আবাসনের ঘাটতি, অভিবাসীদের মরিয়া অবস্থাই বলে দেয় কানাডা তার জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সামলাতে অসমর্থ
ডেনিয়েল টেনসার : গত কয়েক বছরে কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হয়েছে। এজন্যে মূল কৃতিত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের অধিক হারে অভিবাসী আনার লক্ষ্যমাত্রা। কানাডার বয়স্ক জনসংখ্যা সমস্যা মোকাবিলা এবং শ্রমশক্তির ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার অধিক হারে অভিবাসী আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
এই উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে কানাডার অর্থনীতি জোরদার করবে বলে বিশেষজ্ঞরা সাধারণভাবে একমত হলেও স্বল্পমেয়াদে এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃহত্তর টরন্টো অঞ্চলে বাড়িভাড়ার সমস্যা সৃষ্টি করেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে যে, দেশটি তার দক্ষ অভিবাসীদের মেধার অনেকটাই অব্যাহতভাবে অপচয় করতে থাকবে।
কুইবেকের কেইসি দেসজারদিন-এর সিনিয়র অর্থনীতিবিদ বেনোইট পি. ডিউরোচার গত সোমবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে লিখেছেন, জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি “এমনকি সবচেয়ে আশাবাদী জনমিতিগত পূর্বাভাসের চেয়েও অধিক হারে ত্বরান্বিত হচ্ছে।”
২০১৮ এর জুলাই পর্যন্ত আগের ১২ মাসে কানাডায় এসেছে প্রায় চার লাখ ১৩ হাজার অভিবাসী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪ শতাংশ যা জি-৭ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরুর দিকেই কানাডার জনসংখ্যা তিন কোটি ৭০ লাখের সীমা ছুঁয়েছে।
ডিউরোচার লিখেছেন, “জনসংখ্যা বৃদ্ধিার হারের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কানাডার বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।”
“যদিও এই দ্রুততর প্রবৃদ্ধির ফলে শ্রমবাজারে সত্যিকার অর্থেই অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন ঘটেছে এমনটা দেখা যায়নি।”
কানাডার জনসমষ্টি বয়বৃদ্ধ হয়ে পড়ায় অবসরপ্রাপ্ত মানুষের হার বাড়ছে এবং চাকরিতে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এটিই হচ্ছে কানাডায় চলতি বছর দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেওয়ার কারণগুলোর অন্যতম। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রায় চার লাখ চাকরির পদ শূন্য থাকবে।
এই প্রবণতা রোধ করতে সহায়তা করতেই কেন্দ্রের লিবারেল সরকারের অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ। তবে ডিউরোচার বলছেন, এটা যথেষ্ট নয়।
অভিবাসী আগমনের সংখ্যা বাড়লেও চাকরিতে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার দীর্ঘদিনের প্রবণতা রোধ করা যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তোর প্রজন্মের লোকেদের অবসরের পর অনেক কম মানুষ এখন কর্মরত আছে।
ডিউরোচার উল্লেখ করেন যে, “এটাও হয়ে থাকতে পারে যে, নতুন অভিবাসীদের একটি অংশ হয়তো এখনও শ্রমবাজারের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি এবং সেজন্যে তারা এখনও শ্রমশক্তির অংশ নয়।”
“জনসংখ্যা বৃদ্ধি দ্রুততর হলেও তা এখন পর্যন্ত দেশের জনশক্তি সঙ্কটের সমাধানে যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না।”
টরন্টো অঞ্চলের অভিবাসী কর্মসংস্থান কাউন্সিলের প্রকাশিত আলাদা এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, কানাডায় আসা সবচেয়ে দক্ষ অভিবাসীদেরও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে কঠিন সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, টরন্টোতে আসা অভিবাসীদের মধ্যে ২০১৬ সালে চাকরিহীন বেকারের সংখ্যা ছিলো স্থানীয় জনগণের মধ্যে বেকারের সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ সাড়ে ১২ শতাংশ। তবে বছরখানেক সময়ের মধ্যে সেই ব্যবধান কমে এসেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী অভিবাসী নারীরা তাদের কানাডায় জন্মানো প্রতিপক্ষের চেয়ে গড়ে অর্ধেক পরিমাণ অর্থ আয় করেন। রিপোর্টে বলা হয়, “গত ১৫ বছরে এই প্রবণতা সামান্যই পাল্টেছে।”
রিপোর্টে বলা হয়, স্নাতক ডিগ্রিধারী অভিবাসী পুরুষরা মধ্যম মানের অর্থ উপার্জন করেন যা তাদের কানাডায় জন্মানো পুরুষদের আয়ের ৭৪ শতাংশ মাত্র। কিন্তু অভিবাসী পুরুষদের গড় আয় কানাডায় জন্মানো পুরুষদের গড় আয়ের মাত্র ৪১ শতাংশ। এতে করে বোঝা যায়, অভিবাসীদের খুব সামান্য অংশই উচ্চতর হারে আয় করেন।
রিপোর্টে এমন উপসংহার টানা হয়েছে যে, “অভিবাসীসহ সবার জন্য সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপায়নের জন্য এবং বিশ্বজুড়ে মেধা সংগ্রহের লড়াইয়ে কানাডাকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদেরকে আরও অনেক কিছু করতে হবে।”
রিপোর্টে নীতিনির্ধারকদের প্রতি বিশেষ করে অভিবাসী নারীদের মদদ দানের সুযোগ সৃষ্টি, নিয়োগদাতাদের জন্য ‘কানাডীয় কর্ম অভিজ্ঞতার’ চাহিদা থেকে বেরিয়ে আসা এবং নিয়োগদাতারা যাতে বিদেশি প্রার্থীদের শিক্ষাগত সনদের স্বীকৃতি দেন সেজন্যে আরও বেশি সুযোগ করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়।
‘সঙ্কটে’ টরন্টোর আবাসন খাত
কানাডার জনসংখ্যার জোরালো প্রবৃদ্ধি রিয়েল এস্টেটের বাজারকেও জোরদার করছে যাকে ডিউরোচার ইতিবাচক ঘটনা হিসাবেই দেখছেন। যদিও বন্ধকির সুদের উচ্চ হার এবং ভাড়ার নতুন বিধিবিধানের কারণে চলতি বছর আবাসিক খাতের রিয়েল এস্টেট-এ উল্লেখযোগ্য মন্থরতা এসেছে।
ডিউরোচার লিখেছেন, “দেশের বেশিরভাগ এলাকায় ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী জনসংখ্যা যাদেরকে প্রায়শ প্রথমবারের মত বাড়ির ক্রেতা হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ত্বরান্বিত হয়েছে। এর ফলে বাড়ির চাহিদা বেড়েছে এবং সেজন্যে আবাসিক বাড়ি নির্মাণের ও বিদ্যমান বাড়ি বিক্রির হার বেড়েছে।”
“এতে করে আবাসনের বাজারে সুদের হারের পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধির যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হচ্ছিলো তা অংশত হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে।”
তবে যে সমস্যাটি স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে সেটি হলো কানাডার শহরগুলো চলমান অস্বাভাবিকভাবে নবাগতদের বিশাল স্রোত সামলে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। বৃহত্তর টরন্টোতে গত এক বছরে উদ্বাস্তু ও শিক্ষার্থীসহ জনসংখ্যা লাফিয়ে এক লাখ বেড়ে গেছে। এখানে ভাড়া দেওয়ার উপযোগী আবাসন খাত মারাত্মক চাপের মধ্যে রয়েছে।
প্যাডম্যাপার-এর তথ্য অনুযায়ী, এক বেড রুমের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া গত এক বছরে ১৫.৬ শতাংশ বেড়ে বর্তমানে মাসে ২,২২০ ডলারে উঠেছে।
আর অ্যাপার্টমেন্ট খালি হবার হার একেবারেই কমে গেছে। এর হার হলো বর্তমানে ০.৫ শতাংশ মাত্র। গত এক বছরে বাড়ি বিক্রির হার কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ডেভেলপাররা নতুন বাড়ি নির্মাণের কাজে ঢিলে দিয়েছেন।
টরন্টো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং স্বনামধন্য নগরবিদ রিচার্ড ফ্লোরিডা ব্লুমবার্গ নিউজকে বলেন, “আমরা জনসংখ্যা, আমাদের শিল্প এই সব দিক থেকে আমরা এমন এক বিন্দুতে উপণীত হয়েছি যখন আমরা এই সব কিছুরই ভার বহনে মারাত্মকভাবে অসমর্থ।”
“আমরা একটি সঙ্কটের মধ্যে রয়েছি কিন্তু আমরা এমনকি সেটা বুঝতেও পারছি না: আমাদের চলাচল, পরিবহন এবং আবাসনের সমস্যা খুবই জরুরী বিষয়।”
সমাধানের বিষয়ে মতভেদ
প্রিমিয়ার ডাও ফোর্ডের প্রাদেশিক সরকার সম্প্রতি নতুন ভবনের ওপর ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে নিয়েছেন যা সাবেক লিবারেল সরকার ২০১৭ সালে চালু করেছিলো। বাড়ি সুলভ করার উদ্দেশ্যে লিবারেল সরকার ওই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
নতুন সরকার বলছে, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে নেয়ার ফলে ডেভেলপাররা নতুন ভাড়ার বাড়ি নির্মাণে উৎসাহিত হবে। তবে সাবেক লিবারেল সরকারের নীতির সমর্থকরা বলছেন, ২০১৭ সালের আগে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থাই ছিলো না। তারপরও ডেভেলপাররা যথেষ্ট পরিমাণে ভাড়ার বাড়ি নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে। বরং এখন কন্ডো বানানোর জন্য তাদের যথেষ্ট অর্থ আছে।
ফ্লোরিডা মনে করেন, আবাসন সঙ্কট নিরসনে টরন্টোকে অনেক বেশি সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যেমন, ডেভেলপাররা অপেক্ষাকৃত শস্তা ও দ্রুত বানানোর উপযোগী মডিউলার বাড়ি নির্মাণের দিকে মনোযোগ দিতে পারে।
এর পরও সব রকম স্বল্পমেয়াদি সমস্যা সত্বেও কানাডার বৃহৎ অভিবাসী তরঙ্গ দেশটিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে ধীরগতির দেশগুলোর বিপরীতে একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেবে বলে ডিউরোচার মনে করেন।
তিনি লিখেছেন, “জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির মানে হলো দীর্ঘমেয়াদে কানাডার উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা। জনসংখ্যাগত নানা সমস্যা থাকার পরও জনসংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কানাডা যে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে এটি একটি ভরসার জায়গা। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চেয়ে কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুততর রাখাটা এ দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে উপকারী হবে।” – সূত্র : হাফপোস্ট