চলমান জীবনের গল্প

সাইদুল হোসেন

ব্যথিত হৃদয়ের কাহিনী

জীবনের চলার পথে মানুষ মনে ব্যথা পায় কখনোবা নিজের ভুলের কারণে আর কখনোবা অপ্রত্যাশিতভাবে নিজেরই আপনজনের দুর্ব্যবহারে। কেউ সেটা কাটিয়ে উঠতে পারে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে; আবার কেউ সেটার ভার বয়ে দুঃখময় জীবন কাটায়, হৃদয়টা থাকে ক্ষত-বিক্ষত। কাঁদে নীরবে। প্রকাশ করে কখনো-কখনো, তবে সেই প্রকাশে থাকে বৈচিত্র্য। তেমনি দু’টি কাহিনী।

(এক)

আমার ছোট ভাই একদিন আমাকে বললো, আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের কাহিনী শোনাই তোমাকে।

ষাটের বয়সের বাড়িগাড়ির মালিক ধনী ব্যক্তি, কিন্তু বর্ষা-বৃষ্টি থাকলে তিনি গাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বের হন না বহু বছর ধরেই। কেন? জবাবটা হলো এরকম।

“আমি ছিলাম একজন আর্মি অফিসার। বাড়ি থেকে দূরে দেশের দূর-দূরান্তে নানা আর্মি ক্যাম্পে মাসের পর মাস ডিউটি করে ঘরে ফিরে আসতাম। ঘরে ছিল যুবতি স্ত্রী। সুন্দরী। ভালোই চলছিল। তবে শেষরক্ষা হলো না।

একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখলাম শূন্য ঘর, স্ত্রী নেই, ডাইনিং টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দেয়া একখানা চিঠি। চিঠির বক্তব্য : “এমন শূন্য ঘর, একাকী জীবন আমার আর ভালো লাগছে না। সর্বক্ষণ সংগ দিতে পারে, আদর-ভালোবাসা দিয়ে ঘিরে রাখতে পারে তেমন একজন সহৃদয় ব্যক্তির দেখা পেয়েছি। আমি তার সংগে চলে যাচ্ছি। বা-ই।”

“কি আর করি! পরিস্থিতিটাকে মেনে নিলাম সব ব্যথা হৃদয়ে চেপে। দিন-মাস-বছর তার আপন গতিতে চলতে লাগলো। তবে নাটকের যবনিকাপাত হলো কয়েক বছর পর, সেটা দেখা দিলো নূতন রূপে। এক অপ্রত্যাশিত রূপে।

“দু’টি কচিকচি শিশুর হাত ধরে কান্নাভরা চোখে সেই নারী একদিন দেখা দিলো আমার দুয়ারে। সনির্বন্ধ অনুরোধ, “আমি ভুল করেছিলাম, আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে তুমি আবার গ্রহণ কর। এই শিশু দু’টি অসহায়, নিষ্পাপ। বড় কষ্ট। আমাদের তুমি গ্রহণ কর। স্মরণ করে দেখো তুমি আমাকে কত ভালোবাসতে, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসতাম।” কাতর মিনতি তার।

“অঝোর কান্না, তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি গড়িয়ে পড়ছে। করুণ দৃশ্য। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে দিলাম। বললাম, দূর হ! কান্নাভরা চোখে সে ফিরে গেল। সেই বিশ্বাসঘাতিনীর জন্য তিলমাত্রও সহানুভূতি জাগলো না মনে।

“কিন্তু তারপর থেকেই লক্ষ্য করতে লাগলাম যে বৃষ্টির দিনে যখনি গাড়ি চালাই এবং গাড়ির windshield বেয়ে বৃষ্টির পানি নীচে গড়াতে থাকে, ঠিক তখনি ওর কান্নাভরা মুখটা সেই windshield-এ ভেসে উঠে আমাকে বড় বিচলিত করে তোলে, দেহটা অবশ হয়ে যায়, ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ হারিয়ে ফেলি। তীব্র একটা ব্যথা অনুভব করি।

“আমি এই বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চাই না। তাই বৃষ্টিমুখর দিনে ড্রাইভ করাটাই ছেড়ে দিয়েছি।”

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে থামলেন তিনি।

(দুই)

বাংলাদেশের ঘটনা। ১৯৮২ সন।

অতি সুন্দর সুদর্শন স্বাস্থ্যবান পুরুষ। ধনী ব্যক্তি। তবে তার স্ত্রীর গায়ের রং বেশ কালো। দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ালে তাদের গায়ের রঙের ব্যবধানটা প্রকটভাবে চোখে ধরা পড়তো। ভদ্রলোক সুদর্শন, ইচ্ছা করলেই তো তিনি একটি সুন্দরী স্ত্রী ঘরে আনতে পারতেন। চার বছর বয়সের একটি মেয়ে ছিল তাদের, গায়ের রং মায়ের মতোই কালো।

পেছনে কিছু রহস্য আছে কি?

এই পরিবারের সংগে আমার খুব হৃদ্যতা ছিল। সেবাড়িতে যাওয়া-আসা করতাম। একদিন সাহস করে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ক্যাপ্টেন, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই।” তিনি হেসে দিলেন। বললেন, “কি জানতে চান?”

বললাম, “আপনি একজন অতি সুন্দর সুপুরুষ, ধনবান ব্যক্তি। আপনি ইচ্ছা করলে তো একজন সুন্দরী নারীকে বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে এই কালো মহিলাকে বিয়ে করলেন কেন?”

আমার প্রশ্ন শুনে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন না মোটেই। বললেন,

“শুনুন তাহলে। এই মহিলা আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী খুবই সুন্দরী ছিলো। কিন্তু আমার পেশাটা ছিল তার খুব অপছন্দ। পেশাগতভাবে আমি ছিলাম merchant Navy তে Ship -এর একজন Captain . কোম্পেনীর শীপে মালপত্র নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন বন্দরে বন্দরে (Port -এ) যাওয়া-আসাই ছিল আমার কাজ। তিন মাস চার মাস পর বাড়ি ফিরে আসতাম ১৫-২০ দিনের ছুটিতে। ছুটির শেষে আবার শুরু হতো আমার সমুদ্রযাত্রা। এই ছিল আমাদের জীবন।

“কিন্তু এই জীবনধারাটা তার ছিলো খুব অপছন্দ। চার বছর বয়সের আমাদের একটা ছেলেও ছিলো। আমাদের নিজেদের ভাড়া করা বাড়িতেই থাকতো সে ছেলেকে নিয়ে। আমার মা-বাবার সংগে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো।”

“একদিন ছুটিতে এসে বাড়িতে গিয়ে দেখলাম দরজায় তালা দেয়া। পড়শীরা বললো যে এবাড়িতে কেউ থাকে না। অগত্যা গেলাম বাবার বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার ছেলেটা ওখানে আছে এবং শোনলাম যে আমার সেই স্ত্রী আমার অনুপস্থিতির সুযোগে আমাদেরই পরিচিত অন্য একজনের সংগে পালিয়ে গিয়েছে অন্য কোথাও। বর্তমানে ওরা এই শহরে নেই। যাবার দিন আমার ছেলেকে আমাদের বাসায় রেখে যায়। সে তো খুব সুন্দরী ছিল, তাই প্রেমিকের অভাব হয়নি। বাবা জানালেন যে ওর পালিয়ে যাবার খবর পেয়ে তিনিই সেই বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়েছেন। এসব কান্ড গতমাসে ঘটে গেলো।

পরিস্থিতি আমূল বদলে গেলো। বাচ্চা ছেলেটার জন্য সার্বক্ষণিক একজন caregiver দরকার, আমারও একজন সংগিনী দরকার। সমুদ্রযাত্রায় আবারো বের হতে হবে। এটাই আমার পেশা। তাৎক্ষণিক কোন সমাধান চোখে পড়লো না। ভাবতে হবে। আপাততঃ ছেলেটা তার দাদাদাদীর কাছেই থাকবে, এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

সমুদ্রে ভাসমান দিনরাত্রিগুলো অশান্তিতেই কাটলো সেকথা বলাই বাহুল্য। অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম যে কোন সুন্দরী নারীকে আর বিয়ে করবো না; এবার একটি কালো রঙের নারীকে বিয়ে করবো প্রেমিকের ভীড় যেন না জমে উঠে তাকে ঘিরে আমার অবর্তমানে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই এই কালো মহিলাকে বিয়ে করলাম। তিনি এম.এ. পাস, কোন এক গার্লস স্কুলে টিচার তিনি বর্তমানে। বিয়ের আগে তাকে আমার বিগত জীবনের সব কথা খুলে বলেছিলাম। ভালোই আছি এপর্যন্ত।

-ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩

আত্মসচেতনতা এবং আত্মঅন্বেষণ : আমি কে এবং কেমন লোক?

অতি প্রাচীন জ্ঞানীর বচন : “আগে নিজেকে জানো।” Know thyself first.”

“খুদ্কো জানো পেহ্লে।”

আগে নিজেকে চিনে নাও, তারপর অন্যকে চেনাটা সহজ হবে।

অতি মূল্যবান উপদেশ নিঃসন্দেহে, কিন্তু আমরা ক’জন কানে নিই সেই উপদেশ? এবং কানে নিই না বলেই তো পরিবারে-সমাজে যত অশান্তি এজগতে।

আমরা মানুষ। আমাদের দেশ, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন, কিন্তু এক জায়গায় আমাদের মাঝে একটা বড় মিল আছে : আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে সকলে মিলেমিশে বাস করতে পছন্দ করি এবং একটা আদান-প্রদাননির্ভর গ্রহণযোগ্য সামাজিক জীবন গড়ে তুলি। প্রয়োজনে, উৎসবে, আপদেবিপদে একে অন্যের প্রতি সাহায্যের, বন্ধুত্বের হাত বাড়াই। কারণ আমরা মানুষ, মানবিকতা গুণটুকু আমাদের হৃদয়ে-মনে-মস্তিষ্কে সদা জাগরূক থাকে। অন্যের প্রয়োজনের সময় তাদের পাশে থাকতে চাই, সাহস জোগাতে চাই যাতে আমার প্রয়োজনেও আমি তাদেরকে পাশে পাই।

তবে সব মানুষ সমান নয়, আমাদের মাঝে চরিত্রগত, গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান। সবার বুঝার ক্ষমতাও এক নয়। There exists a difference in intelligence and understanding, যদিওবা বাহ্যতঃ আমাদের বিদ্যায় এবং সামাজিক অবস্থানে কোন পার্থক্য না থাকে। অপরের প্রয়োজনে কেউ সাড়া দেয়, কেউবা দেয় না, থাকে উদাসীন, নির্লিপ্ত। তবে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় কারণ এটা নির্ভর করে ব্যক্তিটির মানসিক গঠনের উপর এবং তার পারিবারিক শিক্ষা ও আচরণের উপর।

মানুষ উদার হয়, সাহায্যকারী মনোভাবের হয়, অথবা অসংবেদনশীল, নিষ্ঠুর-নির্লিপ্ত হয় অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিজনিজ পারিবারিক আচরণের tradition অনুসারে। আমরা নিজেদের পরিবারে শৈশব থেকে যা দেখি এবং শুনি ঠিক তাই শিখি। জন্মের পর পরিবারে বেড়ে উঠার কালে মা-বাবা ও বড়দের একে অন্যের প্রতি, পাড়া-প্রতিবেশীদের প্রতি, এবং অপরিচিতদের প্রতি তাদের আচরণ আমাদেরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমরা যদি লক্ষ্য করি যে তাদের ব্যবহার সদা-সর্বদা সদয়-সহানুভূতিশীল এবং হাসিমুখ, তাহলে আমরা তাই শিখি। অন্যদিকে যদি দেখি যে তারা অনুদার, স্বার্থপর অথবা রুক্ষভাষী, তাহলে সেই প্রভাব আমাদের চরিত্রকেও গড়ে তুলে। We learn from our parents’ and the elders’ behaviour. পরিবারের গন্ডীর বাইরে আমাদের প্রত্যেককেই এক সময় বেরিয়ে আসতে হয়, স্বাধীন ও স্বাবলম্বী জীবন যাপন করা শুরু করতে হয়। নিজের জীবন নৌকার হাল নিজের হাতে ধরতে হয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এটাই মানব সমাজের চিরাচরিত রীতি পৃথিবীব্যাপী দেশে দেশে। এবং এই পর্যায়ে পৌঁছলেই নিজের চরিত্রটাকে বিচার করে আত্মসচেতনতা এবং আত্মঅন্বেষণের বিশেষ প্রয়োজন পড়ে।

জানাটা দরকার হয়ে পড়ে : আমি লোকটা কেমন? আমার চারপাশের লোকেরা আমাকে কি চোখে দেখে?

আমি কি একজন সহজ-সরল, উদার, ধার্মিক, সত্যবাদী, সৎ, ধৈর্যশীল, নির্ভরযোগ্য, বিনয়ী, মিষ্টভাষী, নিঃস্বার্থপর, সাহায্যকারী ব্যক্তি?

অথবা আমি কি একজন লোভী, স্বার্থপর, অসৎ, কটুভাষী, কৃপণ, অধার্মিক, অহংকারী, হিংসুক, রাগী, ঝগড়াটে, পরশ্রীকাতর, কুচক্রী, কারো দুঃসময়ে নির্লিপ্ত চরিত্রের লোক?

দিন শেষে ঠান্ডা মাথায় এই অনুসন্ধানটা নিয়মিত নিজেকেই করতে হবে। কারণ এই বিচার-বিশ্লেষণটা করে পরিবারের অথবা সমাজের অন্য লোকেরা আমি কি চরিত্রের লোক এবং আমাকে কতটুকু গুরুত্ব দেয়া যায় সেটা তারা নির্ধারণ করে, যা জানা আমাদের প্রত্যেকের জন্যই একটা অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ পরিবারে অথবা সমাজে গুরুত্বহীন অবস্থান মোটেই কোন গর্বের বা কাম্য বিষয় হতে পারে না।

অতএব আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে যদি আমরা আত্মসমালোচনা করে নিজেদের চরিত্রের দোষত্র“টিগুলো দূর করার চেষ্টায় নিরত থাকি। বেঁচে থাকাকালীন মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-বিশ্বাস অর্জন করাটাই আমাদের কাম্য হওয়া উচিৎ, অশ্রদ্ধা বা ঘৃণা নয়।

জানুয়ারী ১০, ২০২৪

আনন্দময় পুনরাবৃত্তি

২০১৭ সনের কথা বলছি।

গিয়েছিলাম এক বিয়ের নিমন্ত্রণে টরোন্টো সিটির কোন এক ব্যাংকুয়েট হলে। বর পক্ষ থেকে নিমন্ত্রিত আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জন। সেখানে উপস্থিত একজন নিমন্ত্রিত ভদ্রলোক সবার অবগতির জন্য এই মজার কাহিনীটা শোনালেন।

“আজ আমি নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি এই জন্য যে, যে ছেলেটির বিয়ের অনুষ্ঠানে আপনারা-আমরা এখানে উপস্থিত, আজ থেকে ২৭ বছর আগে ওর মা-বাবার বিয়েতেও আমি উপস্থিত ছিলাম। তবে এদেশে বা বাংলাদেশে নয়, দেশটি ছিল রাশ্যা (Russia). যে সিটিতে সেই বিয়ের অনুষ্ঠানটি ঘটেছিল এবং সেখানে আমি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাম আজ রাতের মতন সেই সিটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা রাশ্যান স্কলারশীপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে ইনজিনিয়ারিং ডিগ্রি নিতে গিয়েছিলাম।”

“বহু ছাত্রছাত্রী ওখানে dormitoryতে বাস করতাম। সেখানে জানাশোনা-বন্ধুত্ব হতো, এমনকি প্রেমের দেখাও মিলতো। এমনি এক প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে পড়লো বাংলাদেশী মেয়ে নির্মলা এবং নেপালী ছেলে রিতেশ। গভীর প্রেম। তাই বিয়ের ব্যবস্থাটা করতে হলো। বিয়ে হয়ে গেল, বছর দেড়েক পর জন্মালো ওদের প্রথম সন্তান- ছেলে। নাম রাখা হলো তার আদিত্য। কয়েক বছর পর ডিগ্রির সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে আমরা নিজনিজ দেশে ফিরে গেলাম। রিতেশ ও নির্মলা তাদের ছেলে আদিত্যকে সংগে নিয়ে ফিরে গেল নেপালে।”

“আদিত্য পড়াশোনা করে তার বাবার মতোই ইনজিনিয়ার হলো, বর্তমানে ভালো কাজে নিয়োজিত এই টরোন্টো সিটিতেই। ওর ছোট ভাই বিবেকও ইনজিনিয়ারিং পড়ছে বর্তমানে।”

আদিত্য প্রেমে পড়েছে ওরই স্বদেশী মেয়ে গীতুর সংগে। গভীর প্রেম। অতএব এই বিয়ে। আমিও আমন্ত্রিত ২৭ বছর আগের মত। আমাকে ওরা ভুলেনি। এটাকে আমি আমার পরম সৌভাগ্য বলে গ্রহণ করলাম।

“ধন্যবাদ রিতেশ, ধন্যবাদ নির্মলা।”

এই বলে ঘনঘন করতালির মাঝে তিনি তার বক্তব্য শেষ করলেন।

পূনঃ পাত্রপাত্রীর পরিচয় গোপন রাখার জন্য ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হলো।

জানুয়ারী ২৯, ২০২৪

আমার লেখক জীবনের কথা

বইটার আগের পৃষ্ঠাগুলোতে পাঠক-পাঠিকাকে অন্যদের গল্প শুনিয়েছি, তবে শেষ অধ্যায়ে আমি আমার নিজের লেখক জীবনের গল্প শোনাবো বলে কলম হাতে তুলে নিয়েছি।

বর্তমানে আমি একজন লেখক, যদিও বিখ্যাত কেউ নই। গদ্য ও কবিতা দুই-ই লিখে চলেছি আমি। ২০০৪ থেকে ২০১৯ সন পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৩টি। (ঢাকা থেকে ৬টি এবং টরন্টো [ক্যানাডা] থেকে ১৭টি।) আরো ১০টি নূতন বই প্রকাশনার অপেক্ষায় দিন গুনছে। লক্ষ্য করলে চোখে পড়বে যে অধিকাংশ বই-ই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত অথচ আমি কোন ইসলামিক স্কলার নই, এমনকি কোন মাদ্রাসায়ও পড়িনি কোনদিন। রহস্যপূর্ণ কোন ব্যাপার নয় মোটেও। মূল কারণটা হচ্ছে আমার ইসলাম ধর্মটাকে সঠিকভাবে জানার আগ্রহ।

এবার আসি সাহিত্য জগতে প্রবেশের ইতিহাসে।

আমি মূলতঃ ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে একজন কমার্স গ্র্যাজুয়েট (১৯৫৫)। আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনটা কেটেছে একাউনটিং-অডিটিং-ফাইনান্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট করে করে। সাহিত্য সাধনার না ছিল সুযোগ, না ছিল কোন আগ্রহ। তবে হ্যাঁ, একজন আগ্রহী পাঠক ছিলাম বাংলা-ইংরেজী গল্প-কবিতা ও উপন্যাসের। জীবনের ৫৮টি বছর এমন করেই বাংলাদেশে কাটালাম। সেই জীবনে গল্প তো দূরের কথা, দু’লাইনের একটা কবিতাও লিখিনি কোনদিন।

১৯৯১ সনের মার্চ মাসে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের ক্যানাডায় আগমন Visitor’s Visa নিয়ে ছ’মাসের জন্য ক্যানাডাবাসী আমাদের দুই ছেলের sponsorship -এর সাহায্যে। ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। তাই মাত্র চার মাস পর immigration -এর জন্য এপ্লাই করা মাত্রই ক্যানাডা সরকার আমাদের application accept করে তৎকালীন আইন অনুযায়ী Landed Papers পাঠিয়ে দিলো এবং তৎসংগে Social Insurance Number Card and temporary work permitI পাঠিয়ে দিলো দু’জনকে। থ্যাংক ইউ এন্ড আলহামদুলিল্লাহ!

শুরু করলাম চাকরি খোঁজা। বেকার থাকতে হলো প্রায় তিনটি বছর কারণ Canadian education or work experience ছিলো না। বয়সও পঞ্চাশের উর্ধে। প্রথম চাকরিতে যোগদান করলাম ১৯৯৩ সনের ডিসেম্বার মাসে। সেই বেকার জীবনের এক পর্যায়ে ১৯৯২ সনে পরিচয় হলো তৎকালীন টরন্টো শহর থেকে প্রকাশিত একমাত্র বাংলা পত্রিকার স্বত্বাধিকারী, প্রকাশক ও সম্পাদক জনাব  নজরুল ইসলাম মিন্টুর সংগে। পত্রিকার নাম “দেশে বিদেশে”। যদিও লেখালেখির কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না আমার তথাপি জনাব মিন্টু আশ্বাস দিলেন যে সংযত ভাষায় সাবলীল বাংলায় যা-ই লিখবো তা-ই তিনি প্রকাশ করবেন তাঁর পত্রিকায়। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন।

আল্লাহ ভরসা করে লেগে পড়লাম। ২০০২ সন পর্যন্ত ক্রমাগত ১০ বছর ধরে আমার লেখা প্রকাশিত হলো সাপ্তাহিক দেশে বিদেশে পত্রিকাতে। আমি জনাব মিন্টুর কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ তাঁর উৎসাহ ও সহযোগিতার জন্য এবং আমাকে একজন লেখক বানানোর জন্য। আল্লাহ তাঁর মংগল করুন।

২০০৪ সনে ঢাকা থেকে প্রকাশিত আমার প্রথম গল্প-প্রবন্ধ গ্রন্থ “আজো মনে পড়ে”র (৩৫৬ পৃষ্ঠা) এক কপি উপহার হিসাবে তাঁর হাতে তুলে দিলে মিন্টু সাহেব আনন্দে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

২০০৪ সন। আবার সৌভাগ্য এসে দেখা দিলো দ্বারপ্রান্তে। হঠাৎ করে পরিচয় ঘটলো এক উদার হৃদয় ইসলামপন্থী বাংলাদেশীর সংগে টরন্টো সিটির পার্লামেন্ট ষ্ট্রীটে এক গ্রোসারী ষ্টোরে। আমির জামান। নিয়ে গেলেন তিনি আমাকে ইয়াং স্ট্রীটে তারই প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত মাসজিদ ও টরন্টো ইসলামিক সেন্টারে। সেখানে তিনিই সর্বেসর্বা। বিরাট এক ইসলামিক লাইব্রেরী সেখানে- শতশত ইংরেজী-বাংলা-আরবী বই ও অডিও-ভিডিও ক্যাসেটে ভরপুর সেই ইসলামিক সেন্টার। রিসার্চের জন্য যোগ্য ভান্ডার। আমাকে একদিন নিয়ে গেলেন তার বাসায়। স্ত্রী নাজমা জামান একজন হিজাবী-নিকাবী মহিলা। দেখলাম তাদের বাসাতেও বিরাট এক ইসলামিক লাইব্রেরী গড়ে তুলেছেন তারা। এবং দেখলাম যে বেশ কিছু ইসলামী বইও লিখে প্রকাশ করেছেন। ইসলাম নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, অপরকেও সুযোগ দিচ্ছেন।

কথা প্রসংগে জানালেন যে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই তারা IT expert. আমিও একজন লেখক সেকথা জানার পর আগ্রহ দেখিয়ে বললেন যে আমার লেখা ইসলামিক বই এবং গল্প-কবিতার বইয়ের কমপিউটার টাইপিং এন্ড পাবলিকেশনের দায়িত্ব তারা নিতে রাজী আছেন। আলহামদুলিল্লাহ। আমাকে আর পায় কে? ধীরে ধীরে পরিচয় গাঢ় হতে লাগলো।

২০০৪ সন। নর্থ ইয়র্কের হাম্বার রিভার হসপিটালে আমি একজন ভলানটিয়ার হিসাবে যোগ দিই এবং ২০১৮ সন পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪ বছর একটানা সেখানে কাজ করি। ভলানটিয়ার হিসাবে এবং একজন আগ্রহী শ্রোতা হিসাবে সেখানে প্রতিদিন শত শত patients and visitorদের মুখে এবং কর্মরত স্টাফ ও ভলানটিয়ারদের মুখে নানা বিচিত্র কাহিনী শুনতাম। আমার ডায়েরীতে দৈনিক লিখে রাখতাম। তারপর ছোট ছোট টুকরা গল্প হিসাবে লিখে আমির জামানের কাছে পাঠিয়ে দিতাম তাদের কমপিউটারে বইয়ের আকারে টাইপ করে রাখতে। ইসলামী গবেষণামূলক লেখাগুলোও বিভিন্ন বইয়ের চ্যাপ্টার হিসাবে টাইপ হতে থাকতো।

তারপর এক পর্যায়ে এসে সমাপ্তি টেনে স্বতন্ত্র বই হিসাবে পাবলিশ করতে লাগলেন। আমার বইগুলো বিক্রিতেও অকুণ্ঠ সহায়তা করতে লাগলেন। এমনি করে ২০১৯ সন পর্যন্ত ছোটবড় ১৭টি বই টাইপ এন্ড পাবলিশ করে সাহায্য করলেন আমাকে উদার হৃদয় আমির জামান এবং নাজমা জামান। আল্লাহ তাদের উপর রহমত নাযিল করতে থাকুন।

এলো ২০১৯ সনে COVID-19 Pandemic-এর প্রচন্ড আঘাত। ২০২০ সনের শুরু থেকে দেশের সর্বত্র নেমে এলো এই মহামারী। শুরু হলো কর্ম বিরতির ঘোর অন্ধকার। সব কাজ বন্ধ, ঘরে আবদ্ধ থাকো, মৃত্যুর থাবা থেকে নিজের প্রাণটি বাঁচাও আগে।

তবে ভয় পেলেও কলম বন্ধ করলাম না। ওদিকে নাজমা জামানও তার কমপিউটার shut down করলেন না। আমার লেখাও চলতে লাগলো, ওদিকে কমপিউটার টাইপিংও চালু। আমার ঘরের ছোট পার্সোনাল লাইব্রেরী এবং TV-Internet-magazines ইত্যাদি আমার resources হিসাবে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে লাগলো। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে গৃহবন্দী থাকা সত্বেও আমার লিখিত নূতন বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ১০টিতে! অবিশ্বাস্য! সেগুলো হলো-

১.     আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ  (১১১ পৃষ্ঠা)

২.     ইসলাম ধর্ম : পরিচয়, ব্যাখ্যা ও নির্বাচিত কিছু প্রসংগ নিয়ে অন্ধবিশ্বাসবর্জিত যুগোপযোগী সংক্ষিপ্ত আলোচনা    (১৬৯ পৃষ্ঠা)

৩.     Short Discussions on Some Aspects of Islam (১৩৩ পৃষ্ঠা)

৪.     রাসূলুল্লাহ মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নামে প্রচলিত হাদীস (১৩৩ পৃষ্ঠা)

৫.     ইসলাম ধর্মে হাদীসের শিক্ষা  (৩৯ পৃষ্ঠা)

৬.     সংক্ষিপ্ত দু’আর বই (২৫ পৃষ্ঠা)

৭.     SUFISM (Islamic Mysticism)  (৫৩ পৃষ্ঠা)

৮.     Food for Thought and Action (৫৬ পৃষ্ঠা)

৯.     আমার কবিতাগুলি  (১৫৪ পৃষ্ঠা)

১০.   চলমান জীবনের গল্প  (২০৪ পৃষ্ঠা)

এই ১০টি বইয়ের নিখুঁত টাইপিংয়ের দীর্ঘ দিনের ধৈর্য ও কঠোর পরিশ্রম এবং সহযোগিতার জন্যেও আমি আমির জামান দম্পতির কাছে চির কৃতজ্ঞ। এদের সাহায্য না পেলে আমার লেখক জীবন থমকে যেতো। আল্লাহ তাদের উপর রহমত নাযিল করতে থাকুন।

আমার প্রকাশিত গল্প-প্রবন্ধের বইয়ের সংখ্যা ৫টি : ১) আজো মনে পড়ে (২০০৪), ২) মনের আয়নাতে (২০০৭), ৩) মানুষের কথা (২০১৩), ৪) কাহিনী বিচিত্রা (২০১৬), এবং ৫) চলমান জীবনের গল্প ও কলমবাজি (২০২১-২০২৪,online publication, not as a printed book)

বইয়ের সংখ্যা বহু, প্রকাশনায় খরচও লাগবে মোটা অংকের যার জোগান আমার হাতে নেই। সুতরাং প্রকাশিত বইগুলোর চেহারা দেখে মরতে পারবো এমনটা আশা করতে পারি না। বয়স এখন আমার ৯১ বছর। আল্লাহ ভরসা। তবে এক্ষেত্রেও আল্লাহ আমাকে একেবারে নিরাশ করেননি। সাহায্য পাঠালেন তিনি এক অপ্রত্যাশিত সূত্র থেকে আমার গল্প-প্রবন্ধ প্রকাশনার ব্যাপারে জনাব খুরশিদ আলমের মাধ্যমে। তিনি টরন্টো থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় বাংলা মাসিক “প্রবাসী কণ্ঠ (online and print ) ম্যাগাজিনের Editor & Publisher. ব্যক্তিগতভাবে দেখা-সাক্ষাৎ-পরিচয় নেই আমাদের দু’জনের মাঝে আজো (সব যোগাযোগ টেলিফোনের মাধ্যমে), অথচ তিনি আমার গল্প-প্রবন্ধের বইগুলো গত চার বছর ধরে তাঁর ম্যাগাজিনে নিয়মিত পাবলিশ করে যাচ্ছেন।

কেমন করে সম্ভব হলো সেটা?

অতি সংক্ষেপে বলছি।

আমার একটা বই তাঁকে গিফ্ট হিসাবে পাঠিয়েছিলাম তাঁর ম্যাগাজিন অফিসের ঠিকানায়। সেটা পড়ে তিনি ফোন করে আমাকে তার ম্যাগাজিনে আমার লেখা প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে বইগুলো একেএকে তাঁকে ইমেইল করে দিচ্ছি এবং তিনি সেগুলো পাবলিশ করে যাচ্ছেন। আমি অশেষ কৃতজ্ঞ তাঁর এই উদারতার জন্য। আল্লাহ তার মংগল করুন।

২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

সাইদুল হোসেন

মিসিসাগা, অন্টারিও

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *