ড্যানফোর্থের বাংলাটাউনে চোরদের উপদ্রব

খুরশিদ আলম

গত ২৮ মে মঙ্গলবার ড্যানফোর্থের বাংলাটাউনে অবস্থিত একটি স্টোরের ক্যাশ রেজিস্টারের ড্রয়ার খুলে আড়াই হাজার ডলার চুরি করে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ একটি চোরের দল। অভিযোগ পেয়ে ঐ দিনই টরন্টোর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং তদন্তের জন্য সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ নিয়ে গেছে।

চুরির ঘটনাটি পুরোটাই ধরা পরে সিসি ক্যামেরায়। ওতে দেখা যায় তিনজন চোর ক্রেতা সেজে ঐ স্টোরে প্রবেশ করে। স্টোরে তখন কর্মরত ছিলেন মাত্র একজন কর্মী। এই সময় কয়েকজন সাধারণ ক্রেতাও ছিলেন স্টোরে।

চোরদের একজন প্রথমে স্টোরে ঢুকে বিক্রয় কর্মীকে ব্যস্ত রাখেন বিভিন্ন পণ্য দেখানোর নাম করে। এই সুযোগে চোর দলের অন্য সদস্যরা কৌশলে ক্যাশ রেজিস্টার এর ড্রয়ার খুলে সমুদয় অর্থ হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ে।

পুলিশ এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও চোর ধরা পড়বে কি না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন স্টোরের মালিক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ স্টোরের মালিক প্রবাসী কণ্ঠকে বলেন, আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এ ধরণের পরিস্থিতির শিকার হলে আমাদের পক্ষে ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি ড্যানফোর্থের অন্যান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরকে সঙ্গবদ্ধ এই চোরচক্রের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য যে, দিন কয়েক আগে ড্যানফোর্থের অন্য একটি স্টোরেও একই ঘটনা ঘটিয়েছে সঙ্গবদ্ধ এই চোরের দল। সেখানেও স্টোরে প্রবেশ করে একই কায়দায় ক্যাশ রেজিস্টারের ড্রয়ার খুলে তিন হাজারেরও বেশী ডলার নিয়ে যায় চোরেরা।

শুধু স্টোর নয়, চোরদের উপদ্রপ লক্ষ্য করা গেছে মসজিদেও! ড্যানফোর্থের মারহাবা গ্রোসারীর উপরতলায় রয়েছে একটি মসজিদ। সেই মসজিদে চোরেরা একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে দানবাক্সের অর্থ চুরি করার জন্য। এই চোরেরা কেউ মসজিদে নামাজ পড়তে আসেননা। কারণ এরা কেউই মুসলিম নন। কিন্তু কি করে যেন তারা জেনে গেছেন এখানে দানবাক্সে মুসল্লিরা অর্থ দান করে থাকেন। আর সেই দানের অর্থ চুরি করার জন্য সেখানে চোরেরা একাধিকবার অভিযান চালিয়েছিল।

ড্যানফোর্থের বাংলাটাউন। এখানকার একটি স্টোরের ক্যাশ রেজিস্টারের ড্রয়ার খুলে আড়াই হাজার ডলার চুরি করে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ একটি চোরের দল। ছবি : প্রবাসী কণ্ঠ

ড্যানফোর্থের বাংলাটাউনে রয়েছে বাঙ্গালীদের বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চোরদের উপদ্রপ নতুন কোন ঘটনা নয়। আগেও শুনা গেছে বাঙ্গালীদের এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন কোনটিতে চুরির ঘটনা ঘটেছে। একবার ৩০১৮ ড্যানফোর্থের উপর তলায় ঘটেছিল এমন এক ঘটনা। শেষ রাতের দিকে চোরেরা সেখানে অভিযান চালায়। ঐ ভবনের উপর তলায় গোটা ছয়েক অফিস রয়েছে বাঙ্গালীদের। চোরেরা প্রথমে নিচ তলায় অবস্থিত প্রধান ফটকটি কৌশলে খুলে নিয়েছিল। এরপর দোতলায় উঠে কৌশলে আরেকটি প্রধান দরজা খুলে নিয়েছিল তারা। সেই দরজা পার হয়ে ভিতরে ঢুকে প্রায় সবকটি অফিসে চুরি করে চোরেরা। পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছিল। কিন্তু চোর ধরা পড়েছিল কি না তা আর জানতে পারিনি পরে। প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের অফিসও ছিল সেই ভবনের দোতলায়।

ড্যানফোর্থের বাংলাটাউনে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিন বিক্রির জন্য স্টিলের তৈরী দুটি কয়েন অপারেটেড নিউজপেপার বক্স বসানো হয়েছিল ইতিপূর্বে। একটি বসানো হয়েছিল ঘরোয়া রেস্টুরেন্টের সামনে এবং অন্যটি মারহাবা গ্রোসারীর সামনে। শক্ত তালাও লাগানো ছিল ঐ বক্স দুটিতে। কিন্তু চোরেরা একাধিকবার স্টিল বক্সের তালা ভেঙ্গে সেখান থেকে কয়েন চুরি করে নিয়ে যায়। তালা ভাঙ্গতে গিয়ে তারা বক্সেরও ক্ষতিসাধন করে। কয়েকবার মেরামত করেও কোন লাভ হয়নি। চোরদের উপদ্রব চলতেই থাকে। সে কারণে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ঐ বক্সদুটি সেখান থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছিল।

বাংলাটাউনে বাঙ্গালী মালিকানাধিন গ্রোসারীগুলোতেও ঘটে চুরির ঘটনা। আর দীর্ঘদিন ধরেই ঘটছে এই ঘটনা। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, এই চোরদের মধ্যে জানাকয়েক বাঙ্গালীও আছেন! হাতেনাতে ধরা পরার পরও এই বাঙ্গালী চোর বা শপলিফটারদের কারো কারো হুস হয়নি। এদের কেউ কেউ দ্বিতীয়বার ধরা পরেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। শুধু একা নয়, পরিবারের সদস্যরা দল বেধে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন এমন ঘটনার ভিডিও রেকর্ডও আছে এক গ্রোসারী মালিকের কাছে। এই দলবদ্ধ চুরির বিষয়টি কয়েক বছর আগের ঘটনা।

আগে ধারণা করা হতো চুরি বা শপলিফটিং শুধু কানাডার বড় বড় দোকানগুলোতেই হয়। কিন্তু খোদ বাঙ্গালী পাড়ায় বাঙ্গালী দোকানে এবং বাঙ্গালী কর্তৃক শপলিফটিং হচ্ছে এমন ধারণা গ্রোসারীর মালিকরাও করেননি আগে। তবে গত কয়েকবছর ধরে কয়েকটি গ্রোসারীতে সিসিটিভি বসানোর পর শপলিফটিং এর ঘটনা ধরা পড়ছে। রেকর্ডকৃত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে এক পরিবারের চার সদস্য মিলে খুব ধীরে-সুস্থে ড্যানফোর্থের একটি বাঙ্গালী গ্রোসারী থেকে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন। ভিডিওতে দেখা গেছে তাঁরা ৪০ পাউন্ডের বেশ কয়েক বস্তা চাল পিছনের দরজা দিয়ে পাচার করে গাড়িতে তুলেন। তাঁরা প্রথমে ক্রেতা হিসেবেই দোকানে প্রবেশ করেন। টুক-টাক কিছু কেনাকাটাও করেন যাতে কেউ সন্দেহ না করে। আর এরই ফাকে ফাঁকে চলে তাদের চৌর্যবৃত্তি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রোসারীর মালিক জানান, আমরা ধারণাই করতে পারিনি কোন বাঙ্গালী এরকম অপকর্ম করতে পারেন। কানাডায় যে সকল বাঙ্গালী এসেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই উচ্চ শিক্ষিত এবং মোটামুুটি অবস্থাপন্ন ঘরের সদস্য ছিলেন দেশে। কিন্তু তাদের মধ্যেও যে দু একজন চোর থাকতে পারেন তা ভিডিওতে ধরা না পরলে আমরা বিশ্বাসই করতাম না। এখন দেখছি, এরকম একটি দুটি ঘটনা নয়, বেশ কিছু ঘটনাই ধরা পরছে ভিডিওতে। আমরা ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় পুলিশ ডাকি না। কারণ এই শপলিফটারদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে তাদের নানারকম সমস্যা হতে পারে। ক্রেডিট হিস্ট্রি থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই তাঁরা লাইফ লং চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে পুলিশ ডাকতে হয়।

চুরির ঘটনায় গ্রোসারীগুলোকে কি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে অনুমান করা যায় যে, লাভের ২/৩ পার্সেন্ট চলে যায় এই চুরির ঘটনায়। বা আরো বেশীও হতে পারে।

উল্লেখ্য যে, চুরি বা শপলিফটিং কানাডার মেইনস্ট্রিম গ্রোসারীগুলোতেও বড়রকমের একটি সমস্যা হয়ে বিরাজ করছে।

অন্টারিওতে Walmart, Loblaws এবং Zehrs এর মালিক পক্ষ তাদের স্টোরে চুরি ঠেকানোর জন্য সম্প্রতি বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন। আর এ কারণে কয়েকটি লবলস এবং জেহর্স এর প্রবেশ মুখে একটি নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়া হয় যাতে লেখা আছে ‘Please be prepared to show your receipt upon exiting to validate and maintain inventory accuracy’। আর কয়েকটি ওয়ালমার্টের প্রবেশ মুখেও টানানো নোটিশে লেখা আছে  ‘Please have Receipt Ready for Proof of Purchase.’ অর্থাৎ এই স্টোরগুলো থেকে কেনাকাটা শেষে বের হওয়ার সময় ক্রেতাকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি তার সাথে থাকা পণ্য সামগ্রীর মূল্য পরিশোধ করেছেন ঠিকমত। আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, ক্রেতা কোন কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন না সেটি প্রমাণ করতে হবে।

কিন্তু Walmart এবং  Loblaw এর মালিকানাধীন Loblaws ও Zehrs এর এই উদ্যোগকে সহজভাবে নেননি অনেক ক্রেতা। রীতিমত ক্ষেপে উঠেছেন তাঁরা। জেইন ইসমাইল নামের এক ক্রেতা সিবিসি নিউজের কাছে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, স্টোর মালিকদের এই আচরণের কারণে মনে হচ্ছে তাঁরা আমাদেরকে অপরাধী বা চোর হিসাবে বিবেচনা করছে। আর হঠাৎ করে তাঁরা কেন এই উদ্যোগ নিয়েছে তাও আমার বোধগম্য নয়। ইসমাইল Zehrs এর একজন নিয়মিত ক্রেতা।

লবলস কেন হঠাৎ করে এই ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সিবিসি তা জানতে চাইলে এক ইমেইল বার্তায় কোম্পানীর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, দোকানের পলিসিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং এটি ক্রেতাদেরকে জানানোর জন্য কয়েকটি দোকানে এই নোটিশ টানানো হয়।

তবে ক্রেতাদের রোষানলে মুখে পড়ে লবলস কর্তৃপক্ষ পরে নোটিশটি সরিয়ে নেয়। কিন্তু লবলস কর্তৃপক্ষ বলেনি যে তাঁরা ক্রেতাদের রিসিট চেকের পলিসি বাতিল করেছে। আর বাস্তবতা হলো, রিসিট চেকের প্রক্রিয়াটি ক্রেতাদের কাছে খুবই বিরক্তকর এবং এই পলিসি প্রয়োগ করাও কঠিন।

ধারণা করা যেতে পারে যে, নোটিশের বিষয়টি আসলে ছিল এক ধরণের সতর্কীকরণ প্রক্রিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে দোকানের মালামাল বেশী মাত্রায় চুরি হচ্ছে এই বিষয়টি সবাইকে জানান দেয়া। বিশেষ করে যারা চুরি করছেন তাদেরকে টার্গেট করে এই নোটিশ।

এই ধরণের নোটিশ বা চেকিং প্রক্রিয়া যে রিস্কি বিষয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ কিছু সংখ্যাক চোরের জন্য এই ধরণের নোটিশ বা চেকিং প্রক্রিয়া গোটা ক্রেতা সমাজকেই বিব্রত করে। তারা এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন দোকান থেকে বের হওয়ার সময়। তাদের মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। অনেকে তখন ঐ নির্দিষ্ট দোকানে যাওয়া বন্ধ করে দেন বা বন্ধ করার কথা চিন্তাভাবনা করেন। কারণ কেনাকাটা করতে গিয়ে দোকান মালিকের চোখে সম্ভাব্য চোর হওয়ার বিষয়টি অপমানকর তাতে কোন সন্দেহ নেই। 

অন্যদিকে দোকান মালিকেরা যখন এই ধরণের উদ্যোগ নেন তখন সেটা কতটুকু যৌক্তিক বা আইনসম্মত সে প্রশ্নও উঠে। কারণ গুটি কয়েক চোরের জন্য গোটা ক্রেতা সমাজকে সম্ভাব্য চোর ভাবা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শোভনও নয়।

এটি ঠিক যে প্রতিদিন দোকানে আসা হাজার হাজার ক্রেতাদের মধ্যে দুই চারজন অসাধু ক্রেতা থাকতে পারেন। এবং আছেনও। কিন্তু তাই বলে সব ক্রেতাকে সন্দেহের চোখে দেখা বা চোর ভাবার কোন যুক্তি নেই। এটি নিঃসন্দেহে একটি অপমানজনক আচরণ। তাছাড়া এই পলিসির প্রধান টার্গেট হয়ে উঠতে পারেন অশে^তাঙ্গ জনগোষ্ঠি। ভেঙ্গুভারে বসবাসকারী ক্রিমিনাল লইয়ার কুষধ খবব- ও এই বিষয়ে একমত। তিনি সিবিসি নিউজকে বলেন, ক্যাশ কাউন্টারে খরিদ করা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে প্রধান ফটকের সামনে আসার পর পণ্যসামগ্রী ও রিসিট চেক করার প্রক্রিয়াটি সমস্যা মুক্ত নয়। কারণ, এখানে বর্ণবাদী বা বৈষম্যমূলক আচরণের সম্ভাবনা রয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি। তিনি বলেন সচেতন ভাবে হোক বা অবচেতন ভাবে হোক, কিছু মানুষ একধরণের পক্ষপাতিত্বে ভুগেন যাদের কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারেন। রিসিট চেকের সময় অশে^তাঙ্গ জনগোষ্ঠি যে প্রধান টার্গেট হয়ে উঠতে পারেন সে বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন ডালহৌসির এগ্রি-ফুড ল্যাব এর পরিচালক সিলভাইন শার্লেবোইস-ও।

কানাডায় ক্রেতাদের রিসিট বা ক্রয়কৃত দ্রব্যাদি চেক করার বিষয়ে একটি বড় ধরণের আইনী জটিলতাও রয়েছে। সেটি হলো, কোন অনিয়ম বা চুরির সুষ্পষ্ট প্রমাণ না থাকলে দোকান মালিক বা তাঁর কোন কর্মী কোন ক্রেতাকে বাধ্য করতে পারেন না তাঁর ক্রয়কৃত মালামাল বা রিসিট দেখানোর জন্য। অবশ্য Costco’র বিষয়টি ভিন্ন। তাঁরা ক্রেতাকে রিসিট প্রদর্শনে বাধ্য করতে পারে। কারণ Costco’র মেম্বারশীপ ফর্মে স্বাক্ষর করার সময় ক্রেতারা সম্মতি দিয়ে থাকেন এই বলে যে, দোকান থেকে বের হওয়ার সময় তাদের রিসিট ও ক্রয়কৃত মালামাল চেক করা যেতে পারে।

লবলজ এর পাশাপাশি কানাডার ওয়ালমার্টও সম্প্রতি ক্রেতাদের রিসিট ও ক্রয়কৃত মালামাল চেক করার পলিসি গ্রহণ করে। তাদের ঐ পলিসির বিরুদ্ধেও ক্রেতাসাধারণ ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। ওয়ালমার্ট ক্রেতাদেরকে ক্রিমিনাল হিসাবে গণ্য করছে এমন অভিযোগ অনেকেই করছেন। ক্রেতাদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এমন অভিযোগও উঠেছে। সিবিসি নিউজের এক খবরেও বলা হয়, ওয়ালমার্ট কর্তৃক রিসিট ও ব্যাগ চেক করার যে পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে সেটি ক্রেতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই পলিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন অনেকেই। এমনকি ক্রেতাদের অধিকার সম্পর্কে উদ্বেগও বাড়িয়েছে ওয়ালমার্টের এই পলিসি।

টরন্টোর উত্তরে অবস্থিত ভন অঞ্চলের বাসিন্দা পেনি রিন্টুল অভিযোগ করে বলেন, এটা ওয়ালমার্টের কোন অনুরোধ নয়, দাবী। তিনি নিজেও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। কেনাকাটা শেষ করে ওয়ালমার্ট থেকে বের হওয়ার সময় তাঁর কাছে রিসিট দেখতে চাওয়া হয়েছিল।

ক্রেতাদের দাবী, এই ধরণের পলিসি খুবই বিরক্তিকর এবং একই সাথে অবমাননাকর। দি কানাডিয়ান সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে বলা হয়, স্টোর কর্তৃপক্ষ যে ভাবে রিসিট চেক করছে তা ক্রেতাদের অধিকারকে বিপন্ন করতে পারে। এসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক এবং জেনারেল কাউন্সিলর মাইকেল ব্রায়ান্ট বলেন, ক্রেতাদের রিসিট বা ব্যাগ চেক করার আগে তাদের সম্মতি নেওয়া উচিত। এই পরিস্থিতিতে কোন ক্রেতা যদি সম্মতি প্রদান না করেন তবে তিনি আইন ভঙ্গকারী হিসাবে বিবেচিত হবেন না। এবং তিনি দোকান থেকে বের হয়ে আসতে পারেন রিসিট বা ব্যাগ চেক করতে না দিয়ে।

সিবিসি নিউজ জানায়, ২০১৬ সালে অন্টারিও সুপরিয়র কোর্ট এর এক বিচারক সন্দেহভাজন এক শপলিফটারের বিষয়ে এক রায়ে বলেন, যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে দোকান মালিক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করতে পারেন। কিন্তু তারপরও ব্যাগ বা রিসিট চেক করতে হলে উক্ত ব্যক্তির সম্মতি পেতে হবে।

রিসিট বা ব্যাগ চেক করার পলিসি গ্রহণ করায় ক্রেতাদের অধিকার লংঘিত হচ্ছে কি না এ  বিষয়ে সিবিসি নিউজের এক প্রশ্নের উত্তরে ওয়ালমার্ট সরাসরি কিছু বলেনি। তবে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র অ্যাডাম গ্র্যাচনিক এক ইমেইল বার্তায় বলেন, প্রতিদিনের খরচ পরিচালনা এবং কম দামে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করার স্বার্থে ক্রেতাদের ব্যাগ বা রিসিট চেক করার পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে এবং একই সাথে ক্যাশ কাউন্টারের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে কি না সেটিও দেখা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়।

তবে সিবিসি নিউজের কাছে বেশ কিছু ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, রিসিট বা ব্যাগ চেক করার জন্য কোন অনুমতি চাওয়া হচ্ছে না, বরং চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদের পলিসি মানার জন্য। পলা ফ্লেচার নামের এক ক্রেতা বলেন, তিনি যখন সেল্ফ চেকআউটে দাঁড়িয়ে পণ্যসামগ্রী স্ক্যান করছিলেন তখন ওয়ালমার্টের একজন কর্মী তার উপর নজর রাখছিলেন। স্ক্যান শেষে তিনি যখন বের হয়ে আসছিলেন তখন ঐ কর্মী তার ব্যাগ ও রিসিট চেক করার দাবী জানান। সেই কর্মী পলা ফ্লেচারকে কোন অপশনের সুযোগ দেননি। পলা বলেন, আমি তাদের এই পলিসি পছন্দ করছি না। অপরাধ না করলেও তাঁরা আমাকে একজন অপরাধী হিসাবে বিবেচনা করবে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁরা যদি আমাদের বিশ্বাস নাই করে তবে এই সেল্ফ চেকআউট এর ব্যবস্থা বাতিল করে দিক।

হাম্বার কলেজের আইনজীবী ও ব্যবসায়িক আইনের অধ্যাপক অ্যালেক্স কোলাঞ্জেলো টরন্টো স্টারকে বলেছেন, ক্রেতাদের জন্য এটি জানা গুরুত্বপূর্ণ যে আইনের দোহাই দিয়ে কোন ক্রেতার রিসিট চেক করা যায় না। এবং কেউ তাদের রিসিট দেখতে চাইলে সেই দাবী প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। তিনি আরো বলেন, কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা পুলিশ কর্মকর্তাদের আছে। কিন্তু গ্রোসারীর কোন নিরাপত্তা কর্মী বা লস প্রিভেনশন অফিসারগণ সাধারণ মানুষের মতনই। ক্রিমিনাল বা ফৌজদারী আইনের অধিনে কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা অনেক সীমিত তাদের বেলায়। তাঁরা একজন ক্রেতাকে তাঁর রিসিট প্রদর্শনের জন্য বলতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা সম্মতি দিলে তাঁর রিসিট চেক করা যেতে পারে। তবে নিরাপত্তা কর্মী বা লস প্রিভেনশন অফিসারদের কোন ক্ষমতা নেই একজন ক্রেতাকে আটক করার যদি তিনি রিসিট দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। তারপরও যদি এমন কাউকে আটক করা হয় যিনি কোন অপরাধ করেননি, তখন দোকান মালিকের বিরুদ্ধে সেই ব্যক্তি আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেন।

তবে লক্ষ্যনীয় যে, কানাডায় শিল্প বিশেষজ্ঞরা এবং গ্রোসারী মালিকগণ অনেকদিন ধরেই দাবী করে আসছেন সাম্প্রতিক সময়ে চুরির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে পণ্যসামগ্রীর দামবৃদ্ধি এবং একই সাথে বড় বড় গ্রোসারীগুলোতে সেল্ফ চেকআউট ব্যবস্থার প্রবর্তন। সেল্ফ চেকআউট ব্যবস্থা চোরদের আরো সুযোগ করে দিয়েছে দশটা পণ্যের মধ্যে একটা বা দুটো পণ্য স্ক্যান না করেই দোকান থেকে বের হয়ে যাওয়ার। তবে কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীগুলো এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। কারণ তাঁরা রেকর্ড মুনাফার ঘোষণা দিয়ে আসছে গত দুই তিন বছর ধরে।

কিন্তু ড্যানফোর্থের বাংলাটাউনের বাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের কি হবে? তারাতো রেকর্ড মুনাফা করছেন না। ছোট ছোট এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চোর ঠেকানোর জন্য কোন সিকিউরিটি গার্ড রাখা বা বড় গ্রোসারীগুলোর মত সিকিউরিটি সিস্টেম চালু করা তাদের জন্য ব্যয়বহুল। ব্যাপারটা তাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়’ এর মত অবস্থা। আর এই সব ছোটখাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যারা চুরি করতে আসেন তারা কোন সাধারণ চোর নন। অর্থাৎ অভাবে পড়ে চুরি করছেন তা নয়। এরা প্রফেশনাল চোর। চুরি করাই তাদের পেশা। সে কারণে এই চোরদের ঠেকানো সহজ কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি বিভিন্ন এলাকার এই প্রফেশনাল চোরদের ব্যাপারে কঠোর না হয় তবে ছোটখাট ব্যবসায়ীদের জন্য তা নিশ্চিতভাবেই চিন্তার বিষয়।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ