যে পাঁচটি কারণে দক্ষ অভিবাসীরা কানাডায় চাকরি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন

আপনার কানাডায় আসার স্বপ্ন কি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে?

আপনি এখানে এসেছেন নিজের এবং সন্তানদের উন্নততর জীবনের জন্য। কিন্তু সপ্তাহের পর সপ্তাহ চাকরির আবেদন প্রত্যাখ্যানের চিঠি আপনার ইনবক্স ভরে ফেলছে।

আপনি প্রতিদিন অসংখ্য চাকরির আবেদন করছেন, কিন্তু চাকরির সুসংবাদ দেওয়ার জন্য কেউ আপনাকে ফোন করছে না।

আপনার ফোনে কোনও কল আসছে না, আর যদি আসেও সেটা চাকরি দেবার খবরের জন্য নয়।

আর এরপর আপনি সংশয়ে ভুগছেন। আপনি কি ঠিক জায়গায় আবেদন করছেন? এসবের অর্থ কি? এদেশে এসে আপনি যে দক্ষতা অর্জন করেছেন সেটা কি বাস্তবে অর্থহীন? কানাডিয়ান ড্রিম বলে যে কথাটা বহুল প্রচলিত সেটা কি আসলে মিথ্যা?

গত বছর অন্টারিওর মারখামে আমি একটা গেটওয়ে কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। এতে চাকরি পাবার জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন এমন নবাগতদেরকে তাদের উদ্বেগের বিষয়ে কথা বলার এবং বিভিন্ন কোম্পানির সিইও এবং অন্যান্য পেশাজীবীদেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়।

গত ফেব্রুয়ারিতে টরন্টোতে আয়োজিত একটি জব ফেয়ার এর দৃশ্য। ছবি : ঝো ঝেং/সিনহুয়া

আমি সেখানে চাকরি না পাওয়া দক্ষ অভিবাসীদের অভিযোগগুলো প্রত্যক্ষভাবে জানতে পেরেছি এবং আমি যা আবিষ্কার করেছি এখানে সেটাই তুলে ধরছি।

১.  কানাডিয়ান অভিজ্ঞতার অর্থ নিয়ে ভ্রান্তি

প্রায় প্রত্যেকেই কানাডিয়ান অভিজ্ঞতার বিষয়ে কথা বলেছেন। এমনকি তারা এ নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনারও আয়োজন করেন।

অনেকেই মনে করেন কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স মানে হলো কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেটা আসলে ঠিক নয়। আমার নিজস্ব সংজ্ঞায় কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স:

একজন চাকরিদাতা ব্যবস্থাপকের কাছে কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স মানে হলো মানুষের সঙ্গে কার্যকর ও সুসঙ্গতভাবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আপনার দক্ষতা (সফট স্কিল) এবং কানাডার কর্মসংস্কৃতি সম্পর্কে জানাশোনা।

একটি বিচিত্র পর্যবেক্ষণ: অনেক চাকরিপ্রার্থী বলছিলেন যে, তাদেরকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়, কিন্তু তাতে কখনই চাকরি মেলে না।

বিষয়টি ভেবে দেখুন, সাক্ষাৎকারের জন্য যখন আপনাকে ডাকা হচ্ছে তখনই কিন্তু চাকরিদাতা আপনার রিজিউমি থেকে জানেন যে, কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতা আপনার নেই। এটা যদি কোনও সমস্যা হতো তাহলে চাকরিদাতা আপনাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকবেন কেন?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা ঘটে বলে মনে হয়, সেটা হলো, সাক্ষাৎকারের সময় ওই বিশেষ চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় সফট স্কিল তুলে ধরতে চাকরিপ্রার্থী ব্যর্থ হন।

হয় তার যোগাযোগের দক্ষতার অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে অথবা যখন তাকে পেশাগত অভিজ্ঞতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন প্রার্থী তার শিক্ষাদীক্ষার বিষয়টি বড় করে তুলতে পারেন না (“আমি” শব্দটা ব্যবহারের পরিবর্তে “আমরা” শব্দটি খুব বেশি ব্যবহার করেন)।

একজন চাকরিদাতা মহিলা আমাকে বলেছেন যে, তিনি যেসব প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই কথা বলার সময় এমনকি চোখে চোখে তাকায় না পর্যন্ত। “আলাপ-আলোচনার চেয়ে আমার পায়ের জুতার ব্যাপারেই তাদের আগ্রহ মনে হয় বেশি।”

সাক্ষাৎকারের এই পর্যায়ে ব্যবস্থাপক খুব নম্রভাবে এবং পরোক্ষভাবে আপনাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেবেন (এমনকি বৈষম্য সৃষ্টির দায়ে মামলার মুখোমুখি হওয়ার ভয় মনের মধ্যে থাকলেও) এবং তারা সেই ধরাবাধা কথাই আপনাকে শুনাবেন, “আপনার কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নেই” বা “এই চাকরির জন্য প্রয়োজনের তুলনায় আপনার যোগ্যতা বেশি,” অথচ তারা আসলে বলতে চাইছে যে, “আপনার ইংরেজির মান সন্তোষজনক নয়” অথবা “আমার টিমের প্রতি আপনার মনোভাব ভ্রান্ত” কিংবা “আপনার শিক্ষাদীক্ষা যথেষ্ট নয়”।

মোদ্দা কথা হলো, আপনাকে বুঝতে হবে কানাডীয়রা কীভাবে চিন্তা করে এবং কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স সম্পর্কিত সমস্যা উৎরে যাওয়ার জন্য চাকরিদাতাদের প্রত্যাশা কী!

যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা না করবেন এবং আপনাকে সততার সঙ্গে জবাব দিতে কুণ্ঠিত নন এমন যথাযথ লোকদের কাছে জানতে না চাইবেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপনার ইংরেজি বলার দক্ষতার উন্নয়ন না ঘটাবেন ততক্ষণ পর্যন্ত দক্ষ অভিবাসীরা চাকরি না পাওয়ার অভিযোগ করেই যাবেন।

২.  চাকরির সন্ধানে সক্রিয় উদ্যোগ না নেওয়া

এটি হলো কানাডায় আমার ব্যক্তিগত সাফল্যের উদাহরণ, আমি দুই সপ্তাহে তিনটি চাকরির অফার পেয়েছিলাম।

আপনি যদি একের পর এক অনলাইনে চাকরির জন্য আবেদনপত্র পাঠাতে থাকেন এবং প্রযুক্তিই বাকীটা করে দেবে বলে ভেবে নেন তাহলে আপনাকে দীর্ঘ সময় ধরে চাকরি খুঁজতে থাকতে হবে।

যন্ত্র আপনাকে চাকরি দেবে না। দেবে মানুষ। সুতরাং চাকরিদাতা ব্যবস্থাপককে দেখাতে হবে যে, আপনি কঠোর পরিশ্রম করতে আগ্রহী এবং সেজন্যে মেলবক্সের বাইরে অন্যকিছু চিন্তা করতে হবে।

৩. সরকারের দেওয়া বিভিন্ন পরিষেবা ব্যবহার না করা

পরিষেবা যদি বিনামূল্যে দেওয়া হয় তাহলে সেটা সম্ভবত মানসম্মত হবে না, তাই তো? কানাডায় বিষয়টি এমন নয়!

নবাগতদের জন্য বিনামূল্যে সরকার যেসব পরিষেবা দিয়ে থাকে সেগুলোর মান বিস্ময়করভাব উন্নত।

৪. রিজিউমির কানাডীয়করণ

উল্লেখিত সম্মেলনে কেউ একজন বলেছিলেন যে তার রিজিউমির আকার ছয় পৃষ্ঠা!

মানুষ আসলে ভুল জানে যে, তাদের অভিজ্ঞতার সবকিছুই রিজিউমিতে উল্লেখ করতে হবে এবং তা কানাডার সব চাকরিদানকারী বোর্ডের সামনে পেশ করতে হবে।

এটি ব্যর্থতাকেই নিশ্চিত করে। চাকরিদাতারা নিউজপেপার পড়তে চান না।

আপনাকে পেশাদার লোকদের সাহায্য নিতে হবে এবং নিজের রিজিউমির কানাডীয়করণ ও তাতে চাকরিদাতার প্রয়োজন পূরণের বিষয়টি শিখতে হবে।

রিজিউমির মান পরীক্ষার একটি সেরা উপায় হলো জবস্ক্যান (ঔড়নংপধহ)। এই টুল আপনার আগের রিজিউমির পাশাপাশি চাকরির বিবরণ কপিপেস্ট করে দুটির মধ্যে তুলনা করার সুযোগ করে দেয় এবং আপনার রিজিউমি কতটা মানসম্মত হলো তার স্কোর দেখে নেওয়া যায়।

৫. সাময়িকভাবে এক পা পিছিয়ে যাবার মতো প্রস্তুতি না থাকা

সম্মেলনের সাময়িক বিরতিতে আমি তিনজন অচেনা লোকের টেবিলে উঠে যাই। আমি নিজের পরিচয় দিই। তাদের মধ্যে একজন নার্স, একজন চিকিৎসক এবং একজন ডেন্টিস্ট।

তারা সবাই এরইমধ্যে অন্টারিওর সবচেয়ে জনপ্রিয় দূরত্বমোচন কর্মসূচি (bridging program) ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রিজিং প্রোগ্রামে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।

কিন্তু আমি দেখেছি যে, নবাগতদের অনেকেই এসব পরিষেবার সুযোগ কাজে লাগান না। তাদের একজন বললেন, “আমার ২০ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে, কেন আমি আবার পুরনো বিষয়ে শিখতে যাবো?”

দেখুন, এটা ঠিক যে, আপনাকে আবারও আপনার ক্যারিয়ারের ঘাটতি পূরণের জন্য পিছিয়ে যেতে হচ্ছে এমন অনুভূতি মেনে নেওয়া খুব সহজ নয়।

উন্নততর জীবনের আশায় আত্মীয় পরিজন ফেলে রেখে একটি নতুন দেশে চলে আসার জন্য অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়। কর্মজীবনেও একটি ধাপ পিছিয়ে যেতে একইরকম সাহস লাগে।

আপনার যদি নতুন করে শেখার মত নমনীয়তা এবং কর্মজীবনে ও লক্ষ্যে কয়েক ধাপ পিছিয়ে যাবার  মতো সৎসাহস থাকে এবং যদি আপনি যেখান থেকে শুরু করেছিলেন সেখান থেক উত্তরণের সর্বোত্তম প্রয়াস অব্যাহত রাখেন তাহলে আপনি দেখবেন যে, আপনার আশা বাস্তবে রূপলাভ করতে শুরু করেছে।

আমি অনুসরণ করি এমন একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, কানাডায় নবাগত কোনও ব্যক্তির জন্য পেছনে ফেলে আসা জীবন মান অর্জন করতে মোটামুটি ছয় বছর থেকে শুরু করে ১২ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আমি সেটা পেরেছিলাম তিন বছরে।

এই প্রক্রিয়া শুরু করতে আপনার অহংকার যেন বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়।

সৌজন্যে : কানাডিয়ানইমিগ্রান্ট,কম