বন্ধ কোরো না পাখা
দেলওয়ার এলাহী
কাল সারাটা দিন কেটেছে আনন্দে উচ্ছলতায়। দুপুরে বাচনিক আয়োজিত বনভোজনে গিয়ে চিৎকার হৈচৈ আর আনন্দে মজে ছিলাম। ছোট্ট সোনামণিদের সান্নিধ্যে নির্মল আনন্দের রেশ নিয়ে বিকেলে উপস্থিত হয়েছিলাম অন্যস্বর অন্যথিয়েটার আয়োজিত- ‘আলোকে উজ্জ্বল জীবনে, চঞ্চল-আনন্দগান গা রে হৃদয়’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে। অন্যস্বর অন্যথিয়েটারের যে কোন আয়োজন নির্ধারিত সময়ে শুরু করার যে দৃঢ় সংকল্প তারা প্রতিটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রমাণ রেখে চলেছেন, তার প্রশংসা করতেই হবে। আমরা যেহেতু ঘোষণা দেওয়া নির্ধারিত সময়কে অবহেলার চর্চায় দেখে দেখে অভ্যস্ত ও বিরক্ত; তাই, ব্যতিক্রমী অপরাপর সংগঠনের মতো নির্ধারিত সময়কে সম্মান দেখানোর জন্য অন্যস্বর অন্যথিয়েটার টরন্টোকেও ধন্যবাদ ও অভিবাদন জানাই।
অন্যস্বর অন্যথিয়েটারে যে আবৃত্তিকারদের মধ্যেও যে গানে পারদর্শী শিল্পী আছেন, কালকের অনুষ্ঠানে তা অবাক হয়ে দেখলাম৷ মৈত্রেয়ী দেবী, ফারহানা শান্তা, আশেক ওয়াহেদ চৌধুরী আসিফ, শিরিন চৌধুরী তো কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। অন্যস্বর অন্যথিয়েটারের আয়োজিত অনুষ্ঠানে তারা গান গাইবেন, শ্রোতাদর্শকদের ন্যুনতম চাওয়া-পাওয়াকে সুরের সুধা ঢেলে পূর্ণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কাল সন্ধ্যায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এমনকি প্রত্যেকেই তাদের পরিবেশনায় শ্রোতাদর্শকদের মন জয় করে নিয়েছেন আবারও। তা সত্ত্বেও মেহজাবীন বিনতে ওসনানের গান শুনে সবাই মুগ্ধ। প্রশংসায় পঞ্চমুখ। টরন্টো শহরে মেহজাবীনের উপস্থিতিতে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবারের সঙ্গীতের তালিকাটি আরো সমৃদ্ধ হবে। আরো গৌরবময় হবে, এই আমার বিশ্বাস। স্বাগতম ও শুভকামনা মেহজাবীন। অনুষ্ঠানে অন্যস্বরের পর্বে মঞ্চে বসা পরিবেশনারত তিনজনের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে চাই : রিক্তা মজুমদার, রনি মজুমদার ও রনি পালমার। একই পরিবারের তিনজন গুণী মানুষ। রিক্তা মজুমদার-রনি পালমার বোন-ভাই। রিক্তা মজুমদার ও রনি মজুমদার স্ত্রী-স্বামী। বোন-ভাই-ভগ্নিপতি। এই ছবিটাও তো একটি সাংস্কৃতিক পরিবার হিসেবে আমাদের কাছে অনেক বড় প্রেরণার। যাদের নাম উল্লেখ করলাম, আমি মনে করি এরা প্রত্যেকেই আমাদের টরন্টো শহরের সাংস্কৃতিক পরিবারের আত্মার আত্মীয় ও অলঙ্ঘনীয় স্বজন। এই স্বজনেরা যে কোন উপলক্ষে যখন জমায়েত হোন, এমনিতেই আনন্দের উৎসমুখ খুলে খুলে যায়। স্মৃতির জানালা খুলে সেখানে উঁকি দেন কবি আসাদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান, অনন্ত আহমেদ, অনিন্দ্য শান্ত অথবা অনুপস্থিত মুখের অবয়ব। এরকম পরিবেশে যদি গানের আসর নির্ধারিত থাকে রবীন্দ্রনাথের গানের ডালি দিয়ে, তাহলে আমার নীরব হয়ে অধীর আগ্রহে বসে থাকায় ক্লান্তি আসে না। কাল সন্ধ্যা আটটা বাজার ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে থেকে যন্ত্রসংগীতের সুর মুর্ছনায় অনুষ্ঠানের শুরু হয়। মুনিমা শারমীন কণ্ঠস্বরকে ভারসাম্যের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাহুল্যকে বর্জন করে মেলে ধরলেন অনুষ্ঠানের আয়োজনের পরিকল্পনা। তুলে ধরলেন রবীন্দ্রনাথকে আমাদের জীবনের আনন্দ-বেদনার ভাবনার রঙে এঁকে রাখা ছবিটিকেও। একেকটি গানের সেই অনিবার্য তথ্যটিকেই উল্লেখ করলেন, যেটা গানের রস আস্বাদনকে ব্যাহত করে না, বরং সেই গানটি সম্পর্কে শ্রোতাদর্শককে সমৃদ্ধ করে। গানের আসর এই শহরের ত্রিরত্নের বাদনে নির্বিঘ্ন ও মুগ্ধকর হয়েছিল। জাহিদ হোসেন, রনি পালমার ও জনি ফ্রান্সিস গোমেজ আমাদের রত্নই। শব্দ নিয়ন্ত্রণের অসাধারণ দায়িত্বটি পালন করেছেন আমাদের সবার প্রিয় মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ। মামুনকে অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। গান হলো। কথা হলো। কিন্তু অন্যস্বর তো মূলত আবৃত্তি সংগঠন! কবিতা হবে না! কবিতা হবে। নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন আহমেদ হোসেন, দিলারা নাহার বাবু। একে একে অন্যস্বর-এর আবৃত্তিকাররা সমস্ত শ্রোতাদর্শকদের ঘিরে চারদিকে হেঁটে হেঁটে খোলা কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’। যে পৃথিবীতে আমরা বাস করছি, তার প্রতিটি মানুষের কানে কানে যে মন্ত্র বাণীটি রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিয়েছিলেন – অন্যস্বর খোলা গলায়, খোলা আকাশের নীচে যেন প্রত্যেকের কানে বলে দিলেন – এখনই, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা! আমাদের এই দুঃসময়ের পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের এই বাণী দিয়ে শেষ হয় অন্যস্বর-এর পরিবেশনা। এরপর শুরু হয় সমকালীন রবীন্দ্রসঙ্গীতের দেশবরেণ্য শিল্পী লিলি ইসলামের একক পরিবেশনা। লিলি ইসলামের পরিবেশনা যারা আগে শুনেছেন, তারা জানেন লিলি ইসলামের গানের আসরকে একটি গল্পের আড্ডায় মজাদার ও উপভোগ্য করে তুলেন। লিলি শান্তিনিকেতনে এমন এক সময় সঙ্গীতের ছাত্র ছিলেন, যখন শান্তিনিকেতনে গান শেখাতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখা ও কবিগুরুর স্নেহধন্য রবীন্দ্রসংগীতের দিকপালরা। রবীন্দ্রনাথের গানে ভক্তি ও আসক্তি আছে, এমন যে কোন শ্রোতাদর্শকদের কাছেই অমিতা সেন, শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্র মিত্রের গল্প অমৃতের সমান। লিলি ইসলাম তার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানের পরিবেশনার সঙ্গে সঙ্গে গল্পে গল্পে সেই অমৃতও বিতরণ করেন। ফলে, তাঁর গানের আসর হয়ে ওঠে নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে মুগ্ধ কানে বসে থাকার আনন্দের ফুসরত। আনন্দময় ফুসরতের জন্য অন্যস্বরকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
দেলওয়ার এলাহী জুলাই ৭, ২০২৪ টরন্টো