আমার দুরন্ত শৈশব

কাজী সাব্বির আহমেদ

বৃহৎ এক পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান আমি। প্রথমে দুই ভাই, তারপর চার বোন, এর পর আমার চেয়ে প্রায় দুই বছরের বড় আরেক ভাই এবং সবশেষে আমি। আব্বা ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়র। চাকরির সুবাদে তাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করতে হয়েছে। তার কর্মজীবনের প্রথম পোস্টিং ছিল চিটাগং-এ। কাপ্তাই জল-বিদ্যুৎ প্রকল্পের শুরু থেকেই তিনি সেখানে জড়িত ছিলেন। ফলে আমার বড় ভাইবোনদের অনেকেরই শৈশব কেটেছে চিটাগং-এ। আমার জন্মের সময় আব্বার কর্মস্থল ছিল বরিশালে। অবশ্য আমার জন্মের কিছুদিন পরেই আম্মা আমাদের ভাইবোনদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য ঢাকার লালমাটিয়াতে আমাদের সদ্য নির্মিত একতলা বাসায় এসে থাকা শুরু করেন। সময়টা ছিল ১৯৬৮ সালের শেষভাগ। সেই থেকে আমাদের পরিবারের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যায় লালমাটিয়ার এই বাসাটি যার রয়েছে একটি কাব্যিক নাম -সূর্যসিঁড়ি। আমাদের বাসাটি তার কাব্যিক নামের কারণে পাড়া প্রতিবেশী সবার কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তখন সবাই একনামে আমাদের বাসাটিকে চিনতেন। তবে সেই সময় লালমাটিয়া ছিল বেশ ফাঁকা, ফলে এমনিতেই প্রতিবেশীরা সবাই সবাইকে চিনতেন। আমাদের বাসাটির অবস্থান হচ্ছে সাতমসজিদ রোড সংলগ্ন গ্রাফিক আর্টস কলেজের ঠিক উল্টোপার্শ্বে। মেইন রোড থেকে ঠিক তিনটি প্লট পরেই। কিন্তু সেই সময় সামনের তিনটি প্লটই ফাঁকা থাকাতে গ্রাফিক আর্টস কলেজের ঠিক উত্তরপাশে অবস্থিত ফিজিক্যাল কলেজও আমাদের বাসা থেকে সরাসরি দেখা যেত। আমাদের বাসার ঠিক পরের গলিতেই অবস্থিত বিখ্যাত লালমাটিয়া বিবি মসজিদ। এই মসজিদের সাথে রয়েছে একটি বিরাট পুকর। আমরা ছোটরা যাতে সেই পুকুরে নেমে লাফালাফি-ঝাপাঝাপি না করি সেজন্যে আমাদেরকে বলা হত যে এই পুকুরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি শিকল যা কিনা বাচ্চাদের পা পেঁচিয়ে ধরে পানির মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। তাই আমরা যারা সাঁতার জানতাম না তারা সেই পুকরে কখনই নামার কথা চিন্তাও করতাম না। প্রতি বছর এই পুকুরে মাইকিং করে মাছ ধরা হতো এবং সেই মাছ বিক্রীর টাকা জমা হতো মসজিদ কমিটির কাছে। মসজিদের সাথে রয়েছে একটি মাদ্রাসা। ছোটবেলায় দেখতাম কুরবানী ঈদের দিন মাদ্রাসার ছাত্ররা গরু অথবা খাসীর চামড়া সংগ্রহ করার জন্য প্রতিটি বাড়ীতে এসে খোঁজ নিত। মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেব প্রতিদিন দুপুরে আসরের আগে আমাকে এবং আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইকে আরবী পড়াতে বাসায় আসতেন। রোজার সময় আমরা আমাদের বাসার পিছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম কখন মসজিদের গম্বুজের উপর লাগানো বাতিটি জ্বলে উঠবে সেটি দেখার জন্য। বাতিটি জ্বলে উঠার ঠিক পর পরই মুয়াজ্জিনের সুমধুর কন্ঠে আজান ভেসে আসত আর আমরা তখন রোজা ভেঙে ইফতার শুরু করতাম। লালমাটিয়া এখন অনেক ঘনবসতি হয়ে উঠেছে। কারণ প্রায় প্রতিটি প্লটেই এখন পুরোনো বাড়ী ভেঙে নতুন এপার্টমেন্ট উঠেছে। আব্বা এবং আম্মার অবর্তমানে আমাদের বাসাটিকেও এক সময় ডেভেলপারের হাতে তুলে দেয়া হয়। বাসাটিকে ঘিরে আমাদের পরিবারের রয়েছে অনেক স্মৃতি। আগের বাসাটি এখন না থাকলেও আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় পুরাতন সেই বাসাটি রয়ে যাবে আজীবন। সারা লালমাটিয়াতে এখন ফাঁকা জায়গা বলতে আর কিছুই বাকী নেই। আগে পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে যে সামাজিক মেলামেশা, সখ্যতা এবং বন্ধন ছিল তা আজকাল বিরল। দেশে বেড়াতে গেলে চিরচেনা লালমাটিয়ার সেই প্রিয় অলিগলি গুলি এখন আমার কাছে কেমন যেন অচেনা লাগে।

আমার শৈশবের সেইসব দাপুটে দস্যুরা আজ কে কোথায়? (ছবি – ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

আমাদের প্রজন্মের জন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগে আগে। যুদ্ধের অনেক স্মৃতিই আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই মানসপটে গেঁথে আছে। তেমনি আমারও মনে গেঁথে আছে যুদ্ধ দিনের বেশ কিছু স্মৃতি। রাতের বেলায় সারা বাড়ী অন্ধকার করে আমরা সবাই আমাদের বাসার ঠিক মাঝখানে প্যাসেজের মধ্যে কম্বল বিছিয়ে বসে থাকতাম। কেন আমরা সেখানে জড়ো হয়ে বসে থাকতাম সেটা না বুঝলেও সাংঘাতিক ভয়ংকর যে কিছু যে কোন মুহুর্তে ঘটে যেতে পারে সেটা বেশ বুঝতে পারতাম। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কলাবাগানে আমার এক খালার বাসায় বিমান থেকে শেল পড়েছিল সেই ঘটনার কথা আমার বেশ মনে আছে। সেই শেলটির একটি ভাঙ্গা অংশ অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের বাসার টুলসবক্সে রক্ষিত ছিল। যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে আমরা পরীবাগে আমাদের মেজোমামার বাসায় গিয়ে উঠি। আমার মেজোমামা ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকনোমিকসের প্রফেসর। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অনেক কলিগকেই বুদ্ধিজীবী নিধনের নীল নকশার শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলির মাঝে একদিন আমাদের সবচেয়ে বড় ভাই যাকে আমরা বড় ভাইজান বলে সম্বোধন করি, উনি পরীবাগ থেকে আমাদের লালমাটিয়ার বাসাতে গিয়ে দেখেন বাসার সব জিনিষপত্র লুট হয়ে গেছে। বড়দের মুখে তখন ‘লুট’ শব্দটি বেশ শোনা যেত। বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হয় অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের দিন আমরা পরীবাগেই ছিলাম। সেদিনকার উত্তেজনার কথা আমার বেশ মনে আছে। পুরো দেশ জুড়ে যেন এক আনন্দ উৎসব। আমাদের জন্য সেই উৎসবকে আরো আনন্দময় করে তুলেছিলেন আমার সবচেয়ে বড় মামাত ভাই। বাবরী চুলের জিন্নাহ ভাই তখন ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে ঢাকাতে এসেছেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি আমাদের জন্য একদিন আকাশে ম্যাগনেসিয়াম ফ্লেয়ার ফায়ার করে রাতের আকাশকে আলোকিত করে তুলেছিলেন। সেই স্মৃতি এখনও আমার কাছে জীবন্ত মনে হয়।

যুদ্ধের পর আমরা শিশুরা সবচেয়ে বেশী যে খেলাটা খেলতাম সেটা হচ্ছে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’। আমাদের বাসার আশে পাশে বেশ অনেকগুলি ফাঁকা প্লট ছিল যেখানে যুদ্ধকালীন সময়ে খোঁড়া হয়েছিল বেশ কিছু ট্রেঞ্জ। সেই ট্রেঞ্জগুলিতে নেমে আমরা আমাদের প্রিয় সেই ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ খেলতাম। তখন এক ধরনের শস্তা কাঠের খেলনা বন্দুক পাওয়া যেত। সেই বন্দুক দিয়েই চলত আমাদের খেলা। সেই সময় বাজারে আরও পাওয়া যেত বুলেটের খোলস দিয়ে বানানো আংটি এবং গলার লকেট। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা এক সময় বিরক্তিকর হয়ে উঠল বিশেষ করে যখন প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। লালমাটিয়া গার্লস স্কুল ছিল আমার প্রথম স্কুল। বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটার দূরত্ব। ক্লাস থ্রী পর্যন্ত সেখানে কো-এডুকেশনের ব্যবস্থা। আমি যখন সেখানে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই তখন আমরা ছয় ভাইবোন ছিলাম সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রী। ক্লাস থ্রী-র বার্ষিক পরীক্ষাতে থার্ড হয়ে আমি ঢাউস আকৃতির গাঢ় সবুজ রঙের মলাটের রাশিয়ান গল্পের অনুবাদ ‘মালাকাইটের ঝাঁপি’ বইটি পুরস্কার পাই। সেই সময় নামমাত্র মূল্যে অনেক মূল্যবান রাশিয়ান অনুবাদ বই পাওয়া যেত ঢাকায়। আমাদের সবার বড় যে ভাই উনি তখন বেশ কিছু সেই সব অনুবাদ বই কিনে ভরিয়ে ফেলেছিলেন আমাদের বুক সেলফ। সেই বুক সেলফে ছিল নানা ধরনের গল্পের বই। আমার মেজবোনের শখ ছিল বই কেনার। তখন ঢাকাতে বাসায় বাসায় বিক্রীর জন্য বই নিয়ে আসত ফেরিওয়ালারা। তাদের কাছে বেশী পাওয়া যেত ওপার বাংলার লেখকদের বই এবং ম্যাগাজিন। ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে আমার মেজবোন আশুতোষ, নিমাই কিংবা ফাল্গুনীর উপন্যাসের পাশাপাশি কিনতেন দেশ এবং উল্টোরথ-এর শারদীয় সংখ্যা। এপার বাংলার সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছিল তখন তুমুল জনপ্রিয়। বাসায় নিয়মিত রাখা হত বিচিত্রা। এছাড়াও বিচিত্রার সাংবাদিক চিন্ময় মুৎসুদ্দি ছিলেন বড় ভাইজানের বন্ধু। তার কাছ থেকে পাওয়া সৌজন্য কপিও আসত আমাদের বাসায়। কে কার আগে কোন গল্পের বইটা, ম্যাগাজিনটা কিংবা পত্রিকাটা পড়বে সেটা নিয়ে আমার বড় ভাইবোনদের ভেতর শুরু হয়ে যেত কাড়াকাড়ি।

আমাদের একটা নীল রঙের রেডিও ছিল। সেই যুগে কেন জানি রেডিও-কে ট্রানজিস্টর বলা হতো। ফলে আমরাও আমাদের রেডিও-কে ট্রানজিস্টর বলতাম। সেই সময় আরও বলা হত যে রেডিও-তে মানুষের কথা, গান বা যে কোন মিউজক নাকি ইথারে ভেসে আসে। তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রেডিও-তে প্রচারিত হত সৈনিক ভাইদের জন্য অনুরোধের গানের আসর ‘দুর্বার’। রবিবার দুপুরে প্রচারিত হত নাটক। নাটক শোনার জন্য রেডিও নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত আমার বড় ভাই এবং বোনদের মধ্যে। এক রাতে আমাদের বাসায় চোর এসে রেডিও সহ আরো কিছু জিনিষ চুরি করে নিয়ে যায়। রেডিও খোয়া যাওয়াতে আমার ভাই বোনেরা বেশ মুষড়ে পড়ে। তখন ঢাকার এসপি ছিলেন আমাদের আত্মীয়। তিনি এসে আমাদের পাড়ার নাইট গার্ডদের চুরির ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর কয়েকদিন বাদেই চোর রাতের বেলায় চুপি চুপি আমাদের পিছনের বারান্দায় রেডিও সহ অন্যান্য জিনিষপত্র ফেরত দিয়ে যায়। রেডিও ফেরত পাওয়াতে আমরা সবাই ভীষণ খুশী হই। বড় ভাইজান একবার তার কোন এক ইউনিভার্সিটির বন্ধুর কাছ থেকে ক্যাসেট প্লেয়ার এবং সাথে করে পশ্চিম বাংলার গানের ক্যাসেট নিয়ে আসেন। আমরা বেশ মজা করে সেই গানগুলো শুনতাম।

আমার এবং আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইয়ের জন্য বড় ভাইজান শিশু, নবারুণ, কিশোর বাংলা ইত্যাদি শিশুতোষ ম্যাগাজিনও আনতেন নিয়মিত। এত সব বই এবং ম্যাগাজিনের মাঝে বড় হতে হতেই পড়ার বইয়ের চেয়ে গল্পের বইয়ের প্রতি আমার জন্মায় প্রবল আগ্রহ। সেই আগ্রহে অবশ্য বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি এখনও পর্যন্ত। শৈশবের পড়া ফিকশন বইয়ের নায়ক হিসেবে প্রথম যে চরিত্রটি বা দস্যুটি আমার হাতে ধরা পড়ে তার নাম হচ্ছে ‘দস্যু বনহুর’। এরপর বাংলার সব দস্যুরা একে একে এসে আমার হাতে ধরা পড়তে শুরু করে। সেই সব দস্যুদের দলে ছিল দস্যু বাহরাম, দস্যু তুফান, দস্যু পাঞ্জা, দস্যু মোহন, দস্যু কালো ভ্রমর এবং আরো অনেকে। অবশ্য সেই সব দস্যুদের হাতের নাগালে পেতে সাহায্য করেছিল মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের ‘আরিফ বুক ডিপো’। আট আনার বিনিময়ে ভাড়ায় পাওয়া যেত এই সব দস্যুদের বই সেখানে। জীবনের এই বেলায় এসে মাঝে মাঝে ভাবি বাংলার সেইসব দাপুটে দস্যুরা আজ কে কোথায়? কারণ আজকালকার ছেলেমেয়েদের হাতে কোন দস্যু সিরিজের বই দেখি না বরং তারা ‘হ্যারি পটার’ নিয়েই মেতে থাকে এখন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই মেইনরোডের সাথে লাগোয়া প্লটে এক সিলেটি পরিবার বাসা তৈরি করে। সেই বাসার একটি বিশেষত্ব ছিল যে তারা মেইনরোডের উপর কিছু দোকান করে সেগুলো ভাড়া দেয়। সেখানে ‘ময়নামতি কনফেকশনারী’, ‘গফুর স্টোর’ এবং ‘তনুশ্রী টেইলার্স’ ছাড়াও একটি লন্ড্রী দোকান ছিল। সেই বাসার এক ছেলে ছিল তখনকার জনপ্রিয় পপ শিল্পী ফকির আলমগীরের দলের সাথে ড্রাম বাজাতেন। প্রায়ই বিকেল বেলায় তাদের বাসায় ফকির আলমগীর এসে গানের রিহার্সেল করতেন। আর আমরা ভীড় করে ফকির আলমগীরের গান শুনতাম। ‘কামেলিরা কাম করিয়া কোথায় যেন লুকাইছে, দুই পাহাড়ের মাঝে মওলা মসজিদ বানাইছে’ – ফকির আলমগীরের গাওয়া এই গানটি ছিল তখন তুমুল জনপ্রিয়।

আমাদের গলির শেষ মাথায় দুইটি প্লট খালি ছিল। ক্লাস থ্রী কিংবা ফোর-এ থাকার সময় থেকেই সেখানে আমি এবং আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই বিকেলে নিয়মিত খেলতে যাওয়া শুরু করি। শৈশবের শুরু থেকেই খেলার প্রতি আমার তৈরি হয় এক প্রবল আকর্ষণ। পাড়ার সিনিয়রদের তত্ত্বাবধানে সেখানে সামারে ফুটবল, উইন্টারের বিকেলে ক্রিকেট এবং রাতে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। আমি এবং আমার ভাই, দুজনেই খেলা নিয়ে মেতে থাকতাম সারাক্ষণ। এক সময় ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবলের খেলা ফলো করা শুরু করলাম। আমার ভাই শুরু থেকেই মোহামেডানের সাপোর্টার আর আমি প্রথমে ওয়ান্ডারাস এবং পরবর্তীতে বড় ভাইজানের ইনফ্লুয়েন্সে আবাহনীর সাপোর্টার হয়ে যাই। সেই সময়কার আবাহনীর স্টপার ব্যাক টুটুল আরেফিন ছিল বড় ভাইজানের বন্ধুর ছোট ভাই। মাঝে মাঝেই বড় ভাইজান আমাদেরকে ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনীর খেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। আমি এবং আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই তখন নিউজপেপার থেকে আমাদের প্রিয় দলের খেলোয়াড়দের ছবি কেটে আমাদের স্ক্রাব বুকের পাতা ভরিয়ে ফেলতাম। ফুটবল খেলায় আমার পজিশন ছিল গোলকিপার। তখন পাড়ায় পাড়ায় ছোটদের ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো। ‘চার ফিট দশ ইঞ্চি’ উচ্চতার ক্যাটেগরির টুর্নামেন্টে আমি একবার খেলে বেশ নাম করে ফেলেছিলাম। সেই সুবাদে অন্য পাড়া থেকে প্রায়ই আমাকে হায়ারে খেলতে নিয়ে যেত। কি নিদারুণ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল সেই দিনগুলো। ক্লাস ফোর-এ থাকতে আরেকটি খেলাতে হাতে খড়ি হয়, সেটি হচ্ছে টেবিল টেনিস। আমাদের সামনের বাসার খালাম্মাদের নীচতলার ভাড়াটিয়াদের ছিল টেবিল টেনিস খেলার সরঞ্জাম। প্রতিদিন দুপুরের ঠিক পরপরই টেবিল পাতা হতো। লালমাটিয়ার সব বাঘা বাঘা প্লেয়াররা এসে জড়ো হতেন সেখানে খেলার জন্য। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ন্যাশনাল লেভেলের প্লেয়ার। মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাদের খেলা দেখতাম কিংবা গিলতাম। তাদের খেলার ফাঁকে আমি এবং আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই দুই একটা শট খেলতাম। ছুটির দিনে খেলা শুরু হতো সকাল দশটায়। মাঝে দুপুরে টেবিল পড়ে থাকত ফাঁকা তখন আমরা দুই ভাই দেদারসে খেলতাম। আমাদের বড় দুলাভাইও ছিলেন টেবিল টেনিস এবং ক্রিকেট খেলার ভক্ত। তিনি আমাদেরকে টেবিল টেনিস ব্যাট কিনে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে বাসার ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে বই দিয়ে নেট বানিয়ে আমরা টেবিল টেনিস খেলতাম। এক সময় আমি টেবিল টেনিসে বেশ দক্ষ হয়ে উঠি। সিনিয়রদের খেলা দেখে দেখে বেশ কিছু কঠিন সার্ভ করা শিখে ফেলি যা কিনা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার আমার মারণাস্ত্র। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস ছাড়াও আরও কিছু খেলা ছিল যেগুলোতে বেশ আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। যেমন, মার্বেল, লাটিম, ঘুড়ি উড়ানো কিংবা লোহার চাকা চালানো। আরেকটি খেলা ছিল ‘চারা-ঢেল’ – লোহার চাকতি ছুঁড়ে এক ধরনের বাজীর খেলা ছিল সেটি। অবশ্য বাজী ধরা হত বিভিন্ন ধরনের সিগারেটের খালি প্যাকেট দিয়ে। সেই জন্য সারা পাড়া হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতাম কোথাও সিগারেটের খালি প্যাকেট পড়ে আছে কিনা। তাছাড়া দুপুরে ভাড়া করে সাইকেল চালানোর আনন্দও ছিল অন্য রকম। আর রাতে পড়া ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই। সেই সময় আমরা এতকিছু নিয়ে মেতে থাকতাম যে, দু’টি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় পেতাম না। প্রথমটি, ক্লাসের পড়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘বোরড’ হওয়া। আজ জীবনের এই বেলায় এসে শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ক্যারেন কার্পেন্টারের বিখ্যাত ‘ইয়েসটার ডে ওয়ানস মোর’ গানের শেষ লাইনগুলো কানে এসে বাজে –

অ’ল মাই বেস্ট মেমোরিজ

কাম ব্যাক ক্লিয়ার টু মি

সাম ক্যান ইভেন মেইক মি ক্রাই

জাস্ট লাইক বি’ফোর

ইট’স ইয়েসটার ডে ওয়ানস মোর

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলাম লেখক । টরন্টো