রিফিউজি

জসিম মল্লিক

প্রায় সময়ই অনেক সহজ বিষয়ও মাথায় ঢোকেনা। হয়ত বিষয়টা নিয়ে তত মাথা ঘামাইনা বলে এমন হয়। জগতের অনেক ব্যাপারই বুঝতে পারিনা। আবার সবার জ্ঞানের পরিধিও সমান নয়। আমি আমার নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানি। অনেক গুরূত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা সম্পর্কে আমি ভীষণভাবে অজ্ঞ। সবাই যখন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে তখন আমি ক্যাবলার মত শুনি। আবার ভাবি কত অল্প জেনেও তো মানুষের জীবন পার হয়ে যায়! যে বিষয়টা সম্মন্ধে জানি না সেটা নিয়ে কথা বলে লজ্জা পেতে কে চায়! সেজন্য অপেক্ষায় থাকি কেউ না কেউ না জানা বিষয় নিয়ে বলবেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার বিখ্যাত ‘অর্ধেক জীবন’ গ্রন্থে এক জায়গায় বলেছেন ‘আমার চরিত্রের প্রধান দুর্বলতা এই যে, আমি নিজেকে জোর করে উপস্থাপিত করতে পারি না এবং প্রত্যাখান একেবারে সহ্য করতে পারি না। যেখানে প্রত্যাখানের সামান্য সম্ভাবনা থাকে সেখানে কিছু চাই না, সেখানে যাই না। এমনকী নিশ্চিত সম্মতির আভাস না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোনও মেয়ের কাছেও চুম্বন প্রার্থনা করিনি। তা হলেও কি জীবনে কখনও আমাকে প্রত্যাখান সহ্য করতে হয়নি? হয়েছে অবশ্যই, অনেক সময় নিজের অনিচ্ছায় বা অন্যের তাড়নায় মানুষকে অনেক জায়গায় যেতে হয়, কিছু চাইতে হয়। সংস্কৃতে একটা কথা আছে, যাচ্ঞা মোঘা বরমধি গুনে নাধমে লব্ধকামা। অর্থাৎ, অধমদের কাছে কিছু চেয়ে লব্ধকাম হওয়ার বদলে গুনসম্পন্ন কারও কাছে কিছু চেয়ে ব্যর্থ হওয়াও ভালো। কিন্তু এ যুগে অধমদের হাতেই যে বেশি ক্ষমতা! এবং তারা কিছু দেবার আগে ক্ষমতা দেখাতে চায়।’ আমার অবস্থাও অনেকটা ওইরকমই। তাই ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে দুরে থাকা শ্রেয় বলে জ্ঞান করি।

বিদেশে আসার পর প্রায়ই রিফিউজি কথাটা শুনতে পেতাম। রিফিউজি শব্দটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় ছোটবেলায়। আমাদের বড়ির কাছেই সি এন্ড বি রোডের পাশে বেশ কিছু চারতলা বিল্ডিং ছিল। এগুলোকে বলা হতো রিফিউজি কলোনী। কেনো যে এই নাম হল আজও জানি না। সেখানে আমরা বিকেল হলে মাঝে মাঝে খেলতে যেতাম কারণ আমার বেশ কয়েকজন স্কুলের বন্ধু বাস করতো এই কলোনিতে। আর ছিল সুন্দর সুন্দর মেয়েরা। মেয়েদের দেখার জন্যও যেতাম। রিফিউজি যে আলাদা কিছু, তাদের যে আলাদা ধরণের দ:ুখ বেদনা আছে তখন তো তা মনে হয় নি! আমরা একত্রে খেলতাম, হাসতাম, বেড়াতাম। তারা তো কত সুখী ছিল দেখেছি। একথা ঠিক যে তারা কেউ স্থানীয় ছিল না। চাকরী সূত্রে তারা এসেছে। এটা ছিল আসলে সরকারী কলোনী। সরকারী কলোনীর নাম কেনো রিফিউজি কলোনী হবে? কেউ অন্য যায়গা থেকে এলেই বুঝি তাকে রিফিউজি বলতে হবে!

রিফিউজি আদেনকারীদের মতো দু:খী বিদেশে আর নেই। তাদের কষ্টগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করা দরকার। ছবি : সাটারস্টক

দেশ ভাগের পরে অনেক লোক ভারতে চলে যায়। তারা সেখানে ভাল জীবন পেলেও তাদের মধ্যে একটা দু:খবোধ ছিল। ভাবতো তারা কি রিফিউজি? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ সম্পর্কে অনেকদিন পর বাংলাদেশে বেড়াতে এসে একবার লিখেছেন ‘শীতকালে মেঘহীন নক্ষত্র খচিত আকাশ। ছায়াপথের অণু-পরমাণুর মতন আকৃতির সব তারা, যেমন ছোটবেলায় ছাদে শুয়ে দেখেছি। তখন মনে হত, এই বিশাল মহাকাশে আমাদের এই পৃথিবী নামের গ্রহটি একটা বালুকনার মতোও নয়। তার চেয়েও অতি ক্ষুদ্র। তারই মধ্যে মানুষের সভ্যতা, সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের কল্পনার জগৎ কত সীমাহীন, কালহীন, দিগন্তহীন? এই পৃথিবীরও অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে কত মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে গেছে, খাদ্য, পানীয় ও নিরাপত্তার সন্ধানে মানুষ জন্মস্থান ছেড়ে অজানার সন্ধানে যেতে দ্বিধা করেনি, পাড়ি দিয়েছে আপাতদৃষ্টিতে অকুল সমুদ্র। তা হলে আমার বাবা-কাকারা যে-কোনও কারণেই হোক ফরিদপুর ছেড়ে চলে গেছেন কলকাতায়, তা নিয়ে এত আদিখ্যেতা করারই বা কী আছে? মানুষ তো বাসস্থান বদলাতেই পারে। মাদারিপুরের সেই গ্রামের বাড়ির তুলনায় কলকাতায় আমরা তো তেমন খারাপ অবস্থায় নেই। প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হলেও যে নাগরিক উপভোগ পেয়েছি, তা কি কম আকর্ষনীয়? দেশ কি একটা ধোঁয়াটে আবেগময় ধারণা মাত্র নয়’!

আজকের প্রেক্ষাপটে হয়তবা সব কিছু বদলে গেছে। বস্তুত আমরা সবাইতো সেই অর্থে রিফিউজি! আমরা সবাই নিজের মাটি ছেড়ে কেউ পরবাসী কেউ অনাবাসী। এর মধ্যে আলাদা কিছু আছে কি! আমরা অনেকে ভিন্ন দেশের পাসপোর্টের অধিকারী হলেও আমারতো মনে হয় কিছু মৌলিক ব্যাপার ছাড়া সবই প্রায় এক! সুনীল গঙ্গোপধ্যায় লিখেছেন তার বাবার কথা ‘এতদিন পর যেন তাঁর আবার মনে হল, তিনি পশ্চিমবাংলার নাগরিক নন, এখানে তো বাসা ভাড়া করে থাকা, তাঁর আসল বাড়ি পূর্ববঙ্গে। তিনি কোমায় শুয়ে বলতে লাগলেন, অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি, এবার যেতে হবে, দরজার একটা কব্জা বদল করা দরকার ছিল, বাতাবি লেবু গাছটায় এক সময় অনেক ফল হয়, গোয়ালন্দ ঘাটের সেই হোটেলের খাওয়া তোর মনে আছে? স্টিমার হতে নেমে সেই হোটেলে খাব, তারপর নৌকোয় ধুয়াসার গ্রামের পাশ দিয়ে..কত শাপলা ফুল ফুটেছে, চুনিকে রিখে দিলে সে মাদারিপুরে থাকবে, এই মাসেই যাব…।’

নিজের দেশ ছেড়ে কত দুরে আমরা বসবাসের জন্য এসেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় কানাডা দেশটা বড় বেশী দুর। আর একটু কী কাছে হতে পারতো না! তাহলে একছুটে গিয়ে দেখে আসতে পারতাম মাকে, ভাই বোনদেরকে। মা যখন বেঁচে ছিল তখন আমার প্রায়ই এরকম হতো যে এক্ষুনি মার সঙ্গে কথা বলি, মাকে স্বপ্ন দেখেছি, উল্টো পাল্টা স্বপ্ন। মন খারাপ হয়ে যায় না! তখন কিছুতেই ফোনে পাইনা। কলিং কার্ডগুলোকে আপন মনে হয় না। তখন মনে হয় বরিশাল যায়গাটা বোধহয় এই গ্রহের নয়। হয়ত মাকে ফোনে পেলাম, আমি তার গলা শুনি কিন্তু তিনি কিছুতেই আমাকে শুনতে পান না। হয়ত মা বার্ধ্যক্যের কারণে ফোন সেটটা ঠিকমত কানে লাগাতে পারেন নি বা যে ফোন কার্ডটি ব্যবহার করছি সেটাই ভাল না। হয়ত বাড়ির ফোন সেটটা ঠিক নেই। একটা ফোন সেট বোধহয় কেনা দরকার। কত কথা মনে আসে।

এই যে বিদেশে যারা রিফিউজি তারা তো আমাদেরই ভাই বোন, বন্ধু, আত্মীয় পরিজনই। তাদের দঃুখ, বেদনা, অনুভুতিগুলো অনেক গভীর। দেশে আত্মীয় পরিজনের জন্য তাদের রয়েছে দীর্ঘ দিনের না দেখার হাহাকার!

তাদেরকে কেনো আলাদা চোখে দেখতে হবে! ঈর্ষাপরায়ন জাতি আমরা। অন্যদের কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। তাদের দুর্বলতার সুযোগ কেনো আমরা নেই?। বরং আমাদের উচিত হবে যে মানুষটি সমস্যার মধ্যে আছে তার পাশে দাঁড়ানো। বিপদে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেয়া। তারা বিদেশে এসেছে থাকার জন্য। কে কিভাবে এলো সেটা বড় ব্যাপার নয়। কার কি অবস্থান সেটা বড় করে দেখার চেয়েও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা দরকার। আমি এদেশে ইমিগ্রান্ট হয়ে এসেছি কিন্তু আমাকে বুঝতে হবে রিফিউজি আদেনকারীদের মতো দু:খী বিদেশে আর নেই। তাদের কষ্টগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করা দরকার। মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা না থাকলে আমাদের বেঁচে থাকার আর কোন অবলম্বন থাকে না।

যারা রিফিউজি তাদের এমনিতেই সারাক্ষণ একটা মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে হয়। কখন ডির্পোটেশনের আদেশ হবে তা তার জানা নেই। এই অবস্থায় তার দরকার মানসিক সাহায্য। কামিউনিটির লোকদের উচিত তাদের প্রতি বিদ্বেষ বা ঈর্ষা পরায়ণ না হয়ে তাদের মানসিক সমর্থন করা। যারা এখন এদেৱ উপর খড়গহস্ত তাদের অনেকেই একসময় এই অবস্থা অতিক্রম করেছেন। তারা জানেন এর যন্ত্রনা কতটুকু। এক টুকরো কাগজের যে কত সুদুর প্রসারী আবেদন তা তারাই মাত্র জানেন যারা ভুক্তভোগী। দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে হয়। মানুষের স্বপ্নগুলো কেনো ভেঙ্গে যায় ? কেনো ভেঙ্গে যাবে?

আমার ভাল থাকা মন্দ থাকা

মৃত্যু কোনো ঘটনাই না। জাষ্ট একজন মানুষের নাই হয়ে যাওয়া। শোকের আয়ু ঘন্টাখানেক। তারপর সব স্বাভাবিক। আবার নতুন মৃত্যু, নতুন শোক। ফেসবুক স্ক্রল করে জানতে হয় কে কখন চলে গেলো। নানাভাবে মানুষ মারা যায়। ভুল চিকিৎসা, আগ্নিকান্ডে, সড়ক দুঘটনায়, পানিতে ডুবে। দেশে প্রচুর ভুয়া ডায়গনিষ্ট সেন্টারের খবর পত্রিকায় দেখতে পাই। ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্রই আছে। কানাডায় নাকি বছরে দশ হাজার মানুষ মারা যায় ভুল চিকিৎসায়। এই তথ্য দিয়েছে অর্ক। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে প্রায়ই শুনি ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারা যাচ্ছে। সব খবর যে পত্রিকায় ছাপা হয় বা কোনো ডাটাবেজ আছে তা না। অপঘাতে মৃত্যু ডালভাত এই দেশে।  সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর অবস্থা আরো করুন। সরকারি হাসাপাতালগুলোতে অনেক উন্নতমানের ইকুইপমেন্ট আছে ঠিকই কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা নাই। এতো রোগির চাপ যে হিমশিম খাচ্ছে হাসাপতালগুলো। গাদা গাদা রোগি। মাটিতে,খাটে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। একটা রুম পেতে, অপারেশনের ডেট পেতে তদবির লাগে। রোগিদের খাবার অতি নিম্নমানের। লাভের গুড় পিপড়ায় খেয়ে ফেলে। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের ডাক্তাররা শুধু ঢাকা থাকতে চায়।

মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা ভয়াবহ। হাইজিন, ভেজাল খাবার, নিয়মিত চেকআাপ, বিষাক্ত বাতাস, অর্থনৈতিক, সুষম খাদ্য গ্রহণ না করা, ইত্যাদি নানা কারণে মানুষ নানা সমস্যায় ভুগছে। কেউ কেউ চিকিৎসা করতে যেয়ে নিঃস্ব  হয়ে যাচ্ছেন। সবাইতো আর ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, আমেরিকা যেতে পারছে না। গরীবদের জন্য সরকারি হাসপাতালই ভরসা। আবার এটাও ঠিক যে কেউই অমরত্ব পাবে না। সবাইকেই যেতে হবে। সুস্থ্য থাকতে পারাটাই সবচেয়ে বড় নেয়ামত। কোনো ধন সম্পদই সঙ্গে যাবে না। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু সেটা করতে যেয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে মানুষ। মন্ত্রী,এমপিরা হাঁচি দিলেও ব্যাংকক,সিঙ্গাপুর যান কিন্তু সাধারণ মানুষ তা পারেন না। যারা বাইরে যেতে পারেন না তারা প্রাইভেট হাসাপাতালগুলোতে ভীড় জমান। আমি প্রতিবারই ঢাকা আসলে এক দুইবার অসুস্থ্য হবোই এবং হাসপাতালে দৌড়াবো। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এ পর্যন্ত তিনবার গিয়েছি।

ঢাকায় আসলে আমার একা থাকা হয়। গভীর রাতে অসুস্থ হলে কি করতে হবে জানি না। এরকম দুইবার ঘটেছে। যাকেই ফোন করি কেউ ধরে না। আমি জানিনা ৯১১ কল করলে প্যারামেডিক আসে কিনা। পুলিশ যে সাহায্যে এগিয়ে আসে এটা শুনেছি। কানাডায় যেমন ৯১১ এর সাথে পুলিশ,প্যারামেডিক, ফায়ারব্রিগেড সব জড়িত এবং কল করলে সবাই ১২ মনিটের মধ্যে হাজির হয়। প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রোগির ইচ্ছানুযায়ী হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকায় কি এই ব্যবস্থা আছে? ঢাকার রাস্তা দিয়ে কি এম্বুলেন্স চলতে পারে! প্রায়ই দেখি রাস্তায় এম্বুলেন্স প্যাঁ প্যাঁ করছে কিন্তু কেউ ভ্রুক্ষেপই করছে না। জায়গা ছাড়ছে না। ছাড়ার কোনো সুযোগও নাই। সেই ব্যবস্থাই নাই। কানাডা, আমেরিকা বা যে কোনো উন্নত দেশে পুলিশ,প্যারামেডিক বা ফায়ারব্রিগেডের গাড়ি বের হলে দুই দিকের সব গাড়ি পুলওভার করে। জায়গা ছেড়ে দেয়। ঢাকায় সেই সুযোগ নাই। রোগি এম্বুলেন্সের মধ্যে মারা গেলেও কিছু করার থাকে না।

ঢাকায় এবার দুটো  হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা বেশ ভাল। চিকিৎসা করে সুস্থ হয়েছি। একটার অভিজ্ঞতা বলি। আমার এপয়নমেন্ট ছিল সন্ধ্যা সাতটায়। মহাখালী থেকে ঠিক পাঁচটায় রওয়ানা হই। বন্ধু ওয়ালী গাড়ি পাঠিয়ে রেখেছিল। ঠিক সময়েই পৌঁছে যাই মানে পুরো দুই ঘন্টাই পথে লেগেছে। তিন তলায় পৌঁছে আমার নাম বললাম, এসিস্ট্যান্ট লোকটা বলল, আপনার সিরিয়াল ৪২, তখন মাত্র তিন নম্বর চলছে। আমার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। রিকোয়েষ্ট করায় আমার সিরিয়াল এগিয়ে দিল। ডাক্তার সাহেবকে পছন্দ হলো। অনেক বড় বড় ডিগ্রী। ছেলে টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আলাদা কেয়ার পেলাম মনে হলো। কারণ আমার ছেলে মেয়েও এই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। যথারীতি কয়েকটা টেষ্ট দিলেন। সেটার জন্য টাকা পে করতে আসলাম নিচতলায় ক্যাশ কাউন্টারে। টেষ্ট করাতে হবে দোতালায়। আলট্রাসাউন্ড করাতে এসে দেখি আমার সিরিয়াল ৩১। এখানেও অনুরোধে কাজ হলো। দুদিন পর আবার গেলাম। একটা টেষ্ট বাকী ছিল। আমার এপয়েনমেন্ট সাড়ে পাঁচটায়। প্রথম তারাবি হবে বলে ডাক্তার সাহেব ওইদিনই বলে দিয়েছেন যেনো আগে যাই। টেষ্ট করতে যেয়ে ছেলেটা বলল, রিপোর্ট পাবেন নটায়। আমি বললাম, আমার এপয়নমেন্ট তো সাড়ে পাঁচটায়। সে বলল, কালকে করালেন না কেনো! আমি বললাম বুঝতে পারিনি, সরি। তারপর ছেলেটি টেষ্ট করে সাথে সাথে রিপোর্ট তৈরী করে দিল। যথাসময়ে ডাক্তার দেখলেন।

আমি যে প্রফেসরকে দেখালাম তিনি দুইটা হাসপাতালে বসেন। এতো রোগির চাপ যে একজন রোগিকে দুই তিন মিনিটের বেশি সময় দিতে পারেন না। তবুও ডাক্তার সাহেবকে আমার পছন্দ হলো। নিজের ব্যাক্তিগত নম্বর দিয়েছেন। বলেছেন কোনো অসুবিধা হলে যেনো জানাই। প্রতিদিন চল্লিশ পঞ্চাশজন রোগি দেখা সত্যি কঠিন কাজ ডাক্তারদের জন্য। সবার প্রতি মনোযোগ দেওয়া যায় না। মনের উপরও চাপ বাড়ে। যাইহোক সেই রাতেই আবার আমি খুউব অসুস্থ্ হয়ে পরলাম। সকালে  ডাক্তার সাহেবকে ফোন করলাম এবং তিনি আমার ফোন ধরলেন। আমি ব্যথার কথা বলায় তিনি কিছু ওষুধ চেঞ্জ করে দিলেন। পরের রাতেও আমি তীব্র ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলাম। তার আগেই ফেসবুকে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম। সেটা দেখেই আমার প্রিয় লেখক ও বন্ধু ডা আরিফুর রহমান লিখলেন যোগাযোগ করতে। ডা আরিফ একজন খ্যাতিমান ডাক্তার। সৌদী বাদশার ব্যাক্তিগত চিকিৎকদের একজন ছিলেন। কানাডার বাসিন্দা হলেও এখন ঢাকায় থাকেন।

ডা আরিফ এর আগেও ২০২০ সালের জুনে আমি যখন সিরিয়াস ভার্টিগোতে আক্রান্ত হই তখনও এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি তখন কানাডায় অবস্থান করছিলেন। কোভিড কাল তখন। সেবার তিনি ইউরোপ আমেরিকার ডাক্তারদের ভার্চুয়ালি জড়ো করে কনসালটেন্সি দিয়েছিলেন আমার জন্য। আমি তার গুলশানের বাসায় গেলাম সব রিপোট নিয়ে। তিনি রিপোর্ট দেখে পাখী পড়ার মতো বুঝিয়ে বললেন আমার সমস্যাটা কোথায়। বললেন ভয়ের কিছু নেই। আমার ডাক্তারও তাই বলেছিলেন। কিন্তু সেই রাতেও আমি আবার তীব্র ব্যথায় আক্রান্ত হলাম। তখন মধ্যরাত। আমি নিরুপায় হয়ে ডাক্তার আরিফকে ফোন দিলাম। বললাম, আমি হাসপাতালে যেতে চাই। আমার কাছেই ইউনাইটেড এবং এভারকেয়ার হাসপাতাল। যে কোনো একটায় যাওয়ার কথা ভাবছি। তখন তিনি ইমারজেন্সি কিছু ওষুধ দিলেন। ওষুধ বাসায় পৌঁছানোর ব্যবস্থ্যা করলেন। এবং ওষুধ খেয়ে আমি সুস্থ্ হলাম। সাথে বন্ধুদের দোয়া এবং আল্লাহর রহমততো আছেই। আরিফ ভাই এমনই। বিনে পারিশ্রমিকে সবার জন্য ছুটে যান।

উপেক্ষা বা ঘৃণা কিছুই দেয় না, শুধু দূরে সিরিয়ে দেয়

মানুষের মন খুউবই অদ্ভুত। মানুষ নিজেই তার  মনের নাগাল পায় না। ক্ষণে ক্ষণে মানুষের মনের গতিবিধি বদলায়। এখন এক রকম পরমুহূর্তে বদলে যায় যায় সবকিছু। সকালে ভালবাসে বিকেলে ঘৃণা করে, আবার সকালে অপছন্দ হলো তো বিকেলে ভাল লেগে যায়। খুবই আজব মানুষের মন। খুবই আনপ্রেডিক্টেবল। আমার নিজেরও এই সমস্যা আছে। সামান্য কারণেই আমার মন বদলে যায়। পছন্দের মানুষ তু্চ্ছ কারণেই অপছন্দের হয়ে যায়। একইভাবে আমিও অন্যের অপছন্দের হয়ে যাই। কেউ হয়ত আমাকে খুবই পছন্দ করছে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করি সে আর আগেরমতো আমাকে পছন্দ করছে না, আমাকে ইগনোর করছে। মানুষের মন খুব জটিলও বটে। অনেক সময় দূর থেকেই একজন মানুষ সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে বসে থাকি। মনে মনে ভাবি এই মানুষটার কাছে গেলে আমার ভাল লাগবে না, কথা বলে মজা পাব না। মনে হয় রুড হবে, আন্তরিক হবে  না। অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও কাছে গিয়ে দেখি আরে দারুণ মানুষতো। এতো আন্তরিক, এতো সুন্দর মনের মানুষ। অথচ তার সম্পর্কে ভুল ধারণা করে বসে আছি! তখন নিজের গালে নিজেরই চর মারতে ইচ্ছা করে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জা পাই। আবার উল্টোটাও হয়। দূর থেকে যখন একজনের সাথে কথা বলি তখন খুবই আপন মনে হয়, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মন ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু আসলে মন পরিষ্কার না। স্বার্থপর কিসিমের। যখন দরকার পরে তখন ভালবাসায় ভিজিয়ে দেয়ে। দরকার ফুরিয়ে গেলে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে।

আমার সমস্যা একটাই আমি সবাইকে বিশ্বাস করি, সবাইকেই ভালবাসা দিতে চাই। কেউ আমাকে এভোয়েড করলেও চেষ্টা করি  তার জন্য কিছু করতে। আমার সম্পর্কে পিছনে গীবত করে জেনেও হেল্প চাইলে তার জন্য  কিছু করার চেষ্টা করি। প্যারা নেই। কারো কাছেই তেমন প্রত্যাশা নাই আমার।  কোনো বিনিময় চাই না। আবার যার কাছে কিছুই প্রত্যাশা করি না সেই দেখি আমাকে দু’হাত ভরে ভালবাসা দেয়, বিপদে আমার পাশে থাকে। আমি কাছের মানুষদের জন্য অনেক করে দেখেছি, বিনিময়ে পেয়েছি  অবহেলা, উপেক্ষা, সমালোচনা। কিন্তু কখনও আমি মুখ ঘুরিয়ে রাখিনি। আমাকে যতই উপেক্ষা দেখাক আমি চেষ্টা করি পাশে থাকতে। কোনো না কোনো ভাবে তাদের জন্য কিছু করতে। যারা আমার জন্য কিছুই করেনি তাদেরও আমি পাশে থাকি। আমি ওসব মনে রেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকি না, আবার ভুলেও যাই না। আমি নিজেকে নিজে সান্তনা দেই যে আমি আমার দ্বায়িত্ব পালন করেছি। কিছু মানুষ দরকারের সময় কাছে আসে, দরকার শেষ হলে ভুলে যায়। মনেও রাখে না। আমার জন্য কেউ সামান্য কিছু করলেও আমি সারাজীবন মনে রাখি, কৃতজ্ঞ থাকি মনে মনে। সবকিছুর প্রতিদান দিতে পারি না। সবকিছুর প্রতিদান হয়ও না। অনেকেই আছে যারা কোনো প্রতিদান চায় না। নিঃস্বার্থভাবে করে যায়।

আমি মানুষের অনেক ভালবাসা পেয়েছি। এতো ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য আমি না। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পেয়েছি। এই অনুভূতি আমি অনেকবারই প্রকাশ করেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় ভালবাসা জিনিসটা এমনই যে যতই দেবেন ফুরাবে না। ভালবাসতে পয়সা লাগে না। কোনো পরিশ্রমও নাই। শুধু একটা মন দরকার। তবে অবশ্যই ভালবাসা আসল  হতে হবে। নকল ভালবাসা নয়। ভান বা অভিনয় নয়। কিন্তু প্রকৃত ভালবাসার বড়ই  আকাল পড়েছে। ভালবাসলেই যে ভালবাসা পাওয়া যায় এই সহজ তত্ত্ব অনেকই মানতে চায় না। আমি যত ভালবাসা পেয়েছি সবসময় মনে হয় তত ভালবাসতে পারিনি। ঘাটতি রয়ে গেছে। কৃপণতা রয়েছে। আরো বেশি উদার হওয়ার দরকার। তখন নিজেকে অকৃতজ্ঞ মনে হয়। আমি কি স্বার্থপর! আমার কি ভুল হয় না! অনেকই হয়। আমার অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক ত্রুটি। সেসব কখনোই কাটিয়ে উঠা সম্ভব না। দোষে গুনেই মানুষ। তাই অন্যের ভুলগুলি নিয়ে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না।  ভুল বুঝে অনেকে যেমন আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আবার আমিও অনেককে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। বন্ধুদের সাথে যেমন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তেমনি আত্মীয় স্বজনের সাথেও হয়েছে। মন এমনই সহজে হার মানতে চায় না, অপমানগুলো কুড়ে কুড়ে খায়, উপেক্ষার জ্বালা কষ্ট দেয়। তখন দূরত্ব তৈরী হয়। একসময়  তা অনিতিক্রম্য হয়ে উঠে। সবকিছুর পরও, সব কষ্ট ভুলেও আমি মানুষের পাশেই থাকতেই চা। ভালবাসাই বেঁচে থাকে। উপেক্ষা বা ঘৃণা কিছুই দেয় না, শুধু দূরে সিরিয়ে দেয়।

অস্থির এই মন আমার

আমার কি যেনো একটা অসুখ হয়েছে। ধরতে পারছি না অসুখটা কি। কোথাও মন বসে না। কোথাও স্থির হতে পারি না। চঞ্চল মন। কোথাও বেশিদিন ভাল লাগে না। টরন্টো ভাললাগে না, ঢাকা ভাললাগে না, বরিশালও ভাল লাগে না। আমি প্রতিবছর বইমেলার টানে ঢাকা ছুটে আসি। যে আমি একদিনও কোথাও যাই না মেলা রেখে, কোনো দাওয়াত পযন্ত রাখি না সেই আমি এবার বইমেলায় খুব অল্প দিন গিয়েছি। তেমন টান অনুভব করিনি। বইমেলা রেখে কখনও কোলাকাতা, কখনও ব্যাংকক, কখনও সিঙ্গাপুর, কখনও দেশের আনাচে কানাচে ঘুরেছি। ঢাকায় প্রচুর আড্ডা দিতাম একসময়, এখন আর সেই আড্ডা দেওয়া হয় না। প্রেসক্লাব, বাংলা একাডেমি, গুলশান ক্লাব ছিল আড্ডার প্রিয় জায়গা। এখন সেসব তেমন হয়নি। ঘরেই কেটেছে বেশিরভাগ সময়। বরিশালেও তাই। আগে খুব ঘুরতাম বরিশালের আনাচ কানাচ। এবার দুইবারই বরিশাল ক্লাবের নির্জন গেষ্ট হাউজে শুয়ে বসে কেটেছে। কখনও একটু বাড়িতে গিয়েছি, কখনও সদর রোড বুক ভিলা। মা বাবার কবরের কাছে গিয়ে বসে থেকেছি। আমি নিশ্চিত এবারও টরন্টো ফিরে গিয়ে আমার মন বসবে না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি কোনো যাই! কেনো যেতে হয়! আবার ঢাকায় বসে নিজেকে প্রশ্ন করি এই শহর এমন হলো কবে! নিজের বাড়িতেও আমার একাকী লাগে।

অর্ক, অরিত্রি যেদিন থেকে আলাদা থাকা শুরু করল সেদিন থেকেই এমন হচ্ছে আমার। অরিত্রি আমেরিকা চলে যাবার পর আমার শূন্যতা আরো বেড়েছে। কিন্তু অরিত্রিকে সেটা বলি না। কাউকেই বলি না। এসব বলা যায় না। ছেলে মেয়েরা নিজের সংসারে চলে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। এই বাস্তবতা আমি মেনে নিয়েছি। আমিও মাকে ছেড়ে দূরদেশে চলে এসেছি। অর্ক অরিত্রি সবসময় বলে বাবা তোমার যেখানে ভাল লাগে থাক। আমেরিকা ভাল লাগলে চলে আসো। কিন্তু আমেরিকা গিয়েও কি আমার মন বসবে বেশিদিন! লন্ডন কি ভাল লাগবে! এমনকি আমি কোলকাতা,ব্যাংকক, কুয়ালালামপুরে সেকেন্ড হোম করার কথাও ভাবতাম। জানি এসবই অলিক চিন্তা। বরিশালে একটা ঘর করতে চাই। সিদ্ধান্ত পাকা কিন্তু সেখানে গিয়ে কি থাকতে পারব? বেশিদিন মন বসবে! ঢাকায় কি থাকা সম্ভব! এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা নাই। কোনো কিছুই জানিনা বলে অস্থিরতায় ভুগি। জেসমিনকে বলতে ইচ্ছে করে চলো দেশেই ফিরে আসি। জেসমিন কি সেটা মানবে! সে কি পারবে ছেলে মেয়ে রেখে থাকতে! মায়েদের কাছে সন্তান অনেক বড় ব্যাপার। আমি কারো উপর চাপ প্রয়োগ করি  না কখনও। পরিবার ছাড়া বসবাস করা সত্যি কঠিন।

টরন্টো ২৯ জুন ২০২৪

jasim.mallik@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *