাবার আমাদের কারোরই ভাল লাগত না। কিন্তু আমাদের কোনো চয়েস ছিল না। এতো অল্প পয়সায় আর কোথাও খাওয়ার সুযোগ ছিল না। মাঝে মাঝে একটু উন্নত খাবারের জন্য নীলখেতে যেতাম। মনে আছে মুরগির কোনো একটি পিচকে হেলিকপ্টার বলা হতো। কেনো যে এই নামকরন হয়েছে তা জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সাথে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা হয় না। এখানকার ক্যাম্পাস দিয়ে যারা ঘুরাফিরা করে তারাও মননের দিক থেকে অনেক উঁচু হয়। শত টানাপোড়েনের মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা ছিল আনন্দের। জেসমিন নামক একজনের সাথে পরিচয়ও হয়েছিল এখানেই। আমাদের দু’জনের মধ্যে অবস্থানগত বিশাল দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও পরষ্পরের কাছে আসতে অসুবিধা হয় নি। তাছাড়া আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবনে একজন স্বচ্ছল রূপসী মেয়ের জীবনকেও অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেওয়া ছিল। আমি একটা দু’টা জামা প্যান্ট পড়ে ক্লাস করি আর সে প্রতিদিন একটা করে নতুন ড্রেস পড়ে আসে।
রহমান খাবার নিয়ে ঠাট্টা করত সবসময়। বিশেষ করে ডাইনিংয়ের ডাল নিয়ে। এরকম পাতলা পানির মতো ডাল পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবেনা। দরাজ গলায় হাসতে পারত। আমাকে ডাকত মল্লিক বলে। একসময় আমরা হলের খাবার খেতে খেতে টায়ার্ড হয়ে গেলাম। তখন মহসিন হলে নীরু বাবলুদের দাপট। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদল আর জাসদ ছাত্রলীগ সহাবস্থান করছে। সদ্য প্রয়াত শফি আহমেদ জাসদ ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন। মাঝে মাঝেই হল ছাড়তে হয় আমাকে। নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের সাথে ফাইট। এক রাতে রওফুন বসুনিয়া মারা গেলেন স্বৈরাচার এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে। হল ছাড়তে হলো যথারীতি কিন্তু ঢাকায় আমার থাকার জায়গা নাই। যখন যেখানে সুযোগ পাই রাত কাটাই। মাঝে মাঝে ফার্মগেট ওভার ব্রীজেও রাত কাটানোর কথা ভাবি। আওয়ামী ছাত্রলীগের টোকন ছিল আমার ক্লাসের বন্ধু। ও মাঝে মাঝে থাকতে দিত। পিস্তল দেখিয়ে বলত আমার রুমে থাকবি। নতুন করে হলে ফিরে আসার পর একদিন বন্দোবস্ত হলো আমি আর রহমান একসাথে রুমেই রান্না করে খাব। একটি ছেলে ঠিক করা হলো। সেই বাজার করবে এবং রান্না করবে। শফি ভাই, নীরু ভাই সহ অন্য ছাত্র নেতাদের সাথে পরিচয়ের সুবাদে রুমে হীটার চালিয়ে রান্না করতে অসুবিধা হতো না।
একদিন রহমান বলল মল্লিক আজকে আমাদের বাসায় তোমাকে নিয়ে যাব। রহমানদের যে ঢাকায় বাসা আছে তাই জানতাম না। আমি মহা আনন্দে রাজী হলাম। রহমানের বাড়িতে যাব, নিশ্চয় খেতে দেবে! আমি মহা উত্তেজিত! বাসার খাবার খেতে মন কি রকম আকু পাকু করে। একদিন রহমানের সোলমাইদের বাসায় গেলাম। এলাকাটা তখনও গ্রামই বলা যায়। অথচ গুলশানের লাগোয়া। ৬ নম্বর বাসে চড়ে আমরা গিয়েছিলাম। তারপর রিকশা এবং খানিকটা নৌকায়। পৌঁছে দেখি একটা পুরনো ছোট্ট টিনের ঘর। তাতে দুইটা রুম। রহমানের যে বাবা নাই তাও জানতাম না। ওর মা এবং নাইনে পড়া একটা বোন। আমাদের দেখে খুশীতে উজ্জল হয়ে উঠল বোনটা। রহমানের মা খুব যত্ন করে খাওয়ালেন সেদিন। ওর মা ঘরে বসে কাজ করে পয়সা রুজি করে। কষ্টে সৃষ্টের সংসার। সেদিন আমরা কাজরি মাছ, মেনি মাছ, পাট শাক আর ঘন ডাল দিয়ে পেটপুরে খেয়েছিলাম। ওই রকম স্বাদের খাবার আর খাইনি।
রহমান একদিন আকস্মিক হল ছেড়ে দিল। কোথায় গেলো বলে যায়নি। অনেক খুঁজেও রহমানের হদিস পেলাম না। তারপর অনেক বছর গড়িয়েছে। রহমানের কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ২০১৬ সালে নিউ ইয়র্কে আকস্মিক একদিন রহমানের সাথে দেখা। জ্যামাইকায় আমরা চাইনীজ খেতে গেছি, ওখানে দেখা। হঠাৎ একজন বলল, ’তুমি মল্লিক না!’ আমি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার যেটা হয় প্রথমে আমি কাউকে চিনতে পারি না। একটু সময় লাগে। এ রকম মোটা সোটা চকচকে চেহারার কারো কথা মনে করতে পারলাম না। চিনতে না পেরে লজ্জিত হচ্ছিলাম। সে বলল, আমি রহমান। মহসিন হলের। বলে হা হা হা করে হাসল। এই হাসিটাই আমাকে চিনিয়ে দিল রহমানের কথা।
রহমান একদিন আমাকে ওর লং আইল্যান্ডের বাসায় নিয়ে গেলো। তিন একর জায়গার উপর আলিশান বাড়ি। রহমানের মা নেই। বোনটাও আমেরিকা থাকে। কুইন্সের কোথাও। আমরা খেতে বসলাম। ওর স্ত্রী প্রায় দশ বারো পদের খাবার রান্না করেছে। রহমান বলল, তোমার মনে আছে সেবার আমাদের বাসায় কি কি সব খাইয়েছিলাম! আমি বললাম মনে আছে, কাজরি মাছ, মেনি মাছ আর পাট শাকের সাথে ঘন ডাল। রহমান ঠা ঠা করে হাসল। বলল তোমার মেমোরিতো খুব শার্প! আমি বললাম, আমার সব মনে থাকে। টেবিলে অনেক খাবার দেখতে আমার ভাল লাগে। হল জীবনে আমরা খাবারের জন্য কত কষ্ট করেছি। কিন্তু তা সত্বেও সেই দিনগুলোর কোনো তুলনা হয় না। খালাম্মার হাতের রান্নার স্বাদ কোনোদিন ভুলব না। আজ রহমানের মা নাই আমারও মা নাই। খেতে বসে কত গল্প হলো আমাদের। রহমানের স্ত্রী নাজনীন বলল, আজকাল সবাই খবারের ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করে। এটা আমার পছন্দ না একদম! আমি হেসে বললাম, আমিও পছন্দ করি না। খাদ্য শুধুই বাঁচার জন্য দেখানোর জন্য না ..।
টরন্টো ২২ জুন ২০২৪
গগন বিহার
সত্যি কথা হচ্ছে আমি বেশিদিন এক জায়গায় স্থির থাকতে পারি না। আমার হাঁফ ধরে যায়। মনে হয় কোথাও যাই, কোথাও যাওয়া উচিত, কোথাও গেলে আমার ভাল লাগবে। সংসার থেকেও মাঝে মাঝে বিরতি নিতে হয়। স্ত্রী-সন্তান-আত্মীয়-বন্ধু সবার কাছ থেকে কিছু সময়ের জন্য দূরে থাকা। কখনো কখনো নিজের জন্য বাঁচা উচিত, সবারই উচিত। শুধু নিজের জন্য। প্রতিটি মানুষ একটি ভিন্ন একক, তার নিজস্ব একটা সত্ত্বা আছে। তাকে তার মতো বাঁচতে হবে। ছোটবেলা থেকেই নিজের মধ্যে একটা দূরের ডাক শুনতে পেতাম। মনে হত ওই আমাকে ডাকছে। দূরের পৃথিবী আমায় ডাকে। এখন যেমন ডাকে আমার দেশ, ফেলে আসা ঘরবাড়ি, ওই মেঠো পথ, মা বাবার কবর, পুরনো বন্ধু আমার অপেক্ষা করে। ডাকে আয় আয়।
প্লেনে উড়া একটা নেশার মতো। প্লেনটা গোঁ গোঁ করে ডকিং ছেড়ে রানওয়ের দিকে হাঁটতে থাকে, তারপর বিপুল বেগে ছুট দেয়, তারপর আকাশের দিকে মস্ত এক লাফ মারে। এই সময়টা খুব উপভোগ্য। মনে হয় এক গগনবিহার। জানালা দিয়ে বিমানের গগন-যাত্রার মসৃণ কান্ডটি লক্ষ করি সবসময়। কান বন্ধ হয়ে যায় ফট করে তারপর ঢোক গিললেই খুলে যায়। প্রয়োজনীয় উচ্চতায় উঠে শূন্যে স্থিরবৎ ভারসাম্যে থিতু হলে একধরণের স্বস্থি লাগে।
প্লেন যাত্রায় আমার কখনো ভয় লাগে না। প্রতিবার প্লেনে উঠে ভাবি জীবন কত তুচ্ছ। ক্ষুদ্র ও মলিন পৃথিবীর মাটি ছেড়ে বিশাল আকাশে যখন প্লেনটা উঠে আসে তখন সব ভয় ভুলে সম্মোহিত হয়ে চেয়ে থাকি বাইরে। নিজের ক্ষুদ্রতা বা তুচ্ছতার কথাও মনে থাকে না। ছোট চাকরি হলেও শুরুর দিকে যথেষ্ট প্লেনে চরার সুযোগ পেতাম, তখনই আবিষ্কার করেছিলাম প্লেনের খাবারটাও খুব উপভোগ্য। গরিব ঘরের ছেলে বলে যথেষ্ট খিদা পায় এবং তেমন কিছু বাছাবাছিও নাই..।
টরন্টো ২৩ জুন ২০২৪
কখন সোনার রোদ
আমি সবকিছ্ইু ক্ষমার চোখে দেখি কিন্তু কোনো কিছু ভুলি না। ভুল মানুষের সাথে ভুল সম্পর্কের পুনরাবৃত্তিও করি না। এক সময় সখ্য হয়েছিল কিন্তু কোনো কারণে সখ্যতা নষ্ট হয়েছে সুতরাং ভাঙ্গা সম্পর্ক আর জোড়া লাগাতে যাই না। তার অর্থ এই না যে সে আমার শক্র হয়ে গেছে বা তার মুখ আমি দেখতে চাই না। আমি কখনই কাউকে বুঝতে দেইনা যে আমি তাকে আর পছন্দ করি না। সে আর আমার হৃদয়ের কোথাও নাই। কিন্তু সে আমার শক্র না। আমি কারো সাথে শত্রুটা করি না, প্রতিশোধে বিশ্বাস করি না। শত্রুতা জিইয়ে রাখার জন্য যে রকম শক্ত নার্ভ দরকার তা আমার নাই। আমি যেটা পারি সেটা হচ্ছে মন থেকে মুছে ফেলতে। এটাই সবচেয়ে ভাল সমাধান।
আমি নিজে ভুল করলে লজ্জিত হই, ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা করি না। কিন্তু আমার যদি কোনো ভুল না হয় তাহলে আমি কারো কাছে মাথা নত করি না। কোনো চাপের কাছে নতজানু হই না। সে যত ক্ষমতাবানই হোক না কেনো। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে আর একটা অন্যায় করতে চাই না। অন্যায়কারীর কাছ থেকে দূরত্ব বাজায় রাখাই সহজ সমাধান। আমি কখনও ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা করি না। ভুলের জন্য আমি অনেকই ক্ষমা চেয়েছি।
এমনকি আমি আমার সন্তানদের সাথেও যদি কোনো রুঢ় আচরণ করি এবং যখন বুঝি আমার ভুল হয়েছে তখন আমি নিজের কাছেই লজ্জিত হই। আমার ছেলে অর্ক যতই বড় সড় হোক তার মনটা খুবই নরম। এখনও কড়া কিছু বললে চোখ ছল ছল করে। আমার মেয়ে অরিত্রি মোটেই অর্কর মতো না। সে চুপ করে থাকবে। তখন দু’জনকেই আমি সরি বলি। সামনা সামনি বলতে লজ্জা লাগলে টেক্স করি। মুহুর্তে ওরা আইসক্রীমের মতো গলে যায়। উত্তরে বলবে, ’ইটস ওকে বাবা’। জেসমিনের সাথে ঝগড়া হলেও আমি সমঝোতা করে নিই। আত্মসম্মান ঝেড়ে ফেলে কথা বলি।
টরন্টো ২৭ জুন ২০২৪
এই আমি সেই আমি
দেশে গেলে একাই থাকা হয় আমার। বিশেষ করে রাতটা একাকীত্বে ভরা থাকে। একা থাকা যেমন আনন্দের তেমনি কষ্টেরও। আমি জীবনে দুটোই পেয়েছি। কষ্টও পেয়েছি, আনন্দও পেয়েছি। এখনও পাই। দুঃখ কষ্ট নিয়েই এই জীবন। টাকা পয়সা মনের অর্ন্তনিহিত কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে না। এক সময় কত অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে জীবন পার করেছি। জীবন ছিল সংগ্রামুখর। অনন্ত লড়াই ছিল প্রতি পদে পদে। কিন্তু সেসব নিয়ে কোনো রিগ্রেট নাই। এখনও সংগ্রাম করেই বেঁচে আছি। আমৃত্যু সংগ্রাম করেই বাঁচতে হবে। সম্ভবত আমার জীবনে অবসর বলে কিছু আসবে না। তবে এটা ঠিক এখন যতই স্বচ্ছলতা আর স্বাচ্ছন্দ থাকনা কেনো ফেলে আসা সেই দিনগুলিই বেশি সুখের ছিল। বেশি মহিমান্বিত ছিল।
এমন না যে কানাডায় আমি খুব মানুষ পরিবেষ্ঠিত থাকি। বস্তুতঃ এখানেও আমি একা। অর্ক অরিত্রি দূরে চলে যাওয়ার পর দুঃসহ নিঃসঙ্গতা আমাকে ঘিরে থাকে। ঘরেও আমি একা। নিজগৃহে পরবাসীর মতো। বিদেশে নতুন করে বন্ধুত্ব করা খুবই দুরুহ কাজ। সেই চেষ্টাও আমি করি না। তবে যে কয়জনের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে সেগুলোকে দুর্দান্ত বলা যায়। যেহেতু আমি আড্ডায় ভাল পারফর্ম করতে পারি না, আমার বেশি কথাও থাকে না তাই গর্তের মধ্যেই থাকতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করি। আমি একটু গুটানো মানুষ তাই আমার নিঃসঙ্গতা বেশি। আমি অবশ্য এই জীবনকে মেনে নিয়েছি।
আমার সমস্যাটা একটু অন্য ধারার। মনোজাগতিক সমস্যা। আমি প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ। সে কারণে তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপারেও আমার এক ধরণের ডিপ্রেশন হয়। ক্ষোভ জন্ম নেয় মনে। কিন্তু কেনো এই ক্ষোভ, কার উপর ক্ষোভ সেটা আমার জানা নাই। এসবের প্রতিকার করতে পারি না বলে আমার যন্ত্রণা হয়। অক্ষমতার যন্ত্রণা। আমি আমার সমস্যাগুলো নিয়ে মন খুলে কথা বলতে পারি না। কাউকে কষ্ট দিতে পারিনা। তাই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা কঠিন আমার জন্য। আমি নিজেই নিজেকে কাউন্সিলিং করি, নিজেকে বোঝাই। মনকে শান্ত থাকতে বলি। ঘরে বাইরে কোথাও আমি অবহেলা, অসম্মান মেনে নিতে পারি না। আমার কষ্ট হয়। তারপরও অনেক অন্যায় মেনে নিয়ে বেঁচে আছি। এভাবেই একদিন নাই হয়ে যাব পৃথিবী থেকে। খারাপ কি!
টরন্টো ২৮ জুন ২০২৪
এক দুরন্ত কিশোরের জীবনের প্রথম পাঠ
তখন ভরা বর্ষা কাল। চারিদিকে থৈ থৈ পানি। মামাবাড়ির উঠোন পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। বিল এবং পুকুর পানিতে একাকার। আলাদাভাবে চেনা যায় না। ঘরের পাকা সিঁড়িতে ডিঙ্গি নৌকা এসে ভিড়ছে। বিশাল বিল অথৈ পানিতে ডুবে আছে। বাতাস দিলে সেই পানিতে ঢেউ উঠে। সাগরের মতো বড় বড় ঢেউ। বুক কেঁপে উঠে সেই ঢেউ দেখলে। কয়দিন আগেই পৌষ ধান কাটা হয়ে গেছে। জোয়ারে সব ভরভরন্ত। নদীর দুকুল উপচে পানি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঢুকে পড়েছে। বর্ষার কালটা এভাবেই যাবে। তারপর ভাটার টানে পানি নেমে যাবে। পরে থাকবে কাদা মাটির দাগ। নৌকাই শুধু না গ্রাম দেশে চলাচলের জন্য আরো একটি ছোট যান হচ্ছে তালের ডিঙ্গি। তালের ডিঙ্গি বইঠা হাতে বাওয়ার একটা কৌশল আছে। ব্যালেন্স না রাখতে পারলে উল্টে যাবে পানিতে। আমি নিজে কতবার পানিতে পড়েছি।
আমি ভাল নৌকা বাইতে পারতাম। গ্রামের মানুষরা অবাক হতো। বলত শহরের ছেলে ভালোইতো নৌকা বাওয়া শিখছে! মা বলতেন, ও জসিম তুমি নাকি খালে বিলে নৌকা বাও! না বাবা বাইও না। ডুবলে কি অইবে আনে! মা কে বলতাম আপনি জানেন না আমি কত ভাল সাতার পারি। আমার সাথে গ্রামের ছেলেরাও সাঁতারে পারে না। এখনও আমি সুইমিং পুলে নামলে আমার সাথে পেরে উঠবে না অনেকেই। উজানে কিংবা বা ঢেউয়ের মধ্যে কিভাবে নৌকার হাল ধরতে হয় শিখে ফেলেছিলাম। বৈঠাই শুধু না লগি দিয়েও নৌকা বাইতে হয়। বেশি পানিতে বৈঠা আর কম পানিতে লগি। লগি হচ্ছে বড় বাঁশ। খোচা মেরে মেরে চালাতে হয়। ভরা পানিতে নৌকা সর সর করে এগিয়ে যায়। দু’পাশের গাছ গাছালি দুলে ওঠে। কখনো কখনো ঢোরা সাপ ছুট দেয় পানির শব্দে। আমরা দল বেঁধে নৌকায় চড়ে কোথায় কোথায় চলে যেতাম। একসময় আমার নৌকার মাঝি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। মাকে বলেছিলাম মা আমি মাঝি হবো। মা খুবই অবাক হয়েছিল এইসব কথা শুনে।
তখন আমার আট নয় বছর বয়স। সে রকমই এক ভরা বর্ষার দিনে মামার সাথে কলসকাঠির হাটে গেলাম। গ্রাম দেশে সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। মঙ্গলবার এবং শনিবার। কলসকাঠির হাট অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত হাট। কলসকাঠি বাকরগঞ্জের অন্তর্গত একটা জনপদ। সেটা যুদ্ধের আগের বছরের ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলসকাঠিতে পাক সেনারা অনেক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এলাকাটা হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। কামার কুমারদের জন্য বিখ্যাত ছিল। অনেক বাড়িঘর পুড়য়েছিল সে সময়। আমি নিজেও দেখেছি সেই দৃশ্য।
প্রায় দুই আড়াই ঘন্টা লাগে নৌকায় ঢাপরকাঠি থেকে কলসকাঠির হাটে যেতে। ছোট মামার সাথে যেতে খুব আনন্দ হতো। মামা লাঠি লজেন্স কিনে দিতেন। ঘোল মুড়ি, মোয়া, মিষ্টি খেতাম। খেলনা কিনে দিতেন। আমরা হাট থেকে অনেক রাতে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। গ্রামের সন্ধ্যা মানেই গভীর রাত যেনো। কেরোসিনের কুপি নিভে যায়। ঘরে পৌঁছানোর পর মামা দেখলেন আমার হাতে একটা ছোট্ট প্লাষ্টিকের খেলনা। মামা বললেন, এটা কোথায় পাইছ! আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম দোকান থেকে আনছি। মামা কি বুঝলেন জানি না। সেটা ছিল শনিবারে হাট। পরের হাটে মামা আমাকে নিয়ে গেলেন। খুঁজে খুঁজে সেই দোকানে গেলেন এবং খেলনাটার দাম দিলেন। বললেন ছোট মানুষ না বুঝে নিয়েছে.. সেই ঘটনাটা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি সারা জীবন তা মনে রেখেছি..।
টরন্টো ২৯ জুন ২০২৪
দূর্নীতি একটি আর্ট!
আমার কাছে এখন সবচেয়ে বড় বিনোদন হচ্ছে বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তাদের দূর্নীতির খবর। প্রতিদিনই নতুন নতুন খবর ছাপা হচ্ছে। ভয়াবহ সব দূর্নীতির খবর। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের চা নিজে বানাই। তারপর আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়ি। সকালটা দুর্দান্ত কাটে আমার। ইউরো, কোপা আমেরিকা, টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপের চেয়েও বেশী বিনোদন লাগছে এইসব খবর। আমি যখন দেশে সাংবাদিকতা করতাম তখন কোটি টাকার দূর্নীতি হলেই খবরের শিরোনাম হতো। এখন দুই দশ কোটি টাকার দূর্নীতি অতি তুচ্ছ। ছিঃ টাইপ! এসব খবর ছাপা হলে পত্রিকার স্টাটাসই থাকে না। তারপর আস্তে আস্তে শত কোটির খবর ছাপা শুরু হলো। কয়েকশ কোটি টাকা দূর্নীতি করে ডেসটিনি প্রথম হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। দূর্নীতি তখনই আসলে জাতে উঠেছিল। তারপর নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। দূর্নীবাতিজরাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। তারাই দেশে বিদেশে বহাল তবিয়তে আছে। সবকিছুতে তাদেরই আধিপত্য। তারাই মহান মানুষ এখন। এখনতো হাজার কোটি দূর্নীতি না করলে পত্রিকার পাতায় স্থানই পাওয়া যায় না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে দূর্নীতি হওয়ার পরই সবাই টের পায়। আগে বিশেষ কেউ টের পায় না। কয়দিন থেকে হেভিওয়েট কয়েকজনের নাম খুব আলোচনা হচ্ছে। সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি ছিল বা আছে। তারমধ্যে পুলিশ, আর্মি, কাস্টমসের লোকজনও আছে। সর্বশেষ বরিশাল ভিত্তিক একজন ডিআইজির নাম দেখলাম পত্রিকায়। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া) ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আংশিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঢালাও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএসএ)। সংগঠনটি এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওবায়দুল কাদের স্যারও বলেছেন পুলিশকে ঢালাওভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। সুতরাং এই বিষয়ে কিছু না বলাই ভাল। এমনিতেই আমি ডরফুক মানুষ। বয়স যত বাড়ছে তত ভীতুর ডিম হচ্ছি। আমি শুধু বিনোদিত হওয়ার কথাই বললাম। যাউকগা আপনারা যত খুশী দূর্নীতি করেন। আমি আম জনতা। লিখতে, পড়তে ভালবাসি। পত্রিকা বা সোশ্যাল মিডিয়া আছে বলেই কত কিছু জানা যায়। সত্য মিথ্যা কোর্ট কাছারি আছে তারাই দ্যাখপে আনে।
টরন্টো ৩০ জুন ২০২৪
লধংরস.সধষষরশ@মসধরষ.পড়স