কর্মসংস্থানে জোড়াতালির কারণে টরন্টোর অনেক অধিবাসীর পরিবারে দারিদ্র্যচক্র চিরস্থায়ী হচ্ছে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : রিচার্ড ওয়াং একই সঙ্গে অনেক কাজের সঙ্গে জড়িত। তিনি থালাবাসন মাজেন, দারোয়ানের কাজ করেন এবং খাবারের স্বাদ পরীক্ষা করেন এবং ট্যুর গাইড হিসাবেও কাজ করেন।
তিনি টয়লেট পরিষ্কারের কাজ এবং হ্যামবার্গার পরীক্ষার কাজও করেন। ভাগ্য খারাপ হলে তিনি একটি প্রশিক্ষণ হাসপাতালে সিটি স্ক্যান অথবা এক্স-রে গ্রহণের কাজ করে ৫০ ডলার করে আয় করেন।
কিন্তু সবকিছুর ওপরে তিনি একজন পিতা। তার কাজের অনিশ্চিত সময়সূচি এবং জোড়াতালি দেয়া স্বল্প আয়ের কাজ কেবল একটি মিশনের লক্ষ্যে সেলাই করা যে, তিনি তার ৮বছর বয়সী ছেলের কাছে সম্ভব সবচেয়ে ভালো বাবা হতে চান ।
ওয়াং বলেন, আমি এটা নিশ্চিত করতে চাই যে ছেলের উন্নতি বিশেষ করে মানসিক উন্নয়ন যেন ঠিকঠাক মত হয়। তার যা কিছুরই প্রয়োজন হোক না কেন আমি তা তাকে এনে দিই।’’
এ কাজটি সহজ নয়। ক্রমবর্ধমান সংখ্যক কানাডীয়র মত ওয়াং এক ধরণের অনিশ্চিত কাজের আবর্তে বাধা পড়েছেন যা তাকে কিছু অধিকার দেয়, কোনও সুবিধা দেয় না এবং এজন্য তার নিজের জীবনের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ সামান্যই।
ওয়াং একজন মধ্যবিত্ত বিবাহিত মানুষ হিসাবে কানাডায় আসেন; তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনুবাদক যিনি চারুকলার ইতিহাসের ওপর বক্তৃতা দিতেন। উইনিপেগ-এ স্বল্প সময়ের অবস্থানের পর তার পরিবার টরন্টোর ৩২০ ডিক্সন রোডের টাওয়ার ব্লকে সরে আসেন। এখানে পরিবেশ এমনই অসহনীয় যে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে ক্যালগেরিতে তার বোনের কাছে চলে যান।
তার পর থেকেই ওয়াং একাই ছেলেকে লালনপালন করছেন। তাকে বলা হয় যে, অস্থায়ী চাকরি হলো চাকরির মই বেয়ে ওঠার সবচেয়ে সহজ পথ। কিন্তু এক দশক পরও তিনি মইয়ের সর্বনিম্ন ধাপেই রয়ে গেছেন।
প্রতিদিন সকাল ৭টার সময় ওয়াং তার ছেলেকে রেক্সডেল-এ স্কুল-পূর্ব কর্মসূচিতে দিয়ে আসেন। এর পর তিনি যে চারটি কর্মদাতা এজেন্সিতে নিবন্ধিত সেগুলোর মাধ্যমে যতবেশি সম্ভব কাজ করতে থাকেন। সচরাচর তিনি ক্লিনার বা ব্যক্তিগত সহায়তাকর্মী হিসাবে এক ঘণ্টার শিফটে তিন থেকে চার শিফট কাজ করতে পারেন। সম্প্রতি তিনি একজন নিয়োগদাতার কাছে একটি অভিযোগপত্র লিখেছেন।
‘‘আমি বলেছি যে, ‘আমি এই কাজে আর থাকতে পারছি না। আমি সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত পূর্ণ সময় আপনার কাজে নিয়োজিত থেকেছি। আপনি আমাকে তিন ঘণ্টা দিয়েছেন এবং একটি শিফট বাতিল করেছেন অথবা হঠাৎ করেই এমন সময়ে আমি থাকতে পারবো কিনা জানতে চেয়েছেন যখন আমি অন্য কাজে ব্যস্ত রয়েছি।…এতে করে আপনি আপনার পরিবারকে চাপের মধ্যে ফেলেছেন।’’
শিশুদের দারিদ্র্য, পরিবারের অবস্থা এবং কর্মসংস্থানের অভাব সম্পর্কিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ২০০৮ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘‘শিশুদের বিপন্নতার সবচেয়ে বড় কারণ হলো স্বল্প আয়।’’
এরপরও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, বাবা মায়ের কর্মসংস্থান হলেই সবসময় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা না-ও হতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতি তিনজন স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুর মধ্যে অন্তত একজনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের যে কোন একজন কর্মরত রয়েছেনÑ এতে করে প্রমাণিত হচ্ছে যে, বাবা-মা কী ধরণের কাজ করছেন সেটিও সন্তানের দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
ইউনাইটেড ওয়ে’র গবেষণা বিষয়ক পরিচালক মিচেলিন ল্যাফ্লেচি বলেন, ‘‘আমাদের মনে হয়, আপনার চাকরির নিশ্চয়তা, চাকরির বৈশিষ্ট্য এবং পরিবারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ অর্জনের সক্ষমতার মধ্যে একটি জোরালো এবং গভীর সম্পর্ক রয়েছে।’’
কিন্তু আজকের দিনের শ্রমবাজারে চাকরির নিশ্চয়তা ক্রমশই বিরল হয়ে উঠছে।
১৯৮৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার যখন শিশু দারিদ্র্য নির্মূলের অঙ্গীকার ঘোষণা করে তখন দেশে ১৩ শতাংশ লোক অনিশ্চিত চাকরিতে নিয়োজিত ছিলো। ২০০৭ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ২১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর ২০০৯ ও ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে স্থায়ী চাকরির প্রবৃদ্ধির তুলনায় কানাডীয়দের অস্থায়ী চাকরিতে নিয়োজিত হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণ। জিটিএ অঞ্চলে গত দুই দশকে অনিশ্চিত চাকরি প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
নিরাপত্তাহীনতার প্রভাব ব্যাপকভাবে অনূভূত হচ্ছে:
জিটিএতে অনিশ্চিত চাকরির ওপর ল্যাফ্লেচির গবেষণায় দেখা গেছে, এমনকি অস্থায়ী চাকরিতে নিয়োজিত মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোকেও নিশ্চিত চাকরিতে নিয়োজিত স্বল্প-আয়ের পরিবারগুলোর তুলনায় দৈনিন্দিন চাহিদা পূরণে বড় ধরণের অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়।
সুতরাং অনিশ্চিত চাকরির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া কি আন্তপ্রজন্ম দারিদ্র্যকে সামনে নিয়ে আসছে?
ল্যাফ্লেচি বলেন, ‘‘গবেষণায় তেমনটাই পাওয়া যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এটাই সঠিক আভাস এবং গবেষণায় যা বলা হয়েছে তার যথাযথ ব্যাখ্যা।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘ আপনি যদি আপনার শিশুর জীবনের অন্যান্য চাহিদার ব্যাপারে সময় দিতে না পারেন বিশেষ করে তাদের স্কুল জীবনে, আপনার যদি সময়ের ঘাটতি থাকে অথবা কেবলই কাজে যাওয়ার ডাক পাওয়ার জন্য টেলিফোন কলের জন্য অপেক্ষা করেন তাহলে আপনার শিশু সত্যিই বঞ্চিত হবে। তারা সামাজিক পূঁজি গড়ে তোলার এবং তাদের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক সম্পর্কের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সুযোগ হারাবে।’’
অনিশ্চিত চাকরি কেবল যে বাবা-মার অনিশ্চিত পারিবারিক সময় হরণ করে নেয় তা-ই নয় এতে কেবল ন্যূনতম মজুরি বা তার চেয়ে সামান্য বেশি মজুরি দেয়া হয়।
এদিকে শীঘ্রই প্রকাশিতব্য কানাডিয়ান লেবার কংগ্রেসের (সিএলসি) একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭০-এর দশকের শেষ থেকে এপর্যন্ত কানাডায় ন্যূনতম মজুরি কাউকে দারিদ্র্যসীমা থেকে উঠিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট নয়।
সিএলসির সিনিয়র অর্থনীতিক এঞ্জেলা ম্যাকইওয়ান বলেন, ‘‘কানাডার বেশিরভাগ শহরে আপনি যদি একজন একক ব্যক্তি হন এবং আপনি যদি ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করেন তাহলে আপনি অবশ্যই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। আর আপনার যদি পরিবার থাকে তাহলে আপনি নিশ্চিতভাবেই দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করবেন।’’
ম্যাকইওয়ান বলেন, চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিটের মত বেনিফিট ও ট্রান্সফার সুবিধা যোগ করা হলে তা স্বল্প-আয়ের পরিবারগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। তবে এগুলো অনিশ্চিত চাকরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অস্থির শিফট এবং অব্যাহত অনিশ্চয়তা কমিয়ে আনতে পারে না।
ওয়ার্কার্স অ্যাকশন সেন্টারের দীনা ল্যাড বলেন, ‘‘এটি আসলে কাজের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং পছন্দের অভাব। কর্মচারীদের হয়তো দু’সপ্তাহ ধরে কোনও কাজ নাও থাকতে পারে আবার হঠাৎ করে কাজের সরবরাহ বেড়ে যেতে পারে। তারা কাজ পান আবার কাজের অভাবে হাহাকার করতে পারেন।’’
টরন্টো এলাকায় অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিতরা পূর্ণকালীন চাকরিতে কোন অংশীদার পাবেন এমন সম্ভাবনা কমÑ এর কারণ হলো কাজের অনিশ্চিত সময়সূচি শিশু প্রযত্নের ব্যবস্থা করা অসুবিধাজনক এবং ব্যয়বহুল করে তোলে। অনিশ্চিত চাকরিতে নিয়োজিত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের এক-তৃতীয়াংশই জানান যে তাদের জন্য চাইল্ডকেয়ারের সুবিধা গ্রহণ কঠিন। অপরদিকে স্থিতিশীল চাকরিতে নিয়োজিতদের মাত্র ১৫ শতাংশ এধরণের অসুবিধার কথা জানান।
ওয়াংয়ের জন্য স্কুলের আগের এবং স্কুলে যাওয়ার পর চাইল্ডকেয়ার সুবিধা গ্রহণ ছিলো অপরিহার্য, কারণ প্রতিদিনই তাকে কেবল কাজের পেছনেই ছুটতে হয়েছে। এখন তিনি ভর্তুকি দিয়ে চাইল্ডকেয়ার দেয়ার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য তার অনেক নিয়োগদাতার কাছ থেকে কেবল চিঠি সংগ্রহের জন্য ব্যগ্র। তিনি এখন এমন ভয়ও পাচ্ছেন যে নিয়োগদাতারা না আবার তাকে বোঝা বা ঝামেলা সৃষ্টিকারী হিসাবে মনে করেন।
তবে এসব অনিশ্চয়তার মধ্যেও তার একটি ক্ষুদ্র সাফল্য রয়েছে: ডিক্সন থেকে একটি ব্যাচেলরদের অ্যাপার্টমেন্টে উঠে যাওয়ার পর তিনি ছেলের জন্য একটি গিটার কিনে দিতে পেরেছেন। ওয়াং আশা করেন যে, ছেলের মধ্যে একটি শিল্পীসত্তা রয়েছে।
সম্প্রতি তারা ভার্সিটি স্টেডিয়াম এলাকায় বেড়াতে যান। সেখানে ওয়াং আশেপাশের উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলোর প্রতি ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন: সেগুলি হলো রয়্যাল কনজারভেটরি অব মিউজিক এবং টরন্টো ইউনিভার্সিটি। তিনি তান ছেলেকে বলেন, ‘‘আমি স্বপ্ন দেখি যে তুমি এখানে আইভরি টাওয়ারে আসবে। তাদের একজন হিসাবে। গ্রাজুয়েশন নেয়ার পর তুমি ভালো চাকরি পাবে, স্থায়ী চাকরি পাবে।’’ -সূত্র : টরস্টার নিউজ সার্ভিস